বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

জুলাই ১৫, ২০১৬
CoP 21
শঙ্কর সেন
২০১৫-খ্রিষ্টাব্দকে অনেকেই বিশেষ ভাবে মনে রাখবে তিনটি কারণে-
এক, এর পূর্বে কোনও বৎসরেই পৃথিবীর তাপমাত্রা এত বেশি হয়নি ;
দুই, এই বৎসরে বিশ্ব বায়ুমণ্ডলে কারবন-ডাই-অক্সাইড গাঢ়ীকরণ আক্ষরিক ঊর্ধ্বসীমা হিসাবে '৪০০ ভাগ-প্রতি মিলিয়নে' পৌঁছেছে ;
তিন, এই বৎসরের শেষদিকে- নভেম্বর ৩০ থেকে ডিসেম্বর ১২ প্যারিসে সংঘটিত হয়েছে ২১-তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন '( CoP21) বিশ্ব-ঊষ্ণায়ন ' ও 'জলবায়ু পরিবর্তন' বিষয়ে যা' জন মানুষের মনে অনেক আশা জাগিয়েছিল ।
১৯৬-টি রাষ্ট্র যোগ দিয়েছিল এই সম্মেলনে, বিতরণ করা হয়েছে সভার প্রেসিডেন্টের নামে ৩০-পৃষ্ঠার এক পুস্তিকা যেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে বিশ্ব-ঊষ্ণায়নকে ২-ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার নীচে সীমিত রাখার জন্য এবং চেষ্টা চালানো- তাপমাত্রা-বৃদ্ধিকে ১.৫-ডিগ্রী সেলসিয়াসে নিয়ে যাওয়ার । এও প্রস্তাব হয়েছে যে, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের সাফল্যের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলি বহন করবে আর্থিক মূলধন এবং যোগান দেবে প্রয়োজনীয় উন্নত প্রযুক্তি ; এবং রূপায়নে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে উন্নয়নশীল দেশগুলির একমাত্র ও বিশেষ পূর্বিতা (priority)- ' অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ ' ।
ঐকমত অনুযায়ী এই এগ্রিমেন্ট কার্যকরী হবে ২০২০-খ্রিষ্টাব্দ থেকে এবং তারপর প্রতি ৫-বৎসর অন্তর জাতীয় টার্গেট পর্যালোচনা করা হবে । প্রতিটি রাষ্ট্র, যারা এগ্রিমেন্টকে অনুমোদন করবে, তাদের নিঃসরণ হ্রাসের টার্গেট দিতে হবে- তবে সেটা হবে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত । প্যারিস এগ্রিমেন্ট সই হবে ২০১৬-সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭-সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে এবং লাগু হবে যখন ৫৫-টি রাষ্ট্র যারা গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৫৫-শতাংশের জনয় দায়ী, তাঁরা সকলে সই করলে ।
সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ
খসড়া এগ্রিমেন্ট সাফল্যে পরিণত করার দায়িত্ব উন্নত এবং উন্নয়নশীল সকল রাষ্ট্রেরই । সেই ইচ্ছাকে সামনে রেখে UNFCCC সমস্ত রাষ্ট্রদের অনুরোধ করেছিল তারা যেন (Intended Nationally Determined Contribution- INDC) বা ' জাতীয় সংকল্পিত আনুকূল্য ' টার্গেট জানায় আগামী দিনে কতটা গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করতে সক্ষম হবে । নভেম্বরে সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই বেশ কিছু রাষ্ট্র তাদের INDC-টার্গেট জানায় । পরিশিষ্টে ৮-টি রাষ্ট্রের- চীন, ভারত, মাঃ.যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কানাডা, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া, যারা সম্মিলিতভাবে বিশ্বে ৫০-শতাংশের বেশি গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণ করে থাকে, তাদের INDC- টার্গেট দেওয়া হল ।
সম্মেলন উদ্বেগের সঙ্গে অবধান করছে যে, রাষ্ট্রদের পাঠানো INDC-টার্গেট থেকে প্রক্ষেপিত গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণের লেভেল হচ্ছে ৫৫-গিগাটন (মেট্রিক) ; খসড়া এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ২-ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সঙ্গে সাযুজ্য হল ৪০-গিগাটন (মেট্রিক) বা তারও কম । ফলে, প্যারিস সম্মেলন অনুরোধ জানিয়েছে সকল রাষ্ট্রকে, বিশেষত: যারা INDC মোতাবেক ইতিমধ্যে নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী কতটা গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পারবেন বলে জানিয়েছেন ২০২৫/২০৩০-সালের মধ্যে, তাদের নূতন করে জানাতে সম্মেলনে প্রস্তাবিত ২-ডিগ্রি সেলসিয়াসের কথা মনে রেখে যাতে, ২০২০-সালের পর প্রতি ৫-বৎসর অন্তর কতটা আনুকূল্য হয় তা' বোঝার জন্য ।
সম্মেলনে আরও কয়েকটি প্রস্তাব
প্যারিস এগ্রিমেণ্ট উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিকে যথাযোগ্য সাহায্য করার অঙ্গীকার করেছে এবং প্রতিষ্ঠা করেছে একটি আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্য যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক পরস্পর সহকারিতা ।
সম্মেলনে আরও কয়েকটি কার্যকারী প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যেমন,
(১) এগ্রিমেন্টে বলা হয়েছে যে, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির প্রয়োজন ও 'প্রায়োরিটি' অনুযায়ী একটি অর্থ-ভাণ্ডার গড়ে তোলা হবে প্রতি বৎসর ১০০-বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে ।
(২) Green Climate Fund-সংস্থাকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, তাঁরা যেন অত্যল্প-উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলিকে সাহায্য ত্বরান্বিত করে ।
(৩) প্রযুক্তি নির্বাহ কমিটি এবং জলবায়ু-কৃৎকৌশল সেন্টার ও নেটওয়ার্ক গুলিকে সবল করা হবে যাতে তারা নিম্নবর্ণিত কাজগুলি করতে পারে :
(ক) প্রযুক্তি গবেষণা, বিকাশ ও সপ্রমাণ ;
(খ) অন্তর্জনিষ্ণু(endogenous)ক্যাপাসিটি ও
প্রযুক্তিগুলির বিকাশ এবং বর্ধন ।
(৪) প্যারিস ' ক্যাপাসিটি নির্মাণ কমিটি ' প্রতি বৎসরে ক্যাপাসিটি নির্মাণের উন্নত প্রযুক্তি-বিনিময়ের উপর রিপোর্ট দেবে, যার ফলশ্রুতি হিসাবে যে কোনও ক্ষেত্রে সাফল্য এবং চ্যালেঞ্জ জানা যাবে ।
(৫) উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির নিজেদের প্রয়াসে পরিচ্ছন্ন জলবায়ু-উৎপতনশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ইচ্ছাকে যথাযোগ্য উচ্চহারে অর্থ সাহায্য দেবে শিল্পোন্নত দেশগুলি এবং এই প্রয়াসে অন্য কিছু রাষ্ট্রের স্বেচ্ছা প্রণোদিত সাহায্যও মিলবে আশা করা যায় ।
২৮ এপ্রিল, ২০১৬ তারিখের ১.৫৪p.m. পর্যন্ত সময়ে প্যারিস এগ্রিমেন্টে সই করেছে ১৭৭-টি রাষ্ট্র ।
পরিশিষ্ট
৮-টি নির্বাচিত রাষ্ট্রের INDC- টার্গেট
চীন
চীনের INDC-টার্গেট ( ৩০ জুন, ২০১৫-সালে সমর্পিত ) হল :
২০৩০-সালের মধ্যে কারবন-নিঃসরণ ' পিক ,-এ পৌঁছানো ;
২০৩০-সালের মধ্যে কারবন-তীব্রতা ২০০৫-খ্রীর ৬০- থেকে ৬৫- শতাংশে নিয়ে যাওয়া ;
ঐ সময়ে মোট প্রাথমিক শক্তির ২০-শতাংশ করা অ-জীবাশ্ম-জ্বালানি উৎসগুলি থেকে ;
বনাঞ্চল ২০০৫-খ্রীর তুলনায় ৪.৫-বিলিয়ন ঘন মিটার বৃদ্ধি ।
ভারত
অক্টোবর ০১, ২০১৫ সালে ভারত তার INDC-টার্গেটে জানিয়েছে :
নিঃসরণের মাত্রা কমানো হবে ২০০৫-খ্রী-র থেকে ৩৩- ও ৩৫- শতাংশের নীচে ; শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে জ্বালানিতে অ-জীবাশ্ম অংশ বাড়িয়ে স্থাপিত বিদ্যুৎ-ক্যাপসটির ৪০-শতাংশ [ যা' ২০৩০-সালের ২৬-৩০ শতাংশের তুল্যমূল্য ] করার পরিকল্পনা আছে ;
২০৩০-সাল নাগাদ অতিরিক্ত বনসৃজন দ্বারা carbon sink নির্মাণ করা হবে ২.৫ থেকে ৩.০ Gt কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ-ক্ষমতার ।
পূর্বে ভারত গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণকে ২০ থেকে ২৫- শতাংশ কমাবার ( ২০০৫-সালের লেভেল থেকে ) আশ্বাস দিয়েছিল ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
৩১ মার্চ, ২০১৫ সালে মাঃ. যুক্তরাষ্ট্র যে INDC-টার্গেট জমা দিয়েছে, তা'তে তারা জানিয়েছে :
২০০৫-সালের তুলনায় গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণ কমানো হবে ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ, ২০২৫-সালের মধ্যে ( ২৮-শতাংশ করার জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা চালানো হবে ) ।
ব্রাজিল
ব্রাজিলের অভিপ্রায় হল ( ২০১৫-সালের ২৮-সেপ্টেম্বর সমর্পিত INDC-টার্গেট অনুযায়ী ) :
২০০৫-সালের হিসাবে গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণ কমানো হবে ৩৭-শতাংশ ২০২৫-সালে, ৪৩-শতাংশ ২০৩০-সালে । এই হিসাবে ধরা হয়েছে- জমি-ব্যবহার, ও তদ্বারা পরিবর্তন এবং বনসম্পদ ।
কানাডা
কানাডা INDC-টার্গেট জমা দিয়েছে ১৫ মে, ২০১৫-সালে । তার অভিপ্রায় হল :
গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণকে কমানো হবে ৩০-শতাংশ ( ২০০৫-সালের নীচে ) ২০৩০- সালে । এই হিসাবে ধরা হয়েছে জমি ও বনসম্পদ এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক নিঃসরণ- 'ক্রেডিট' ।
রুশ ফেডারেশন
জমা দিয়েছেন ২০১৫-সালের ৩১ মার্চ । এর INDC-টার্গেট হল :
১৯৯০-সালের তুলনায় গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণকে কমানো- ২৫ থেকে ৩০ -শতাংশ, ২০৩০-সালের মধ্যে । এর মধ্যে যতদূর সম্ভব ধরা হবে জমি সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে ।
ইন্দোনেশিয়া
২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সালে যে INDC-টার্গেট জমা দিয়েছে তার মুখ্য বিষয়গুলি হল :
নিঃসর্তভাবে গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণ কমানো যেমন-চলছে-চলুক(BAU)অবস্থা থেকে ২৯-শতাংশ ২০৩০-সালে ( জমি-ব্যবহার, জমি-ব্যবহারে পরিবর্তন এবং বনসম্পদ সহ ) ;
যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়া যায়, তবে ঐ সময়ে ৪১-শতাংশ খর্বীকরণ সম্ভব হবে ।
অস্ট্রেলিয়া
INDC-টার্গেট জমা দিয়েছে ১১ আগস্ট, ২০১৫ তারিখে ।
নিজস্ব নিঃসরণ খর্বীকরণ ফাণ্ড ও উন্নয়নের অন্যান্য পলিসি থেকে ২০৩০-সালের মধ্যে গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণ কমাবে ২৬ থেকে ২৮-শতাংশ ২০০৫-এর লেভেল থেকে । এই হিসাবে জমি-ব্যবহার, তার পরিবর্তন এবং বনাঞ্চল ধরা হয়েছে ।
০৪ মে, ২০১৬
লেখক পরিচিতি - শিক্ষাবিদ। বি.ই. কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর। এক সময় পশ্চিম বঙ্গ সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী ছিলেন। অবসর-এর যুক্ত প্রায় জন্মকাল থেকেই। অবসর-এর উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।