প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

মার্চ ১, ২০১৬

 

সবুজের সন্ধানে- ডেনমার্ক

শঙ্কর সেন

 

মনুষ্যকৃত anthropogenic জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যখন সারা বিশ্বের মানুষ জর্জরিত, এক-দুই করে ২১-টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে ফেলেছেন রাষ্ট্রনায়করা সর্বগ্রাহ্য সূত্রের সন্ধানে, তখন ইয়োরোপের একটি রাষ্ট্র নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে সবুজ-শক্তিতে উত্তরণের পথ ধরে ; তাদের প্রতিজ্ঞা ⤒ শক্তি-উৎপাদনে ২০৫০-সালের মধ্যে ১০০-শতাংশ পুনর্নবীকরণ-শক্তি উৎস ব্যবহার ।

কি করে এটি সম্ভব হল সেই আলোচনাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ।

সূত্রপাত হয়েছিল অনেক বৎসর আগে, যখন সারা বিশ্বে এসেছিল ' তৈলসঙ্কট ' , ১৯৭৪- সাল নাগাদ। ডেনমার্কের কিছু উৎসর্গপ্রাণ ও সহস্রবুদ্ধি মানুষ নিজেরাই তৈরি করে নিতে থাকলেন বায়ু-টারবাইন । পরে ডেনমার্কের কিছু বিদ্যুৎ-কোম্পানি প্রস্তাব দিল যে তৈল-সঙ্কট এড়াবার একমাত্র পথ হল পারমাণবিক কেন্দ্র গড়ে তোলা । গড়ে উঠল জনপ্রতিরোধ- সর্ব শ্রেণীর মানুষ এগিয়ে এলো এক বক্তব্য নিয়ে যে, পারমাণবিক-শক্তির বদলে আমরা চাই নিরাপদ ও সুস্থিত উৎস, যা দিতে পারে পুনর্নবীকরণ শক্তি-উৎস বিশেষত:, বায়ু । জনপ্রতিরোধে যত পরিবেশ বিজ্ঞানী, কৃৎকৌশলী ও ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যুক্ত হলেন ততই পারমাণবিক-বিদ্যুতে সমর্থন গেল কমে এবং ১৯৮৫-সালে পারমাণবিক-শক্তিকে বাদ দেওযা হল ডেনমার্কের ভবিষ্যৎ শক্তি-মানচিত্র থেকে ।

ডেনমার্ক-সরকার এর পর ভরতুকি দিতে শুরু করলেন যারা বায়ু-বিদ্যুতে লগ্নী করেছে । ভরতুকির পরিমাণ হয়েছিল প্রতিটি বায়ু-টারবাইন নির্মাণে প্রাথমিক খরচে র ৪০-শতাংশ ।

নাগরিকদের নিজস্ব মালিকানার পাশাপাশি গড়ে উঠলো ' টারবাইন কো-অপেরেটিভ ' । ডেনমার্কে বায়ুবিদ্যুৎ এখন এত লোকপ্রিয় যে বর্তমানে বায়ু-বিদ্যুৎ মালিকানার তিন-চতুর্থাংশ হল সাধারণ জনমানুষের । বায়ু-বিদ্যুৎ এখন ডেনমার্কবাসীর এত প্রিয় যে তাঁরা এই পরিক্রমার নাম দিয়েছে ' টারবাইন Adventure ' ।
এখনই ডেনমার্কের বিদ্যুৎ-ব্যবহারের ৩৪-শতাংশ আসছে বায়ু থেকে । শক্তি-অবস্থান্তর শুরু হয়ে গেছে, ফলে :
- কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ;
- ক্রমবর্ধমান রপ্তানি ;
- ক্রমক্ষীয়মাণ জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহার এবং জ্বালানী আমদানির খরচ হচ্ছে কম ;
- শক্তি-অবস্থান্তরে পুনর্নবীকরণ শক্তির অংশ বৃদ্ধি ।

ফলস্বরূপ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শক্তি-ব্যবহারের মধ্যেকার গাঁটছড়া গেছে ছিন্ন হয়ে ; ১৯৮০-সাল থেকে ডেনমার্কের শক্তি- কনজাম্পশনে বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি কিন্তু অর্থনীতি হয়েছে দ্বিগুণ ।
এখন আর কোনও বাঁধা রইলো না ১০০-শতাংশ পুনর্নবীকরণ শক্তিতে অবস্থান্তরে ।

নিঃসরণ ও অর্থনীতি

বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ কমানোর ফলে ডেনমার্কের অর্থনীতিতে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি । অর্থনৈতিক উন্নয়ন শক্তি-কনজাম্পশনের থেকে ছিন্ন হওয়ায় কোনও কোনও স্থলে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ঠিকই, কার্যদক্ষতা বেড়েছে, বেড়েছে উৎপাদন এবং শক্তি ব্যবহারে ঘটেছে মিতব্যয়িতা ।

নূতন চাকুরীর সংস্থান করা হল ডেন জলবায়ু-প্ল্যানের একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্য যার জন্য ডেনমার্কে বড় লগ্নী হয়েছে পুনর্নবীকরণ শক্তি, শক্তি-কার্যদক্ষতা কৃৎকৌশল এবং পুনর্নবীকরণ তাপীয় ব্যবস্থা বিষয়ে গবেষণায় । ১০০-শতাংশ পুনর্নবীকরণে অবস্থান্তর হলে কর্মসংস্থান আশা করা হচ্ছে অন্তত: ৪০,০০০ মানুষের ।

ডেনমার্কের শক্তি দৃশ্যপট

মে ২০১৪, ডেন শক্তি এজেন্সি নিয়োজিত হলেন চারটি বিভিন্ন দৃশ্যপটের উপর যাতে ডেনমার্ক তার ২০২০, ২০৩৫ এবং ২০৫০-এর টার্গেট রক্ষা করতে পারে । দৃশ্যপটগুলির মধ্যে মূল বিভিন্নতা আসছে বায়ু ও বায়োমাসের পারস্পরিক অবস্থানের উপর ।

 

FIG 1: জীবাশ্ম-জ্বালানি পর্যায়ক্রমে হ্রাস এবং ১০০-শতাংশ পুনর্নবীকরণ শক্তিতে বদলান ।

যেহেতু পুরোপুরি অবস্থান্তর হতে সময় লাগবে, সরকারকে বেছে নিতে হবে দুটি দৃশ্যপট থেকে, ২০২০-সালের মধ্যে। পরিবেশ ও জলবায়ু-পরিবর্তন বিচার করে দুটি দৃশ্যপট হল :

(১) বায়ু- দৃশ্যপট,
(২) হাইড্রোজেন- দৃশ্যপট ।

দুটিই নির্ভরশীল বিশাল বায়ু-শক্তির সঙ্গে কতটা বায়োমাস-শক্তি মিশ্রিত হবে তার উপর । আবার, দুটোরই মূল নির্ভরতা হল বিরাট শক্তি-মিতব্যয়ে ।

যদিও ডেনমার্কের জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহার থেকে মুক্তি এবং ১০০-শতাংশ পুনর্নবীকরণ-শক্তিতে যাওয়া ডেনমার্ক- প্রাসঙ্গিক, তবুও এর অনেক সুপারিশই অন্যান্য রাষ্ট্রের পক্ষে প্রযোজ্য । একটি বিষয় হয়তো বিশেষ প্রাসঙ্গিক যে, বিবর্তনের খরচ ' যেমন চলছে চলুক (Business as usual)' চিত্রের থেকে খুব বেশি এদিক-ওদিক হবে না ।

বায়ু-শক্তি হল চাবি

ডেনমার্ক শক্তি এজেন্সি-র মত হল জীবাশ্ম-জ্বালানি থেকে মুক্ত হওয়ার চাবি- কাঠি আছে বায়ু-শক্তিতে ( বিশেষত: সৈকত-দূরস্থানের ) । এর মুখ্য কারণ হল, গত কয়েক দশক ধরে বায়ু-শক্তিতে ডেনমার্কের বিশ্ব-নেতৃত্ব, দেশের প্রয়োজনের শক্তির এক-তৃতীয়াংশই আসছে বায়ু-শক্তি থেকে- যেটা বিশ্বে সবথেকে বেশি ।

ডিসেম্বর ২০১৩, ডেনমার্কের শক্তি-চিত্রে বায়ু-শক্তির অবদান ৫৫-শতাংশের বেশি, যেটা একটা রেকর্ড ।
২০৫০-সালে ডেনমার্কের প্রয়োজন হবে ১১,০০০ থেকে ১৮,০০০ মেগা-ওয়াট । ১১,০০০- যখন বেশি বায়োমাস আমদানি করতে হবে, ১৮,০০০ হল যখন বায়োমাস- ব্যবহার থাকবে নিজস্ব উৎপাদনের মধ্যে ।
প্রসঙ্গত, ২০১৩-তে মোট ৪,৭৯২ মেগা-ওয়াট বায়ু-টারবাইন নির্মিত হয়েছে যেগুলি সৈকত-দূরস্থানের জন্য ।

নূতন শক্তি-মিশ্রণ

' বায়ু দৃশ্যপটে ' ২০৫০-সাল নাগাদ বায়োমাসের ব্যবহার ( বায়োগ্যাস ও বর্জ ব্যতীত ) ২০১২-র তুলনায় বৃদ্ধি পাবে ৫৫-শতাংশ, এবং মোট শক্তি-কনজাম্পশন কমে যাবে ২৭-শতাংশ, শক্তি-কার্যদক্ষতা বৃদ্ধির ফলে । অন্যদিকে, ' হাইড্রোজেন দৃশ্যপটে ' বায়োমাসের অংশ বাড়বে মাত্র ২.৭-শতাংশ ।

২০৫০-সালে শক্তি ব্যবহারের একটা বড় অংশ ব্যয় হবে গৃহাদি ও জেলায় তাপ মোচনে । এই তাপীয় শক্তি আসবে বৈদ্যুতিক তাপ- পাম্পগুলি থেকে যা' মৃত্তিকা, জল বা বায়ু থেকে তাপ আহরণ করবে । জেলাগুলির উত্তাপের জন্য অনেক শহরেরই আছে ভূতাপীয় শক্তির সান্নিধ্য ।

পাশাপাশি,বিশাল সৌর প্রতিষ্ঠা জেলাগুলির তাপ দিতে পারবে । এই উচ্চাভিলাষী পথ ধরে তাপীয়-পাম্প, ভূতাপীয়-উৎস এবং সৌর-তাপীয় হবে ডেনমার্কের ভবিষ্যৎ শক্তি ।

পুনর্নবীকরণ-শক্তি কৃৎকৌশলগুলি বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ তাড়াতাড়ি । ২০১০-সালে জলবায়ু কমিশন ভাবেনি যে, সৌর পি-ভি ও তরঙ্গ-শক্তি কখনও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে । আজ, সৌর পি-ভি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে পুনর্নবীকরণ-শক্তি মিশ্রণে । বর্তমানে প্রায় প্রতি মাসে ৩৬-মেগাওয়াট সৌর পি-ভি বসানো হচ্ছে এবং ২০৩০-সাল নাগাদ মোট সৌর পি-ভি বসানো হবে ৩,৪০০- মেগাওয়াট ।

অর্থনৈতিক হাতিয়ার ও ভরতুকি



FIG 2: ২০৫০-সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারের রূপরেখা ।


(১) পুনর্নবীকরণ-শক্তি ( মোট ) ;
(২) তেল ;
(৩) প্রাকৃতিক গ্যাস ;
(৪) কয়লা ।
জলবায়ু কমিশনের বিচারে জীবাশ্ম-জ্বালানি থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে গেলে অর্থনৈতিক যন্ত্রাদির সঠিক ব্যবহার যেমন, জ্বালানীর উপর থেকে ক্রমান্বয়ে ট্যাক্স কমিয়ে আনা ।

শক্তি-সুরক্ষা

সুস্থিত চাহিদা ও হ্রাস-বৃদ্ধি বৈদ্যুতিক সাপ্লাইয়ের মধ্যেকার সম্ভাব্য ছেদ পূর্ণ করতে নিম্নবর্ণিত কৃৎকৌশলের কথা ভাবা যেতে পারে :

১. পরিরক্ষিত বায়োগ্যাস, বায়োমাস এবং কিছু শক্তি, যা' পাওয়া যাবে বিকেন্দ্রীভূত প্ল্যান্ট থেকে, যখন বায়ু-বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন কম ;
২. intelligent বৈদ্যুতিক ভাণ্ডার যেমন, বৈদ্যুতিক গাড়ীর ব্যাটারি, তাপীয়-পাম্প, এবং চাহিদা-মাফিক ম্যানেজমেন্ট ;
৩. পার্শ্ববর্তী দেশগুলির সঙ্গে ট্রান্সমিশন লাইন মারফৎ যোগাযোগ ।

চাহিদা-মাফিক ম্যানেজমেন্টের নব-প্রবর্তন
স্মার্ট শহর Kalundborg হল ডেনমার্কের ৩-বৎসরের একটি পাইলট প্রোজেক্ট ।

এই প্রোজেক্টে আছে বেশ কিছু নব-প্রবর্তন স্মার্ট-শহর ও স্মার্ট-গ্রিডের সংযোগ বিষয়ে । যদিও এই প্রোজেক্ট ইয়োরোপের অন্যান্য বাজার-তান্ত্রিক চাহিদা-মাফিক ম্যানেজমেন্টের মতন, তফাৎ হল এতে আছে বর্ধিত নাগরিক পরিসেবার যথা, জল সম্পদ ম্যানেজমেন্ট, পরিবহন এবং জেলা-তাপীয় ব্যবস্থা ।

উৎস : http://www.navigantresearch.com/blog/in-denmark-demand-response-powers-a-smart-city


একটি সক্ষম অবস্থান্তর

অবস্থান্তরের জন্য অর্থনৈতিক ভার হল আশ্চর্য ভাবে পরিমিত । ১০০-শতাংশ পুনর্নবীকরণ-শক্তিতে অবস্থান্তরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বাড়তি খরচাপাতি হবে ২০৫০-সালের ডেন-GDP-র ০.৫ শতাংশ ।
প্রাথমিক কারণ হল জীবাশ্ম-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ।

শক্তি-সিস্টেমে পূর্ণ অবস্থান্তর ঘটাতে প্রয়োজন হবে গুরুতর লগ্নী এইসকল প্রাথমিক অঞ্চলে :

১. ইলেকট্রিক গাড়ীতে পরিবর্তন ;
২. সৈকত-বহির্ভূত বায়ু-টারবাইনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ;
৩. ব্যক্তিগত ও জেলাগুলির জন্য তাপীয়-পাম্প ।
৪. গার্হস্থ্য'insulation'।
৫. সীমানা বহির্ভূত অঞ্চলে শক্তির পরিকাঠামো বৃদ্ধি ।

উপরে আলোচিত কাহিনিতে উল্লিখিত হয়েছে ডেনমার্কের এক বিশেষ সংগ্রাম - জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহার থেকে মুক্তি এবং ১০০-শতাংশ পুনর্নবীকরণ-শক্তিতে যাওয়ার পথ-মানচিত্র । এটা হয়তো ডেনমার্ক- প্রাসঙ্গিক, তবুও অনেক রাষ্ট্রই শিক্ষা নিতে পারবে এই পরিক্রমা থেকে ।

উৎস : The Danish Government (2011) Our Future Energy
http://www.cphcleantech.com/media/1465822/our_future_energy.pdf
www.greenpeace.org

 


লেখক পরিচিতি - শিক্ষাবিদ। বি.ই. কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর। এক সময় পশ্চিম বঙ্গ সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী ছিলেন। অবসর-এর যুক্ত প্রায় জন্মকাল থেকেই। অবসর-এর উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।