বিজ্ঞান
জুলাই ৩০, ২০১৬
গণিতের উৎপত্তি
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
গণিতের শুরু কবে ও কোথায় হয়েছিল এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। অনেকের মতে গণিতের আদিভূমি মিশর। এনিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। এর কারণ ভারতবর্ষে, ব্যাবিলনে এবং চিনে প্রাচীনকালে যে উন্নতমানের গণিতচর্চা হত তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই অনেক পণ্ডিতের মতে ভারতবর্ষই গণিতশাস্ত্রের উৎপত্তিস্থল। এমন দাবী করার পিছনে যুক্তি কী?
ইতিহাসেরও একটা ইতিহাস থাকে। সেভাবে ইতিহাসের খোঁজ করলে পিছোতে পিছোতে হয়তো মানবসভ্যতার উষালগ্নে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। তবে বলা যতটা সহজ বাস্তবে তা নয়। বরং অত্যন্ত কঠিন কাজ। যত অতীতে যাওয়া যাবে তত প্রাচীন নিদর্শন এবং সাক্ষ্য প্রমাণ কমতে থাকবে। ফলে এক সময় থেমে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সেভাবে থেমে গেছে ভারতীয় সভ্যতার অতীত ইতিহাস। সিন্ধু সভ্যতার আগের ইতিহাস আমাদের অজানাই বলা চলে। তাই আমাদের শুরু করতে হবে সিন্ধু উপত্যকায় যে সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল সেখান থেকে। কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে জানা গেছে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল সাতটি স্তরে। প্রথমটির বয়স খ্রিস্টপূর্ব 3300-3200 অব্দের। এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব 2500-1700 অব্দের মধ্যে। ভারতীয় গণিতের উৎস সন্ধানে যাবার আগে সমকালীন অন্যান্য সভ্যতাগুলিতে গণিতচর্চা কেমন ছিল তা নিয়ে আলোচনা করে নেওয়া যাক।
মিশরে গণিতের উদ্ভব কবে হয়েছিল তার সঠিক সময় জানা সম্ভব নয়। প্রত্নতত্ত্বীয় গবেষণার উপর নির্ভর করে তাঁদের গাণিতিক জ্ঞান কেমন ছিল সে সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। 1877 খ্রিস্টাব্দে আইসেনলোর ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত ‘আহমেস্ প্যাপিরাস্’-এর মর্মোদ্ঘাটন করতে সমর্থ হন। তখনই জানা যায় যে এটি মিশরীয়দের একটি প্রাচীন গণিত গ্রন্থ। তবে এটি মূল গ্রন্থ নয়। আনুমানিক 1600 খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে হিকোসাস রাজত্বকালে ফারাও আ-আসার রে’র সময় আহ্মেস্ নামে জনৈক পুরোহিত পূর্বের কোনো গ্রন্থ বা প্যাপিরাস থেকে সঙ্কলন করেছেন। পণ্ডিতদের অনুমান মূল গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল 1849 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 1801 খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে। মিশরে তখন তৃতীয় আমেন এম হেটের রাজত্বকাল। তবে এই সময়কাল নিয়ে সব পণ্ডিত এক মত নন। বার্চ সাহেবের মতে এর রচনা কাল 3400 খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
ব্যাবিলনে কোনো কিছু লিখে রাখার জন্য মাটির চাকতি ব্যবহার করা হত। নরম অবস্থায় সরু শলাকার সাহায্যে লেখা হত। তারপর তা শুকিয়ে নিয়ে পোড়ানো হত যাতে সেগুলি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। এগুলিই ছিল ব্যাবিলনীয় গ্রন্থ। খননকার্য চালিয়ে অসুরবনিপালের (মৃত্যু 626 খ্রিস্টপূর্ব) গ্রন্থাগারে 22000 কিউনিফর্ম লিপির চাকতি পাওয়া গেছে। আর নিপ্পুর মন্দিরের গ্রন্থাগারে পাওয়া গেছে প্রায় 50,000 এই ধরনের চাকতি। বিশেষজ্ঞদের মতে এই চাকতিগুলি লেখা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব 3000 থেকে 450 অব্দের মধ্যে।* [* বিজ্ঞানের ইতিহাস (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড একত্রে); সমরেন্দ্রনাথ সেন, শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ, কলকাতা] এই চাকতিগুলির মধ্য থেকে গণিত সংক্রান্ত যে চাকতিগুলি পাওয়া গেছে তার অস্তিত্বকাল প্রায় 2000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 1200 খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এ থেকে অনুমান করা হয় প্রাচীন ব্যাবিলন এই 800 বছর গাণিতিক তৎপরতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।
চিনা গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস অতি প্রাচীন। রোশিও মিকামির মতে 2900 খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেদেশে গণিতচর্চার রেওয়াজ ছিল। তবে তা বিক্ষিপ্তভাবে। পদ্ধতিগতভাবে গণিতচর্চার ভাবনা চিনাদের মধ্যে শুরু হয়েছিল 2700 খ্রিস্টপূর্বাব্দে পীত সম্রাট হুয়ান তি’র আমলে।** [** প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা; প্রদীপ কুমার মজুমদার, গ্রন্থমেলা, কলকাতা]। তবে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে সময় লেগেছিল অনেকটা। 152 খ্রিস্টপূর্বে চাঙ্গ ৎসাঙ্গ নামে একজন চিনা গণিতবিদ ‘কিউ চাঙ্গ সুয়ান সু’ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। অনেকের মতে পদ্ধতিগতভাবে লেখা এটাই চিনাদের প্রথম গণিতের বই। এর আগে অবশ্য আরও একটি বই লেখার চেষ্টা হয়েছিল। বইটির নাম ‘আই কিং’। দ্বাদশ খ্রিস্টপূর্বে চিনা পণ্ডিত ওয়ান ওয়াঙ্গ-এর লেখা এই বইটি মূলত বিজ্ঞানের। এতে গণিতের কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাই একে পূর্ণাঙ্গ গণিতের বই বলা চলে না। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে প্রাচীনকালে ভারতীয়রা গণিতকে যে ভাবে দেখতেন চিনারা সেভাবে দেখতেন না। তাঁদের কাছে গণিত ছিল মূলত ব্যবহারিক ও বাস্তব সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার মাত্র। তাই তাঁদের কাছে গণিত ভারতীয়দের মতো সর্ববিদ্যার ঊর্ধ্বে ছিল না।
গ্রিক গণিতের ইতিহাস অত পুরোনো নয়। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর আগে গণিতের আঙিনায় গ্রিকদের তেমন দেখা যেত না। এর পায় দু’হাজার বছর আগে থেকে মিশরীয়, ব্যাবিলনীয় ও প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতরা গণিত চর্চায় আত্মনিয়োগ করে আসছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে গ্রিকদের পূর্বে কোনো জাতিই গণিতের নিয়মের স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করেন নি। গ্রিক জাতিরাই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন যে গণিতের কতকগুলি বিক্ষিপ্ত তথ্য আবিষ্কারই যথেষ্ট নয়। এর নেপথ্যে যে নিয়ম ও শৃঙ্খলা ক্রিয়াশীল তার রহস্যভেদই গবেষণার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই দেরীতে শুরু হলেও গ্রিক গণিতচর্চার ধারা এক নতুন পথের সন্ধান দেয়।
ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে মিশর ও ব্যাবিলনের সঙ্গে গ্রিকদের যোগসূত্র ছিল। সেই সূত্র ধরেই মিশর বা ব্যাবিলনে গিয়ে গ্রিকদের গণিত শেখা। এরপর তাঁরা নিজ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে মেধাবী ছাত্রদের গণিত শিক্ষাদানের মাধ্যমে দেশে গণিত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে থাকেন। এ ব্যাপারে থ্যালেস-কে (Thales) গ্রিক গণিতের জনক বলা হলেও আধুনিক গণিতের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত যে তিনজন গ্রিক গণিতবিদের হাত ধরে তাঁরা হলেন— পীথাগোরাস (540 খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ইউক্লিড (300 খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং আর্কিমিডিস (225 খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। প্রাচীন গ্রিক গণিতের ইতিহাসকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে— (1) থ্যালেস থেকা পীথাগোরাস-এর সময়কাল পর্যন্ত ক্লাসিক্যাল যুগের সূচনা পর্ব, (2) পীথাগোরাসের পরবর্তী সময় থেকে আলেকজান্দ্রিয়ায় ‘মিউজিয়াম’ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত ক্লাসিক্যাল যুগ এবং (3) আর আলেকজান্দ্রিয় যুগ হল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরবর্তী সময় অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব 300 অব্দ থেকে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত।
প্রাচীনকালে গণিতচর্চায় রোমকদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। ব্যবহারিক জীবনে যতটুকু গণিতের প্রয়োজন তার বাইরে গণিত শিক্ষার কোনো প্রয়োজন আছে বলে তাঁরা মনে করতেন না। তাই গণিত গবেষণায় রোমকদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। একমাত্র বোয়েথিয়াস্ ছাড়া প্রাচীন রোমক ইতিহাসে আর কোনো গণিতবিদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও গাণিতিক গবেষণায় গ্রিক গণিতজ্ঞদের মতো তাঁর কোনো মৌলিক অবদান নেই। তাই তাঁকে সমকালীন গ্রিক গণিতবিদদের সঙ্গে সম আসনে বসানো যায় না।
জ্ঞান বিজ্ঞানে আরব জাতির অবদান লক্ষণীয়। পীথাগোরাস, ইউক্লিড বা আর্কিমিডিসের মতো গণিতজ্ঞ আরবে জন্মান নি ঠিকই তবে আল্-খোয়ারিজ্মি, আল-বাত্তানি ও ওমর খৈয়ামের প্রচেষ্টায় সেখানে গণিতের যে অভাবনীয় উন্নতি সাধন হয়েছিল তা বিস্ময়কর। বিশেষ করে বীজগণিতে আরব গণিতজ্ঞদের অবদান প্রশংসনীয়। ত্রিকোণমিতি ও বিশ্লেষণমূলক জ্যামিতিতেও তাঁরা আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন।
গ্রিকদের গণিত শিক্ষা যেমন মিশরীয়দের কাছ থেকে তেমন আরবদের গণিত শিক্ষা মূলত মেসোপটেমিয়া ও ভারত থেকে। জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরব পণ্ডিতরা একটি চিরস্মরণীয় কাজ করে গেছেন। তাঁরা ভারতীয় ও গ্রিক জ্ঞান বিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থরাজি নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা করেছেন। শুধু অনুবাদ করেই তাঁরা ক্ষান্ত হন নি। মৌলিক গবেষণার দ্বারা গণিতের আঙিনায় তাঁরা তাঁদের কৃতিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন। ব্রহ্মগুপ্তর লেখা ‘ব্রহ্ম-স্ফুট-সিদ্ধান্তের’ খ্যাতি স্বদেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রন্থটি পারসী ভাষায় অনুদিত হওয়ার পর থেকে। খলিফা আল্-মানসুরের রাজত্বকালে ইব্রাহিম আল্-ফাজারি ও ইয়াকুব ইব্ন্ তারিক নামে দুই আরব্য গনিতজ্ঞ এটি আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন। এরপর থেকেই আরবে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। গ্রন্থটির আরবী নাম রাখা হয়েছিল ‘সিন্দহিন্দ’। ব্রহ্মগুপ্তের ‘খন্ডখাদ্যক’ গ্রন্থটি ‘অর্কন্দ’ নামে আরবীতে অনুদিত হয়েছিল।
ভারতবর্ষে গাণিতিক চিন্তার সূচনা কবে হয়েছিল তা বলা কঠিন। তবে বৈদিক যুগে গণিতের বিশেষ করে সংখ্যা সম্বন্ধীয় গণনার ধারণা ছিল। বেদের বিভিন্ন অধ্যায়ে এর নিদর্শন রয়েছে। তবে আলাদা করে গণিতের কোনো গ্রন্থ এ যুগে পাওয়া যায় নি। তাই অনুমান করা যায় এই সময় যে গণিতচর্চা হত তা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। তাহলে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে বৈদিক যুগের আগে ভারতবর্ষে গণিতের কোনো চর্চা হত না? সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এমনই ধারণা ছিল। মহেঞ্জোদড়ো, হরপ্পা ও চানহূদড়োর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের পর এই ধারণা পাল্টে যায়। নগর পরিকল্পনা ও ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে সে যুগে পর্যাপ্ত গণিতচর্চা হত। যদিও প্রামাণিক কোনো গ্রন্থ ধ্বংসাবশেষের ভিতর থেকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। পাঁচ হাজার বছর আগে স্থাপিত কোনো নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকে যখন অসংখ্য মূর্তি, ছবি, চিত্রিত মৃৎপাত্র, শীলমোহর, স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া যায় তখন অস্বীকার করার উপায় নেই যে সে যুগে ললিতকলার পর্যাপ্ত চর্চা ছিল।
মহেঞ্জোদড়ো, হরপ্পা ও চানহূদড়োর ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গেছে ছোট বড় নানাধরনের বাটখারার মতো জিনিস। এগুলি যে পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হত সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়াও পাওয়া গেছে ভাঙা দাঁড়িপাল্লা, বিভিন্ন দাগকাটা স্কেল বা মাপনী যা ব্যবহার করা হত মাপজোকের কাজে। গুজরাটের বলস্কান্ত জেলার দত্রানা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে সান্ত্রালিতে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন আমলের একটি কারখানা। এখানে তৈরি হত নানা ধরনের ফলা, খাঁজকাটা যন্ত্র যা সব ছিল বর্গ ষড়তলাকৃতির (Square parallelopiped)। পণ্ডিতদের ধারণা এই কারখানাটি সিন্ধু সভ্যতা আমলের। সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল ব্রোঞ্জ যুগে। এই ভগ্নাবশেষ থেকে পাওয়া নিদর্শনগুলি সবই ছিল তামার তৈরি।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদড়োর নগর পরিকল্পনা ছিল দেখার মতো। সেখানকার সমস্ত রাস্তাই ছিল চওড়া ও সোজা। ছিল উন্নতমানের পয়ঃপ্রণালী। বাড়িগুলি ছিল পোড়া ইটের তৈরি। প্রত্যেকটি ইটের আকৃতি ছিল কোনো না কোনো জ্যামিতির আকার বিশিষ্ট— কোনোটা কীলকাকৃতির, কোনোটা বা চতুস্তলাকৃতির, কোনোটা সমকোণী ত্রিভুজাকৃতির আবার কোনোটা পিরামিডাকৃতির। মহেঞ্জোদড়োর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সাগরের কাছে লোদালে যে বিশাল ডক্ইয়ার্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায় যে সে যুগে নৌ-বিদ্যা এবং নৌ-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। জ্যামিতি বা গণিতবিদ্যা ও জরিপবিদ্যার সুগভীর জ্ঞান না থাকলে এসব সম্ভব হত না। তাই একথা মনে করা অসঙ্গত হবে না যে প্রাচীন ভারতের গণিত চিন্তার শুরু সেই প্রাক্ বৈদিক ভারতীয় সভ্যতার সময় থেকেই।
এখন প্রশ্ন হল, সিন্ধু সভ্যতার আগে ভারতভূমি কি মনুষ্য বর্জিত ছিল? কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে সিন্ধু সভ্যতা দ্রাবিড় সভ্যতারই একটি রূপ। এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল ব্রোঞ্জ যুগে (Bronze Age)। এই যুগ তাম্র যুগেরই একটি পরিণত রূপ। এর উদ্ভব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব 4000 অব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময় থেকে। সিন্ধু সভ্যতায় তামা এবং ব্রোঞ্জ নির্মিত হাতিয়ার ও তৈজসপত্র ইত্যাদির নিদর্শন পাওয়া গেছে। ব্রোঞ্জ একটি সংকর ধাতু। তাই বলা যায় তাম্র যুগের শেষ লগ্নের মানুষেরা এই সংকর ধাতু নির্মাণের কলাকৌশল করায়ত্ত করতে পেরেছিল। যেকোনো বিজ্ঞানের পিছনে গণিতের প্রয়োগ থাকে। সেটা প্রত্যক্ষও হতে পারে বা পরোক্ষও হতে পারে। গণিত ছাড়া কোনো বিজ্ঞান এগোতে পারে না। এখন দেখা যাক ভারতভূমিতে মানুষের পদচিহ্ন পড়েছিল কোন সময়ে— ব্রোঞ্জ যুগে না আরও আগে? ভারতবর্ষের দাক্ষিণাত্যে প্রত্নপ্রস্তর যুগের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা সম্ভবত এই যুগের মানুষেরই বংশধর। দক্ষিণভারত, বিন্ধ্যপর্বত এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নব্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকদের মতে কোল, ভীল, মুণ্ডা প্রভৃতি আদিবাসীরা সম্ভবত এই যুগের মানুষেরই বংশধর। তাহলে বলা যায় ব্রোঞ্জ যুগের আগেও ভারতের মাটিতে মানুষের বসবাস ছিল। তবে নগর সভ্যতার সূচনা সম্ভবত ব্রোঞ্জ তথা সিন্ধু সভ্যতাতেই। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের অর্থাৎ দ্রাবিড়দের আগমন বহির্ভারত থেকে। এমন ধারণার কারণ দ্রাবিড়দের ভাষা এবং বেলুচিস্তানের ইস্লাম ধর্মাবলম্বী ‘ব্রাহুই’ জাতির লোকেদের ভাষায় অনেক মিল আছে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে আর্যদের মতো সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরাও বহিরাগত ছিল তাহলে প্রশ্ন হতে পারে এরা কি খ্রিস্টপূর্ব 4000-3300 অব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এদেশে এসেছিল, না আরও আগে থেকেই এদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল? ব্রোঞ্জ প্রযুক্তি যদি এদের সঙ্গেই এসে থাকে তাহলে ধরে নেওয়া যায় এদেশে বিজ্ঞান ও গণিতের আগমনও এদেরই হাত ধরে। প্রসঙ্গত বলা যায় মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতা এবং নীল নদের উপত্যকায় গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতার বিকাশও প্রায় সমসাময়িক সময়ে। ঐতিহাসিকদের মতে এই সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব 3000 অব্দের মতো সময়ে। সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার যোগাযোগ থাকলেও মিশরীয় সভ্যতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল কিনা জানা নেই। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ভারতীয় গণিতের বিকাশ এদেশের মানুষের চিন্তা ভাবনাতেই ঘটেছিল। তাই যাঁরা মনে করেন ভারতবর্ষই গণিতের সূতিকাগার তাঁদের ভাবনাকে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। এনিয়ে অবশ্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে ভারতীয় গণিত যে মিশর, ব্যাবিলন বা চিনের থেকে পিছিয়ে ছিল না সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বিঃদ্রঃ অদূর ভবিষ্যতে আমার একটি বই প্রকাশিত হতে চলেছে। তাতে এই নিবন্ধটি একটি অধ্যায় হিসেবে থাকবে।
তথ্য সূত্রঃ-
The Rhind Mathematical Papyrus – Thomas Eric Peet.
The Developmentof Mathematics in China – Yoshio Mikami.
History of Hindu Mathematics (Part I & ii) – Bibhutibhusan Datta and Avadhesh, Motilal Banarsi Das, Lahore.
The Indus Civilization – Ernest Mackay, Lovat Dickson & Thomson Ltd, London.
Prehistoric, Ancient and Hindu India – R.D.Banerjee, Nag Publishers, New Delhi.
Men of Mathematics – E.T. Bell, Simon & Schauster, 1965.
A Historyof Mathematics – C.B.Boyer, Jhon Wiley and Sons, 1968.
প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা – প্রদীপ কুমার মজুমদার।
বিজ্ঞানের ইতিহাস – সমরেন্দ্রনাথ সেন, শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ, কলকাতা।
গ্রীক গণিতের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত – নন্দলাল মাইতি, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
চীনা গণিতের ইতিবৃত্ত – নন্দলাল মাইতি, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা, নলিনীকান্ত চক্রবর্তী, জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী, আগরতলা।
সংখ্যা এল কেমন করে, কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বেস্টবুক্স, কলকাতা।
প্রাচীন ভারতে গণিতচিন্তা – রমাতোষ সরকার, বেস্টবুক্স, কলকাতা।
প্রাচীন ভারতীয় গণিতের ইতিবৃত্ত (প্রাচীন ও মধ্যযুগ) – নন্দলাল মাইতি, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাস – রেবতীমোহন লাহিড়ী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, 1976।
লেখক পরিচিতি: বিজ্ঞানের নানান বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। ২০০৫ সালে গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কারে সম্মানিত। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সহ-সভাপতি, দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি এবং সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।