প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিজ্ঞান

নভেম্বর ১৫, ২০১৪

 

কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি

কৌশিক সেনগুপ্ত


বিগ ব্যাং-এর ইঙ্গিত

১৯২৯ সালে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রথম প্রমাণ উপস্থাপন করলেন এডুইন হাবল্। বহুদূরে অবস্থিত অনেকগুলি ছায়াপথকে টেলিস্কোপে অনুসরণ করে উনি দেখালেন ছায়াপথগুলির দূরত্ব ওদের রেডশিফটের (redshift) উপর দৃঢ়ভাবে নির্ভরশীল (correlated)। এই ফল কিন্তু প্রথম ১৯২৭ সালে উত্থাপন করেছিলেন লেমাত্রা। হাবলের পরীক্ষিত অধিকাংশ ছায়াপথেই যেন পৃথিবীর থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। ছায়াপথের গতিবেগ (ν) সঙ্গে পৃথিবীর থেকে এদের দূরত্বের (d) সম্পর্ক এই সমীকরণে প্রকাশ করা যায়: ν=H0 d এখানে H0 কে হাবলস্ কন্সটান্ট বা হাবল্ ধ্রুবক বলা হয়। এই ধ্রুবক মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার নির্ধারণে সহায়তা করে

[রেডশিফট (redshift) কথাটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন যখন একটি মহাজাগতিক বস্তু আমাদের থেকে কতটা দূরে অবস্থান করছে তা নিরূপণ করার জন্য। একটি তারকা বা ছায়াপথের দূরত্ব পরিমাপ করা হয় তাদেরই উৎপাদিত বর্ণালী মধ্যে শোষণ বা নির্গমন রেখাগুলি পরীক্ষা করে। প্রতিটি পারমাণবিক উপাদানের একটি বিশিষ্ট বর্ণালী থাকে। একটি বিশেষ পারমাণবিক উপাদানের ক্ষেত্রে এই বর্ণালীর শোষণ বা নির্গমনের রেখাগুলি সবসময় একই দূরত্বে অবস্থান করে। যখন মহাকাশীয় বস্তুটি আমাদের দিকে আসে অথবা আমাদের থেকে দূরে চলে যায় তখন এই শোষণ বা নির্গমন রেখাগুলির অবস্থানের পরিবর্তন হয়। শোষণ বা নির্গমন রেখাগুলির তরঙ্গদৈর্ঘ্য বস্তুটি চলন্ত অবস্থায় যা হবে আর অচল অবস্থায় থাকলে (আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে) যা হবে, তা এক নয়। বস্তুটি যখন আমাদের দিকে আসতে থাকে, আলো তখন নীল স্থানান্তরিত (blueshifted)—কারণ আলোক তরঙ্গ আমাদের ভিতরকার স্থানটুকুর মধ্যে সংকুচিত হয়ে খাটো তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বা উচ্চ কম্পাঙ্কে পরিণত হয়। অপরদিকে দূরে যাওয়ার সময় আলো লাল স্থানান্তরিত (redshifted) হয় যখন আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক হ্রাস পায় বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হয়। পৃথিবী থেকে দেখা মহাবিশ্বের বেশীরভাগ বস্তুর থেকে আলো লাল স্থানান্তরিত অবস্থায় আমাদের কাছে আসে। কেবল অল্প কতগুলি গ্রহ এবং কিছু নিকটবর্তী নক্ষত্রের ক্ষেত্রে আলো নীল স্থানান্তরিত হতে দেখা যায়।]

পর্যবেক্ষকের অবস্থান যদি মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থলে না হয় (যুক্তিগত ভাবে যার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী), তাহলে এই ঘটনার একটি মাত্র ব্যাখ্যাই সম্ভব—আমাদের দৃষ্টি পথে অবস্থিত ছায়াপথগুলি যেন একে অপরের থেকে ক্রমশই দূরে অপসৃত হচ্ছে। ছায়াপথগুলি দূরত্ব পৃথিবী থেকে যতটাই বেশী, এদের গতিবেগও সমানুপাতিক হারে ততটাই বেশি। ছায়াপথের দূরত্ব এবং গতিবেগের সম্পর্ক হাবলের সূত্র নামে পরিচিত। চিত্র ২র লেখচিত্রে দেখান হল বিভিন্ন ছায়াপথের রেডশিফটের এর সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণের ডাটা।

চিত্র ২: বিভিন্ন ছায়াপথের রেডশিফটের এর সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ। কৃতজ্ঞতা স্বীকার: স্টিফেন হওকিংগের বই The universe in a nutshell।

আজ যদি ছায়াপথগুলি পরস্পর থেকে দূরে সরবার কাজে রত হয়, একসময় ওরা নিশ্চয় নিজেদের অনেক কাছেই অবস্থান করত। বর্তমান হারে সম্প্রসারণের গতিবেগ ধরে নিয়ে মহাবিশ্বের বয়স হিসাব করলে দেখা যাবে ১০ থেকে ১৪ লক্ষ কোটি বছর আগে ছায়াপথগুলি যেন পরস্পরের উপরই অবস্থান করত।

হাবলের এই আবিষ্কার মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রথম পর্যবেক্ষণগত সমর্থন। বহুদূরের ছায়াপথ বা নক্ষত্রপুঞ্জগুলির গতিবেগ পরিমাপ করে দেখা গেল যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ফ্রিডমান-লেমাত্রার মডেল অনুসরণ করে। এই সম্প্রসারণ বিপরীত দিকে ফেরালে দেখা যায় যে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্থানে যার ঘনত্ব ও তাপমাত্রা ছিল প্রায় অপরিসীম, কিন্তু যার সূচনা অসীম কাল আগে নয়। এই ঘটনার নামই বিগ ব্যাং।

জর্জ গ্যামো ও ওঁর সহকর্মীদের ১৯৪৮ সালের তাত্ত্বিক পূর্বাভাস মতে বিগ ব্যাং থেকে নির্গত বিকিরণের চিহ্ন এখনও সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা উচিৎ। বিজ্ঞানীরা (বিশেষ করে গ্যামোর ছাত্র রালফ আলফার এবং ওঁর সহ গবেষক রবার্ট হারমান) বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে নবজাত মহাবিশ্বে হিলিয়াম (He) গ্যাসের প্রাচুর্য ব্যাখ্যা করতে গেলে মহাবিশ্বের বর্তমান তাপমাত্রা জন্মের ১৪ লক্ষ কোটি বছর পরে হওয়া উচিৎ ছিল ৫°K।

১৯৬৪ সালে রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে পেঞ্জিয়াস ও উইলসন মহাবিশ্বের জন্মের ১৪ লক্ষ কোটি বছর পর সেই তাপমাত্রা পরিমাপ করলেন ৩°K। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য হল রেডিও টেলিস্কোপ থেকে নির্গত সংকেতটির মাত্রা সমস্ত দিকেই অপরিবর্তনশীল। এই উচ্চ মানের সমসারকতা (isotropy)অর্থ একটাই—সংকেতের উৎস আমাদের নিজস্ব মিলকি ওয়ে (milky way) ছায়াপথের বাইরে অবস্থিত অথবা উৎসের সৃষ্টি বহু লক্ষ কোটি বছর আগে। উপরন্তু, উৎসটি খুবই শক্তিশালী না হলে এতো কাল পরে সংকেতটিকে সনাক্ত করা অসাধ্য হতো। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট ডিকি ও জেমস পিবলসের সহায়তায় পেঞ্জিয়াস ও উইলসন সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে ওঁদের সংকেত জর্জ গ্যামভ ও ওঁর সহকর্মীদের পূর্বাভাস মতো কসমিক মাইক্রোওয়েভ আভার রেশ। কিন্তু বিজ্ঞানীদ্বয় যে সত্যিই বিগ ব্যাঙ্গের দীপ্তি আবিস্কার করেছেন সেটা বিশ্বাস করতে যেন কল্পনার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ভাগ্যক্রমে রহস্যের সূত্র পাওয়া গেল উনবিংশ শতকে আবিষ্কৃত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে যার নাম কৃষ্ণ-বস্তুর বিকিরণ (blackbody radiation) । ১৯০০ সালে মাক্স প্লাংক কৃষ্ণ-বস্তুর বিকিরণের বর্ণালী এবং বৈশিষ্ট্য অঙ্ক কষে নির্ধারণ করে পদার্থবিদ্যায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন।

[ ঠিক কী ওঁরা সনাক্ত করেছেন সে সম্পর্কে পেঞ্জিয়াস এবং উইলসনের প্রথমে কোন ধারণাই ছিল না। একজন বন্ধু (এম.আই.টির অধ্যাপক বার্নার্ড এফ. বার্ক) যখন পেনজিয়াসকে প্রিন্সটন বিশ্বাবিদ্যালয়ের রবার্ট ডিকির গবেষণার দলের সদস্য জেমস পিবলসের তাত্ত্বিক কাজের হদিশ দিলেন তখন ওঁরা নিজেদের আবিষ্কারের তাৎপর্য বুঝতে শুরু করলেন। পিবলসের গবেষণাটির বিষয় ছিল বিগ ব্যাং থেকে উৎপন্ন বিকিরণের রেশ যে এখনও মহাকাশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকতে পারে, তার সম্ভাবনা নিয়ে। পেঞ্জিয়াস এবং উইলসনের সংকেত যে কোন কোন মহাজাগতিক তত্ত্বের পূর্বাভাস অনুযায়ী কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড, ডিকিই প্রথম সেই যোগাযোগটি অনুধাবন করেন। ১৯৭৮ সালের ৮ই ডিসেম্বর উইলসন নোবেল পুরষ্কার গ্রহণের সময় তাঁর ভাষণে জানিয়েছিলেন--

চিত্র ৩: COBE থেকে পাওয়া কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের তীব্রতার ডাটা বিভিন্ন কম্পাঙ্কে দেখানো হয়েছে। কৃষ্ণ-বস্তু বিকিরণের বক্ররেখার সঙ্গে এর নিখুঁত সামঞ্জস্যটি লক্ষ করার মত।

Shortly after sending the preprint, Dicke and his coworkers visited us in order to discuss our measurements and see our equipment. They were quickly convinced of the accuracy of our measurements...

We agreed to a side-by-side publication of two letters in the Astrophysical Journal - a letter on the theory from Princeton and one on our measurement of excess antenna temperature from Bell Laboratories. Arno and I were careful to exclude any discussion of the cosmological theory of the origin of background radiation from our letter because we had not been involved in any of that work. We thought, furthermore, that our measurement was independent of the theory and might outlive it. We were pleased that the mysterious noise appearing in our antenna had an explanation of any kind, especially one with such significant cosmological implications.

তার মানে কি ডিকি ও পিবলসের অসামান্য অবদান নোবেল কমিটি উপেক্ষা করেছে? অনেকেই আজ মনে করেন যে পেঞ্জিয়াস এবং উইলসনের সাথে ডিকি ও পিবলসের স্বীকৃতি না দিয়ে নোবেল কমিটি ভুলই করেছে।]

বিগ্ ব্যাং-এর মডেল অনুযায়ী নবীন মহাবিশ্বের দারুণ উষ্ম পরিসরটি ছিল পরমাণবিক কণা এবং ফোটন দিয়ে পরিপূর্ণ। এদের অবিরাম সংহর্ষের ফলে ফোটনগুলি অবিরত ভাবে পারমাণবিক কণাগুলি দ্বারা একযোগে শোষিত এবং বর্জিত হয়েছিল। অবিলম্বেই বোঝা গেল কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের বর্ণালীর সঙ্গে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের বর্ণালীর কোন আকৃতিগত পার্থক্য নেই।

১৯৯১ সালে COBE (কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার) উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে থেকে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা শুরু করল। দেখা গেল, মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের বর্ণালী (চিত্র ৩) নিখুঁত ভাবে কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের বর্ণালীর সাথে একমত এবং এর গড় তাপমাত্রা ২.৭২৫ ± ০.০০২°K। চিত্র ৩এর লেখচিত্রটিতে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের তীব্রতা বিভিন্ন কম্পাঙ্কে দেখানো হয়েছে। কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণের বর্ণালীর সাথে ৩৪টি ডাটা বিন্দু সামঞ্জস্য এতই নিখুঁত যে এরর্ বারগুলি (error-bar) বক্র রেখার অন্তরালে ঢাকা পরেছে।

জ্যোতির্বিদ্যা শাস্ত্রের ইতিহাসে তত্ত্বর সাথে পরীক্ষার ফলাফলের এমন ত্রুটিহীন সমন্বয় COBE এর আগে কখনো দেখা যায় নি।

বিগ ব্যাঙ্গের পরিমার্জনা

সুতরাং বিগ্ ব্যাঙ্গের তত্ত্বে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষামূলকভাবে যাচাইযোগ্য পূর্বাভাস পাওয়া যায়:

  • বিগ্ ব্যাং-এর প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যেই সরল মৌলিক সংশ্লেষণের মাত্রা (জটিল নিউক্লিয়াসগুলি তারকার অভ্যন্তর অনেক পরে উত্পাদিত হয়েছিল)
  • কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বিগ্ ব্যাং-এর থেকে নির্গত তীব্র তাপের অবশেষ এবং তার বর্ণালীর আকৃতি
  • হাবলের পর্যবেক্ষণ: মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হেতু ছায়াপথগুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে যাওয়ার গতিবেগ তাদের মধ্যকার দূরত্বর আনুপাতিক।

বিগ্ ব্যাং মডেলর কেন্দ্রীয় ধারনা বা চিন্তা (ক) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ (খ) শুরুর প্রচণ্ড উত্তপ্ত পরিবেশ (গ) সরল মৌলিক পদার্থগুলির সংশ্লেষণ, এবং (গ) ছায়াপথের সৃষ্টি—সবই উপরোক্ত এবং অন্যান্য পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত। এটা এখন নির্দ্বিধায় অনুমান করা যেতে পারে যে, অতীতে একসময় ছায়াপথ ও নক্ষত্রপুঞ্জগুলি নিশ্চয়ই একে অপরের সন্নিকটে ছিল কারণ এদের দূরত্ব আজ দ্রুতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। ব্যাং-এর সময় এবং এর অনতিকাল পরের অবস্থা আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিগ্ ব্যাং-এর মডেলর আকর্ষণীয় সাফল্য সত্ত্বেও এর কিছু বিভ্রান্তিকর দিক ক্রমেই প্রকাশ হয়ে পড়ল। যেমন, মহাবিশ্বের অপরিবর্তনশীল তাপমাত্রা বিতরণের ঘটনা বিস্ময়কর। উপরন্তু, মহাবিশ্বের জ্যামিতিক ফ্ল্যাটনেসেএর (flatness) এর কোন ব্যাখ্যা এই তত্ত্ব দিতে পারে নি।

দিগন্ত সমস্যা

মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রার বিতরণ এবং অন্যান্য ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলি বৃহদায়ত স্কেলের নিরীক্ষণে আশ্চর্য ভাবে অনুরূপ। এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর, কারণ, এই অঞ্চলগুলির দূরত্ব অসামান্য থাকার ফলে এদের মধ্যে কোনরকম “যোগাযোগ” থাকা সম্ভব নয়। তথ্য স্থানান্তরের (বা শক্তি, তাপ, ইত্যাদির স্থানান্তর) গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান। কিন্তু আলোর গতিবেগ তো অনন্ত নয়, সুতরাং বিগ ব্যাং-এর মুহূর্ত থেকে আলো কেবল একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত পরিক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুতে একটি ১৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধের গোলক কল্পনা করা যায় যাকে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব বলে।

দিগন্ত সমস্যা বুঝতে হলে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের কম্পাঙ্কের বিতরণ আর একবার ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করা দরকার (COBE, WMAP এবং প্লাংক প্রভৃতি কৃত্রিম উপগ্রহগুলি মারফত মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের বর্ণালী একাদিক্রমে অধিকতর স্পষ্টতায় মাপা হয়েছে। এ সব তথ্য পরে আলোচিত হবে।)। আমরা আগেই দেখছি মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বৃহদায়তন স্কেলের মাপে প্রায় isotropic। আপাতদৃষ্টিতে এটা সম্ভব যদি অতীতে, মহাকাশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলির মধ্যে কোনরকম "যোগাযোগের" ফলে একটা তাপ সুস্থিতি বা thermal equilibrium পর্যায় পৌছনো যেত। ধরা যাক দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বিপরীত প্রান্তে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের পর্দায় দুটি বিন্দু যাদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ২৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এই দূরত্ব কিন্তু আলোর পক্ষে বিগ ব্যাং ঘটে যাওয়ার ৩৮০,০০০ বছরের পর (যখন মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ প্রথম উন্মোচিত হয়েছিল) থেকে এখনকার মধ্যে পরিক্রমণ করা সম্ভব নয়। কারণ, কোন সংকেতই আলোকের গতিবেগের থেকে দ্রুতগামী হতে পারে না । সুতরাং বিভিন্ন অঞ্চলগুলির মধ্যে কোনপ্রকার যোগাযোগ মহাবিশ্বের জীবদ্দশায় হওয়া অসম্ভব।

জ্যানা লেভিন তার How the Universe Got its Spots বইটিতে একটি উপমা ব্যবহার করে দিগন্ত সমস্যাটি সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। একজন নৃতত্ববিদ যদি আবিষ্কার করেন যে দুই প্রাচীন সভ্যতার ভাষা এমনই অভিন্ন যে প্রত্যেক শত সহস্র শব্দের মধ্যে শুধুমাত্র একটি করে শব্দ বিশিষ্ট, তাহলে এই অদ্ভুত ঘটনাটির উৎপত্তি সম্বন্ধে বিতর্ক হবেই। দুই সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগ নিশ্চয় ছিল এবং নৃতত্ববিদ মহাশয় এই যোগাযোগ কিভাবে সম্ভব হয়েছিল তার বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজতে শুরু করবেন। পরবর্তী অনুচ্ছেদে দেখবেন অ্যালেন গুথের স্ফীতি তত্ত্বও কিভাবে সৃষ্টিতত্বের বেলায় অনুরূপ সমস্যাটির সমাধান করেছিল। বলা বাহুল্য, গুথের কাজই বিগ ব্যাং মডেলকে শেষ পর্যন্ত দিগন্ত সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়েছিল।

ক্রমেই বোঝা গেল, মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্তগুলির অনুরূপ তাপমাত্রার হওয়ার কোন লুকনো মৌলিক কারণ রয়েছে যার ব্যাখ্যা বিগ ব্যাং তত্ত্বে মেলে না।

ফ্লাটনেস সমস্যা

বিজ্ঞানীরা এখন বিশ্বাস করেন যে মহাবিশ্বের আকৃতি খুব সম্ভব সমতল কিম্বা বক্রতাহীন। পূর্ববর্তী সংখ্যাতে কিভাবে মাত্রাহীন মহাজাগতিক পরামিতিটি Ω0 ব্যবহার করে মহাবিশ্বের জ্যামিতি এবং সম্ভাব্য চূড়ান্ত পরিণতির কথা অনুমান করা যায়, তা বিশদ ভাবে আলোচিত হয়েছে। Ω0 রাশিটি মহাবিশ্বের প্রকৃত ভর-ঘনত্ব (mass density) এবং ক্রিটিকাল (critical) ভর-ঘনত্বের অনুপাত। মহাবিশ্বের আকৃতি সমতল (বক্রতাহীন) যখন Ω0 = ১। এই অবস্থাতে মহাবিশ্বের জ্যামিতি বদ্ধ-আর-সীমাবদ্ধ এবং মুক্ত-আর-অসীমের মাঝামাঝি। অন্য কথায়, এই পরিস্থিতিতে মহাবিশ্বের প্রকৃত ভর-ঘনত্বের মান ক্রিটিকাল ভর-ঘনত্বের প্রায় সমান। সম্প্রসারণ এবং বিবর্তনের ১৪ বিলিয়ন বছর পরেও মহাবিশ্বের ভর-ঘনত্ব ক্রিটিকাল ঘনত্বের এত কাছাকাছি হওয়ার অর্থ এই হতে পারে যে অতীতে দুটি রাশির মান নিশ্চয় আরও কাছাকাছি ছিল। কারণ, আদিতে যদি সামান্য ধনাত্মক কিম্বা ঋণাত্মক বক্রতার আকার নিয়ে মহাবিশ্বের জন্ম হতো তাহলে এই বক্রতা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়াই উচিত ছিল, কমা নয়।

মহাবিশ্বের প্রকৃত ভর-ঘনত্বের মান ক্রিটিকাল মানের এত নিকটবর্তী হোল কেন, বিগ ব্যাঙ্গ মডেলে তার কোন উত্তর মেলে না। বিজ্ঞানে এমন কাকতালীয় ঘটনা অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছনীয়।

উপরে বর্ণিত কারণগুলির জন্য বিগ ব্যাং তত্ত্বে কিছু কিছু পরিমার্জনার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। পরবর্তীকালে এই তত্ত্বের উন্নতি সাধান অবশ্যই হয়েছিল। স্ফীতি (Inflation) সৃষ্টিতত্ত্ব নামে পরিচিত, এই নূতন তত্ত্বের আবির্ভাবের সঙ্গে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান শাস্ত্রে যেন একটি নব দিগান্তের সূচনা হল। স্ফীতি সৃষ্টিতত্ত্ব আমাদের পরবর্তী অনুচ্ছেদের আলোচনার বিষয়।

ম্যাটার এ্যান্টি-ম্যাটার অসামঞ্জস্যতা

আরেকটি বিস্ময়কর প্রশ্ন হল মহাবিশ্বে প্রতিবস্তু চেয়ে বস্তুর আধিক্য কেন? পদার্থবিদরা এখন মনে করেন যে বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের সময় প্রচুর পরিমাণে ম্যাটার বা পদার্থ এবং এ্যান্টি-ম্যাটার বা প্রতিবস্তু সম পরিমাণে সৃষ্টি হয়েছিল। ম্যাটার এবং এ্যান্টি ম্যাটার অবিলম্বে একে অপরকে ধ্বংস করার পরেও অল্প পরিমাণে ম্যাটার উদ্বৃত্ত থেকে গিয়েছিল। আশ্চর্যের কথা হল এই উদ্বৃত্ত পদার্থ থেকেই ক্রমে সমস্ত ছায়াপথ, নক্ষত্রপুঞ্জ এবং গ্রহরাশির সৃষ্টি।

বস্তু এবং প্রতিবস্তুর অপ্রতিসাম্য আচরণের কারণ বিজ্ঞানীরা পুরদমে অনুসন্ধান করে চলেছেন কিন্তু অধিকাংশ পরিচিত কণা-প্রতিকণার (particle-antiparticle) বেলাতে কোন রকমের অপ্রতিসাম্য আচরণের বৈশিষ্ট্য আজ পর্যন্ত ধরা পড়ে নি। এর একমাত্র ব্যতিক্রম নিউট্রিনো নামের একটি কণা। নিউট্রিনোই এই অসামঞ্জস্য ব্যবহারের উৎস বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ পর্যন্ত তিনটি বিভিন্ন ধরনের নিউট্রিনো (ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো, এবং টাউ নিউট্রিনো) এবং তাদের প্রতিকণাদের অস্তিত্ব্ব পরীক্ষামূলক ভাবে পাওয়া গিয়েছে। নিউট্রিনোর এই ধরনগুলিকে ফ্লেভার (flavor) বা স্বাদ বলে। মজার ব্যপার এই যে নিউট্রিনো চলার পথে নিজের পরিচয় পরিবর্তন করতে পারে। একটা ফ্লেভার থেকে অন্য ফ্লেভারে অনায়াসে রূপান্তরিত হওয়া নিউট্রিনোর একটা ধর্ম যাকে নিউট্রিনোর স্পন্দন বা অসিলেসন (oscillation) বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এখন, নিউট্রিনো যদি ওর নিজেরই প্রতিকণা (এটা অনেক পারমাণবিক কণার ক্ষেত্রে সম্ভব) না হয়, তাহলে সম্ভবত নিউট্রিনো এবং এ্যান্টি-নিউট্রিনোর স্পন্দনের হার ভিন্ন, যদিও এর পরীক্ষামূলক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে এই ভিন্ন হারে স্পন্দনের জন্যই হয়তো বেশ কিছু বাড়তি নিউট্রিনো মহাবিশ্বের প্রথম দিকের ম্যাটার এ্যান্টি-ম্যাটার নাশের যুগকে এড়িয়ে টিকে থাকতে পেরেছিল।

নিউট্রিনোই পদার্থবিদ্যার অন্য সব পরিচিত পারমাণবিক কণাগুলির মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় কণা। রহস্যময় নিউট্রিনো মহাবিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু আমরা ওদের দেখতে কিম্বা “ছুঁতে” পারি না। অধিকাংশ সময় ওদের গতিও রোধ করা সম্ভব নয়। বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের সময় প্রচুর পরিমাণে নিউট্রিনোর সৃষ্টি হয়েছিলো। আমাদের সূর্যের মত তারকারা পর্যাপ্ত পরিমাণ নিউট্রিনো ক্রমাগত ভাবে উত্পাদন করে চলেছে। নিউট্রিনো এবং ম্যাটার এ্যান্টি-ম্যাটারের অসামঞ্জসতা এতই রহস্যপূর্ণ বিষয় এবং এর গবেষণার কাহিনী এমনই ঘটনাবহুল যে একটা প্রবন্ধে সে কাহিনী বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়।

(চলবে)


ছায়াপথের রেডশিফট পরিমাপনের কাজ পৃথিবীর বিভিন্ন মানমন্দিরে শুরু হয়েছিল ১৯১৭ সালেরও আগে। রেডশিফটের তাৎপর্য প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন জেমস এডওয়ার্ড কিলার (লেহন এবং অ্যালিঘেনি), ভেস্ত মেলভিন স্লাইফার (লোএল), এবং উইলিয়াম ওয়ালেস ক্যাম্পবেল (লিক)। আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির আগস্ট ১৯১৪ সালের সম্মেলনে স্লাইফার তাঁর ক্লাসিক গবেষণাপত্রটি উপস্থাপনা করার সময় রেডশিফটের প্রমাণ স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেছিলেন ১৫টি মধ্যে ১১ টি ছায়াপথের বেলায়। উপস্থাপনার পর গবেষণার উৎকৃষ্টতা কবুল করে দর্শকরা সকলে উঠে দাঁড়িয়ে স্লাইফারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রমাণ কিন্তু প্রথম প্রদর্শন করেন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল উইলহেম রিটজ। রিটজের গবেষণাপত্র এডুইন হাবল এর বিখ্যাত গবেষণাপত্রটির প্রকাশনের কয়েক বছর আগে ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো।

যে পারমাণবিক কণা নিজেরই প্রতিকণা তাদের মাজরানা (Majorana) কণা বলে। পদার্থর সঙ্গে নিউট্রিনোর সংঘাত অত্যন্ত ক্ষীণ বলে এদের সনাক্ত করাও খুব কঠিন কাজ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে নিউট্রিনো মেজরানা কণার একটি উদাহরণ হতে পারে—নিউট্রিনো এবং এ্যান্টি-নিউট্রিনো আসলে একই কণার ভিন্ন রূপ।


লেখক পরিচিতি: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচ ডি করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোস্ট ডক্টরেট করেন। বর্তমানে আই.বি.এম-এ কর্মরত।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।