বিজ্ঞান
অক্টোবর ৩০, ২০১৫
কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি (সূচী)
কৌশিক সেনগুপ্ত
কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের সনাক্তকরণ
আমরা অবশেষে এই ধারাবাহিক নিবন্ধের শেষ অংশে এসে পৌঁছিয়েছি। এখন, ১৯১৪ সালের শুরুর দিকে একদল মার্কিনী বিজ্ঞানী কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির মধ্যে আঁকা সমবর্তনের সংকেত চর্চা করে কিভাবে মহাবিশ্বর স্ফীতি পর্যায়ের প্রমাণ দাখিল করেছিলেন, সেই কথাই আলোচনা করব।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী স্ফীতি বা ইনফ্লেসন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপাদনের কারণ। ছড়িয়ে পড়ার পথে এই তরঙ্গগুলি স্পেইসকে নিষ্পেষণ করে মাইক্রোওয়েভের পটভূমির উপর একটা ইম্প্রিন্ট বা ছাপ সৃষ্টি করেছিল। ব্যাপারটা একটি উপমা দিয়ে বুঝতে সুবিধা হয়। মনে করুন সমুদ্রতীরে দাড়িয়ে আপনি ঢেউগুলির পাড়ে ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্যটি উপভোগ করছেন। জল সরে গেলে যেমন বালির উপর তরঙ্গের ছাপ চোখে পড়ে, তেমনি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মাইক্রোওয়েভের পটভূমির উপর একটা ছাপ সৃষ্টি করেছিল যার বহিঃপ্রকাশ বিগ ব্যাং-এর অস্তরাগের মধ্যে। এই অস্তরাগের আভাস যে এখনো মহাকাশের সবত্র ছড়িয়ে আছে তা ১৯৬০ সালে পেনজিয়াস এবং উইলসনের গবেষণায় প্রথম ধরা পরেছিল। পরে আরো নিশ্চিত ভাবে দেখা গেল কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে সঙ্কলিত তথ্যের মধ্যে।
চিত্র ৯: গোষ্ঠী প্রায় ২৫০টি বুড়ো আঙুলের নখের আকারের পোলারাইজেশন ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন আকাশের ছোট একটি অংশে কসমিক মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের পার্থক্য ধরার জন্যো। তাঁদের দূরবীক্ষণ যন্ত্রটিকে এর জন্য দুটি লম্ব অবস্থানে স্থাপন করতে হয়েছিল। তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল আমুন্ডসেন-স্কট সাউথ পোল স্টেশনে, জানুয়ারী ২০১০ থেকে ডিসেম্বর ২০১২-র মধ্যে যখন দক্ষিণ মেরুর শীতল, শুষ্ক বায়ু, নিরীক্ষণ কাজে বিশেষ সহায়ক।
কয়েক বছর আগে ব্যাকগ্রাউন্ড ইমেজিং কসমিক এক্সট্রাগ্যালাকটিক পোলরাইজেশন (BICEP2) দলটির গবেষকরা মাইক্রোওয়েভ পটভূমির মধ্যে আদিম (primordial) B-মোড পোলারাইজেশন নামে একটি বিশেষ ছাঁচ বা প্যাটার্ন লক্ষ করেন (চিত্র ৯)। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই ছাঁচই হবে মহাজাগতিক স্ফীতি তত্ত্বের প্রথম সরাসরি এবং অভেদ্য প্রমাণ। মনে রাখতে হবে যে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড আলোরই একটা রূপ যার মধ্যে পোলারাইজেশন সহ আলোর অন্য সব রকম বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। সূর্যের আলো যেমন বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করার সময় বিক্ষিপ্ত হয়ে সমবর্তিত আলোতে পরিণত হয়, তেমনই মাইক্রোওয়েভ পটভূমিও আদিম মহাবিশ্বের পরমাণু এবং ইলেকট্রন দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়ে সমবর্তিত আলোর ছাঁচটা তৈরি করেছিল। B-মোড একটি বিশেষ ধরনের পোলারাইজেশন যার প্রকাশ এই প্রাচীন কালের আলোর সমবর্তিত সঙ্কেতের মধ্যে মোচড় অথবা কুঞ্চনের প্যাটার্নের মধ্য দিয়ে। স্ফীতি পর্যায় চলার সময় এই প্যাটার্নটা একমাত্র মহাকর্ষীয় তরঙ্গই তৈরি করতে পারে বলে ১০ মনে করা হয়।
দক্ষিণ মেরুর শুষ্ক, হিমশীতল পরিবেশে BICEP2 দূরবীনটি বসান হয়েছিল এই অত্যন্ত ক্ষীণ মহাজাগতিক আলোকে সঠিক ভাবে সনাক্তকরণের করবার কাজে। প্রাথমিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিস্মিত হলেন গবেষকরা। B-মোড পোলারাইজেশনের সংকেত যা হবে আশা করেছিলেন, তার থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। একটি সত্যিকারের আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজনীয় "৫ সিগমা" পরিসংখ্যানের তাৎপর্য সংকেতটি অবশ্যই প্রদর্শন করে। গবেষকরা দীর্ঘ তিন বছর ধরে তাদের বিশ্লেষণ বহাল রাখলেন যাতে সকল প্রকারের সম্ভাব্য ভুলত্রুটিগুলি ফলাফল থেকে সম্পূর্ণ ভাবে অপসারিত হয়। এমন কি আমাদের ছায়াপথের ধুলোর অবদান ফলাফল থেকে যাতে সম্পূর্ণ ভাবে বাদ দেওয়ার যায়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলিও তাঁরা নিয়েছিলেন।
BICEP2-র গবেষকরা r পরামিতিটি পরিমাপ করেন নিচের সমীকরণটির সাহায্যে।
r=(কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের তারতম্য বা fluctuations) / (পদার্থর ঘনত্বের perturbations এর জন্য তারতম্য বা fluctuations)
দেখা গেলো, r এর মান আশ্চর্যজনক ভাবে একটি বড় সংখ্যা। WMAP এবং প্লাংক উপগ্রহগুলির থেকে পাওয়া মাইক্রোওয়েভ পটভূমির পূর্ণ-আকাশ মানচিত্র ব্যবহার করে r এর মান ০.১১ হতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল। বাস্তবে r এর মান পাওয়া গেল ০.২০—r এর মান এত বেশী হওয়া মানে মহাবিশ্বের কিছু কিছু মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী ব্রহ্মাণ্ডে স্ফীতি পর্ব যে সময় শুরু হয়েছিল, বাস্তবে তা তারও আগে ঘটেছিল। হয়ত বিগ ব্যাঙ্গের ১০-৩৬ সেকন্ড পরই।
স্ফীতির পর্ব ঠিক কখন শুরু হয়েছিল তা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কারণ, সেই সময় মহাবিশ্বের শক্তির পরিমাণ যে কি ছিল, তার একটি আন্দাজ পাওয়া যায়। r এর মান থেকে সিদ্ধান্তে পৌছনো গেল যে শুরুতে মহাবিশ্বের শক্তি পরিমাণ এমনই সাংঘাতিক ছিল যে, মাধ্যাকর্ষণ ছাড়া প্রকৃতির সব বলই (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক, স্ট্রং, এবং উইক) যেন একটি একক বলে একীভূত বা ইউনিফাইড। শেষোক্ত চিন্তাটির প্রথম প্রবর্তন গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি (GUT) নামক তত্ত্বে। BICEP2-র ফলাফল যেন এই একীকরণের ধারণাকে আরও জোরদার করল।
অবশেষে, বিজ্ঞানীরা যেন সবকিছুর শুরুতে কি ঘটেছিল তার একটা ধারণা পেলেন। কিন্তু সত্যিই কি তা পেলেন?
বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ কিন্তু মোটেই কুসুমাকীর্ণ নয়। মহান আবিষ্কারগুলিকেও প্রথম প্রথম সন্দেহের চোখে দেখা হয় এবং এদের সৃজন মুহূর্তগুলি প্রশ্নের নাগপাশে আবদ্ধ থাকে। প্রাথমিক অবিশ্বাসই পিয়ার রিভিউ (peer review) প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। গবেষণার ফলাফল যাচাইযোগ্য হওয়া চাই। অনেক সময় এক দল গবেষকের ফলাফল অন্য দল গবেষকরা পরীক্ষামূলক ভাবে পুনরুত্পাদন করতে পারেন না। যাচাই করা না গেলে মূল ফলাফলটি বিশ্বাসযোগ্য হয় না এবং শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে।
সম্প্রতি BICEP2 ফলাফলের বৈধতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সীর প্লাংক কৃত্রিম উপগ্রহের বিজ্ঞানীরা। অবশ্য সরাসরি বৈজ্ঞানিক ত্রুটির অভিযোগের কেউ করেন নি। সন্দেহ নেই যে BICEP2-র দূরবীনটি দক্ষিণ মেরুর আকাশে উল্লেখযোগ্য একটি সংকেত সনাক্ত করতে পেরেছে। কারণ বিজ্ঞানীরা তাঁদের যন্ত্রের সম্ভাব্য পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলি সতর্কতার সাথে পরিহার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সংকেতটির উৎস যে কি তা নিয়ে দ্বিমতের অভাব নেই। BICEP2 বিজ্ঞানীরা যে সত্যিই মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ থেকে উৎপন্ন্ন প্রাচীন মাইক্রোওয়েভের বিকিরণের পোলারাইজেশন বা সমবর্তনের সংকেত পরীক্ষামূলক ভাবে সনাক্ত করতে পেরেছেন তা এখন ঘোর তর্কের বিষয়। এমনও হতে পারে যে BICEP2-র সংকেতটি ছায়াপথের মধ্যকার ধূলিকণার পুরোভূমি দ্বারা দূষিত।
মজার কথা হল BICEP2 গোষ্ঠী কিন্তু পুরোভূমি পোলারাইজেশনের প্রভাব সাধ্য মতোই বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু কি প্রক্রিয়াতে করেছিলেন সেটাই বিতর্কের বিষয়। যেহেতু প্লাংকের ডাটা সেই সময় প্রকাশিত হয়নি, BICEP2 গবেষকরা প্লাংকের ফলাফলের একটি পিডিএফ (pdf) স্লাইড থেকে বিপরীত-ইঞ্জিনিয়ারিং (reverse engineering) প্রথা মারফত প্রয়োজনীয় তথ্যটি সংগ্রহ করেছিলেন। এই প্রক্রিয়াটিকে ইংরাজিতে “data scraping” বলে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে data scraping বা “তথ্য চাঁচুনি” তথ্য বিশ্লেষণের আদর্শ উপায় নয়, কিন্তু বিজ্ঞানীরা অনেকসময় পদ্ধতিটিকে অল্প-সল্প ব্যবহার করে থাকেন। BICEP2 গবেষকরা অন্যান্য গতানুগতিক দূষণের প্রভাবের সঙ্গে প্লাংকের থেকে পাওয়া পুরোভূমির প্রভাবটিকেও হিসাবের মধ্যে এনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ধূলিকণার দূষণের মাত্রা ওঁরা প্রথমে যা অনুমান করেছিলেন, দেখা গেল তা মোটেই নয়। মাত্রাটা অনেকই বেশী। ২০১৫ সালে BICEP2 এবং প্লাংকের গবেষকদের একটি যৌথ প্রকাশনে সেই কথটিই উদ্ঘাটিত হল।
তার মানে কি স্ফীতি তত্ত্ব ভুল? তা একেবারেই নয়। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সঙ্কেত হয়তো সত্যিই লুকনো আছে পর্যবেক্ষণের তথ্যের মধ্যে, কিন্তু সেই সঙ্কেত এখনো ধরা যায় নি কারণ পর্যবেক্ষণের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল বলে। সুতরাং ব্যাপারটার শেষ এখানেই নয়। ইতিমধ্যে অন্যান্য গবেষকদের দলও বিভিন্ন প্রযুক্তি ও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে B-মোড সংকেতটির পশ্চাদ্ধাবন করা শুরু করেছেন। মজার ব্যাপার হল BICEP2 গোষ্ঠীই হয়তো শেষ পর্যন্ত এই ধাঁধাটির সমাধানে সক্ষম হবেন। কারণ এদের কাছে রয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি আর উন্নত প্রযুক্তির জোর। তার উপর দলে আছেন শীর্ষস্থানীয় গবেষকবৃন্দ। পূর্ব অভিজ্ঞতা এদের সমৃদ্ধই করবে।
মহাবিশ্বের পরিণতি
চিত্র ১০: ১৪ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম মুহূর্ত থেকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার। সম্প্রসারণের হার দ্রুততর যখন বক্ররেখার বক্রতা গভীরতর। প্রায় ৭ বিলিয়ন বছর আগে বক্রতার পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবে বাড়তে শুরু করল যখন মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু একে অপরের থেকে দ্রুত গতিতে ছিটকে দূরে সরে যেতে শুরু করল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে দ্রুত সম্প্রসারণের হারের কারণ এক রহস্যময় বল যার টানে ছায়াপথগুলি দূরে চলে যাচ্ছে। চিত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার: NASA/STSci/Ann Fiel
|
বিখ্যাত গণিতজ্ঞ এবং সৃষ্টিতত্ত্ববিদ, রজার পেনরোজ, তাঁর লেখাতে বর্ণনা করেছেন কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের আবিষ্কার সৃষ্টিতত্ত্বকে কেমন করে কল্পনা ভিত্তিক বিষয় থেকে একটি প্রমাণযোগ্য বিজ্ঞানে পরিণত করেছিল। ভাবতে অবাক লাগে যে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি মহাকাশের গভীরতম প্রান্তে অবস্থিত নক্ষত্র এবং ছায়াপথ থেকে বিচ্ছুরিত ক্ষীণতম আলোও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। এই সব নক্ষত্রপুঞ্জ এবং ছায়াপথগুলিই সবচেয়ে পুরাতন—বিগ ব্যাং-এর মাত্র কয়েক হাজার বছর পরই এদের আবির্ভাব হয়েছিল। দক্ষিণ মেরুতে রাখা BICEP2-র দূরবীক্ষণ যন্ত্রটিও অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন—যদিও BICEP2-র ফলাফল বর্তমানে বিতর্কিত এবং গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান তাৎপর্য তৈরি হতে এখনও বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। কিন্তু BICEP2-র ফলাফল যদি শেষপর্যন্ত সত্যি বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে মহাবিশ্বের সূচনাতে স্ফীতির ভূমিকা হবে অনস্বীকার্য। এই সময় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার ছিল অকল্পনীয়—গাণিতিকভাবে প্রকাশ করলে, এই হারের মাত্রা এক্সপোনেন্সিয়াল (exponential)। সেই সময় বহু বার মহাবিশ্বের আয়তন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছিল। স্ফীতিই হল মহাবিশ্বের আকার নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া। এবং বর্তমান মহাবিশ্বের যে বৈশিষ্ট্য¬—প্রতি দিকেই মহাবিশ্বের অবয়ব এক—এর কারণ সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্বের এক কোণা থেকে আর এক কোণায় আলোর পৌঁছোবার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল না বলে।
১৪ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং-এর ফলে মহাবিশ্বর সম্প্রসারণের নজির প্রদর্শন করেছিলেন এডুইন হাবল। সল পারল্মাটার, ব্রায়ান শ্মিট, অ্যাডাম রিস্ এবং ওঁদের গবেষণার দলগুলি ৫০টি দূরবর্তী সুপারনোভা, যাদের আলো প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে দুর্বল, নিরীক্ষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার নিঃসন্দেহ ভাবে ত্বরান্বিত হচ্ছে। এটি একটি অভূতপূর্ব ফলাফল। তাছাড়া, সম্প্রসারণের হার এখন তুলনামূলক ভাবে ৭ বিলিয়ন বছর আগে যা ছিল তার তুলনায় বেশী (চিত্র ১০ দেখুন। সম্প্রসারণের বক্রতার পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবে প্রায় ৭ বিলিয়ন বছর আগে বেড়ে গিয়েছিল)। এই ত্বরণ ডার্ক এনার্জির প্রভাবে বেড়েছিল বলেই মনে করা হয়, কিন্তু ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে এখনও বিশেষ কিছু জানা যায় নি।
বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন যে বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের ঠিক পরেই মহাবিশ্ব অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত হয়েছিল। তখন মহাবিশ্বর আকারে ছিল আজকের তুলনায় অনেকই ছোট এবং অত্যন্ত জমাটবদ্ধ। সমস্ত পদার্থই খুব ছোট জায়গায় আবদ্ধ ছিল বলে মাধ্যাকর্ষণের টানে মহাবিশ্বের বিস্তারের গতি কমতে শুরু করে। রহস্যময় ডার্ক এনার্জির প্রভাব তখন অনেকটাই ক্ষীণ কারণ নবীন মহাবিশ্বে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব ছিল অনেক বেশী শক্তিশালী। ডার্ক এনার্জির অবস্থা তখন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতার লাইন দিয়ে বর্ণনা করা যায় “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”। কিন্তু ডার্ক এনার্জির ক্ষমতা ক্রমশ জাহির হয়ে পড়ল যখন সম্প্রসারণের ফলে সমস্ত বস্তুর মধ্যে দূরত্ব বেড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে দুর্বল করার পর। ক্রমে ডার্ক এনার্জির প্রভাব এমনই প্রবল হল যে একসময় মহাবিশ্ব ত্বরিত হারে বিস্তারিত হতে শুরু করল। ডার্ক এনার্জি আজ পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে রহস্যময় বিষয়গুলির অন্যতম। কারণ এই শক্তিই সম্ভবত মহাবিশ্বের প্রায় তিন চতুর্থাংশ পদার্থের অস্তিত্বের জন্য দায়ী।
WMAP এবং প্লাংক কৃত্রিম উপগ্রহগুলি মহাজাগতিক পরামিতি Ω0 টির পরিমাপ করে দেখিয়েছে যে এর মান ১.০২±০.০২। তার মানে, মহাবিশ্বের জ্যামিতি সমতল। সুতরাং মহাবিশ্ব হয়তো চিরকালই সম্প্রসারিত হবে।
এখন থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর পর মহাবিশ্বের পরিণতি কি হবে সেই সম্পর্কে কিছু বলা যায় কি?
আজ থেকে ১০০ বিলিয়ন বছর পর মহাকাশে ছায়াপথগুলির অবস্থান কি হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী লরেন্স ক্রাউস (Krauss) এবং রবার্ট জে স্বেইরর (Scherrer) সম্প্রতি করা চেষ্টা করেছেন। যেহেতু শক্তিশালী ডার্ক এনার্জি ছায়াপথগুলিকে পরস্পর থেকে কার্যক্রমে দ্রুততর হারে দূরে সরানোর কাজে রপ্ত, মহাবিশ্বের আকার, ১০০ বিলিয়ন বছর পরে, নিঃসন্দেহে এখনকার থেকে বহুগুণ বড় হবে। ক্রাউস ও স্বেইরর মনে করেন অধিকাংশ ছায়াপথগুলি সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য হয়ে পড়বে যখন ওদের গতিবেগ বেড়ে আলোর গতির নিকটবর্তী হবে, ঠিক যেমন করে মহাজাগতিক বস্তু বা পদার্থ ইভেন্ট-দিগন্ত (event horizon) উত্তরণের পরে ব্ল্যাক হোলের অন্ধকূপে নিক্ষেপিত হয়। ছায়াপথ থেকে নিঃসৃত আলোর রেডশিফট হবে ব্যাপক। ছায়াপথগুলির প্রচণ্ড গতির জন্য আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে প্রায় সীমাহীন এবং দীপ্তি হবে ক্ষীণ। সবচেয়ে দূরবর্তী ছায়াপথগুলিই প্রথমে অদৃশ্য হবে কেবল স্থানীয় গ্রুপের (Local group) ছায়াপথগুলি মহাকর্ষের প্রভাবে একসঙ্গে আবদ্ধ থেকে রাতের আকাশকে আলোকিত করবে।
১৯৮৭ সালে জর্জ এলিস এবং টনি রথম্যান দেখিয়েছিলেন মহাবিশ্বর সাধারণ বিস্তারও (স্ফীতির প্রভাব বিবেচনা না করে) অধিকাংশ দূরের ছায়াপথগুলিকে ক্রমে এমনই দূরে সরিয়ে দেবে যে ওদের সনাক্ত করা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতির একটা অভিনব নাম আছে—“মহাজাগতিক অজ্ঞতা”। ডার্ক এনার্জি শুধুমাত্র প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করে। মহাবিশ্বের এই দশাকে ইংরাজিতে বলে “asymptotically empty"।
অত্যন্ত দ্রুত গতিতে রেডশিফটের মাত্রা বাড়ার দরুন ভবিষ্যতের কসমিক মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ আমাদের নিজস্ব ছায়াপথের রেডিও noise এর প্রভাবে ঝাপসা হয়ে পড়বে। (মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের দীর্ঘতম তরঙ্গগুলির তরঙ্গদৈর্ঘ্য এই সময় মিটারে পরিমাপ করা যাবে—মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের বদলে এরা এখন বেতার তরঙ্গের রূপ নিয়েছে।) বিগ ব্যাং-এর সময় প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত ডিউটেরিয়াম (হাইড্রোজেনের ভারী আইসোটোপ) এখন সম্পূর্ণ ভাবে দৃষ্টি পথের অন্তরালে চলে গিয়েছে কারণ দূরবর্তী quasar গুলি দ্বারা ডিউটেরিয়াম আর পিছন দিক থেকে প্রজ্জ্বলিত থাকবে না। ডিউটেরিয়াম এবং quasars—উভয়ই ইভেন্ট-দিগন্ত অতিক্রম করে এখন চিরতরের জন্য হারিয়ে গিয়েছে।
মজার ব্যপার হল, মহাবিশ্বের বয়স যখন ৭ বিলিয়ন বছর, ডার্ক এনার্জি পরিমাপযোগ্য ছিল না (unobservable)। একটি সম্পূর্ণ অন্য কারণে এখন থেকে ১০০ বিলিয়ন বছর পর, ডার্ক এনার্জি আবার পরিমাপযোগ্য হবে না (unobservable)। প্রথম ক্ষেত্রে, মহাবিশ্বের কোন ত্বরক বিস্তার ছিল না, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, মহাবিশ্বের এতই বৃহদাকার হয়ে পড়ল যে আলো পর্যবেক্ষকের অবস্থানস্থলে পৌঁছানোর সময় পর্যন্ত পাবে না।
কল্পনা করা যাক ভবিষ্যতের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে এখন থেকে লক্ষ কোটি বছর পরে কি দেখতে পাবেন (একমাত্র সম্ভব যদি মানব জাতি ৫ বিলিয়ন বছর পরে এবং সূর্যের "মৃত্যুর” আগেই সৌরমণ্ডল থেকে প্রস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে)! স্থানীয় গ্রুপের ছায়াপথগুলি মিলে মিশে একটি বৃহৎ ছায়াপথে পরিণত হবে কারণ অন্যান্য ছায়াপথগুলি বহু কাল আগেই ইভেন্ট-দিগন্ত অতিক্রম করে মহাকালে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথের দিকে তাকিয়ে অনেক তারকা পুঞ্জ অবশ্যই দেখতে পাবেন কিন্তু আজকের আকাশের বৃহত্তম এবং সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলি তাদের পারমাণবিক জ্বালানী শেষ করে ততদিনে অন্তর্হিত হয়ে পড়েছে, শুধু ছোট তারাগুলিই রাতের আকাশ আলোকিত করে থাকবে।
আশা করা যায় ভবিষ্যতের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উন্নত জ্ঞানের অধিকারী হবেন কারণ ওঁদের যুগযুগান্ত ধরে সঞ্চিত জ্ঞানের ভাণ্ডার প্রায় অফুরন্ত, কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যদি সঠিক হয়, তাহলে ওঁরা মহাবিশ্বের কিনারায় ছায়াপথগুলি দেখবার কাজে টেলিস্কোপ নির্মাণ করতে সক্ষম হবেন না! হাবল এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, ১০০ বিলিয়ন বছর পর সম্পূর্ণ ভাবে irreproducible হয়ে যাবে। আর irreproducible হবে মহাবিশ্বর ত্বরান্বিত সম্প্রসারণের অদ্ভুত ঘটনা, কারণ পরিমাপের জন্য যে রেফারেন্স পয়েন্টগুলির প্রয়োজন ছিল, তা এখন চিরকালের জন্য হারিয়ে গিয়েছে।
The quickening expansion will eventually pull galaxies apart faster than light, causing them to drop out of view. This process eliminates reference points for measuring expansion and dilutes the distinctive products of the Big Bang to nothingness. In short, it erases all the signs that a Big Bang ever occurred.
To our distant descendants, the universe will look like a small puddle of stars in an endless, changeless void.
— The Editors, Scientific American
সন্দেহ নেই যে তথ্যের অবলুপ্তি হওয়া সুদূর ভবিষ্যতে অনিবার্য। এর কারণ মহাজাগতিক ত্বরণ। মহাবিশ্বের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ত্বরিত বিস্তারের হারের যদি কোন পরিবর্তনও হয়, তাহলেও তথ্যের অবলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। এর একমাত্র ব্যাতিক্রম হয় যদি কোনভাবে উচ্চতর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সহায়তায় ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বর সুদূর অতীত দর্শনের জন্য একটি উপায় বার করতে পারেন। আমরা এখন কেবল কল্পনাই করতে পারি ভবিষ্যতের সেই সভ্যতাটি অবশেষে কেমন করে ওই উচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হবে এবং অতীত দর্শনের সেই উপায়টিই বা কি!
১০ আলোর তরঙ্গের মত মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ডান কিম্বা বাম হাতি সমবর্তন হতে পারে। B-মোড প্যাটার্ন হল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অন্যতম স্বাক্ষর।
লেখক পরিচিতি: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচ ডি করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোস্ট ডক্টরেট করেন। বর্তমানে আই.বি.এম-এ কর্মরত।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।