প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ছবিতে ভ্রমণ

জুন ১৫, ২০১৫

 

মঙ্গলাজোড়ির মঙ্গলকাব্য

প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য


কোথায় যাই, কোথায় যাই, সেই ফেব্রুয়ারী মাস থেকেই মনটা উড়ু-উড়ু। বন্ধুরা কেউ-কেউ বললেন, এই তো বড়দিনে উত্তরাখন্ড ঘুরে এলে, আবার বেড়ানো ? তা, ড্রয়িংরুম-বিলাসীরা কি করে বুঝবেন, পায়ের নীচে সর্ষে থাকলে খুব বেশি তো তিনমাস অন্তরই প্রচন্ড বেড়ানো পায়, তা সে ঘরের কাছে কোন ‘অচেনার আনন্দ’ই হোক বা দূর বিদেশ। কলেজেও ক্লাস বিশেষ নেই, সিলেবাস শেষ, শীত যেটুকু এসেছিল তাও যাই যাই করছে। সামনে আসছে দীর্ঘ ব্যস্ত মরশুম, পরীক্ষার নজরদারি থেকে অ্যাডমিশান তারপর শিক্ষাবর্ষ শুরু। এই তো সময়, যদিও নিয়মনিষ্ঠরা বলবেন, এই সব হচ্ছে যখনতখন ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে পড়বার যাবার পক্ষে কুযুক্তি বা অজুহাত। বহু ছটফটানির পর শেষকালে দিন তিনেকের একটা ফাঁক বার করা গেল, ফেব্রুয়ারীর শেষাশেষি। জায়গাটার খবর দিলেন প্রাণীবিদ্যার বরিষ্ঠ এক অধ্যাপক। নামটি ভারী সুন্দর – মঙ্গলাজোড়ি। সেটা আবার কোথায় আর কি আছে সেখানে ? সে কি কথা, এও জানো না, মঙ্গলাজোড়ি পাশের রাজ্য উড়িষ্যায়, সেই ১৯৮১-তেই ভারতের ‘রামসর’ (Ramsar Convention, Iran 1971) জলাভূমির তালিকায় নাম তুলেছে আর ওটা পুর্ব ভারতে পরিযায়ী পাখীদের অন্যতম সেরা আস্তানা, আন্তর্জাতিক পক্ষী-অঞ্চল (International Bird Area) হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, এবং শীতেই ওদের আনাগোনা বাড়ে। তা শীত তো এখন যাই-যাই, এখনো থাকবে ওরা ? জানা গেল, যারা থাকবে, তাদের দেখেই চোখ টেরিয়ে যাবার একশো পারসেন্ট গ্যারান্টি। ফুড়ুৎ-পার্টিদের উড়ে যেতে আর কিছু দরকার আছে কি ? যা দরকার সেগুলো ইন্টারনেটেই হয়ে গেল, যথা মঙ্গলাজোড়ি সহজে যেতে ট্রেনে করে নামতে হবে খুর্দা রোডে, যদিও যাকে বলে Nearest railhead সেটা হল কালুপাড়াঘাট। কেটে ফেলা গেল টিকিট। ফেরাটা ঠিক হল পুরী হয়ে, পুরী ওখান থেকে একশো চল্লিশ কিলোমিটারের মত। ঠিক করা হল, পাখী দেখতেই যখন যাওয়া, তখন পুরীতে একদিন থেকে চিল্কার নলবন পাখীর বাসাও ঘুরে আসা হবে। 

সেইমত রাতের হাওড়া-পুরী গরীবরথ ধরে ভোর সাড়ে চারটেয় নেমে পড়া গেল শেষ শীতের হিমেল শেষরাতের সুখী ঘুমে আচ্ছন্ন খুর্দা রোড স্টেশানে। গাড়ি বলা ছিল আগে থেকেই, সে গাড়ি যে ঠিকঠাক স্টেশানে আসবে সে আশা খুব জোর করে কেউই করিনি। কিন্তু কি আশ্চর্য, সে ব্যাটা এক আরামদায়ক সিডান গাড়ি নিয়ে স্টেশানের বাইরে দেখি অপেক্ষমান। ফলে ভোরের ক্রিয়াকর্ম স্থগিত রেখেই রওয়ানা দিলাম ঘুমন্ত খুর্দা শহর চিরে। মঙ্গলাজোড়ি খুর্দা রোড স্টেশান থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার, খুর্দা জেলার টাঙ্গি ব্লকের সবচেয়ে পুরোন গ্রাম, ভুবনেশ্বর থেকে দূরত্ব পঁচাত্তর কিলোমিটার। কলকাতা-চেন্নাই জাতীয় সড়ক নং ৫ দিয়ে এগিয়ে টাঙ্গি জনপদে (আদতে অতি পুঁচকে একটা গঞ্জ) জাতীয় সড়ক ছেড়ে বাঁদিকে পাঁচ কিলোমিটার গেলেই মঙ্গলাজোড়ি গ্রাম। এখান থেকেই সেই পাখীদের রাজ্যের প্রবেশপথ – এটা আসলে চিল্কা হ্রদেরই অংশ। এইখানেই চিল্কা হ্রদের উত্তর-পূর্বের কমবেশি দশ বর্গ কিলোমিটার অগভীর জলাভূমিতে (Brackish water) পাখীদের স্বর্গরাজ্য – মঙ্গলাজোড়ি আন্তর্জাতিক পক্ষী-অঞ্চল। বিস্তীর্ণ জলাভূমির পাড় বরাবর এলিয়ে আছে নিস্তরঙ্গ গ্রাম, ঘুম ভেঙ্গে আড়মোড়া ভাঙ্গছে কেবল, সেই সময় আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম তার দুয়ারে। দেখা গেল ঠিক গ্রামের বাইরেই একখানা আস্তানা আছে যেখানে কাঁধের স্যাক ইত্যাদি রেখে মুখটুক ধুয়ে প্রাতঃরাশ করা যেতে পারে যাতে ঝাড়া হাত-পা হয়ে স্রেফ ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে পাখীদের রাজ্যে জলায় ভেসে পড়া যায়, নাম গডউইট রিসর্ট। গাড়ি থামিয়ে ঢুকে পড়া গেল, এবং প্রথম চমক, একটা-দু’টো দিন থাকবার পক্ষে আশাতীত ভাল ব্যবস্থা। সঙ্গী প্রানীবিদ্যার সেই প্রবীণ অধ্যাপককে বেশ রসিয়ে বললাম, " দাদা খেয়াল করেছ, রিসর্টের নামটা জব্বর রেখেছে কিন্তু, ‘গড উইট’ (God Wit), ঈশ্বরের রংতামাশা !"

তিনি তখন তাঁর চেনা ‘মঙ্গলাজোড়ি-ইকোট্যুরিজম-গাইড’কে ফোনে ধরবার চেষ্টা করছেন (এখানে ঘুরতে ওদের কারুর সাহায্য নেওয়াটা বাধ্যতামূলক, এবং অতি প্রয়োজনীয়ও বটে), আমার কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, " দূর হতভাগা, এ দেখছি কিস্যু জানে না, গডউইট একটা পাখীর নাম, এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখতে পাবে, চিনিয়ে দেব’খন।"

তর সইছে না আর, যত তাড়াতাড়ি পারি প্রাতঃকৃত্য আর প্রাতঃরাশ সেরে এগিয়ে পড়লাম।



গ্রামের শেষে উঁচু বাঁধের উপর দিয়ে গাড়ি এসে নামিয়ে দিল এক অপার্থিব জায়গায় – যতদূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ জলাভূমি, মাঝে মাঝে ছোটবড় ভূখন্ড তাতে ঘাসজঙ্গল-ঝোপঝাড়, কোন উঁচু গাছগাছালি নেই, আদিগন্ত সুনীল আকাশে দু-একখন্ড সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ; সরু অগভীর খাল ধরে এগোবে ছই-দেওয়া হাতে বাওয়া ডিঙি নৌকো, তাতে আগেপিছে দুই মাঝি-কাম-গাইড ও আরো সর্বাধিক চারজনা উঠতে পারে।  গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হতেই এক পাগল-করা কলকাকলি কানে এল, কাছে-দূরে নানা জাতের হাজার-লক্ষ পাখীর গানে এখানকার বাতাস আনন্দিত হয়ে আছে। কাছেই একটি নজরমিনার, আরো দূরে বাঁধের উপরে দেখা যাচ্ছে আরো একটি। অদূরেই আমাদের ইকো-গাইড মধু বেহরার তাঁবু, সহাস্যে তিনি এগিয়ে এসে বললেন – "আসেন আসেন সার, নৌকো রেডি, আহা আর কয়দিন আগে আসলে আরো দেখতে পেতেন গো।"

"তবে এখন কি তারা নেই ? "

"আছে, আছে, ‘ভেরি রেয়ার’ স্পিসিসও কিছু এখনো আছে, চলেন দেখাবো, মোবাইল ফোন সুইচ অফ করে দিবেন সার, ওরা আওয়াজে উড়ে যেতে পারে, ক্যামেরা তৈরি রাখেন।"

নৌকার ছইএর ভিতর ঢুকে দেখি পাখী দেখবার জন্য অলিম্পাস কম্পানীর একখানি দামী দূরবীন আর তাদের চিনে নেওয়ার জন্য মঙ্গলাজোড়ির পাখীদের একটি সচিত্র পরিচয়পত্রও রাখা আছে। সেখানা উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়েই বুঝলাম, এ আমার কর্ম নয়, বরং সহজে পাখী-চেনাবার ব্যাপারটা গাইড আর প্রাণীবিদ্যার স্যারের উপরেই ছেড়ে দেওয়া ভাল, আর এসেই যখন পড়েছি তখন ‘দেখাশোনা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার’। পাখীর গান, পাখির রূপ আর তার উড়ানের ছন্দের উল্লাসে মাতোয়ারা হওয়ার জন্য বুঝি তার নাম জানা খুব দরকার ? আমার ব্যক্তিগত মতামত – না। তাহলে তো রাগরাগিনীর নাম না জানলে সুরাস্বাদন অসম্ভব হত, কই তা তো হয় না; আমি তো এ যাবৎ সে সব সুরের শাস্তর বিন্দুমাত্র না জেনেও বহু গান শুনে বিভোর হয়েছি বহুবার! তখন সকাল আটটা, নৌকো ছেড়ে দিল, আমরা চারজন চারটে কামান (টেলিলেন্স-লাগানো ক্যামেরা) বাগিয়ে শিকারির উত্তেজনায় টানটান হয়ে বসলাম।



শামুকখোল বা ‘ওপেন বিল স্টর্ক’

নৌকোয় চড়ার আগেই দেখে ফেলেছি শামুকখোল বা ‘ওপেন বিল স্টর্ক’ আর ডাহুক (হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন)। সামনে পিছনে হাতে-লগি-ঠেলা মধু বেহরার ‘বোট’ এইবার সংকীর্ণ নালার দু’ধারে মানুষপ্রমাণ উঁচু ঘাসজঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটু এগোতেই বেহরা ফিসফিসিয়ে বললো –

"ওই দেখুন সার, ‘ইয়ালো বিটার্ণ’ (Yellow Bittern), হিমালয় থেকে আসে" (পরে জেনেছি, এখানেও ওদের দু’-চারটে দেখা যায়)।



‘ইয়ালো বিটার্ণ’

কিন্তু কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না কেউ, হঠাৎই চোখে পড়ল নৌকো থেকে গজ পাঁচেক দূরে নলখাগড়া আর ঘাসের খয়েরি রঙে মিশে জলের ধারে ওঁত পেতে বসে একটি মেটে-খয়েরি-সাদা-মেশানো আপাতদৃষ্টিতে সাদামাটা পাখী। ভাবছি কি আর এমন এর বিচিত্রতা, তবু ক্যামেরা তুলেছি কি তুলিনি, আচমকা ওই বিগতপ্রমাণ পাখীটা তার গলাটা পুরো শরীরের সমান প্রায় বিগতপ্রমাণ বা তার বেশি লম্বা করে জল থেকে ছোঁ মেরে কুচো মাছ বা পোকা জাতীয় শিকার মুখে পুরল। হতবাক হয়ে গিয়ে ছবি তুলতে ভুলে গেলাম। তবে সে আমাদের বঞ্চিত করল না, আবার শিকার-ধরার পোজ দিয়ে বাধিত করল শিগ্রিই।

একে ছেড়ে নৌকা কয়েক গজ এগোতে নালাটা বেশ খানিক চওড়া হল, দু’ পাশে ঘাসের বন নেই। কম্পাসে বুঝলাম আমরা জলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলেছি। গাইড বলল, এই দিকটায় পাখী বেশি। আমাদের হাতে চার ঘন্টা সময়ে জলাটার যতটা পারা যায় বৃত্তাকারে বেড় দিয়ে ফিরে আসা হবে যেখান থেকে উঠেছি সেইখানে। দক্ষিণের আকাশটা যেন ঈষৎ কালচে-মেঘলা। এইখানে দেখলাম এক মায়াবী দৃশ্য। নৌকো থেকে প্রায় গজ বিশেক দূরে বাঁ ধারের পাড় থেকে বড়সড় একটা ধবধবে সাদা পাখী, তার শ্বেতশুভ্র বিরাট ডানা মেলে উড়ান দিল কালচে আকাশে, কি রাজকীয় তার সেই উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিটি !



‘ইগ্রেট’

চারপাশে চার-চারটে ক্যামেরার সাটারের অবিরাম শব্দের মধ্যেই প্রাণীবিদ্যার প্রোফেসার জানালেন, এনার নাম ‘ইগ্রেট’; হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই, গ্রেট তো বটেই। সে পাখী বেশ খানিক দূরে উড়ে গিয়ে জলার ভেতরেই কোথাও গিয়ে বসল আবার, আর আমাদের চোখ পড়ল, লাল মাথা ছোট ঠোঁট কালচে-নীল শরীরের ‘মুরহেন’ বা জলপায়রার দল, যেন রাজার সভায় সভাসদেরা রাজা অন্তঃপুরে গেলেন বলে নিজেদের মধ্যে গুঞ্জনে ব্যস্ত। একটা ঝটাপটির শব্দে অন্য দিকটায় চেয়ে দেখি, দু’টো সিড়িঙ্গে-গলাওয়ালা বিরাট পাখী নিজেদের মধ্যে মারামারি লাগিয়েছে।



‘পার্পল হেরন

ক্যামেরা তাক করবার আগেই লড়াইয়ের ফয়সালা হয়ে গেল, হেরোটা ঘাসজঙ্গল ছুঁয়ে নীচু উড়ান দিয়ে কিছু দূরে গিয়ে বসল আর জয়ী পাখীটা আমাদের যেন আশ মিটিয়ে পোজ দিল, মহম্মদ আলি বক্সিং লড়াই জিতে যেমন দিতেন আর কি! ছাই-ছাই রঙের শরীর, হলদের মধ্যে উজ্জ্বল কালো চোখ আর ডাইনোসরের মত সরু লম্বা গলা তার, নাম জেনে নিলাম – ‘পার্পল হেরন’। পার্পল কেন ? নজর করে দেখে বুঝলাম, ওর ধুসর গায়ের রঙে একটা হালকা বেগনী আভা আছে। ওর বাংলা নাম নাকি ‘লালকাঁক’ (কাক নয়)। মধু বেহরা আঙ্গুল তুলে পার্থক্য দেখিয়ে দিল – ওই দেখুন, বিলকুল সাদা, ঠোঁটটা হলুদ, ওইটা হচ্ছে ‘পন্ড হেরন’ বা কোঁচবক, ওদের আপনারা আপনাদের অঞ্চলেও দেখতে পাবেন। একটু পরে ‘গ্রে হেরন’-এরও (Grey heron) দেখা পেলাম, ঈষৎ ধূসর গা, কিন্ত ডানার প্রান্তগুলো সমুদ্রনীল।



‘গ্রে হেরন’

"কিন্তু গডউইট ? সে কই ?"

মধু এক গাল হেসে বলল – সে কি, গডউইট চেনেন না ? ওই দেখুন জলের ধারে কি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, বেশ লম্বাটে কমলা ঠোঁট, পিঠে-পাখায় কালো-খয়েরি ছিটে, বুক-পেটের দিকটা সাদা, লেজটা কালো (black-tailed Godwit)।



Black-tailed godwit ('গডউইট')

দেখলাম, দেখে বুঝলাম একে তো এইটুকু আসতে নৌকোর দু’ধারে প্রচুর দেখে ফেলেছি। ওই গডউইটের ভিড়ের পেছনেই আমার চোখ পড়ল একটা সাদা পাখী, হলদে তার ঠোঁট, ঠোঁটের ডগাটা কালো, আর দুই চোখ থেকে মাথা বেড় দিয়ে কালো রঙ, হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন কানে হেডফোন পরে আছে! আমাদের দেখেই বোধহয়, সেও একটু জাত চেনাবে বলে বসে বসেই ডানা মেললো, ডানার প্রান্তের পালকগুলি ধুসর, এবং শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক বড় ডানা।



‘টার্ন’ (Whiskered Tern)

ইনি কে মধুদাদা ? ইনি ‘টার্ন’ (Whiskered Tern) বটেন, আর ওই পাশে, ছোট ঠোঁট, এরও চোখের পাশে চিতাবাঘের মত ‘টিয়ার মার্ক’ (তাই বলে কিনা জানিনা, আমি বোঝাবার জন্য কথাটা লিখলাম), বেশ সংসার পেতে বসে আছেন, উনি হলেন ‘গাল’ (Gull)। এ ছাড়া ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি আর ‘পিনটেইল’ (Northern Pintail) বা ‘বড় দীঘর’ সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে দেখলাম, দেখলাম উজ্জ্বল ও গাঢ় খয়েরি রঙের লাদাখি হাঁস (Ruddy Shelduck) আরো চেনা নামে ‘চখাচখি’, ঘাড় গুঁজে নিজের পালক নিজেই পরিষ্কার করছে। উড়ে যাবার সময় তাদের পাখার প্রান্তের কালচে সবুজ পালকগুলো সূর্যের আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠল।



‘বড় দীঘর’ বা ‘পিনটেইল’



লাদাখি হাঁস (Ruddy Shelduck)

জলার অনেক ভিতরে চলে এসেছি, পাড় এখান থেকে অনেক দূরে। এমন সময় প্রোফেসার সাহেব তাঁর ক্যামেরায় ময়ূরকন্ঠী নীল গলাওয়ালা একটি ছোট্ট পাখীর ছবি দেখিয়ে বললেন, তোমরা মিস করে গেছ, একে বলে ‘ব্লু-থ্রোটেড থ্রাশ’, ইওরোপের পাখী। এত পাখীর মাঝে এই রত্নটিকে একা তাঁর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী চোখ খুঁজে পেয়েছে এমন অহঙ্কারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নৌকার এক্কেবারে কাছে উড়ে এসে বসল অবিকল সেই পাখী! পাখী তো, মানুষের অহং-টহং পাত্তা দিতে ওদের বয়েই গেছে। মধু দূরে জলের মধ্যে গাঁথা বাঁশের ডগার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে নৌকা সেইদিকে নিয়ে চলল। এক্কেবারে কাছে পৌঁছে দেখলাম রাজাধিরাজের ভঙ্গিতে ঘাড় বেঁকিয়ে বাঁশের মাথায় বসে আছে শঙ্খচিল (Brahminy Kite) – সেই শঙ্খচিল, যার বাদামী দু’-ডানায় ঢেউএর দোলা, যার দু’চোখে নীল, শুধু নীল ?



শঙ্খচিল (Brahminy Kite)

আমার হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বিখ্যাত গান ‘শঙ্খচিল’ মনে পড়ে গেল। আশ মিটিয়ে ছবি তোলা হল, উনি আমাদের হিসেবের মধ্যেই আনলেন না, রাজাধিরাজ বলে কথা! আশে পাশে অজস্র ‘স্যান্ড পাইপার’ (Pectoral Sand piper) আর জলপিপি (Jacana) অলস ভঙ্গিতে ভেসে বেড়াচ্ছে অগভীর জলে।



‘স্যান্ড পাইপার’ (Pectoral Sand piper)

এত সব নাম জেনেটেনে আমারও একটু জ্ঞান ফলাতে ইচ্ছে করল, বেশ ভারিক্কী চালে প্রশ্ন করলাম – আচ্ছা, আলব্রাটাস দেখা যাবে না ?

প্রাণীবিদ্যার প্রোফেসর প্রশ্নটা শুনে এতই রেগে গেলেন, পারলে আমায় নৌকা থেকে ঠেলে ফেলেই দেন, বললেন, "মুখ্যু ওটা সমুদ্রের পাখী, এখানে পাওয়া যায় না।"

এখানে নয়-নয় করে একশো বিশ প্রজাতির পাখী দেখতে পাওয়া যায়, শীতের সময় (সিজনে) পাখীর সংখ্যা নাকি পাঁচ-সাত লাখ ছাড়িয়ে যায়! যা দেখছি, তাতে এই পরিসংখ্যান অবিশ্বাস করবার কোন কারণ পেলাম না। এবার ফেরার পালা, ফেরার পথেও পাখী আর পাখী। আগেরগুলো ছাড়াও এবার নতুন দেখলাম, প্লোভার (Plover), ‘ব্ল্যাকহেডেড’ আর ‘গ্লসি’ ‘আইবিস’ (Ibis, কাস্তেচরা), ‘কুট’ (Koot), ‘ইউরেশিয়ান ডাক’ (Eurasian Duck), আরো অনেক অনেক। সবার নাম জানতে পারিনি, অনেকের নাম মনে রাখতে পারিনি, সবার ছবি তোলবার সুযোগও পাইনি, তবে তাদের রূপবৈচিত্র্য মনক্যামেরায় ধরে এনেছি। মাত্র কয়েকটির ছবি ও নামধাম (সৌজন্যে মধু বেহরা ও অগ্রজ প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক) এই লেখার সঙ্গে জুড়ে দিলাম, ছবি দেখে দু-পাঁচটাকে আগেভাগে চিনে নিলে অনুবর্তী অ-পাখীবাজ পর্যটকের পাখীদের ওই রাজ্যে গিয়ে আমার মত হংস-মধ্যে-বক-যথা মার্কা ভ্যাবাচেকা-খাওয়া অবস্থা কিছুটা কমতে পারে।

ফেরবার পথে মধু বেহরা মঙ্গলাজোড়ি গ্রামের ইতিবৃত্ত শোনাল, শোনাল এখানকার পতিতপাবন মন্দিরের খ্যাতির কথা। মা মঙ্গলা আর মা ব্রাহ্মণীর জোড়া মন্দির থেকেই নাকি গ্রামের নাম হয়েছে ‘মঙ্গলাজোড়ি’। মহাপাত্র বংশের আড়াইশো বছর পুরোন রঘুনাথ মন্দির, গুপ্তেশ্বর মন্দির, নীলকান্তেশ্বর মন্দির আর মা বালিমাঝির মন্দিরের কথাও জানতে পারলাম। জানতে পারলাম, বহুকাল আগে এইখানে নাকি ছিল এক সমুদ্রবন্দর, উড়িষ্যাগামী সব বাণিজ্যতরী জিরোতে দাঁড়াত এখানে। এখনো ছোটখাট একটি মৎস্যবন্দর আছে (চিল্কা সাইট নং ২২৯), মাছধরা ডিঙিনৌকা বানাবার পাঁচ-সাতটি ছোটখাট কুটীরশিল্প গোছের সংস্থা আছে, যার উপর আশপাশের তিরিশ-চল্লিশটি গ্রামের মৎস্যজীবীরা নির্ভর করে থাকেন। মধু বেহরা আরো শোনাল এক অবাক-করা গল্প – গত দেড় দশক ব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন এক আশ্চর্য আন্দোলনের কাহিনী। মঙ্গলাজোড়ির (ও আশপাশের পাঁচ-দশটা গ্রামের) হতদরিদ্র বাসিন্দাদের দু’ দশক আগেও প্রধান জীবিকা ছিল জলার পাখী ধরা ও মেরে তার মাংস বাজারে বিক্রি করা; পাখীর ডিমও ছাড় পেত না চোরাশিকারির লোলুপ নজর থেকে। সরকারী নজরদারি চালিয়ে কোন লাভ হয়নি, বরং ২০০০ সালে পক্ষীগণনায় দেখা যায়, জলায় মাত্র পাঁচ হাজারের মত পাখী বিলুপ্ত হতে হতে কোনরকমে টিঁকে আছে। অবলুপ্তির এই বিলয়রেখা থেকে শুরু হয় সেই আন্দোলন, দারিদ্র্য দূরীকরণ আর প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র-সংরক্ষণের মেলবন্ধন যে আন্দোলনের অভিলক্ষ্য। অসরকারী ব্যাসিক্স সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ গ্রূপ (BASIX Social enterprises Group)-এর অলাভকারী শাখা-সংগঠন ভারতীয় গ্রাম সেবার (Indian Grameen Services) নেতৃত্বে এই আন্দোলনে গ্রামবাসীদের সচেতন করে বোঝাতে পারা গেল যে এই এলাকার ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখে, প্রকৃতির আপন ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবিকার্জন অনেক বেশি লাভদায়ক এবং দারিদ্র্যের দীর্ঘকালীন সমাধান (Sustainable Livelihood)। প্রথমদিকে সরকারি সাহায্য ছিল নেহাতই অপ্রতুল, মূলত অসরকারি উদ্যোগে লাভের উদ্দেশ্য ছাড়াই (Non-government & Non-Profit) ১০ ডিসেম্বর ২০০০-এ সৃষ্টি হল “শ্রী মহাবীর পক্ষী সুরক্ষা সমিতি” ও “মঙ্গলাজোড়ি সংরক্ষণ ও পরিপর্যটন ন্যাস” (Mongalajodi Conservation & Ecotourism Trust, ‘পরিপর্যটন’ কথাটি ecotourism-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা তৈরি করলাম)। কালে কালে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন RBS Foundation (Royal Bank of Scotland Group), উড়িষ্যা সরকারের পরিবেশ ও বনদপ্তর ও চিল্কা উন্নয়ন পর্ষদ। এ এক অনির্বচনীয় অভিযাত্রা – মাত্র দু’ দশক আগেও চোরাশিকারিদের গ্রাম হিসেবে কুখ্যাত মঙ্গলাজোড়ির (ও পার্শ্ববর্তী আরো পনেরো-বিশটি গ্রামের) আবালবৃদ্ধবনিতা এই আন্দোলনের জাদুস্পর্শে আজ এই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রের  সবচেয়ে বড় সংরক্ষক। পাখীরা তাই আবার নিশ্চিন্তে ফিরে এসেছে তাদের আস্তানায়, নির্ভয়ে ডিম পাড়ে তারা, আকাশবাতাস ভরিয়ে তোলে কলকাকলিতে।    

নৌকো থেকে নেমে মধু আর তার সঙ্গীর সঙ্গে হাত-মেলাচ্ছি যখন, তখনও ঘোর পুরো কাটেনি। পাখীদের সঙ্গে এতক্ষণ কাটাবার কেমন একটা স্বপ্নালু রেশ নিয়ে সেই নজরমিনারটার কাছে রাখা আমাদের গাড়িতে ফিরতে ফিরতে দেখি, কাদায় পড়ে থাকা পট্যাটো-চিপসের প্লাস্টিকের প্যাকেট ঠুকরে খাচ্ছে একটা স্যান্ডপাইপার। এ প্লাস্টিকের প্যাকেট মঙ্গলাজোড়ির বাসিন্দাদের আনা নয়, আমার মত কোনো শৌখিন শহুরে পর্যটকের কীর্তি এটা, যারা পয়সা দিয়ে সমস্ত ফূর্তি কিনতে পারা যায় বলে ভাবে, আর ভাবে দুনিয়াটা তাদেরই শর্তে ঘুরপাক খাবে। এ বিষাদের ছবি আর তুললাম না। মনে মনে বললাম, বাড়ি ফিরে যাকেই মঙ্গলাজোড়ির পাখীদের কথা শোনাবো, তাকে নিশ্চয়ই বলবো, স্বর্গ-থেকে-নেমে-আসা ওই পাখীদের মন থেকে ভালোবেসে তবেই ওখানে যেও, আমাদের সভ্যতার বিষ ওইখানে ফেলে এসে ওদের মঙ্গলগান থামিয়ে দিও না।   


লেখক পরিচিত - পেশা - কলকাতার উপকন্ঠে একটি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপনা, নেশা - হিমালয় আর থিয়েটার। বাংলায় লেখালেখির অভিজ্ঞতা - না-থাকার মত, ইদানীং দু'চারটি পত্রপত্রিকায় অনিয়মিত কিছু লেখা ছাপা হয় বলে উত্তরোত্তর স্পর্ধা বাড়ছে। তবে সময়ের দাম সম্পর্কে ধারণা না থাকায় উত্তোরণ হ'বার নয়। একটা পাহাড়-জঙ্গল জায়গায় হলুদ পাতায় ছাওয়া বনে মরবার ইচ্ছে।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।