বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
অগাস্ট ১৫, ২০১৬
কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি
শঙ্কর সেন
১. কয়লার ভবিষ্যৎ
কয়লাকে জ্বালানি করে বিদ্যুৎ-শক্তি উৎপাদন বর্তমান সভ্যতার বাহক হলেও এর আয়ুষ্কাল কিন্তু দু'শ বছরেরও কম । প্রথম কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয় ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে এবং তখন থেকে আজও অপ্রতিদ্বন্দী জ্বালানি হিসাবে কয়লা বিরাজ করছে পৃথিবীর বুকে ।
কয়লা ছাড়া অন্যান্য জীবাশ্ম-জ্বালানিও ব্যবহৃত হয় শক্তি উৎপাদনে যথা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস । কয়লার গ্রহণযোগ্যতা অন্যগুলির থেকে বেশি কারণ,
(১) তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য যেখানে ৬ থেকে ১২ মার্কিন ডলার প্রতি মিলিয়ন Btu [ উল্লেখ্য, ১ Btu = ১.০৬ জুল ], কয়লার মূল্য সেখানে ১ থেকে ২ ডলার ( মার্কিন ) প্রতি মিলিয়ন Btu ;
(২) কয়লা ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবী জুড়ে, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস- মোটামুটি মধ্য প্রাচ্য ও রাশিয়ায় ;
(৩) ভূগর্ভে যে সকল জীবাশ্ম-জ্বালানি সঞ্চিত আছে [ পরিশিষ্ট ১ দেখুন-বিশ্বের নানা রাষ্ট্রে সঞ্চিত ভাণ্ডার- ( ২০১৩ খ্রীস্টাব্দের হিসাব ) ], তার মধ্যে কয়লার পরিমাণই হল ৫২২-বিলিয়ন মেট্রিক টন ।
(৪) বর্তমান ব্যবহারের হিসাবে, জীবাশ্ম-জ্বালানিগুলির মধ্যে তেল, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার নিঃশেষ হবে আনুমানিক যথাক্রমে ৩৫, ১০৭ এবং ৩৭ বৎসরে । এর অর্থ, কয়লা পাওয়া যাবে ২১১২-সাল পর্যন্ত, ২০৪২-সালের পর এটি থাকবে একমাত্র জীবাশ্ম-জ্বালানি ।
১.১ অদূর ভবিষ্যতের চাহিদা
উপরোক্ত কারণে এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, বিশেষতঃ ভারত, চীন, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ; চীন দেশে প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে তারা প্রতি সপ্তাহে দুটি ৫০০-মেগাওয়াট বা সমতুল্য কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনা করবে যাতে বছর শেষে মোট সংযুক্তি হয় যুক্তরাজ্যের পুরো শক্তি-গ্রীডের সমান ।
চীন দেশের চাহিদা বিশ্ব কনজাম্পশনের ৫০-শতাংশের বেশি হয়ে ২০৩০-সাল থেকে আবার কমতে শুরু করবে ; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ OECD-দেশগুলির চাহিদা এক-তৃতীয়াংশ কমে যাবে ; আর ভারত ২০২০-সালের পূর্বে কয়লার দ্বিতীয় বড় ব্যবহারকারী হবে এবং বিশ্বের সব থেকে বড় আমদানীকারি হবে চীনকে ছাড়িয়ে ।
একটা হিসাবে বিশ্বে কয়লার চাহিদা ১৫-শতাংশ করে বৃদ্ধি পাবে ২০৪০-সাল পর্যন্ত, কিন্তু এই বৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশ বাড়বে আগামী ১০ বছরে ।
১.২ কয়লা ও পরিবেশ-দূষণ
যদিও কয়লা প্রাচুর্যে ভরা এবং এর যোগান নিশ্চিত, এর ভবিষ্যৎ ব্যবহার নির্ভর করছে কি ভাবে দূষণকে রোধ করা যায় এবং গ্রীনহাউস-গ্যাস নিঃসরণ কমানো যায় । বর্তমানে প্রতি বছর কয়লা ব্যবহার হয় ৬ বিলিয়ন মেট্রিক টনের মত, যা থেকে উৎপন্ন হয় ১৮ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড । বিভিন্ন উপায়ে এই নিঃসরণ যাতে বায়ুমণ্ডলে না পৌঁছায় তার জন্য মানুষের যা প্রচেষ্টা হয়েছে তার কয়েকটি আলোচিত হয়েছে ' অবসর'- এর পাতায় [ ' পরিবেশ ' বিভাগে দেখুন- জীবাশ্ম জ্বালানী (৪)- পরিবেশ, জীবাশ্ম জ্বালানী (৫)- ইউ. এস. ভিশন ২১, পরিচ্ছন্ন কয়লা প্রযুক্তি- উন্নত পরিবেশের জন্য, জীবাশ্ম জ্বালানী- কয়লার গ্যাসায়ন ] ।
২০১১-সালে যুক্তরাজ্যের জনৈক non-profit- Carbon Tracker তার রিপোর্ট- Unburnable Carbon-এ বলছে যে, ২-ডিগ্রী সেলসিয়াস সীমার মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রাকে রাখতে হলে বর্তমান শতাব্দীর প্রথমার্ধে জীবাশ্ম-জ্বালানিগুলি থেকে কার্বন-নিঃসরণ সীমায়িত রাখতে হবে ১,৪০০ গিগা-টনের ( ১ গিগা-টন = ১ বিলিয়ন টন ) মধ্যে । যেহেতু ২০১৩-সালের মধ্যে আমরা ৪০০ গিগাটন নিঃসরণ করে ফেলেছি, ২০৫০-সালের মধ্যে আমাদের নিঃসরণের সীমা হল ১,০০০ গিগাটন ।
বর্তমানে বিশ্বে প্রমাণিত জীবাশ্ম-জ্বালানিগুলি আছে আনুমানিক মোট ২.৮৬০ গিগাটন, যার মধ্যে আছে কয়লা- ৬৫ শতাংশ, তেল-২২ শতাংশ ও প্রাকৃতিক গ্যাস- ১৩ শতাংশ । অতএব, ১,০০০ গিগাটন সীমার মধ্যে থাকতে হলে ভূগর্ভে ছাড়তে হবে অব্যবহৃত ১,৮৬০ গিগাটন ।
২০৫০-সালের সময়সীমার মধ্যে আমরা ভাবতে পারি কয়লাকে " সেতু জ্বালানি "(bridge fuel) হিসাবে, যদি তার পরে অচিরাচরিত শক্তি বর্ধিত ব্যবহারে নিঃসরণকে ১,০০০ গিগাটনে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় ।
নিরন্তর গবেষণা দ্বারা আমরা উপনীত হয়েছি যে, দু'টি প্রযুক্তির মিলিত ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ অনেক কমানো সম্ভব :
(১) বায়ুমণ্ডলে পাতিত কার্বন : কার্বন সংগ্রহ- ও গুদামজাত-করণ(CCS)। এটি আলোচিত হয়েছে ' অবসর '-এর 'পরিবেশ'-বিভাগে । কয়লা ব্যবহারে এই প্রযুক্তিকে আবশ্যিক বলে মন্তব্য করেছেন বিশের বিভিন্ন সংস্থা যথা, বিশ্ব শক্তি কাউনসিল, IPCC, ইত্যাদি, এমনকি পুরানো কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে পরাস্থাপন(retrofit)- সহ ;
(২) জীবাশ্ম-জ্বালানি দহনে কার্যদক্ষতা-বৃদ্ধিকে সামনে রেখে নূতন প্রযুক্তিগুলির- সুপার ক্রিটিক্যাল, আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল, ও উন্নত সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির ব্যবহার ।
২. সাব-ক্রিটিক্যাল প্ল্যান্ট
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে অজস্র কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্র যার বেশির ভাগেই ব্যবহৃত হচ্ছে সাব-ক্রিটিক্যাল প্ল্যান্ট [ দেখুন পরিশিষ্ট ২(ক) : সাব-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্টের সংক্ষিপ্ত কার্যপদ্ধতি। ] ।
সাব-ক্রিটিক্যাল প্রক্রিয়ায় বাষ্পের চাপ ও তাপ হয় যথাক্রমে- ২২.০MPa এবং ৫৫০-ডেগ্রী সেল্সিয়াস । বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যদক্ষতা ৩৩ থেকে ৩৭-শতাংশ । এই তথ্য কয়লার গুণ, ব্যবহার ও ডিজাইন পরিমিতির উপর নির্ভরশীল ।
চিত্র ১ক-এ সাব-ক্রিটিক্যাল PC বিদ্যুৎ উৎপাদকের ত্রিমাত্রিক রূপ দেখানো হল ।
চিত্র ১ ক : সাব-ক্রিটিক্যাল বিচূর্ণ-কয়লা বৈদ্যুতিক প্ল্যাণ্টের ত্রিমাত্রিক চিত্ররূপ ।
উৎস : Future of Coal, MIT, ২০০৭
৫০০-মেগাওয়াট (নেট) বিদ্যুৎ প্ল্যাণ্টের বিভিন্ন ইনপুট ও আউটপুট দেওয়া হয়েছে, পিটসবার্গ- কয়লা ব্যবহার করে । লক্ষ্যণীয়- বয়লার / সুপারহিটারে বাষ্পীয়- অবস্থা হল- চাপ ১৬.৫ MPa ও তাপমাত্রা ৫৩৮ C এবং স্ট্যাক থেকে উদ্গত গ্যাসের পরিমাণ হল- ২৭৭,০০০ কেজি প্রতি ঘণ্টায়, ০.১ MPa চাপ ও ৫৫-ডিগ্রী সেল্সিয়াস।
২.১ কার্বন-বন্দীকরণসহ সাব-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্ট
উপরোক্ত ৫০০-মেগাওয়াট ( নেট ) সাব-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্টে, বয়লার-সুপারহিটারের একই বাষ্পীয় অবস্থায় এবং একই মানের কয়লা ব্যবহার করে যদি কার্বন-বন্দীকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, তার ত্রিমাত্রিক চিত্ররূপ দেখানো হল চিত্র ১খ-এ ।
চিত্র ১ খ : কার্বন-বন্দীকরণসহ সাব-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্টের ত্রিমাত্রিক চিত্ররূপ ।
উৎস : Future of Coal, MIT, ২০০৭
লক্ষ্যণীয়, তুলনা করলে দেখা যাবে, কয়লা- ও বায়ু- যোগান কমে হয়েছে যথাক্রমে ঘণ্টায় ১৬৪,০০০ ও ১,৯৪০,০০০ কেজি, স্ট্যাক-নিঃসরণ বেড়ে হয়েছে ৩,২১০,০০০ কেজি প্রতি ঘণ্টায়, যার তাপমাত্রা বেড়ে হয়েছে ৬০-ডিগ্রী সেলসিয়াস অপরিবর্তনীয় চাপে । বন্দীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন দুটি যন্ত্রের- কার্বন-বন্দীকরণ ও সংকোচন ; গুদামজাত-করণের জন্য পাওয়া যেতে পারে ঘণ্টায় ৪৫০,০০০ কেজি কার্বন ।
উল্লেখ্য, কার্বন-বন্দীকরণের জন্য অতিরিক্ত অন্তস্থঃ বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন ১৩০-মেগাওয়াট ।
৩. সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্ট পরিবার
গবেষণায় দেখা গেছে, চাপ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে কার্যদক্ষতার একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে, কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি করতে চাপ ও তাপমাত্রা বাড়ানো দরকার । এই তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্ট পরিবার [ চিত্র ২ ] ।
চিত্র ২ : সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্ট পরিবার ।
উৎস : Toshibaa ।
পরিবারের তিন সদস্য : সুপার-ক্রিটিক্যাল, আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিক্যাল (USC) এবং নবতম সদস্য- উন্নত আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিক্যাল ( Advanced সুপার-ক্রিটিক্যাল- AUSC ) । চাপ- ও তাপ-এর ভিত্তিতে সদস্যদের পৃথক করা হয়েছে । যেমন,
বিচূর্ণ বিটুমেন কয়লা ব্যবহার করে সুপার-ক্রিটিক্যাল ইউনিটে ( গ্রস ) প্ল্যাণ্ট-কার্যদক্ষতা হয় ( সাধারণভাবে ) ৪৩-৪৫ শতাংশ যখন, বাষ্পীয় পরামিতি ২৫০ বার/৫৪০/৫৬০ থেকে ২৭০ বার/৫৮০/৬০০-সহ, যা সাব-ক্রিটিক্যাল ইউনিট [ ১৬৭ বার/৫৩৮/৫৩৮ ]-এর থেকে ১৩-১৮ শতাংশ বেশি ।
আল্ট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল ইউনিটে ( গ্রস ) প্ল্যাণ্ট-কার্যদক্ষতা হয় ৪৬-শতাংশের মতন [ বাষ্পীয় পরামিতি ২৮০ বার/৬০০/৬৮০ ] এবং উন্নত(Advanced)আল্ট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল ইউনিটে ( গ্রস ) প্ল্যাণ্ট-কার্যদক্ষতা হয় ৫০-শতাংশের মতন [ বাষ্পীয় পরামিতি ৩৫০ বার/৭০০/৭২০ ] । চাপ- ও তাপ- বৃদ্ধি হলে কার্যদক্ষতা বাড়ে, কয়লার প্রয়োজন হয় কম এবং ফলে, কমে যায় কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ [ চিত্র ৩ ] ।
চিত্র ৩ : কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বনাম প্ল্যাণ্ট- কার্যদক্ষতা ।
( পিটসবার্গ #8 কয়লা ব্যবহার করে )
সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ প্ল্যাণ্ট ৫০-দশকের শেষদিক থেকে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু তখন প্রযুক্তিটি ঠিক গ্রহণযোগ্য হয়নি নির্ভরযোগ্যতা, বিশেষতঃ মেটালার্জি-সমস্যার কারণে । উচ্চ চাপ- ও তাপ-এ যেতে হলে পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অংশগুলির মেটালার্জি উন্নত হওয়া প্রয়োজন ।
একটি সুপার-ক্রিটিক্যাল বিচূর্ণ-কয়লা বিদ্যুৎ প্ল্যাণ্টের পরিকাঠামো দেখানো হল চিত্র ৪-এ । আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্টের পরিকাঠামো একই, শুধু কিছু তাপ-অনুভূতিপ্রবণ অংশের মেটালার্জি ভিন্ন । পরিশিষ্ট ২-খ-এ সুপার ক্রিটিক্যাল(SC)এবং আল্ট্রা- সুপার ক্রিটিক্যাল(USC)প্ল্যাণ্টের কার্য-পদ্ধতি সংক্ষেপে দেওয়া হল ।
চিত্র ৪ : একটি সুপার-ক্রিটিক্যাল বিচূর্ণ-কয়লা বিদ্যুৎ প্ল্যাণ্ট ।
বিগত কয়েক দশক ধরে পৃথিবীতে ৬০০-র বেশি সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্ট সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কাজ করছে, আর ২০১০-সালে সারা পৃথিবীতে ৬০-টি আলট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। চীন ২০০৬-০৮ -খ্রীষ্টাব্দে ৪০০০- ( ৪ x ১০০০)- মেগা-ওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে যেখানে প্ল্যাণ্টগুলি হল আলট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল ; কার্যদক্ষতা ৪৫-শতাংাশ ।
নীচে একটি বিচূর্ণ-কয়লা আলট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল বৈদ্যুতিক প্ল্যাণ্টের ত্রিমাত্রিক চিত্ররূপ দেওয়া হল [ চিত্র ৫ ]।
চিত্র ৫ : বিচূর্ণ-কয়লা আল্ট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল বৈদ্যুতিক প্ল্যাণ্টের ত্রিমাত্রিক চিত্ররূপ ( কার্বন-বন্দীকরণ ছাড়া ) ।
উৎস : Future of Coal, MIT, ২০০৭ ।
৩.১ উন্নত - আল্ট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল
(Advanced Ultra Super Critical: A-USC) প্ল্যাণ্ট
৭০০/৭৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে প্ল্যাণ্ট চালালে ১১-শতংশ কম কয়লার প্রয়োজন হয় ও CO2-নিঃসরণ ১১-শতাংশ কম হবে । ফলে, কার্বন বন্দীকরণের ব্যয় কম হবে -- নিঃসরণ হবে কম । nickel alloy ব্যবহারের জন্য মূল প্ল্যাণ্টের মূল্য বৃদ্ধি হবে । এর অর্থ, নিঃসরণ-ব্যয় হ্রাস সত্ত্বেও মেগা-ওয়াট প্রতি equipment-এর সাইজ কমানো, নির্মাণে আনুষঙ্গিক খরচা ইত্যাদি অপ্টিমাইজেশনে আনতে হবে ।
মেইন বাষ্পীয় তাপমাত্রা যখন ৭০০-ডিগ্রী সেলসিয়াস বা তার বেশি হয় এবং চাপমাত্রা হয় ৩০০-বার বা তার বেশি, তখন সেই শ্রেণীকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে- উন্নত(Advanced)- আলট্রা-সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্ট(A-USC)। এ অবস্থায় মাল-মশলার নির্বাচন আরও দৃঢ়রূপে আবদ্ধ, মেসিনিং-সহ সব কিছু বিবেচনা করে । তবে,মানুষের ধর্মই হল নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে না থাকা, তাই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নেমেছে সারা বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষকরা । তৈরী হয়েছে বেশ কিছু মিলিত- গোষ্ঠী যথা, (ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে- GE, Alstom, B&W, FosterWheeler এবং EPRI, ONRL, NETL ইত্যাদির কন্সর্টিয়াম । একই ধরণের কন্সর্টিয়াম তৈরী হয়েছে : (খ) ইয়োরোপে- Alstom, Hitachi Power, SIEMENS, EON, VGB ও অন্যান্য, (গ) জাপানে- NIMS, তোশিবা, হিতাচি, মিৎসুবিশি, ইত্যাদি, (ঘ) চীনে- ১৮টি শিল্প নিয়ে কন্সর্টিয়াম, (চ) ভারতে- BHEL, IGCAR, NTPC ইত্যাদির কন্সর্টিয়াম । এরা প্রত্যেকেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে । যেমন, মাঃ. যুক্তরাষ্ট্র কন্সর্টিয়াম-এর উচ্চাভিলাষী প্রোগ্রাম- ৭৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপ ও ৩৫০-ata চাপে nickel alloy products (৭৪০ঃ, ২৮২) ব্যবহার, ২০২৫-সালের মধ্যে Demo নির্মাণ ; ইয়োরোপ- ৭০০/৭২০ ডিগ্রী সেল্সিয়াস ও ৩০০ ata; জাপানের cool earth প্রোগ্রাম, ৭০০/৭২০ হC ও ৩৫০ ata; চীন- জাপানের মতই লক্ষ্য ; ভারত-এর লক্ষ্য- ২০২২-২৩ সালের মধ্যে ৮০০-মেগাওয়াটের Demo নির্মাণ ॥ গবেষণা চলছে পাশাপাশি, মূল focus হল বয়লার-প্লেট ও critical piping, টারবাইন ইত্যাদি ।
৪. তুলনা
| সাব-ক্রিটিকাল |
সুপার-ক্রিটিকাল | আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিকাল |
নির্বাহ | বন্দীকরণ- ছাড়া | বন্দীকরণ-সহ | বন্দীকরণ- ছাড়া | বন্দীকরণ-সহ | বন্দীকরণ- ছাড়া | বন্দীকরণ-সহ |
তাপ-হার, | ৯,৯৫০ | ১৩,৬০০ | ৮,৮৭০ | ১১,৭০০ | ৭,৮৮০ | ১০,০০০ |
কার্যদক্ষতা, - শতাংশ | ৩৪.৩ | ২৫.১ | ৩৮.৫ | ২৯.৩ | ৪৩.৩ | ৩৪.১ |
কয়লা যোগান, হাজার কেজি, ঘণ্টা-প্রতি | ২০৮ | ২৮৪ | ১৮৫ | ২৪৩ | ১৬৪ | ২০৯ |
CO2 নিঃসরণ, হাজার কেজি, ঘণ্টা-প্রতি | ৪৬৬ | ৬৩.৬ | ৪১৫ | ৫৪.৫ | ৩৬৯ | ৪৬.৮ |
CO2 বন্দীকরণ (১)হাজার কেজি, ঘণ্টা-প্রতি | ০ | ৫৭৩ | ০ | ৪৯১ | ০ | ৪২২ |
CO2 নিঃসরণ, গ্রাম / ইউনিট | ৯৩১ | ১২৭ | ৮৩০ | ১০৯ | ৭৩৮ | ৮৪ |
মূল্য :প্ল্যাণ্ট, মাঃ ডলার /কিলোওয়াট | ১,২৮০ | ২,২৩০ | ১,৩৩০ | ২,১৪০ | ১,৩৬০ | ২,০৯০ |
মূল্য: বিদ্যুৎ, মাঃ.সেণ্ট /ইউনিট | ৪.৮৪ | ৮.১৬ | ৪.৭৮ | ৭.৬৯ | ৪.৬০ | ৭.৩৪ |
সারণি ১
ভিত্তি : ৫০০
মেগা-ওয়াট নেট আউটপুট, ইলিনয় #৬ কয়লা,'গ্রীণ-ফিল্ড'
(১) বন্দীকরণের জন্য ৯০-শতাংশ স্থানান্তর-করণ
সারণি ১-এ দেখুন একটি তুলনা- সাব-, সুপার- ও আল্ট্রা সুপার-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্টের মধ্যে । দেখা যাচ্ছে, আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল CO2 বন্দীকরণ-সহ প্রযুক্তিতে কার্বন-নিঃসরণ ও বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি মূল্য সব থেকে কম এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার সত্ত্বেও প্ল্যাণ্টের সার্বিক মূল্য খুব বেশি নয় । উল্লেখ্য, এই তালিকার তথ্যগুলি দেয় একটি সার্বিক চিত্র, নির্ভর কয়লার গুণগত মানের উপর ।
৫. ভারত
ভারতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট স্থাপিত ক্যাপাসিটি হল ২৭৩- গিগাওয়াট ; এর মধ্যে কয়লা-জ্বালানির ভাগই হল ১৬৫-গিগা-ওয়াট । তুলনায়, মাঃ. যুক্তরাষ্ট্র কয়লার ব্যবহার ৪০-শতাংশ । ভারতে বর্তমানে আছে ৬০০-র বেশি প্ল্যাণ্ট যার সবই সাব ক্রিটিক্যাল- গড় কার্যদক্ষতা হল ৩০.৫-শতাংশ ।
ভারতীয় কয়লায় ছাই-এর অংশ এবং সিলিকা ও স্ফটিকের অংশ অত্যন্ত বেশি ; ফলে, সঞ্চলন-টিউবসারিগুলির মধ্য দিয়ে গ্যাসের গতিবেগ কম । এই কারণে পালভারাইজার ও বয়লারের অংশগুলিতে বিশেষ রক্ষা-ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে । গ্যাস প্রবাহের জন্য ক্ষেত্রফলের বৃদ্ধি হবে অন্ততঃ ৫০-শতাংশ, এবং তাপচলন(heat-rate)মাত্রা কম হওয়ার দরুণ তাপীয় পৃষ্ঠ বর্ধিত হবে । উন্নত বিটুমেন কয়লার ( যথা, মার্কিন কয়লা ) তুলনায় ভারতীয় কয়লা ব্যবহার করলে চুল্লীর আয়তন বৃদ্ধি পাবে ৭৮-শতাংশ এবং চুল্লীর উচ্চতা হবে ৫০-শতাংশ বেশি।
এরই জন্য দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে,
(ক) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভবিষ্যতে সুপার-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ৪-টি আল্ট্রা মেগা বিদ্যুৎ প্রোজেক্টের (UMPP) মধ্য দিয়ে- প্রতিটির ক্যাপাসিটি হল ৪,০০০-মেগাওয়াট ;
(খ) বর্তমান কেন্দ্রগুলিকে উন্নত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হবে সুপারক্রিটিকাল প্রযুক্তিতে উন্নীত করার ।
আজ পর্যন্ত ৪-টি ৪,০০০ মেঃ.ওয়াট সুপার-ক্রিটিক্যাল কেন্দ্র 'কমিশন' হয়ে গেছে ; পরিকল্পনা হয়েছে আরও ৪-টির ।
পরিশিষ্ট
১. বিশ্বে ( ২০১৩ খ্রীষ্টাব্দে ) জীবাশ্ম-জ্বালানির পরীক্ষিত ভাণ্ডার
সারণি প১ : বিশ্বে তিন জীবাশ্ম-জ্বালানির পরীক্ষিত ভাণ্ডার,
২০১৩- সাল
কয়লা
দেশ | প্রমাণিত ভাণ্ডার ( মিলিয়ন টন ) |
মাঃ যুক্তরাষ্ট্র | ২,৩৭,২৯৫ |
চীন | ১,১৪,৫০০ |
অস্ট্রেলিয়া | ৭৬,৪০০ |
ভারত | ৬০,৬০০ |
কাজাকিস্তান | ৩৩,৬০০ |
প্রাঃ গ্যাস
দেশ | প্রমাণিত ভাণ্ডার ( ট্রিলিয়ন ঘন-ফুট ) |
ইরান | ১,১৮৭ |
রাশিয়া | ১,১৬৩ |
কাতার | ৮৮৫ |
তুর্কমেনিস্তান | ৬১৮ |
মাঃ যুক্তরাষ্ট্র | ৩০০ |
সৌদি আরব | ২৯১ |
সংযুক্ত আরবশাহী | ২১৫ |
ভেনিজুএলা | ১৯৬ |
নাইজেরিয়া | ১৮২ |
আলজেরিয়া | ১৫৯ |
তেল
দেশ | প্রমাণিত ভাণ্ডার ( বিলিয়ন ব্যারেল ) |
ভেনিজুএলা | ২৯৮ |
সৌদি আরব | ২৬৬ |
কানাডা | ১৭৪ |
ইরাক | ১৫০ |
ইরান | ১২৭ |
কুয়াইত | ১০২ |
সংযুক্ত আরবশাহী | ৯৮ |
রাশিয়া | ৮৭ |
লিবিয়া | ৪৮ |
নাইজেরিয়া | ৩৭ |
সারণি প ১ (উৎস : www.businessinsider.in)
২ (ক). সাব-ক্রিটিক্যাল প্ল্যাণ্টের সংক্ষিপ্ত কার্যপদ্ধতি
সনাতন পদ্ধতিতে কয়লা জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়- (১) বয়লারে জল ফুটিয়ে বাষ্প, (২) বাষ্প দিয়ে চালানো হয় বাষ্পীয় টারবাইন, [(১) ও (২) এর মিলিত কার্যদক্ষতা হল প্রায় ৩২-শতাংশ] এবং (৩) টারবাইন থেকে পাওয়া যায় যান্ত্রিক শক্তি যাকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে ইলেক্ট্রিক জেনারেটর ।
বিচূর্ণ কয়লা ইউনিটে কয়লাকে ' ট্যালকম পাউডারের ' মতন মিহি অবস্থায় চূর্ণিত করে চুল্লীর বার্নারে অনুবিদ্ধ করা হয় বায়ু-সহ দহনের জন্য । মিহি কয়লা তাড়াতাড়ি তপ্ত হয়, pyrolysis-রূপান্তর ঘটে এবং জ্বলে ওঠে । দনন বায়ুর বেশির ভাগটাই অগ্নিশিখার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে কয়লাকে সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দেয় ।
বয়লার টিউবে উৎপাদিত হয় শুষ্ক সংস্পৃক্ত বাষ্প যাকে আরও উত্তপ্ত করা হয় চুল্লির সুপারহিটারে । এই উচ্চ-চাপ, অতিতাপিত বাষ্প চালনা করে একটি বাষ্পীয় টারবাইনকে যেটা যুক্ত আছে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রের সঙ্গে । পাশাপাশি বাষ্পীয় টারবাইনের অল্প-চাপ বাষ্পকে ঠাণ্ডা করে বয়লারে পাঠানো হয় বাষ্পে পরিণত করার জন্য ।
বয়লার থেকে উদ্গত ফ্লু গ্যাসকে এবার পরিশ্রুত করা হয় কণাময়, SOx এবং NOx বিতাড়নের জন্য । পরিশ্রুত ফ্লু গ্যাসে থাকে ১০-১৫ শতাংশ কার্বন-ডাই অক্সাইড- বায়ুমণ্ডলীয় চাপে ।
২ খ. সুপার-ক্রিটিক্যাল এবং আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিকাল প্ল্যাণ্টের
সংক্ষিপ্ত কার্যপদ্ধতি
সুপার ক্রিটিক্যাল(SC)এবং আলট্রা- সুপার ক্রিটিক্যাল(USC)শক্তি-কেন্দ্রগুলি কাজ করে জলের সন্ধি-বিন্দুর(critical point)উপরে অর্থাৎ যে তাপমাত্রা ও চাপ-এর উপরে জলের তরল ও বাষ্পীয় অবস্থাগুলি স্থিতাবস্থায় অবস্থান করে, যে বিন্দুতে জলীয়-বাষ্প ও তরল-জলের মধ্যে কোনও প্রভেদ থাকে না । ফলস্বরূপ, কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি পায়- ৪৫-শতাংশের উপরে ।
Rankin-বাষ্পচক্রের তাপগতিক কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় যত টারবাইনে প্রবেশকরা অতিতাপিত বাষ্পের তাপ- ও চাপ-মাত্রা বাড়বে । যুক্ত তাপশক্তির গড় উষ্ণতাকে আরও বাড়ানো সম্ভব যদি টারবাইন থেকে আংশিক সম্প্রসারিত ও বিজারিত(reduced)তাপমাত্রার বাষ্পকে বয়লারে নিয়ে পুনর্তাপিত(reheat)করা হয়, এবং পরে আবার টারবাইনে প্রবেশ করানো হয় । এই ভাবে দু'- তিন-বার পুনর্তাপিত করা হয়, যেটা চিত্রে দেখানো হয় :
চাপমাত্রা, প্রথম পুনর্তাপিত তাপমাত্রা / দ্বিতীয় পুনর্তাপিত তাপমাত্র / তৃতীয় পুনর্তাপিত
তাপমাত্রা । উদাহরণস্বরূপ, ৩০৯ বার, ৫৯৪ / ৫৯৪ / ৫৯৪ সেলসিয়াস ।
জুলাই ১৯, ২০১৬.
উল্লেখ্য :
Future of Coal, MIT, 2007
Clean Coal Power Generation Technology Review, Worldwide experience with implications for India, June, 2008, World Bank
ieema Journal, vol.6,April, 2015.
Advanced Ultra-Supercritical Power Plant (700 to 760C)- Design for Indian Coal, Babcock &Wilcox Technical Paper, Oct 2-5, 2012 .
লেখক পরিচিতি - শিক্ষাবিদ। বি.ই. কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর। এক সময় পশ্চিম বঙ্গ সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী ছিলেন। অবসর-এর যুক্ত প্রায় জন্মকাল থেকেই। অবসর-এর উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।