প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিজ্ঞান

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৬

 

নিউট্রিনো এবং এক অজানা বিশ্ব

অভিরূপ ঘোষ


নোবেল পুরষ্কার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। প্রতি বছর ডিসেম্বরে আরও পাঁচটি বিষয়ের সাথে পদার্থবিদ্যায় মৌলিক গবেষণার জন্য এক বা একাধিক(সর্বোচ্চ তিন জন) পদার্থবিদকে দেওয়া হয় নোবেল পুরষ্কার। পুরষ্কারপ্রাপকদের নাম ঘোষণা হয় সাধারণত অক্টোবরের প্রথম এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে। সেই হিসাবে খুব শীগগিরই ২০১৬ সালের নোবেল প্রাপকদের নাম জানা যাবে। তার আগে দেখে নেওয়া যাক গতবছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালের পদার্থবিদ্যার নোবেল প্রাপকদের নাম ও কৃতিত্ব। গতবছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জাপানি বিজ্ঞানী তাকাকি কাজিতা এবং কানাডিয়ান বিজ্ঞানী অর্থার ম্যাকডনাল্ড। তারা নিউট্রিনোর দোলন এবং ভরের অস্তিত্ব নির্ণয় জন্য পেয়েছিলেন এই সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার। এখন দেখা যাক কি এই নিউট্রিনোর ইতিবৃত্ত।

আপনি যতক্ষণ এই লেখাটি পড়বেন ততক্ষণে কয়েক লক্ষ কোটি নিউট্রিনো আপনার শরীর দিয়ে পেরিয়ে গেছে এবং ঠিক এই মুহূর্তে আপনার নাকের ডগায় প্রায় ৬৫ বিলিয়ন নিউট্রিনো অপেক্ষা করে আছে, তবু আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না – কারণ এই কণাটি পার্থিব বস্তুর সঙ্গে ভৌত এবং রাসায়নিক সংযোগ করেনা বললেই চলে ( এটির সংযোগ করার প্রবণতা এতটাই কম যে এটিকে যদি ১ আলোকবর্ষ, অর্থাৎ ১ ট্রিলিয়ন লম্বা একটি পারদপাত্রের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয়, এটি সংযোগ না করে বেরিয়ে যেতে পারে )।

অজানা এই কণাটির ব্যাপারে তত্ত্বগতভাবে প্রথম ভেবেছিলেন বিজ্ঞানী পাওলি। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিটা-ক্ষয়ের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সময় দুটি আলাদা কণার সন্ধান পেলেন যেগুলি শক্তি, রৈখিক ভরবেগ এবং কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র মেনে চলে। তিনি ভাবলেন কণা দুটি সমগোত্রীয়। ইলেকট্রন এবং প্রোটনের সাথে নাম মিলিয়ে তিনি কণাটির নাম রাখলেন নিউট্রন। ২ বছর পর ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী চ্যাডউইক ওই একই পরীক্ষা থেকে বুঝলেন কণাদুটির মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও তারা আলাদা। তার একটির ভর প্রোটনের প্রায় সমান এবং সেটি নিস্তড়িৎ - সেই কণাটির নাম স্থির হল নিউট্রন। অপর কণাটি, যার ভর তখন শূন্য বলে ভাবা হল এবং যেটি আলোর বেগে চলে, বিজ্ঞানী ফার্মি এক বিজ্ঞান সম্মেলনে তার নাম দিলেন ‘নিউট্রিনো’ (যার অর্থ ‘একটি অতীব ক্ষুদ্র নিস্তড়িৎ কণা’)। ১৯৫৯ ( যদিও পরীক্ষার তত্ত্বটি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত) খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক রেইন্স এবং তার সঙ্গীরা পরীক্ষামূলক ভাবে এই কণাটির অস্তিত্ব প্রমাণ করলেন। ফলস্বরূপ বিজ্ঞানী রেইন্স ১৯৯৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান।

ষাটের দশকের গোড়ায় বিজ্ঞানীরা সূর্যের মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন নিউট্রিনোর সংখ্যা নির্ণয় করলেন তত্ত্বের সাহায্যে। কিন্তু পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলেন এখানে যতগুলি নিউট্রিনো আসা উচিত, তার মাত্র এক তৃতীয়াংশ নিউট্রিনোর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে ১৯৬২ সালে Brookhaven এর বিজ্ঞানীরা একটি পৃথক ধরনের নিউট্রিনোর সন্ধান পেলেন। বিজ্ঞানী রেইন্সের সন্ধান দেওয়া নিউট্রিনোটি ইলেকট্রনের সাথে সংযোগের ফলে সংযোগের ফলে তৈরি হচ্ছিল বলে এর নাম দেওয়া হল ইলেকট্রনিক নিউট্রিনো এবং এই নতুন নিউট্রিনোটি অপর একপ্রকার মৌলিক কণা মিউওনের সাথে সংযোগের ফলে তৈরি হল বলে এর নাম দেওয়া হল মিওনিক নিউট্রিনো। ১৯৭৮ সালে Stanford (SLAC) এর বিজ্ঞানীরা আরও এক ধরনের নিউট্রিনোর সন্ধান পেলেন- টাওনিক নিউট্রিনো। ফলত এখন তিন ধরনের (বিজ্ঞানের ভাষায় ‘স্বাদ’ বা ‘Flavour’) নিউট্রিনো – ইলেকট্রনিক, মিওনিক এবং টাওনিক। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও হিসাব করা নিউট্রিনোর সংখ্যা পৃথিবীপৃষ্ঠে এক-তৃতীয়াংশ কেন হয়ে যাচ্ছে তা বিজ্ঞানীরা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। ফলে বিজ্ঞানীদের হাতে তিনটি বিকল্প পরে রইল। হয় হিসাবে কোথাও গরমিল হচ্ছে, বা বাকি নিউট্রিনো মহাবিশ্বে কোন অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে যাচ্ছে, নয়ত নিউট্রিনোর ‘স্বাদ’ এর পরিবর্তন হচ্ছে কোন অজানা কারণে। বহু জায়গায় বহুবার পরীক্ষার পরে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন যে হিসাবে কোন গরমিল নেই এবং মহাবিশ্বে নিউট্রিনোর হারিয়ে যাওয়াও অসম্ভব(কারণ নিউট্রিনো সংযোগ করেনা বললেই চলে)।

হাতে পরে রইল শেষ বিকল্পটি। কিন্তু যে কোন মৌলিক কণার ‘স্বাদ’ পরিবর্তন হতে গেলে তার ভর থাকতেই হবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত জানা ছিল যে নিউট্রিনোর কোন ভর নেই। ১৯৮৫ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা তত্ত্বগতভাবে দেখলেন নিউট্রিনোর ভর আছে এবং তা ইলেকট্রনের ভরের ১০০০০ ভাগের এক ভাগ- অর্থাৎ নগণ্য। এই আবিষ্কার সত্ত্বেও ‘স্বাদ’ পরিবর্তনের যথাযোগ্য কারণ বা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না এবং এখানেই ২০১৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাপকদের কৃতিত্ব। বিজ্ঞানী তাকাকি কাজিতা জাপানের Super- Kaniokande যন্ত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখালেন বায়ুমণ্ডল হয়ে আসা নিউট্রিনো তাদের ‘স্বাদ’ বা পরিচয় পরিবর্তন করে। বিজ্ঞানী আর্থার ম্যাকডনাল্ড এবং তার দল কানাডার Sudbury Nutrino Observatory তে প্রমাণ করলেন সূর্য থেকে আসা ইলেকট্রনিক নিউট্রিনো হারিয়ে যায়না- বরং তা অন্য নিউট্রিনোতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রকৃতিতে তিনটি ‘স্বাদ’ এর নিউট্রিনো পাওয়া যায় বলে যে ইলেকট্রনিক নিউট্রিনোর সংখ্যা গণনা করা হয়, তা হিসাবের একতৃতীয়াংশ হয়ে যায় এবং তা হয় নিউট্রিনোর এই ‘স্বাদ’ পরিবর্তন বা পর্যায়ক্রমিক দোলন এর জন্য। অর্থাৎ নিউট্রিনো ভয়শূন্য নয়, তার ভর আছে- এই তত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হল। উত্তর পাওয়া গেল কয়েক দশকের পুরানো প্রশ্নের।

বিভিন্ন মৌলিক কণা দিয়ে পদার্থ এবং মহাবিশ্বের গঠন সংক্রান্ত সর্বাধুনিক এবং বর্তমানে প্রচলিত স্ট্যান্ডার্ড মডেল( যা ধরে নিয়েছে নিউট্রিনো ভরশূন্য) যে ত্রুটিমুক্ত নয়, বিজ্ঞানী কাজিতা এবং বিজ্ঞানী ম্যাকডনাল্ড তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। এবার শুরু হবে ণতুন তত্ত্বের খোঁজ। চেষ্টা করা হবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে অজানা মৌলিক কণা নিউট্রিনোকে আবদ্ধ করে সেটিকে নানা কাজে লাগানোর। খোঁজ হবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির গূঢ় রহস্যের সমাধানের।


লেখক পরিচিতি: পুরুলিয়ার একটি স্কুলে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। জন্ম বর্ধমান জেলার জামালপুরে। পড়াশোনা বর্ধমান, দুর্গাপুর এবং যাদবপুরে। পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর, বর্তমানে গবেষণার সঙ্গেও যুক্ত। মূলত বিজ্ঞান এবং আর্থসামাজিক বিষয় নিয়ে লেখেন। সেইসঙ্গে ছোট গল্প, কবিতা এবং নিবন্ধ। কয়েকটি লেখা বাংলা দৈনিকে এবং ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।