বিজ্ঞান

ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫
কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি (সূচী)
কৌশিক সেনগুপ্ত
কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সনাক্তকরণ
আমরা এখন ফিরে আসব এই প্রবন্ধের মূল বিষয়ে। মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্য বুঝতে হলে কসমিক মাইক্রোওয়েভের বৈশিষ্ট্যও অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরী। আগেই বলা হয়েছে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সৃষ্টির সময় মহাবিশ্ব খুব তপ্ত এবং জমাট অবস্থায় ছিল। এখনও এই বিকিরণের রেশ থেকে গিয়েছে মহাবিশ্বের সর্বত্র। এই অংশে আমরা মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আর একবার ঝালিয়ে নেব। আমাদের আলোচনার মূল বিষয় কৃত্রিম উপগ্রহর উপর স্থাপিত আধুনিকতম টেলিস্কোপের সাহায্যে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের সুস্পষ্ট ম্যাপিং এবং সেই গবেষণা ফল অনুধাবন করা। বলা বাহুল্য, কৃত্রিম উপগ্রহগুলি গবেষণার কাজে লাগানোর মূল উদ্দেশ্য হল গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক পরামিতিগুলিকে সঠিকভাবে পরিমাপ করা যাতে ওগুলির সর্বোত্তম মান ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা কোন কোন ভ্রান্ত স্ফীতি মডেলের ক্লাসকে সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাগ করতে অথবা তাদের পূর্বাভাসের সীমানা নির্দিষ্ট করতে পারেন।
১৯৬০ সালে, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত হয়ে, নাসা (NASA) এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা সৃষ্টিতত্বের গবেষণার কাজে অনেকগুলি কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের পরীক্ষামূলক সমীক্ষা এবং পরিমাপ। নূতন ডাটা বিজ্ঞানীদের বুঝতে সাহায্য করবে সৃষ্টিতত্বের নানা অজানা বিষয়। নীচের বিভাগগুলিতে এই কৃত্রিম উপগ্রহ মিশন থেকে বৈজ্ঞানিকরা যে তথ্য অর্জন করেছিলেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, মিশনগুলির আসাধারন সাফল্য পর্যবেক্ষণ এবং তাত্ত্বিক সৃষ্টিতত্বের গবেষণার ক্ষেত্রগুলিতে নূতন দ্বিগন্ত খুলে দিয়েছিল।
নাসার কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার (COBE) কৃত্রিম উপগ্রহটি গ্রীবেল্ট, মেরীল্যান্ডের গডার্ড (Goddard) স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে নির্মিত হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের ১৮ই নভেম্বর এটিকে কক্ষপথে স্থাপন করা হল। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড যথাযথ পরিমাপ এবং ম্যাপিং ছিল COBEএর মূল উদ্দেশ্য।
COBE প্রদত্ত কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির উষ্ণ এবং শীতল অঞ্চলগুলির মানচিত্র (চিত্র ৪) আজ জগত বিখ্যাত। এই মানচিত্রের মধ্যে বিজ্ঞানীরা যেন প্রথম বার নবজাত মহাবিশ্বকে দেখতে পেলেন বিগ ব্যাঙ্গের শুধুমাত্র ৩৮০,০০০ বছর পর। মনে করা হয়, মহাকাশের মানচিত্রের অস্পষ্ট ছাপ বা অঞ্চলগুলি শেষ পর্যন্ত ছায়াপথে পরিণত হয়েছিল বহু বিলিয়ান বছর পর। মানচিত্রের বিভিন্ন রঙের ছাপগুলি সূক্ষ্ম তাপমাত্রা তারতম্যের ইঙ্গিত করে। স্টিফেন হওকিং (Stephen Hawking) তাঁর বই The Universe in a Nut Shell এ কিভাবে মাইক্রোওয়েভ পটভূমির উষ্ণ এবং শীতল অঞ্চলগুলির তাপমাত্রা তারতম্যের থেকে মহাজাগতিক বস্তুগুলি শেষ পর্যন্ত গঠিত হয়েছিল, তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন এইভাবে—

চিত্র ৪: চিত্রে নীল এবং গোলাপী রঙ দিয়ে দেখানো তাপমাত্রার সামান্য তারতম্য প্রাচীন মহাবিশ্বের ঘনত্বর তারতম্যের সাথে সংযুক্ত। এই বৈচিত্রই কালক্রমে ছায়াপথগুলির সমষ্টি বা ক্লাস্টার এবং সুবিশাল আন্তঃগ্যালাকটিক খালি অঞ্চলগুলি সৃষ্টি করেছে বলে মনে করা হয়।
|
The different colors indicate different temperatures, but the whole range from red to blue is only about a ten thousandth of a degree. Yet this is enough variation between different regions of the early universe for the extra gravitational attraction in the denser regions to stop them expanding eventually, and to cause them to collapse again under their own gravity to form galaxies and stars. So in principle, at least, the COBE map is the blueprint of all the structures in the universe.
COBEর দুইজন বিজ্ঞানী—নাসা গডার্ড (NASA Goddard) স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের জন মাথের, এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলের, জর্জ স্মুট, এই কাজের জন্যই ২০০৬ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। COBE মিশন জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা শাস্ত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল সূক্ষ পরিমাপ পধ্যতির স্থাপনের জন্যে।

চিত্র ৫: WMAPএর নিরীক্ষিত কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি। তাপমাত্রা বিতরণের উচ্চতর স্পষ্টতা লক্ষ্য করুন।
|
২০০১ সালের ৩০শে জুন উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানয়াইসোট্রপ প্রোব (WMAP) নামের কৃত্রিম উপগ্রহটি কক্ষপথে পাঠান হয়েছিলো। ঐ প্রথম কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির বিস্তারিত পূর্ণ-আকাশ মানচিত্র (চিত্র ৫) বিজ্ঞানীদের হাতে এলো। সম্পূর্ণ আকাশকে স্ক্যান করতে WMAPএর দীর্ঘ নয় বছর সময় লেগেছিল। উপগ্রহটি যে বিজ্ঞানীদের কসমিক মাইক্রোওয়েভের অবশিষ্ট আভার দেখার ও সমীক্ষা করার এপর্যন্ত সেরা সুযোগ করে দিয়েছিল তা শুধু নয়, মহাবিশ্বের বিবর্তন এবং গঠনের বৈজ্ঞানিক মডেল প্রতিষ্ঠানেও WMAP এর অবদান অপরিসীম ।
WMAP কে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক মহাজাগতিক পরামিতি মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। এসব রাশিগুলি মহাবিশ্বের গঠন ও বিবর্তনের ইতিহাস বোঝার পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। WMAP ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া ফলাফলের সারাংশ নিচে দেওয়া হল।
- মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৭৭ ± ০.৫% বিলিয়ন বছর
- পূর্ণ-আকাশের জন্য প্রস্তুত করা প্রথম মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের সূক্ষ্ম-রিসোলিউশন (0.২º)-মানচিত্র প্রকাশ (কসমিক মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ মধ্যে ক্ষুদ্র fluctuation)
- প্রথম তাড়াকার আবির্ভাব বিগ ব্যাঙ্গের ২০০ মিলিয়ন বছর পর
- এর পূর্ণ-আকাশ স্ক্যান অনুযায়ী আলোকের আবির্ভাব বিগ ব্যাঙ্গের ৩৭৯,০০০ বছর পর
- মহাবিশ্বের বিষয়বস্তু:
- ৪.৬% সাধারণ পরমাণু
- ২৪% ডার্ক ম্যাটার (যে পদার্থ সাধারণ পরমাণু দ্বারা গঠিত না)
- ডার্ক এনার্জি। এর প্রকাশ মহাজাগতিক ধ্রুবকের মধ্য দিয়ে; মহাবিশ্বের ৭১.৪% ভরের জন্যর দ্বায়ী এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার নিয়ন্ত্রণ করে
- হাবল ধ্রুবক (মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার) মাপা হয়েছে H_0=৬৯.৩২ ±০.৫ কিমি/সেকন্ড/Mpc
- মহাজাগতিক পরামিতি মাপা হয়েছে: Ω_০=১.০২±০.০২। এই মান ইঙ্গিত করে মহাবিশ্ব প্রসারণ চিরস্থায়ী হবে
- পূর্ণ-আকাশের জন্য প্রস্তুত করা মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের পোলারাইজেশন ম্যাপ। WMAP এর ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেল মহাবিশ্বের পুনরায় আয়নিত হওয়ার (re ionization) পর্বটি যে সময় ঘটেছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, বস্তুতপক্ষে ঘটনাটি তার পূর্বেই ঘটেছিল
- মহাবিশ্বের ঘনত্ব পরিবর্তনের বিস্তার যদি তুলানামুলক ভাবে বড় স্কেলে পরিমাপ করা হয় তাহলে দেখা যায় যে এর মান ছোট স্কেলের পরিমাপের থেকে সামান্য কিছু বড়। এই তথ্যটি এবং WMAP এর অন্যান্য ফলাফল স্ফীতি তত্ত্ব সমর্থন করে। মহাবিশ্বের আয়তন নাটকীয় ভাবে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বর্ধিত হয়েছিল এক সেকেন্ডের এক ট্রিলিয়নের এক ট্রিলিয়ন ভাগ সময়ের মধ্যে। সম্প্রসারণের সময় ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম ফ্লাক্টুএসান বা তারতম্যগুলি (fluctuation) ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে অবশেষে ছায়াপথে পরিণত হল।
- কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির উপর ফ্লাক্টুএসানের বিতরণ একটি বেল কার্ভকে (Bell curve) অনুসরণ করে। (ক) এই কার্ভের বৈশিষ্ট্যের আকাশের সর্ব প্রান্তেই এক এবং (খ) উষ্ণ ও শীতল অঞ্চলগুলির সংখ্যাও গড়ে সব প্রান্ততেই সমান। এই বৈশিষ্ট্যগুলির পূর্বাভাস স্ফীতি তত্ত্বের সবচেয়ে সহজ সংস্করণগুলিও সফলভাবে প্রদর্শন করেছে। WMAP এর কোয়ান্টাম ফ্লাক্টুএসানের সূক্ষ্ম পরিমাপ কসমিক মাইক্রোওয়েভের উপরক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির নিশ্চিতভাবে সমর্থন করেছে।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার প্ল্যাঙ্ক কৃত্রিম উপগ্রহটি কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের আরও বিস্তারিত অনুশীলনের (চিত্র ৬) কাজে নির্মিত হয়েছিল। ২০০৯ সালের মে মাসে উপগ্রহটি কক্ষ পথে স্থাপন করার পর প্লাংক মহাবিশ্বের জন্ম এবং এর ধারাভাবিক বিবর্তনের গাণিতিক মডেলগুলির পরিমার্জনের কাজে সক্রিয় হয়েছে। মহাবিশ্বের বয়স আরো সঠিকভাবে পরিমাপ করা ছাড়াও প্লাংক থেকে পাত্তয়া কিছু অপ্রত্যাশিত ফলাফল জ্যোতিঃপদার্থবিদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে (নীচে দেখুন)।
চিত্র ৬: প্লাংক থেকে পাওয়া কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের মানচিত্রে তাপমাত্রার সূক্ষ্ম তারতম্যগুলিই
হল আজকের নক্ষত্র এবং ছায়াপথগুলির আবির্ভাবের মূল কারণ। এই বিস্ময়কর তথ্যটি ঠাহর করা অনেকটাই সহজ হয়ে পড়ে এক্সোপ্লানেট (Exoplanet) নামের একটি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি টুলের সাহায্য নিলে। এক্সোপ্লানেট টুলটির মধ্যে "গালাক্সি ক্লাস্টার অ্যান্ড সি.ম.বি"বলে যে প্যাকেজটি আছে, সেটি আইপ্যাডে (iPad) চালু করলে আমাদের সূর্যের নিকটবর্তী কয়েক হাজার নক্ষত্র এবং ছায়াপথের ছবি আইপ্যাডের স্ক্রীনে ভেসে উঠে। আঙ্গুল দিয়ে জুম আউট (zoom out) করলে অন্যান্য ছায়াপথের সমুদ্রে আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথটি ক্রমশ প্রকাশিত হয়। কিন্তু যদি বার বার জুম ইন (zoom in) করেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের অন্তিম প্রান্তটিতে পৌঁছে যাবেন, যেন বর্তমানকে পেছনে রেখে অতীত পানে ভ্রমণ করছেন আপনি। অবশেষে প্লাংকের দেখা মহাবিশ্বের কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের ছবিটি আপনার সামনে উন্মোচিত হবে। যেন মহাবিশ্বের জন্ম মুহূর্তর কাছাকাছি কোন একটি সময় পৌঁছে গিয়েছেন, কারণ কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডই মহাবিশ্বের আদিতে আলোকের প্রথম প্রকাশ। এক্সোপ্লানেট টুলটিতে প্রদর্শিত প্রত্যেকটি তারকা এবং ছায়াপথের অবস্থান এবং এদের মধ্যকার দূরত্ব ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের পরিকল্পিত হিপার্কস (Hipparcos) নামের উপগ্রহটি পরিমাপ করেছে। মহাজাগতিক বস্তুগুলির অবস্থান সঠিক ভাবে পরিমাপ করার জন্যই হিপার্কস উপগ্রহটিকে কক্ষপথে পাঠান হয়েছিল (তথ্য নাসা GSFC থেকে পাওয়া)। এক্সোপ্লানেট টুলের উপরে বর্ণিত ব্যবহার স্বয়ংক্রিয় ভাবে চালু করা যায় এক্সোপ্লানেট ভিডিও ক্লিপটির (এক্সোপ্লানেট অ্যাপ্লিকেশন সংস্করণ 5.4 - গালাক্সি ক্লাস্টার অ্যান্ড সি.ম.বি) সাহায্যে। এক্ষেত্রে পাঠকে সক্রিয় ভাবে জুম-ইন কিম্বা জুম-অউট করার দরকার নেই। ক্লিপটির অ্যানিমেশন শুরু আমাদের সূর্যকে দিয়ে। তারপর স্বয়ংক্রিয় ভাবে স্ক্রীনের ছবিটি কয়েকবার সঙ্কুচিত হবার পর কসমিক মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের মানচিত্রটি শেষ পর্যন্ত স্ক্রীনের উপর ভেসে উঠবে। এর পর অ্যানিমেশন দিক পাল্টে কালের যাত্রার অভিমুখ হয়ে যাবে সমুখের দিকে (কসমিক মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের আবির্ভাব থেকে শুরু করে সময়ের সীমারেখা ধরে এগিয়ে চলেছেন যেন)। অবশেষে পৌঁছবেন আমাদের সৌরজগতে কাছাকাছি কোন একটি স্থানে। লক্ষণীয় যে, অগণিত তারাকারাশির মধ্যে একটি অতি সাধারণ মানের তারকা আমাদের সূর্য, যার অবস্থান অগণিত ছায়াপথদের মধ্যে একটি আটপৌরে, সর্পিল ছায়াপথয়ের গায়ে, যার নাম আকাশগঙ্গা অথবা মিল্কিওয়ে । মহাবিশ্বের কটি ছায়াপথ আছে? গ্রহণযোগ্য সংখ্যাটি হল ১০০ এবং ২০০ বিলিয়নের মধ্যে। এই সংখ্যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নির্ধারণ করেছেন মহাকাশের একটি বিশেষ অঞ্চলে সবকটি ছায়াপথের সংখ্যা গণনা করে। তারপর মোট সংখ্যাটিকে অনুমান করেছেন মহাকাশের অন্যান্য অঞ্চলগুলির থেকে অবদান যোগ করে।
বলা বাহুল্য, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সর্বপেক্ষা উৎকৃষ্ট পূর্ণ-আকাশ মানচিত্র প্লাংকের সৌজন্যে প্রাপ্ত। চিত্র ৬-এ দেখানো তাপমাত্রার সূক্ষ্ম ব্যবধানের জন্য মহাবিশ্বের ফ্যাব্রিকে কোয়ান্টাম ফ্লাক্টুএসানের আবির্ভাব হয়েছিল। তখন মহাবিশ্বের বয়স এক সেকন্ডের একটি অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। এই ফ্লাক্টুএসানগুলি আয়তনে বড় হয়ে কালক্রমে তারকামন্ডল ও ছায়াপথে পরিণত হয়েছে।
নীচের টেবিলে (টেবিল ২) WMAP এবং প্লাংকের পরিমাপ করা মহাজাগতিক পরামিতিগুলিকে তুলনামূলক ভাবে দেখানো হোল।
টেবিল ২: মহাজাগতিক পরামিতি |
পরামিতি |
WMAP |
প্লাংক |
সাধারণ পদার্থ |
৪.৬% |
৪.৯% |
ডার্ক ম্যাটার |
২৪ |
২৬.৮ |
ডার্ক এনার্জি |
৭১.৪ |
<="" td="" style="text-align: center;">
মহাবিশ্বের বয়স |
১৩.৭৭ বিলিয়ন বছর |
১৩.৮২ বিলিয়ন বছর |
হাবল্ ধ্রুবক, H_0 |
৬৯.৩২ km/sec/Mpc |
৬৭.১৫ km/sec/Mpc |
ক্রিটিক্যাল ঘনত্ব, Ω_0 |
১.০২ ± ০.০২ |
১.০২ ± ০.০২ |
১ Mpc = ৩,২৬০,০০০ মিলিয়ন আলোক বর্ষ |
যদিও WMAP এর সময় প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, প্লাংক উপগ্রহটিও কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সম্বন্ধে কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য অভূতপূর্ব স্পষ্টটার সঙ্গে উন্মোচন করল:
- প্লাংকের ডাটাতে মাইক্রোওয়েভের পটভূমির মধ্যে একটি বৃহদায়তন শীতল অঞ্চলের উপস্থিতি প্রথম দেখা গেল (চিত্র ৭)। এই পর্যবেক্ষণটি বিশেষভাবে বিস্ময়কর কারণ বিজ্ঞানীরা এযাবৎ মহাবিশ্বকে সত্যিই isotropic এবং সমসত্ত্ব বলে জানতেন।
- মাইক্রোওয়েভের পটভূমিতে এক অস্বাভাবিক অপ্রতিসাম্যর (anisotropies) উপস্থিতি প্রথম লক্ষ করলেন বিজ্ঞানীরা। এই অপ্রতিসাম্যের প্রশস্ততা মহাকাশের একটি দিকে বেশী প্রকট অন্যান্য দিকের তুলনায়। মহাকাশের যে একটি আকাঙ্ক্ষিত দিকে আছে তার যেন একটা পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া গেলো। আরও অস্বাভাবিক এই যে আকাঙ্ক্ষিত দিকটি যেন সৌর অয়নবৃত্তের ৯ সমান্তরাল। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে আমাদের সৌর জগতের সম্পর্ক কি বা কেন হতে পারে তা এখন বিজ্ঞানীদের কাছে একেবারেই স্পষ্ট নয়।
চিত্র ৭: প্লাংক কিত্রিম উপগ্রহটি কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম সনাক্ত করেছে। চিত্রে দেখান বৃহৎ শীতল অঞ্চলটির (বৃত্তাকার) আবির্ভাবের কোন ব্যাখ্যা এপর্যন্ত পাওয়া যায় নি। আর ব্যাখ্যা মেলে নি অয়নবৃত্তের উত্তরের তুলনায় দক্ষিণের তাপমাত্রার তারতম্য অসামঞ্জস্যতা (সাদা রেখা দ্বারা চিহ্নিত)। চিত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ESA এবং প্লাংক গোষ্ঠী।
|
সারাংশে বলা যায় COBE, WMAP, এবং প্লাংক থেকে সঙ্কলিত তথ্য বিগ ব্যাং তত্বর অন্তরাত্মা, স্ফীতি তত্ত্বকে আকর্ষণীয় ভাবে সমর্থন করে। সমস্ত সঙ্কলিত তথ্য পরবর্তী উপগ্রহ মিশনগুলি দ্বারা উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিমার্জিত এবং পরিশ্রুত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক পরামিতিগুলির এযাবৎ সবচেয়ে বিশুধ্য মান এই মিশনগুলিই সরবরাহ করেছে, যেমন মহাবিশ্বের বয়স, স্থান-কালের বক্রতা এবং কখন প্রথম পরমাণু, নক্ষত্রপুঞ্জের আবির্ভাব হল, ইত্যাদি। তাছাড়া পদার্থের মৌলিক উপাদানগুলি—ডার্ক ম্যাটার, সাধারণ পদার্থ, ডার্ক এনার্জি প্রভৃতি—সম্বন্ধে বহু জরুরি তথ্য আমাদের সামনে প্রথম হাজির করেছে এই মিশনগুলিই। এদের অঙ্কিত মাইক্রোওয়েভের পটভূমির ক্ষুদ্র তাপমাত্রার ওঠানামাগুলি আসলে জন্মের ৩৮০,০০০ বছর পর মহাবিশ্বর বিভিন্ন ঘনত্বের অঞ্চলগুলির চিহ্ন। এই অঞ্চলগুলি মহাবিশ্বর সব ভবিষ্যৎ কাঠামোর—যেমন আজকের ছায়াপথগুলির—বীজ। মাইক্রোওয়েভের পটভূমির মানচিত্র থেকে নিষ্কাশিত তথ্য সৃষ্টিতত্ত্বের সাধারণ মডেলের (standard model of cosmology) বৈধতাকে সামগ্রিকভাবে সমর্থন করে। প্লাংকের ডাটা স্ফীতি তত্ত্বের বিভিন্ন মডেলের মধ্যে প্রভেদ বুঝতে এবং কসমিক মাইক্রোওয়েভ বর্ণালী মধ্যে বৈসাদৃশ্য বা অসঙ্গতিগুলি অনাবৃত করতে সাহায্য করেছে। মনে করা হয় যে উপরোক্ত বৈসাদৃশ্যর প্রথম আবির্ভাব মহাবিশ্বের শৈশব কালে। বলা বাহুল্য, এই ফলাফলগুলির প্রভাব সুদূরপ্রসারিত এবং ভবিষ্যতে পর্যবেক্ষণ দিয়ে সমর্থিত হলে, এরা নির্দিষ্ট শ্রেণীর স্ফীতি মডেলের পরিশোধনের কাজে বিশেষ ভাবে উপযোগী হবে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন স্ফীতি পর্বের সময়, কোয়ান্টাম fluctuation এর কারণে সমবর্তিত (polarized) কসমিক মাইক্রোওয়েভ উপাংশটির মধ্যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রেখাগুলি অঙ্কিত হয়েছিল।
চিত্র ৮: 1975 সাল থেকে পরিমাপ করা বাইনারি পালসার PSR1913 + 16এর কক্ষীয় পর্যায়কাল। চিত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার: স্টিফেন হওকিংগের বই The universe in a nutshell.
|
আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের পূর্বাভাস মেলে। বস্তুর উপস্থিতি স্থান-কালের ফাব্রিকের মধ্যে বক্রতার সৃষ্টি করে এবং এই বক্রতাই বস্তুর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। স্থান-কালের বক্রতার প্রভাবের অন্য নাম মাধ্যাকর্ষণ। সচল মহাজাগতিক বস্তু হতে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নির্গত হয়। বস্তু থেকে নিঃস্বরিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গও আলোর তরঙ্গের মতো বস্তুর শক্তি ক্ষয়ের কারণ। তবে, শক্তি ক্ষয়ের হার যারপরনাই অল্প বোলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের এ পর্যন্ত যা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে তা শক্তি এবং কৌণিক ভরবেগ পরিমাপ মারফত। ১৯৭৪ সালে রাসেল এ Hulse এবং জোসেফ এইচ টেলর একটি বাইনারি পালসার PSR1913+16 পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। বাইনারি পালসারটি আসলে দুই কম্প্যাক্ট নিউট্রন তারার সমষ্টি যাদের মধ্যে সর্বোচ্চ দূরত্ব এক সৌর ব্যাসার্ধের সমান। ভাবা হয়েছিলো, নক্ষত্র দুটি একে অপরের চারিদিকে দ্রুত গতিতে পরিক্রমণ করে বলে সমষ্টিটির কক্ষীয় পর্যায়কাল দ্রুত গতিতে হ্রাস পাবে যেহেতু সমষ্টিটি থেকে ক্রমাগত ভাবে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিঃস্বরিত হয়ে শক্তির ক্ষরণ ঘটাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করলেন যে বাইনারি পালসারটির কক্ষীয় পর্যায়কালের পরিবর্তন সত্যিই হচ্ছে, এবং এই পরিবর্তনের হার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে মিলে যাচ্ছে। শক্তি এবং কৌণিক ভরবেগের ক্ষরণ সম্ভব যেহেতু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিঃসরণ (চিত্র 8 5) হচ্ছে বলে । Hulse এবং টেলর এই অনন্যসাধারণ গবেষণার জন্য ১৯৯৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
অচিরেই বোঝা গেল, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবির্ভাব হয়েছিল খুব সম্ভবত মহাজাগতিক স্ফীতির পর্বের সময় যখন মহাবিশ্ব অত্যন্ত দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হয়েছিল। আর সমবর্তিত (polarized) কসমিক মাইক্রোওয়েভ উপাংশটির মধ্যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রেখাগুলি যদি বাস্তবিকই অঙ্কিত হয়ে থাকে, তার পরীক্ষামূটা প্রমাণ যদি বৈজ্ঞানিকরা সত্যসত্যি উদ্ঘাতন করতে পারেন, তাহলে স্ফীতি তত্ত্ব অস্বীকার করা কঠিন হবে। সেই পরীক্ষার ফলাফলই হবে স্ফীতি তত্ত্ব এবং বিগ ব্যাং তত্ত্বের সব চেয়ে বড় সমর্থক।
(চলবে)
৯ সৌর অয়নবৃত্ত হল জ্যোতিষ্কমণ্ডলে সূর্যের আপাত কক্ষপথ যা উপবৃত্তাকার স্থানাঙ্ক সিস্টেমের মূল। অয়নবৃত্ত বলতে এই কক্ষপথের সমতলটিকেও বোঝায় যা সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথ ও পৃথিবীর চারপাশে সূর্যের আপাত কক্ষপথের উভয় সঙ্গে একতলীয়। সূর্যের কক্ষপথ পৃথিবীর থেকে সাধারণত লক্ষণীয় নয় কারণ পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে পর্যবেক্ষকও সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের চক্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় অন্যান্য নক্ষত্রদের পটভূমিতে সূর্যের এই আপাত গতিকে লক্ষ করে না।
লেখক পরিচিতি: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচ ডি করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোস্ট ডক্টরেট করেন। বর্তমানে আই.বি.এম-এ কর্মরত।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।