প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

মে ৩০, ২০১৬

 

প্রকৃতি-তীর্থ অমরনাথের পথে

প্রতিভা ভট্টাচার্য

(লেখিকা ১৯৮৩ সালে অমরনাথ দর্শন করার পরে, এই ভ্রমণকাহিনীটি রচনা করেন। আজ তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই... অমরনাথ যাত্রা পথেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রচনাটি অপরিবর্তিত রাখা হল)

ভবঘুরে মনটাকে কিছুতেই সংসারে আবদ্ধ করতে পারি না, কেবলই ছুটতে চায় এখানে সেখানে। তারই তাগিদে কেদারনাথ- বদ্রীনাথ সহ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের নানা যায়গায় ঘুরেছি। কেদারনাথ দর্শন করার পর থেকেই কেন জানিনা কেবলই অমরনাথ দর্শনে যেতে চাইছিল মনটা, কিন্তু মন চাইলেই কি সব কিছু করা যায়?
কর্তব্যের বাঁধনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি যে, তাই বেরোতে পারিনি এতদিন। মনটা কেবলই গুমরে উঠেছে, ‘ঠাকুর! তোমার দেখা কি পাবনা?’ শুনেছি তীর্থের দেবতা ডাক না দিলে তীর্থ দর্শন হয়না...শুধু তীর্থ দর্শন কেন, দেবতার ইচ্ছে ছাড়া জীবনে কিছুই ঘটতে পারেনা, তাই খালি তাঁকে ডেকে বলেছি- ‘প্রভু দেখা দাও, নিয়ে চল আমায় তোমার পদপ্রান্তে’।

দেবাদিদেব বোধহয় আমার প্রার্থনা শুনেছিলেন, একদিন স্কুলে গিয়ে হঠাৎ শুনলাম, বড়দি মানে আমাদের প্রধান শিক্ষিকা অমরনাথ দর্শনে চলেছেন, কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে। খুবই ইচ্ছে হল এই দলে যোগ দিতে, কিন্তু নানা কথা ভেবে তখনই ‘যাব’ বলতে পারলাম না, শুধু একমনে অমরনাথকে ডাকতে লাগলাম; এবং তাঁর দয়াতেই বোধহয় এক এক করে সব বাধা কাটিয়ে উঠলাম।

১৫ই জুলাই অমৃতসর মেলে হাওড়া স্টেশন ছাড়লাম আমরা। আমাদের যাত্রা পরিচালনা করছিলেন ‘ক্যালকাটা ট্র্যাভেলস’। যথাসময়ে ট্রেন অমৃতসর পৌঁছল। স্নানাহার সেরে আমরা অমৃতসরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। স্বর্ণমন্দিরে জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রবেশাধিকার আছে, সেখানে দেখলাম বহু সম্ভ্রান্ত পুরুষ ও মহিলারা তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে পুণ্য অর্জনে (কর সেবা) ব্যস্ত, যে কাজগুলিকে আমরা হীন মনে করি যেমন বাসন মাজা, মন্দির প্রাঙ্গণ ধোওয়া মোছা- তাঁরা অতি আনন্দের সঙ্গে সম্পন্ন করে চলেছেন। পরিশ্রান্ত ও তৃষ্ণার্ত দর্শনার্থীদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য কেওড়া দেওয়া ঠাণ্ডা পানীয় জলের ব্যবস্থা রয়েছে যায়গায় যায়গায়, জলপানের অনতিবিলম্বে জলের পাত্রগুলি সযত্নে ধুয়ে মুছে রাখছেন মহিলারা। জামাইবাবু (বড়দির স্বামী) একজন শিখ গাইড নিয়ে এলেন, তিনি আমাদের ঘুরিয়ে সবকিছু দেখালেন ও বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর কাছেই শুনলাম, এখানে সকলেই ‘ফ্রি সার্ভিস দেন’। তিনি নিজেও একটি ব্যাঙ্কে কাজ করেন এবং অবসর সময়ে এখানে প্রদর্শকের কাজ করে সেবা করে থাকেন। পরে জেনেছি, এইরকম সেবার কাজ পন্ডিচেরী আশ্রমেও করা হয়ে থাকে।

স্বর্ণমন্দিরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলেরই প্রবেশাধিকার

স্বর্ণমন্দিরে বস্ত্রাচ্ছাদিত পবিত্র ‘গুরু গ্রন্থসাহেব’ রক্ষিত আছেন। ‘গ্রন্থসাহেব’ ২৬ জন মনীষীদের বাণী একত্রিত করা শিখ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় গ্রন্থ, এই গ্রন্থটিকে তাঁরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করেন। মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলে মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই মাথায় কাপড় দিতে হয়, আমাদের কিছু কিছু অনভ্যস্থ সঙ্গী সাথী এই প্রথায় বিশেষ অসুবিধায় পড়েছিলেন; মাথার কাপড় বার বার সরে যাওয়ায়, আমাদের শিখবন্ধু- গাইড তাদের সেকথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। ব্যাপারটা আমরা বেশ উপভোগ করছিলাম। মন্দিরে সারাক্ষণ নামগান (শব্দ কীর্তন) করে চলেছেন পণ্ডিত ও ভক্তেরা, এই নামগান কখনও বন্ধ হয়না।

পরের দ্রষ্টব্য স্থান, ‘লঙ্গরখানা’। সেখানে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হাঁড়িতে রান্না চলছে। একপাশে স্তূপাকৃতি মাখা আটা ভিজে কাপড় দিয়ে ঢাকা, সেই আটা দিয়ে হাতে হাতেই রুটি বানিয়ে বিশাল চাটুতে সেঁকে চলেছেন অগণিত নারী- পুরুষ। কি বিরাট কর্মযজ্ঞ যে সেখানে চলছে, তা আমি লিখে বোঝাতে পারবনা। নিয়মমাফিক সকলকেই একটু হলেও রুটি আর ডাল মুখে দিতে হল। খাওয়ার পরে হাত ধোওয়ার জল ও হাত মোছার জন্য তোয়ালেও পেলাম, কি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা! মনে মনে বললাম, ‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’। অনেক তীর্থ দর্শন করেছি কিন্তু এমন শান্ত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবেশ আর কোথাও দেখিনি। আমাদের গাইড বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম, কোনও স্বতঃস্ফূর্ত কাজের পরিবর্তে যে কেউ এখানে তিন- চার দিন নিখরচায় আহার ও বাসস্থান পেতে পারেন।

আজ আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিক, এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে পরিমাণ রক্তক্ষয় হয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগে, কিছু নিরপরাধ দেশবাসীর- স্ত্রী- পুরুষ- শিশু নির্বিশেষে- কালের প্রবাহে সে রক্তের চিহ্ন মুছে গেলেও এই বাগ তার সাক্ষ্য বহন করে চলবে চিরদিন। স্বাধীনতাকামী সেই অমর প্রাণগুলি এই বাগেই চির আশ্রয় নিয়েছে। পরে মনে হয়েছিল, এখানে না এলেই ভাল ছিল। ভারাক্রান্ত মনে আমরা সে স্থান ত্যাগ করলাম।

অনেক কিছুই বাকী রয়ে গেল দেখার, সময়াভাবে। ঐদিন রাতেই আমাদের জম্মু রওনা হওয়ার কথা। হোটেলে ফিরেই ষ্টেশনে ছুটতে হল, ট্রেনের সময় হয়ে গেছিল। একই সময়ে টিকিট না কাটার জন্য কলকাতা থেকে অমৃতসর আমাদের আলাদা আলাদা আসতে হয়েছিল, অসুবিধাও ভোগ করতে হয়েছিল অনেক। এবারে আমরা সবাই একই সঙ্গে যেতে পারব ভেবে খুব খুশী হলাম, কিন্তু বাধ সাধলো পাশের কুপের কয়েকটি ছেলে। বয়েসে অনেক ছোট- ‘যৌবনের দূত’। প্রাণশক্তিতে ভরপুর, অত্যন্ত চঞ্চল...তাই আমাদের কাছে অদ্ভুত।

আমাদের বাড়ীর সকলেই সঙ্গীত রসিক, আমিও গান অন্তর দিয়েই ভালবাসি, কিন্তু সেই গান যে এত পীড়াদায়ক হতে পারে তা উপলব্ধি করলাম সেই ছেলেগুলির আনন্দ উপভোগের জন্য টেপরেকর্ডারে বাজানো গানগুলি শুনে। বিভিন্ন পূজা প্যান্ডেলে মাইক সহযোগে বাজানো এইসব চলতি গান আগেও শুনেছি, ভালো লাগেনি যদিও, এতো কষ্টবোধ করিনি কারণ তা শুনেছি দূর থেকে। আর সহ্য করতে না পেরে ছেলেগুলির কাছে গিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমরা অমরনাথের যাত্রী। অনেক কষ্টের যাত্রা, একটু ঘুমোতে দেবেন না?’ একটি ছেলে ঘড়ি দেখে কেবল বলতে গেছে, ‘এখনও তো দশটা...’ আমি তাকে বাধা দিয়ে বলি, ‘আমি কোন আইনের কথা বলতে আসিনি, ছোট ভাইদের কাছে কেবল একটা অনুরোধ করতে এসেছি’। কি অদ্ভুত পরিবর্তন! ছেলেটি লজ্জিত হয়ে বলে ওঠে, ‘না দিদি, অনুরোধ না হুকুম করুন’। বললাম, ‘গান শুনুন- শুধু একটু আস্তে বাজাতে বলছি’। একটু পরেই ছেলেগুলি গান থামিয়ে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা এল মনে, ‘বর্তমান যুব সমাজের এক অংশকে লোকে দোষারোপ করে, তাদের দুর্বিনীত ও অশোভন আচরণের জন্য। আমার মনে হয় পরিস্থিতি ও পরিবেশই দায়ী এর জন্যে মুখ্যত দায়ী। তাদের মনের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়নি, কিছুটা স্নেহ- ভালোবাসা দিয়ে তাদের সঠিক রাস্তা দেখানো যায়, তারাও মানসিক শান্তি পায়।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙল ওই ছেলেগুলিরই বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ গানটি শুনে। জম্মু পর্যন্ত ওদের বাজানো সুন্দর সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে সকালটা খুব ভাল কাটলো।

জম্মু স্টেশনের বিশ্রামাগারে তৈরি হয়ে নিয়ে, বাস আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে ‘ক্যালকাটা ট্র্যাভেলস’ এর কর্মীরা আমাদের জন্যে গরম গরম লুচি- তরকারী ও চায়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাসও এসে পড়ল। আমরাও জলখাবার শেষ করে যাত্রা শুরু করলাম, গন্তব্য শ্রীনগর। এই যাত্রাপথে হিমালয়ের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পাব, ভাবতেই মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল।

হিমালয়ের রূপ বর্ণনা করার মত ভাষা আমার নেই।

হিমালয়ের রূপ বর্ণনা করার মত ভাষা আমার নেই। দার্জিলিং, নৈনিতাল, রাণীক্ষেত, মুসৌরী, কেদারনাথ, বদ্রীনাথে হিমালয়কে দেখেছি নানারূপে- কোথাও তিনি উদ্ভিদ- জগতের জন্যে তাঁর দ্বার বন্ধ রেখেছেন, কোথাও পরম স্নেহে তাদের নিজ অঙ্কে ধারণ করেছেন, আবার কোথাও তুষারে সর্বাঙ্গ আবৃত করে অপরূপ সাজে সেজেছেন। বাসে যেতে যেতে আজ আবার হিমালয়কে নবরূপে পেলাম। ঝাউ, পাইন, পপলার গাছগুলি সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে যেন নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সুরু করেছে, কে কতটা মাথা উঁচু করতে পারে... এই রূপদর্শনে আনন্দিত হয়ে আমাদের কয়েকজন শিক্ষিকা সঙ্গী সম্মিলিত কণ্ঠে ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি গেয়ে আমাদের খুব আনন্দ দিয়েছিলেন। সেই গানে অনুপ্রাণিত হয়ে ট্র্যাভেলসের এক কর্মী, প্রতাপ আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন দুটি পুরাতনী ও বাউল গান গেয়ে।

‘ক্যালকাটা ট্র্যাভেলস’ এর কর্মকর্তা অশোকবাবু জানালেন যে আমরা ‘কুদ’ পৌঁছে গেছি, আর তার পরেই ‘বাটোট’। বাসের ঝাঁকুনিতে সকলেরই বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছিল, তাই বাটোটের নাম শুনে সকলকেই বেশ খুশি মনে হল, কারণ আগেই জানা ছিল যে বাটোটে আমাদের দুপুরের খাওয়া দেওয়া হবে। অশোকবাবুর কাছে আরও জানলাম যে জম্মু- শ্রীনগরের পথে কুদ তৃতীয় উচ্চতম স্থান, উচ্চতা প্রায় ৫৭০০ ফুট। জম্মু থেকে আমরা প্রায় ৬৬ মাইল এসেছি, আরও ১২ মাইল পরে বাটোট। কুদের পর থেকেই আমরা নীচে নামতে শুরু করব, বাটোটের উচ্চতা ৫১১৬ ফুট।

হোটেলের সামনে বাস থামলে, সবাই দৌড়ল খাবার জন্যে। এখানে মুড়ি- মিছরি এক দর। ভাত, ডাল, কঢ়ি (বেসন ও দই দিয়ে তৈরি), আলুর তরকারি, টক দই- সবই প্লেট প্রতি ৫ টাকা। কোনো রকমে ক্ষিদে মিটিয়ে আবার বাসে চড়লাম।

বাটোট থেকে দিকের পরিবর্তন হল, এবারে যাব সোজা উত্তরে, বনিহাল পর্যন্ত। হিমালয় কে বিদায় জানিয়ে এবারে আশ্রয় নিলাম ‘পিরপঞ্জাল ও জাস্কর’ পর্বতশ্রেণীর কোলে। শুরু হল খাড়া চড়াই। রাস্তার পাশে পাশে বয়ে চলেছে চেনাব নদী। শ্রীনগর যাওয়ার পথে উচ্চতম স্থান আপারমুন্ডা, ৭২২৪ ফুট। বেলা পড়ে আসছিল, সূর্যদেব আমাদের সঙ্গ ছেড়ে দিলেন। পথের ওপরে আঁধার নেমে এল পাহাড়ের গা বেয়ে। বাসের আলোয় আলোকিত পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম- হঠাৎ দেখতে পেলাম, আলোর সুরঙ্গ- বানিহাল গিরিবর্ত্ম। আলোয় সজ্জিত এই টানেলের মধ্যে দিয়ে যেতে ভীষণ ভালো লাগছিল। ১৯৫৬ সালে তৈরি এই টানেলটির অন্য নাম- ‘জওহর টানেল’। গাড়ী যাওয়ার ও আসার রাস্তা আলাদা। আগে, এই গিরিবর্ত্মের ৯০০০ ফুট ওপরের রাস্তা দিয়ে কাশ্মীরে আসতে হত। শীতকালে সেই রাস্তা তুষারপাত ও তুষার ঝড়ের জন্যে অগম্য হয়ে উঠত। বানিহাল শব্দের অর্থ তুষার ঝড়। এই টানেল তৈরি হওয়ার আগে, শীতের চার মাস কাশ্মীর ও লাদাখের সঙ্গে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের কোনও যোগাযোগই থাকত না। পৌঁছলাম কাশ্মীর উপত্যকায়। জামাইবাবু জানতে চাইলেন, আমরা ভেরীনাগ দর্শনে আগ্রহী কিনা। উনি আগে অমরনাথ দর্শন করেছেন ও তাই এই পথ সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। আমরা সানন্দে সম্মতি জানালেও কর্তৃপক্ষ রাজী হলেন না, শ্রীনগর পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে সেই সঙ্গে রাতের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাতেও। বাস এগিয়ে চলল। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কাশ্মীর উপত্যকাকে বড় সুন্দর লাগছিল।

হোটেলে আশ্রয় পাওয়ার পরেই গরম চা ও চিঁড়েভাজা এসে গেল। শীলা, রেখাদি আর নীলিমাদি তাঁদের পানের ডিবে খুলে বসলেন। কলকাতা থেকে এঁরা প্রচুর পান নিয়ে এসেছেন, আমরা কয়েকজন নিয়মিত ভাবে তাঁদের পানে ভাগ বসাতাম।

অতিরিক্ত তুষারপাতে অমরনাথের যাত্রাপথ হয়ে পড়েছে বিপজ্জনক

শুরু হল কাশ্মীর দর্শন। নিশাতবাগ, শালিমারবাগ, হজরতবাল, চশমাশাহী সহ শ্রীনগরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে অভিভূত হলাম। পরের দিন পহলগাঁও যাত্রা, তাই বিশ্রাম নিতে হোটেলে ফিরলাম তাড়াতাড়ি। শুনলাম, অতিরিক্ত তুষারপাতের জন্যে অমরনাথের যাত্রাপথ অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। মনটা দমে গেল, এযাত্রায় বোধহয় অমরনাথ দর্শন সম্ভব হবেনা। মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে বললাম, ‘এতদূরে নিয়ে এসে ফিরিয়ে দিওনা ঠাকুর’। মনে জোর এল- বললাম, ‘যত বিপজ্জনকই হোক, লোকের কথা শুনে আমরা ফিরে যাবনা- শেষ দেখবই’। দেখলাম সকলেই একমত আমার সঙ্গে। রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে আমরা অমরনাথ যাত্রা পথের অত্যাবশ্যক জিনিষগুলি গুছিয়ে নিলাম। সকলের মধ্যেই যে কি উৎসাহ, তা বলে বোঝাতে পারবনা।

অমরনাথ দর্শন হবে তো! এই ভাবনা মনে নিয়ে পরদিন সকালে আমরা বাসে চড়লাম, পহলগাঁও যাওয়ার জন্যে। পথে আপেলের গাছে ছোট ছোট আপেল ধরে আছে। আখরোট গাছও দেখলাম, গাছে ফুল নজরে এলনা, তবে দেখলাম ফুলের মত ফুটফুটে বাচ্চা, তাদের দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। পাহাড়েরই সন্তান কাশ্মীরী ও নেপালি...কিন্তু কত পার্থক্য তাদের চেহারাতে, পরম করুণাময় ঈশ্বরের কি অপূর্ব সৃষ্টি।

পহলগাঁওএর প্রাকৃতিক দৃশ্যে আমরা মোহিত হয়ে গেলাম। খাওয়ার পরে বেড়াতে বেরলাম। শহরের একদিকে হোটেল, কটেজ, বাড়িঘর আর অন্যদিকে বয়ে চলেছে শহরের প্রাণধারা, নদী লিডার বা নীলগঙ্গা। লিডারের ধারে ঘাসে ছাওয়া সবুজ প্রান্তর আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে পাহাড়ে মিশেছে। সেখানে পাইনের সারির মাঝে মাঝে আলো ছায়ার খেলা। শহরের সুখে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য পাই, কিন্তু প্রকৃতির স্নেহছায়ায় যে শান্তি পেলাম, শত চেষ্টা করলেও শহরে তা পাওয়া যাবেনা। বহুক্ষণ লিডারের ধারে বসে তার অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

কোলাহাই হিমবাহ থেকে নেমে আসা লিডার নদী

লিডার নদীর সৃষ্টি হয়েছে পহলগাঁও থেকে ২২ মাইল দূরে, কোলাহাই হিমবাহে। স্থানীয় নাগরিকদের কাছে নদীটির নামকরণের কারণ সম্বন্ধে অবহিত হলাম...আসে পাশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে অনেক নদীই সমতলে অবতরণ করেছে, কোলাহাই হিমবাহ নিঃসৃত নদীটি তাদের নেতা- তাই লিডার। লিডারের তীর ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। বেশ দূরে মাঠের মধ্যে একটি তাঁবু দেখতে পেলাম। কাছাকাছি পৌঁছতেই, একজন সন্ন্যাসী আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁবুর ভেতরে। গুরুস্থানীয় একজন সন্ন্যাসী বসে আছেন, আর তাঁকে ঘিরে কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের জামাইবাবুকেও বসে থাকতে দেখলাম। তীর্থযাত্রার আগে সন্ন্যাসী দর্শন শুভ। আমরা তাঁর চরণ স্পর্শ করে, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আমরা অমরনাথ দর্শনে চলেছি, সফল হব তো?’ তিনি হেসে বললেন, ‘কেন পারবিনা? মুখে নমঃ শিবায় বলবি, খারাপ পথ দেখলে ঘোড়া থেকে নেমে পড়বি। কোনও ভয় নেই’। তাঁর দেওয়া শিব মন্ত্র আমাদের মন থেকে সব ভয় দূর করে দিল। শিষ্যের আনা মা বিন্ধ্যবাসিনীর প্রসাদ ও চানাচুর তিনি নিজে হাতে আমাদের সবাইকে দিলেন।

জামাইবাবুর কাছে জানলাম- ইনি একজন বাঙালি সাধু, নাম স্বামী বিমলানন্দ। প্রায় প্রতি বছরেই তিনি পায়ে হেঁটে অমরনাথ দর্শনে যান, এবারে যাচ্ছেন না। মনে যেটুকু নৈরাশ্য এসেছিল, ওনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে সব দূর হয়ে গিয়ে মন আবার উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ভরে উঠল। হোটেলে ফেরার পথে, অমরনাথ যাত্রায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী- কেডস জুতো, লাঠি, বালাক্লাভা এবং পথের জন্যে কিছু শুকনো খাবার সংগ্রহ করলাম। খাবার জিনিষ কেনার ব্যাপারে রেখাদি ছিলেন সবার অগ্রণী। কার কি দরকার, আগে থেকে চিন্তা করে এমনভাবে নিজেকে তৈরি রাখতেন, আমরা এই যাত্রাপথে কখনও কোনও অসুবিধা ভোগ করিনি। নীলিমাদিও তাঁকে সবসময় সাহায্য করতেন।

ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আজ আমাদের যাত্রা শুরু হবে অমরনাথের পথে। মনে মনে দেবাদিদেবকে স্মরণ করে প্রার্থনা জানাই-‘হে রুদ্রনাথ, তুমি কি শুধুই সংহারক, তুমি কি রক্ষক নও? হে আশুতোষ তুমি আমাদের প্রতি তুষ্ট হয়ে এই বিপদসংকুল পথ বিপদমুক্ত করে তোমার কাছে নিয়ে চল প্রভু’। বাইরে বেরিয়ে দেখি, ঘোড়াওয়ালারা ঘোড়া নিয়ে হাজির। স্তূপীকৃত মালের সামনে বসে অশোকবাবু মাল ওজন করাচ্ছেন। মালগুলি পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। আমার ঘোড়াওয়ালাটিকে দেখে খুব ভাল লাগল, যেন দেবশিশু। তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে, নাম গুলাম মহম্মদ। কিন্তু চিন্তায় পড়ে গেলাম, তার বয়েস মাত্র ১১/১২ বছর। দীর্ঘ অমরনাথ যাত্রা পথের সঙ্গী হিসেবে ভাবতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। যাই হোক, দেবাদিদেবকে স্মরণ করে তার শরণ নিলাম। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে আর এক বিপত্তি, জীবনে কখনও ঘোড়ায় চড়িনি। দুরুদুরু বক্ষে ঘোড়াগুলির মালিক মকবুলের সাহায্যে কোনরকমে ঘোড়াতে চড়লাম...একবার এইদিকে হেলে পড়ি তো আরেকবার ওদিকে।

শ্রাবণী পূর্ণিমায় অমরনাথের মূল যাত্রা হয়। আমরা এসেছি আষাঢ়ী পূর্ণিমা বা গুরু পূর্ণিমাতে অমরনাথের দর্শনের অভিলাষ নিয়ে, তাই ছড়িযাত্রা দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হব আমরা। স্থানীয় লোকেদের কাছে শুনলাম, প্রতি বছর শ্রাবণী শুক্লা চতুর্থীতে শ্রীনগরের দশনামী আখড়া থেকে ছড়িযাত্রা শুরু হয়, অমরনাথের গুহায় এই ছড়ির প্রবেশাধিকার সর্বাগ্রে। রূপার পাতে মোড়া দুটি লাঠি ও একটি ত্রিশূলই হরপার্বতীর প্রতিনিধি, তাই এই বিশেষ যাত্রা।

‘জয় বাবা অমরনাথজী কী জয়’ ধ্বনিতে চারিদিক পবিত্র হয়ে উঠল- কেউ মুখে বলল, কেউ মনে। আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত যাত্রা হল শুরু। ঘোড়াগুলি একে একে পথে নামল। মনে মনে ‘ওম নমঃ শিবায়’ জপ করতে করতে চললাম। খানিকটা রাস্তা চলার পরে মনে হল কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আগের মত আর অত ভয় করছিল না। শহর ছেড়ে পৌঁছলাম লিডার নদীর ধারে, এই নদীর তীর ধরেই এখন আমাদের চলতে হবে। সামনে পেছনে যতদূর নজর যায়, কেবল যাত্রীর সারি। পদযাত্রীদের আগেই রওনা করিয়ে দিয়েছেন আশোকবাবু, পহলগাঁও থেকে ১০ মাইল হেঁটে চন্দনবাড়ী পৌঁছতে তাদের সময় লাগবে।

আমাদের পোষাকের বাহার দেখার মত। প্রায় সবাই শাড়ীই পরেছে, ঘোড়ায় চড়তে হবে তাই এবং ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্যে শাড়ীর নীচে ড্রয়ার, পায়ে মোজা ও কেডস। গায়ে উলের ব্লাউজের ওপরে কার্ডিগান আর মাথায় বালাক্লাভা। সহযাত্রীদের মধ্যে অনেকেই সালোয়ার- কামিজ, প্যান্ট ইত্যাদি পরেছিলেন। আমাদের কাকিমার সাজ হয়েছিল সবচেয়ে জমকাল। তিনি ব্রঙ্কাইটিসের রোগী, প্রায়ই ভোগেন। তাঁর খেলোয়াড় পুত্র মাকে তার লাল রঙের ট্র্যাক সুট দিয়েছে, যাতে তিনি ঠাণ্ডায় কষ্ট না পান। সেই পোশাক ও বালাক্লাভা পরে তিনি যখন ঘোড়ায় চড়তেন, আমি তাঁকে ভাস্কো ডা গামা বলে ডাকতাম। উনি মজা পেতেন, কখনও রাগ করতেন না।
পাহাড়ি পথে ঘোড়ায় চড়া যেমন কষ্টকর, তেমনই বিপজ্জনক। প্রতি মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার ভয়। আমার অতি প্রিয় পাহাড় শ্রেণীর অপরূপ রূপ উপভোগ করার সুযোগই পাচ্ছিলাম না। এগিয়ে চললাম...বাঁ দিকে নৃত্যরতা লিডার, ডানদিকে ঘন জঙ্গল আর মাঝে মাঝে বাড়িঘর। আমাদের দেখে ফুলের মত সুন্দর বাচ্চারা তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, হাত বাড়িয়ে বলে ‘পয়সা’। ঘোড়ার পিঠে বসা, সঙ্গে খুচরো পয়সাও বেশী ছিলনা। দু একটি করে লজেন্স তাদের হাতে দিতেই মহাখুশী হয়ে তারা চলে যায়।

ফুলের মত ফুটফুটে বাচ্চা

পথটি এবারে বাঁয়ে ঘুরল, উৎরাই পথ বেয়ে লিডার নদীর তীরে নেমে এলাম ও কাঠের পুল পেরিয়ে অপর পারে পৌঁছলাম। এবারে লিডার আমাদের ডানদিকে, সামনে চড়াই। কিছুটা হাঁটার পরে চড়াই শেষ হল, আমরা পৌঁছলাম প্রায় সমতল একটি সঙ্কীর্ণ অধিত্যকায়। পহলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ীর রাস্তা মোটামুটি ভালো, জীপ বা ট্যাক্সিতেও যাওয়া যায়। আমরা চন্দনবাড়ী পর্যন্ত জীপে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু মন্টু বলল,’ পহলগাঁও থেকে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় ঘোড়া পাবেন কিন্তু চন্দনবাড়ী থেকে ঘোড়া পেতে অসুবিধে হয়, পেলেও ভাড়া অনেক বেশী চায়’।

লিডার তার সুনীল ফেনিল উচ্ছলতায় আমাদের সাথে সাথে চলল। পথের অন্য ধারে পাহাড়ের সারি ঘন জঙ্গলে ঢাকা। নানা জাতের ফার্ন, নাম না জানা লাল- নীল- হলুদ অনেক রকম ফুল। ভেড়ার পাল নিয়ে দলে দলে চলেছে নানা বয়েসী নারী- পুরুষ...এরাই কি গুর্জর? এদেরই মত একজন যাযাবর গুর্জর আক্রাম বাট মল্লিক ভেড়া চরাতে বেরিয়েছিলেন। একটি ভেড়া হারিয়ে যাওয়ায়, তাকে খুঁজতে খুঁজতে আক্রাম গিয়ে পৌঁছলেন অমরনাথের গুহাতীর্থে। তিনি ভেড়া খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি কিন্তু দর্শন পেয়েছিলেন অমরনাথের তুষারলিঙ্গের। কথিত আছে, পূণ্যার্থীরা অমরনাথের উদ্দেশ্যে যা কিছুই দেন, তার তিন ভাগ করা হয়। একভাগ পান ছড়ির মহান্ত, একভাগ পান অমরনাথের পূজারীরা আর তৃতীয় ভাগটি যায় আক্রাম বাটের বংশধরদের কাছে। হিন্দু-মন্দিরে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশাধিকার নেই, তাদের স্পর্শ করা খাদ্য বস্তু আমরা গ্রহণ করতে চাইনা, তারাও আমাদের দেওয়া কিছু খায়না। জানা নেই কে কবে এই বিভেদের সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু মুসলমান, আক্রাম বাটই সর্বাগ্রে অমরনাথের দর্শন পেয়েছিলেন- এর ব্যাখ্যা কার কাছে পাওয়া যাবে? ভগবানের কাছে তাঁর সন্তান- মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই।

উঠে এসেছি অনেকটা ওপরে। পথের পাশেই সুগভীর খাদ, ঝোপে ঝাড়ে বোঝাই। অনেক নীচে বয়ে চলেছে লিডার, বড় সুন্দর লাগছিল দেখতে- সাদা পাথর ও বালির ওপর দিয়ে এঁকে বেঁকে যাওয়া একটা নীল রেখা যেন।

বিকেলেই আমরা চন্দনবাড়ী পৌঁছে গেলাম। চন্দনবাড়ী উপত্যকায় একটি নদী পার হতে হল। বাঁদিকের পাহাড় থেকে নেমে নদীটি লিডারের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীটির নাম জলজপট। ঘোড়া থেকে নেমে আমাদের এই পুল পার হতে হল। পুলটির অবস্থা খুবই খারাপ, যাত্রীদের সুবিধের জন্যে পুলটির নীচে শিকড় সমেত প্রকাণ্ড একটি গাছের সাহায্যে তাকে মজবুত করা হয়েছে।

উপত্যকাটি বড় সুন্দর, চারিদিকে সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা- তাদের চূড়াগুলি তুষারাবৃত। পপলার ও উইলো গাছ এবং নাম না জানা নানাবিধ ঝোপঝাড়ে ভরা এই উপত্যকাটির এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য তাঁবু। বিভিন্ন ট্র্যাভেলসের ব্যানার দিয়ে তাঁবুগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমাদের বন্ধুরা অনেকেই আগে পৌঁছে গেছেন, তাঁবুর দখল নিয়ে খাটিয়ায়- বিছানা পেতে তাঁরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা মহানন্দে বিছানাতে আশ্রয় নিলাম। ঘোড়ার পিঠে দশ মাইল পথ অতিক্রম করার পরে সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছিল। বড়দি ও জামাইবাবুকে খুব ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখে আমরাও বাইরে এলাম। জামাইবাবুর দাদা- বৌদির ডান্ডি তখনও এসে না পৌঁছনোয় তাঁদের খুব চিন্তিত দেখলাম। একটু পরেই দাদার ডান্ডি এসে পড়লেও বৌদির দেখা নেই। তাঁর আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। পাল্কিতে আসা নতুন বৌয়ের মত আমরা তাঁকে উলুধ্বনি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালাম, সকলে নিশ্চিন্ত হলাম।

কিছুদূরে একটা বড় গ্লেসিয়ার দেখা যাচ্ছিল। মন্টুর কাছে জানতে পারলাম, ঐ গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়েই আমাদের শেষনাগ যেতে হবে। রাতের খাবার, গরম গরম খিচুড়ি আর পাঁপর ভাজা যে কি অপূর্ব লেগেছিল তা আর বলার নয়।

পরদিন খুব ভোরে উঠলাম- শেষনাগ যেতে হবে। তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি মাঠের মাঝে কয়েকজন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, পাশে আগুন জ্বলছে। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে, কোনও আচ্ছাদন ছাড়াই এই ঠাণ্ডায় শুয়ে থাকার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থাকেনা, অমরনাথ দর্শনের ঐকান্তিক ইচ্ছেই বোধহয় তাঁদের এই সহ্যক্ষমতা যুগিয়েছিল। ঘোড়াওয়ালারা তাড়া দিচ্ছিল। আমার বাচ্চু ঘোড়াওয়ালা আমাকে ঘোড়ায় চড়ার কায়দা কানুন কিছুই শেখায় নি। পথে একজন পথচারী আমাকে লাগামের ব্যবহার শিখিয়েছিলেন, তবে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল। পরে জেনেছিলাম যে খাড়াই পথে ওঠার সময়ে শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখতে ও রেকাব শুদ্ধু পা পেছনের দিকে ঠেলে রাখতে হয়...’বদন আগে প্যায়ের পিছে’। আবার উৎরাইয়ের সময়, ঠিক বিপরীত অর্থাৎ ‘বদন পিছে ঔর প্যায়ের আগে’। কায়দাটি অজানা থাকায় বার বার ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থায় ছিলাম। অমরনাথের দয়ায় কোনরকমে সামলে নিয়েছিলাম, পরে আর অসুবিধে হয়নি। পদযাত্রীরা আগে রওনা হলেও অশ্বারোহীরা তাদের সঙ্গেই চলছেন। মাঝে মাঝেই ঘোড়াওয়ালাদের ‘হৌস’ ও ‘বাচো’ হুঙ্কারে পদযাত্রীরা হুঁশিয়ার হয়ে যাচ্ছিলেন। ঘোড়ার জন্যে তাঁদের পথ চলতে বেশ অসুবিধেই হচ্ছিল। পার্বত্য পথে পায়ে হেঁটে চলাই ভাল, নিরাপদে অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি উপভোগ করতে করতে যাওয়া যায়। ঘোড়াগুলি কেবল খাদের পাশ দিয়েই চলতে চায়, নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘুরে যায়।

একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছলাম। পথটি পাহাড়র গা বেয়ে এঁকে বেঁকে ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে। গুলাম মহম্মদ জানাল, এর পরেই ‘পিসুটপ’। প্রতিটি ধাপে সারি সারি ঘোড়সওয়ার ও পদযাত্রী। সমুদ্র ও পাহাড় আমাকে সবসময় আকর্ষণ করে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ যেমন ভয়ঙ্কর তেমনই সুন্দর। পাহাড়ের ধাপগুলিকে দেখেও তাইই মনে হচ্ছিল, ভয়ঙ্করের এত সৌন্দর্য। নীচ থেকে বিভিন্ন পোষাকে সজ্জিত যাত্রীদের দেখে মনে হচ্ছিল রুদ্রনাথ যেন গলায় অসংখ্য মালা পরে ধ্যানস্থ...আমাদের পদশব্দে তাঁর ধ্যানভঙ্গ হবেনা তো?
পিসু চড়াইয়ের উচ্চতা ১৫০০ ফুট কাশ্মীরী শব্দ ‘পিসর’ মানে পিচ্ছিল। আমার ঘোড়াওয়ালা অতি সন্তর্পণে আমাকে এই সঙ্কট- সঙ্কুল পাহাড়ি পথ অতিক্রম করালো। প্রখ্যাত পরিব্রাজক- সাহিত্যিক প্রবোধ কুমার সান্যালের লেখা পড়ে জেনেছি শেখ মহম্মদ আবদুল্লাহ, পণ্ডিত নেহরু আর সীমান্ত গান্ধীকে শেষনাগের সৌন্দর্য দর্শন করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পন্ডিতজী পিসু পার হতে না পারায়, তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়ে ওঠেনি। পিসু চড়াই পার হয়ে আমরা প্রায় সমতল সবুজ প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম। পথশ্রমে ঘোড়াটিও খুব ক্লান্ত, তাকে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হল। আমি আমার আর কোনও সাথী কে খুঁজে না পেয়ে গুলামকে নিয়ে চা খেতে গেলাম। এই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে তারও খুবই পরিশ্রম হয়েছে, সারাক্ষণ আমার পাশে পাশে থেকে, আমাকে সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। গুলাম আর আমি হোটেলওয়ালার পেতে দেওয়া চাটাইয়ে বসে চা খেলাম। গুলাম গেল তামাক খেতে, এখানে ছোট বড় সকলেই তামাকে অভ্যস্ত। গুলামের তামাক খাওয়া দেখে বড় মজা লাগল। এদেশের হুঁকোর গড়ন ভারী অদ্ভুত...নীচের অংশটি আমাদের ছোট কুঁজোর মত, মাথার ওপরে কল্কে বসান আর গলার কাছে একটি ফাঁপা নল, যার সাহায্যে তামাক খাওয়া হয়।

আবার যাত্রা শুরু হল, সবুজ প্রান্তরটি দুপাশের পাহাড়ের সঙ্গে মিশেছে, মাঝের পথটি ধরে আমরা যাব যোজিপাল। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের থেকে কাশ্মীরের পাহাড়ে পাথর কম মাটি বেশী, তাই এখানে সবুজের এত সমারোহ। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে জানলাম- শীতকালে এই প্রান্তর বরফে সাদা হয়ে যায়। যোজিপালে কয়েকটি যাত্রীনিবাস থাকলেও সেখানে কেউ রাত্রিবাস করেনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচবার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এবারে আমাদের গন্তব্য শেষনাগ। দূর থেকেই তাঁবুর সারি দেখে বুঝলাম, এসে গেছি। ব্যানার দেখে নিজেদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের জন্যে বরাদ্দ ১ নং তাঁবুতে পৌঁছে দেখি, কমলাদি ও কৃষ্ণা আগেই এসে গেছে আর তাঁবুর ব্যবস্থাপক রসিদ ভাইয়ের সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। কৃষ্ণা এই ব্যাপারে খুবই ওস্তাদ, সে তার মিষ্টি হাসি ও কথা দিয়ে সকলের সঙ্গেই বেশ তাড়াতাড়ি ভাব জমিয়ে নিতে পারে। আমাদের তাঁবুর সদস্যদের মধ্যে কখনও মনান্তর হয়নি, দিনগুলি বড় আনন্দে কেটেছিল।

নিজেদের তাঁবুতে বসে আমরা আমাদের এক সহযাত্রী বন্ধুকে দিয়ে ভবিষ্যৎ গণনা করাচ্ছিলাম, এমন সময়ে দেখি একটি লোক হাতে বর্ষাতি ও টুপি, আমাদের তাঁবুতে ঢুকে রেখাদির বর্ষাতিটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে ব্যাপারটা আগে বুঝে উঠতেই পারিনি, কিন্তু তাড়াতাড়ি লোকটির হাত থেকে রেনকোটটি কেড়ে নিয়ে রেখাদিকে ডাকতে থাকি। রেখাদি কিছু না বুঝেই, লোকটির হাত থেকে টুপিটা কেড়ে নিয়ে বলতে থাকেন, ‘তোম চোর হ্যায়’। টুপিটা যে তাঁর নয়, রাগের মাথায় তা তিনি খেয়ালই করেননি। গোলমাল শুনে রসিদ ভাই ও মন্টু এসে হাজির। সকলের মধ্যস্থতায় স্থির হল যে বর্ষাতিটি রেখাদির। সম্ভবত: ঘোড়াওয়ালা তার মালিকের রেনকোটটা হারিয়ে ফেলেছে আর দুর্ভাগ্যক্রমে দুটো বর্ষাতিই একরকম দেখতে। ভুল বুঝতে পেরে তাঁরা আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন, রেখাদিও টুপিটা তাঁদের ফিরিয়ে দিলেন।

শেষনাগ...কাশ্মিরী ভাষায় নাগ শব্দের অর্থ জলাশয়

শেষনাগ হ্রদ দেখতে গেলাম, তবে অনেক দূর থেকে। পথের গা ঘেঁসে বাঁদিকে খাড়া পাহাড় আর ডানদিকে অনেক নীচে নদী, যা গিয়ে পড়েছে একটি হ্রদে- ঘন নীল তার রঙ। এই হ্রদ থেকেই লিডার নদী বা নীল গঙ্গার উৎপত্তি হয়েছে। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নদী তার চলার পথ করে নিয়েছে। কাশ্মীরী ভাষায় ‘নাগ’ শব্দের অর্থ জলাশয়। কেদারনাথ দর্শনের সময়ে পথে সেরকম বরফ দেখতে পাইনি বলে মনে খুব দুঃখ ছিল, অমরনাথের যাত্রা পথে সে দুঃখ আমার দূর হয়ে গেছে, আসে পাশে চারিদিকেই বরফ জমে আছে।

আমাদের তাঁবুর একটু দূরে দেখলাম ‘রেড ক্রস’ এর তাঁবু। সেখানে বিশিষ্ট ডাক্তাররা ওষুধপত্র নিয়ে যাত্রীদের চিকিৎসার জন্যে উপস্থিত রয়েছেন। আমরা এসেছি অমরনাথ দর্শন করে পুণ্য সঞ্চয় করতে, ওঁরা এসেছেন ওঁদের অমূল্য সময় ব্যয় করে আর্তের সেবা করতে। এর থেকে বড় পুণ্য আর কি হতে পারে? ইতিমধ্যে একটি মেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে, ডাক্তারবাবুরা এসে তাকে স্ট্রেচারে করে তাঁদের তাঁবুতে নিয়ে গেলেন, তার চিকিৎসার জন্যে। শেষনাগের উচ্চতা ১২৫০০ ফুট, এই উচ্চতায় অনেকেরই শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা যায়।

শেষনাগ আসলে একটি হিমবাহ অঞ্চল। শীতকালে পুরো শেষনাগই বরফে ঢেকে যায়, তাছাড়া এখানে সর্বদাই প্রবল বাতাস বইতে থাকে, তাই এই উপত্যকার অপর নাম ‘বায়ুযান’। কাশ্মীরীরা বলেন ‘ওয়ারয়ান’। অশোকবাবু বলে গেলেন, ‘রাতের বেলা চাঁদের আলোয় শেষনাগকে দেখবেন, এই দৃশ্য আর কখনও দেখতে পাবেন কিনা সন্দেহ’। সময়টা ছিল পূর্ণিমার কাছাকাছি। চাঁদের আলো পুরোপুরি শেষনাগের জলে এসে পড়েছে। সে যে কি অপরূপ দৃশ্য তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। শিল্পীর হাতের আঁকা ছবি দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হই, ভুলে যাই যে প্রকৃতিদেবীই তাদের শিল্পী করে তুলেছেন। আর যে শিল্পীর ছোঁয়ায় প্রকৃতি এই অপরূপ সজ্জায় সজ্জিত হন, তাঁর শিল্পসৃষ্টি আমাদের মূক করে দেয়, মনে মনে বলি-‘করুণাময়, তোমার অপার করুণায় আমি যা দেখলাম, তা চিরদিন আমার মনে আঁকা থাকবে। কবিগুরুর দুটি কলি মনে পড়ে যায়...’কেমনে বর্ণিব তোমার রচনা, কেমনে রটিব তোমার করুণা’।

দুর্গম পথ বেয়ে চলতে চলতে কৃষ্ণা একদিন মজা করে বলল, ‘শিবঠাকুর পার্বতীকে অমরকাহিনী শোনাবার আর যায়গা পেলেননা, কলকাতা কি দোষ করল?’ দীপাদি আমাদের গল্প শোনাতে আরম্ভ করলেন, ‘নারদের পরামর্শে পার্বতী শিবকে অমরকথা শোনাতে বলেন। এই কাহিনী যে শুনবে সেই অমর হবে, তাই পার্বতীকে নিয়ে শিব অমরনাথ পাহাড়ের এক অপরূপ গুহাতে গেলেন, শেষনাগে তাঁর গলার সাপটিকেও রেখে গেলেন, সেও যেন এই কাহিনী শুনতে না পায়। এই খবর দেবতারাও পেলেননা। কাহিনী শুরু করার আগে শিব বললেন, ‘পার্বতী, অমরকথা শুনতে শুনতে যেন তুমি ঘুমিয়ে পড়োনা, ঘুমোলেই আমি কথা শোনান বন্ধ করে দেব। আমি চোখ বন্ধ করে গল্প শোনাব, তুমি যে জেগে আছ তার প্রমাণস্বরূপ তুমি মাঝে মাঝে হুঁ হুঁ করে যাবে’। পার্বতী সম্মত হলে শিব শুরু করলেন অমরকথা। কথা শেষ হলে শিব দেখেন পার্বতী সমাধিস্থা, কে তাহলে আওয়াজ করল? গুহার এক কোনে একটি শুক পাখীকে দেখে ক্রুদ্ধ রুদ্রনাথ ত্রিশূল নিয়ে তাকে হত্যা করতে গেলেন। সেই শুক আসলে গোলকের লীলাশুক। কৃষ্ণের খোঁজে উড়তে উড়তে শ্রান্ত পাখীটি এই গুহায় আশ্রয় নিতে গিয়ে শিব- পার্বতীকে দেখতে পায়। অমরকথা শোনার লোভে পার্বতীর আওয়াজ নকল করে শিবকে ছলনা করে। রুদ্রনাথের ভয়ে ভীত শুক উড়ে গিয়ে পৌঁছয় বদ্রিকাশ্রমে। ব্যাসদেবের স্ত্রী বটিকাদেবী, স্নানান্তে সরস্বতী নদীর তীরে সূর্য প্রণাম করছিলেন। প্রণাম শেষে উনি যেই হাই তুলেছেন, শুকটি তাঁর দেহে প্রবেশ করে। আশুতোষ শুকের বুদ্ধি, কষ্টসহিষ্ণুতা ও জ্ঞানলাভের আগ্রহ দেখে তুষ্ট হন। বটিকা দেবীকে আশীর্বাদ করে বলেন, ‘এই শুক তোমার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করবে, সে হবে ব্রহ্মজ্ঞানী’। এই শুকই ব্যাসদেব পুত্র শ্রী শুকদেব।

মন্টুর কাছে শুনলাম, সে শেষনাগের কাছে পঞ্চমুখী নাগের দেখা পেয়েছে। আগেই শুনেছিলাম, অমরনাথের ছড়ি যাত্রার সময় পূজারীরা একটি নির্দিষ্ট পাথরের ওপরে ছড়ি রেখে স্নান ও পূজা সমাপন করেন; সেই সময়ে একটি পঞ্চমুখী সাপ শেষনাগ থেকে উঠে আসে ও মোহান্তজীর দেওয়া খাবার খেয়ে ফিরে যায় শেষনাগের জলে। অবিশ্বাসী মন, বিশ্বাস করতে চায়না এই সব গল্প...সাপ ‘শীতল শোণিত’ প্রাণী, তার পক্ষে অত ঠাণ্ডায় থাকা সম্ভবই নয়, কিন্তু দেবতার মহিমায় কী না হতে পারে?

যতদূর চোখ যায়, শুধু বরফ

পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু হল, এবারের গন্তব্য পঞ্চতরণী। মাঝে মহাগুণাস গিরিবর্ত্ম পার হতে হবে। বায়ুযান উপত্যকা শেষ হল, শুরু হল চড়াই। খাড়া পাহাড়ের ওপরে তুষারপাতের ফলে চড়াই অনেক কমেছে বটে কিন্তু বিপদ বেড়েছে। এই অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে যে এরকম ভয়ঙ্করতা লুকিয়ে থাকতে পারে তা ভাবতেও পারিনি। যতদূর দেখা যায় শুধু বরফ আর বরফ, পথ বিপদসংকুল নিশ্চয়ই কিন্তু বাবা অমরনাথের কৃপায় যা দেখলাম তা জীবনে আর কোনদিন দেখতে পাব কিনা জানিনা। আমাদের চলার পথ পেঁজা তুলোর মত বরফে ঢাকা। বরফ গলতে শুরু করেছে, ওপরের অংশ নরম- পা ডুবে যায়। শুনলাম, গত ১৫ বছরের মধ্যে এরকম বরফ পড়েনি। চলেছি ভয়ে ভয়ে...চারিদিকের দৃশ্য এত মনোরম যে নিজের বিপদের কথাও সব সময়ে মনে থাকছেনা। পদচারীদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বরফের ওপরে পথচলা খুবই বিপজ্জনক, ঘোড়াদের যাতায়াতে তা আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

এবারে নীচে নামার পালা। ঘোড়াওয়ালারা আমাদের ঘোড়া থেকে নেমে যেতে বলল, বরফে ঢাকা উৎরাই পথে ঘোড়ার পিঠে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের ঘোড়াওয়ালারা লাঠি ও ঘোড়া নিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, দেখতেই পেলাম না। হাতে লাঠি না থাকায় চলতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। পথচারীরা শিখিয়ে দিলেন, চলার সময়ে আগে পায়ের গোড়ালি ফেলতে হবে। মাঝে মাঝেই এই উপদেশ ভুলে গিয়ে আছাড় খেতে থাকি। আমার দুরবস্থা দেখে এক ভদ্রলোক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, তাঁর হাত ধরে কিছুটা চললাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা ঘোড়ায় যাচ্ছেন না কেন?’ বললাম, ‘ঘোড়াওয়ালারা আমাদের নামিয়ে দিয়েছে’। শুনে উনি খুব রাগ করলেন। মানুষে মানুষে কত প্রভেদ! এই ঘোড়াতে যাওয়া নিয়ে কত বিরূপ মন্তব্য শুনেছি... ‘পয়সা আছে, আরাম করে চলেছে। তীর্থ করতে এসেছ, কষ্ট করনা বাপু’। হেসে উত্তর দিই- ‘ঘোড়ায় চড়ায় কোন আরাম নেই ভাই, এতটা খাড়াই পথ হেঁটে চড়ার ক্ষমতা নেই তাই ঘোড়া নিয়েছি’। আমার কথায় লোকটি লজ্জা পেয়েছিল।

খানিকটা পথ চলার পরেই বরফে পিছলে পড়ে প্রায় ২০ ফুট নীচে গিয়ে থামলাম। যিনি আমার হাত ধরে সাহায্য করছিলেন, আমার সঙ্গে তিনিও পড়ে গিয়েছিলেন কিনা দেখতে পাইনি। এই পড়ে যাওয়া আমার কাছে বাবা অমরনাথের আশীর্বাদের মত এল, যেখানে এসে থামলাম, দেখলাম সেখানেই উৎরাই শেষ, একটুও ব্যথা পাথা পাইনি। এর পরে আর কোন অসুবিধে হয়নি। আমাকে ছাড়িয়ে এক সাধু হেঁটে চলে গেলেন, খালি গায়ে শুধু একটি পাৎলা চাদর জড়ানো, খালি পা...অবাক হয়ে ভাবি ভক্তিতে বোধহয় সবই সম্ভব। ‘পোষ পত্থরে’ পৌঁছনোর পরে আমাদের অন্যান্য সঙ্গী আর ঘোড়াওয়ালাদের সঙ্গে দেখা হল। এটিই পোষ পত্রী (meadow of flowers)। প্রান্তরটি ভারী সুন্দর। ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে অজস্র ফুল। ঘোড়াওয়ালাদের হাতে দেখলাম জুনিপারের গাছ। অমরনাথ পর্বতের এই ছোট ছোট জংলী গাছগুলির পাতায় ধূপের গন্ধ ও সেগুলি তৈলাক্ত, ফলে তুষারের আক্রমণ থেকে তারা রক্ষা পায়। পাতাগুলি কাঁচা অবস্থাতেও জ্বলে তাই গরীব পাহাড়িদের জ্বালানীর প্রয়োজন মেটায়, মা প্রকৃতির দয়া।

আকাশ মেঘমুক্ত, নির্মল- বেশ চড়া রোদ উঠেছে কিন্তু কোন কষ্টই হচ্ছেনা। চড়াই পেরিয়ে পৌঁছলাম, প্রায় সমতল একটি সবুজ উপত্যকায়- ‘মহাগুনাস টপ’ (১৪৫০০ ফুট)। অপূর্ব এক ঝর্ণার দর্শন পেলাম। আবার নীচে নামার পালা। ১৩৫০০ ফুট উচ্চতায় ‘ওয়াফবল টপ’, এই ওঠা নামাই অমরনাথ যাত্রা পথের বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক সমতলেই চা এর দোকান আছে। পথে শুধু চা নামের গরম জল খেয়েই শক্তি অর্জন করি। ঘোড়াওয়ালারা খায় ‘নমক চায়’। গন্তব্য স্থল যত এগিয়ে আসতে থাকে, ঘোড়ায় চড়ার কষ্ট যেন ততই বাড়তে থাকে, মনে হয় কতক্ষণে নামব। দূরে তাঁবুর সারি দেখে ধড়ে প্রাণ আসে...পৌঁছলাম পঞ্চতরণী। ভীমা। ভগবতী, সরস্বতী, ঢাকা ও বর্গশিরা...এই পাঁচটি নদী বিধৌত উপত্যকা এটি। অমরনাথ গুহা আর মাত্র ৪ মাইল। ঘোড়াওয়ালারা উৎসাহিত করলেও আমরা পথশ্রমে এতই ক্লান্ত ছিলাম যে আর ঘোড়ায় চড়ার কথা ভাবতেই পারছিলাম না। মন্টুও বারণ করল। আমাদের সঙ্গীরা অনেকেই রওনা হয়ে গেলেন। তারপরেই নামল প্রচণ্ড বৃষ্টি, পাহাড়ি পথ হয়ে উঠেছিল আরও বিপজ্জনক। যাত্রীরা খুবই বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টির জল পড়ে আমাদেরও লেপ তোষক ভিজে গিয়েছিল।

অবশেষে এল সেই আকাঙ্ক্ষিত দিনটি, আজ আমরা দর্শন পাব অমরনাথের। কোন কষ্টকেই আর কষ্ট বলে মনে হচ্ছিল না। পঞ্চতরণীর পাঁচটি ধারা মিলিত হয়ে বয়ে চলেছে, তারই তীর ধরে আমাদের পথ। সবাই মিলে সার বেঁধে এগিয়ে চলেছি, বিপরীত দিক থেকেও দর্শন শেষ করে ফিরে আসছেন অনেক যাত্রী। এতদিনের যাত্রাপথে আকাশ নির্মেঘ থাকলেও এবারে মাঝে মাঝেই মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল আকাশ। সূর্যদেব যেন আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন। একমনে অমরনাথকে স্মরণ করে অচঞ্চল মনে এগিয়ে চললাম। অনেকটা চড়াই পার করে সমতলভূমি ‘ভৈরবঘাটী’ তে এলাম। এই যায়গার আর একটি নাম সঙ্গম। অমরনাথ থেকে অমরগঙ্গা এসে পঞ্চতরণী নদীর সাথে মিলে বয়ে চলেছে বলতালের দিকে, দুটি মিলনস্থল তাই নাম সঙ্গম। সোনমার্গ থেকে বলতালের পথেও অমরনাথ আসা যায়, সময় কম লাগে কিন্তু পথ বড়ই দুর্গম। অমরগঙ্গার দেখা পেলাম, তবে অনেকটাই বরফে ঢাকা। নদীর ওপারে অনেকটা উঁচুতে অমরগুহার দেখা মিলল, চোখে জল এসে গেল...মনে মনে বললাম, ‘ঠাকুর তোমার দর্শন পাব তাহলে?’ শরীরের শক্তি ও মনের বল বেড়ে গেল। আর যেন তর সয় না, কখন পাব দেখা আমার প্রাণের ঠাকুরের...

অমরগুহার দেখা পেলাম, মনোবল বেড়ে গেল

পাহাড়ের গা বেয়ে পুল পেরিয়ে অমরগঙ্গার অপর পারে পৌঁছলাম। গুহা আবার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। পথ পুরো বরফে ঢাকা, তবে মহাগুনাসের মত সেরকম মারাত্মক নয়। দেখলাম অনেকে অমরনাথ গঙ্গায় স্নান করছেন। পথের ধারে পূজা- সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে আছে স্থানীয় কিছু লোক। তাদের কাছ থেকে কিছু উপকরণ নিলাম, কিছু কিছু তো কলকাতা থেকেই নিয়ে এসেছি। আর দেরী নেই, শুরু হল সিঁড়ি চড়া। আনন্দ ও উত্তেজনায় আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলাম না। বেশ খাড়া সিঁড়ি, মাঝে মাঝে থেমে থেমে চড়তে থাকলাম। হঠাৎ একটা বেশ বড় প্রস্তরখণ্ড আমার পায়ের ওপরে এসে পড়ল, পায়ে সাধারণ কেডস জুতো ও মোজা। ভাবলাম আর বোধহয় অমরনাথ দর্শন হলনা। সবাই বকাবকি করতে লাগলেন একটি ছেলেকে, অসহিষ্ণু সেই ছেলেটি তাড়াতাড়ি দর্শনের ইচ্ছায় সিঁড়ি ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে থাকার ফলেই এই বিপত্তি। বাবার অসীম করুণা, কোনোরকম যন্ত্রণা অনুভব করলাম না। অত বড় পাথর পায়ের ওপরে পড়লে হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। পরে জুতো খুলে দেখেছি আঘাত লাগা যায়গাটি থেঁতলে গেছে। মনে মনে বলি ‘ঠাকুর, কে বলে তুমি সংহারক? হে রুদ্রনাথ, তুমিই আমার রক্ষাকর্তা। তোমাকে জানাই আমার শতকোটি প্রণাম’। সঙ্গীরা বললেন, অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় পা অসাড় হয়ে গেছে, তাই ব্যথা লাগেনি...বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

যাঁদের দর্শন হয়ে গেছে, পরিতৃপ্ত মনে নীচে নেমে আসছেন। সিঁড়ির ধারে উনুনে তৈরি হয়ে চলেছে, চা আর হালুয়া। ভক্তগণ দর্শন সেরে নেমে আসার সাথে সাথে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে চা- হালুয়া আর আম। প্রায় পৌঁছে গেছি হঠাৎ মকবুল এসে বলল, ‘চল দর্শন করো’। আসে পাশে চেনা কেউই ছিলেননা তাই ওকে দেখে যেন হাতে স্বর্গ পেলাম। গুহার ভেতরে সব জলে ভেজা। একফালি বাঁধানো রেলিং ঘেরা যায়গায় ধূপ ও মোমবাতি জ্বেলে দিলাম। গুরুপূর্ণিমাতে দর্শনার্থীর ভিড় খুব বেশী। মকবুল তার দুহাতের বেষ্টনীর মধ্যে আমাকে পরম যত্নে আগলে রাখল, যাতে ভিড়ের ঠেলায় আমি পড়ে না যাই। এক যাত্রীর লাঠির খোঁচায় তার গাল কেটে গেল।
যেখানে আমি পূজা- সামগ্রী স্পর্শ করালাম, তা তুষারে নির্মিত যোনীপীঠ, আমি আকুল আগ্রহে চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজছি, কোথায় তুষারলিঙ্গ! নজর গেল গুহার একেবারে শেষপ্রান্তে, ডানদিকে নীলচে সাদা বরফের লিঙ্গমুর্তি- কি উজ্জ্বল, কি সুন্দর। পূর্ণ লিঙ্গমুর্তি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তখনও লিঙ্গমুর্তি ও যোনীপীঠ যুক্ত হয়নি। আনন্দাশ্রুর নৈবেদ্য দিই দেবাদিদেবকে, মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে থাকি সে অপরূপ মূর্তির সামনে। অপর একটি ঘোড়াওয়ালা, গুহার ওপরের দিকে দুটি পায়রাকে দেখিয়ে বলে- হরপার্বতী। অনেকেই বলেন এই পায়রা দুটিকে পাণ্ডারাই উড়িয়ে আনেন দর্শকেরদের জন্যে।

নীচে নামার পালা। ভাবতে থাকি, অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের ত্রিসীমানায় যে মুসলমানের প্রবেশাধিকার নেই, তারই হাত ধরে পৌঁছেছি অমরনাথে। অমরতীর্থে করুণাময় অমরনাথের সন্তান কেবলই ‘মানুষ’...কোন ভেদাভেদ নেই তাঁর কাছে।

নীচে এসে দেখলাম সবাই খেতে বসেছে, আমিও বসে পড়লাম। নামার পথে এক পুণ্যকামী আমাকে একটি আম দিয়েছিলেন। মকবুলকে দিতেই তা সে আগ্রহভরে নিল, কিন্তু আমাদের খাবারের ভাগ দিতে চাইলে সে কিছুতেই নিলনা। আমার বাচ্চা ঘোড়াওয়ালাকেও খাবার দিয়েছিলাম, আমার ভাগ থেকে। যদিও সে হাত পেতে নিয়েছিল, পরে জানতে পারলাম ঘোড়াকে খাইয়ে দিয়েছে। হিন্দু- দেবতা অমরনাথকে এরা ভক্তি করে, জয়ধ্বনি দেয় কিন্তু হিন্দুর হাতের খাবার খায়না।

এবারে ফেরার পালা। নামার সময়ে দেখি, একযায়গায় বড়দি চোখ বুজে বসে আছেন, দাদার ডান্ডিতে। দাদা ও জামাইবাবুও দাঁড়িয়ে তাঁর পাশে। জানতে চাইলাম কি হয়েছে, প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই নেমে এসেছি অনেকটা, উত্তর পেলাম না, এই পথে পিছন ফিরে দেখার উপায় নেই। পঞ্চতরণীর তাঁবুতে পৌঁছে জানতে পারি যে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বড়দি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, উচ্চ রক্তচাপের রোগী তিনি। একটু পরেই সকলে এসে পড়লেন। রেড ক্রসের ডাক্তারবাবুকে ডাকা হল, তিনি খুব চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘এই রুগীকে এতটা উঁচুতে আনা ঠিক হয়নি। দুদিন বিশ্রামের দরকার’। স্থানীয়েরা আপত্তি জানালেন, যে কোন সময়ে তুষারঝড় শুরু হতে পারে। যেভাবেই হোক মহাগুনাস পার হয়ে যেতেই হবে।

সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম সকলে। বড়দি চলেছেন তাঁর দাদার ডান্ডিতে। পোষ পত্রীতে পৌঁছে, সঙ্গীদের পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে দৌড়ে যাই তাদের দিকে, দেখি নীলিমাদি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন, সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে, মুখ চোখের অবস্থাও ভাল না। রোগা মানুষ অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে পড়েছেন। আমাদের কাছে ব্র্যান্ডি ছিলনা, কাছেই বিশ্রামরত কয়েকটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করাতে কোরামিন পাওয়া গেল। খানিকক্ষণ পরেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। অপরিচিত ছেলেগুলিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম।

শেষনাগ হয়ে চন্দনবাড়ী যাব আমরা। চারিদিক বরফে ঢাকা, ঘোড়াগুলির পা পিছলে গেলেও তারা খুব সাবধানে চড়াই চড়ছে, মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে থাকে। দেখে বড় কষ্ট হয়, অবলা জীব, আমাদের জন্যে কত কষ্টই না করছে। বিপদ বাঁচিয়ে, সাবধানে তাদের পথ চলা দেখলে অবাক হতে হয়। মানুষের থেকে তাদের দায়িত্ববোধ কোন অংশে কম নয়।

উৎরাই পথে আবার বিপদ ঘটল। একে একে দুবারে রেখাদি ও সতীদি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে জখম হলেন। রেখাদির সহ্যশক্তি খুব বেশী, সব ব্যথা- বেদনা অগ্রাহ্য করে ফুলে ওঠা চোখ মুখ নিয়েই তিনি ঘোড়ায় চড়েছেন ও মকবুলকে বকাবকিও করছেন। শেষনাগে পৌঁছনোর একটু পরেই মন্টু আর মকবুল সতীদিকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। পিঠে ও কোমরে খুব আঘাত পেয়েছেন, দাঁড়াবার ক্ষমতাও নেই। সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়ল। এদিকে ঘোড়াওয়ালারা তাগাদা দিচ্ছে যাওয়ার জন্যে, আকাশের অবস্থা ভাল নয়। ব্যথার স্থানে বরফ লাগিয়ে কষ্ট একটু কমলেও তাঁর পক্ষে উঠে দাঁড়ানো সম্ভবই ছিলনা। সকলের বসে থেকে লাভ নেই, আমরা কয়েকজন ডাক্তারের অপেক্ষায় রয়ে গেলাম। ডাক্তারবাবু এসে ব্যথার যায়গাটা প্রেশার ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দিলেন, আর কিছুই করার নেই। পহলগাঁও পৌঁছিয়ে হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে হবে।

যাত্রা শুরু হল। সতীদিকে ঘোড়াতে বসিয়ে দুদিক থেকে প্রতাপ ও মন্টু ধরে নিয়ে চলল। আমার বাচ্চু ঘোড়াওয়ালা গুলাম, দিদির ঘোড়া নিয়ে চলল। আমাকে সাহায্য করল তার থেকেও ছোট একজন। সতীদির ঘোড়া সামলিয়েও, গুলাম বিপদের রাস্তা দেখলেই এক হাতে লাগাম আর এক হাতে আমার হাত ধরে, পরম যত্নে পার করে দিচ্ছিল। যাত্রা শুরুর আগে ছোট্ট গুলামকে দেখে ভরসা পাইনি, ভাবতেই পারিনি যে ওই বাচ্চা এত সুন্দর ভাবে, নিরাপদে আমাদের যাত্রা সম্পূর্ণ করিয়ে দেবে। কদিনের যাত্রায় আমি তাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম, সেও ভালবেসেছিল আমায়।

ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, যোজিপালে তাঁবুতে আশ্রয় নিই। বৃষ্টি থামলে আবার যাত্রা শুরু হয়। রাস্তা খুবই খারাপ, ঘোড়া থেকে নেমে আমরা হেঁটে যাওয়াই নিরাপদ মনে করলাম। মন্টু আর প্রতাপ কত যত্নে যে আমাকে আর সতীদিকে নিয়ে এল সে কথা বলার নয়, প্রার্থনা করি ভগবান তাদের মঙ্গল করুন। ঘোড়াদুটিকে নিয়ে বাচ্চাদুটি চলে গেল চন্দনবাড়ী। সেখানে পৌঁছনোর আগেই মকবুলকে দেখতে পেলাম, আমাদের খোঁজে এসেছে সে। তাঁবুতে পৌঁছতেই নিশ্চিন্ত হয়ে আমার বন্ধুরা চা ও খাবার এগিয়ে দিলেন। গুলাম কম্বল নিয়ে আমার অপেক্ষায় ছিল, এইটুকু শিশু কত দায়িত্বশীল ও সৎ।

পরদিন যাঁরা অসুস্থ ছিলেন, জীপে করে পহলগাঁও চলে গেলেন, আমরা ফিরলাম ঘোড়াতে। এবারে গুলামকে ছাড়তে হবে। তার ঘোড়াকে আদর করে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বখশিস দিলাম, সে খুশী হয়ে চলে গেল। আমার মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে রইল।

হোটেলের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছিলাম। হঠাৎ নজর গেল মকবুলের দিকে, সে হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। জোয়ান ছেলে, ফুটফুটে ফরসা রঙ, খাড়া নাক, নীল চোখ। কথায় কথায় ক্ষেপে যেত সে...তাতার দের কথা মনে পড়ত তাকে দেখলে।। শ্রীনগরে ফিরে এলাম। এবারে বাড়ী ফিরতে হবে। প্রণাম অমরনাথ, বিদায় পঞ্চতরণী, শেষনাগ, চন্দনবাড়ী, পহলগাঁও...তোমরা আমাদের ভুলে যেওনা।


লেখক পরিচিতি - প্রতিভা ভট্টাচার্য (১৯৩৪- ২০১৫) ভাগলপুরের বিখ্যাত ধ্রুপদী বংশে জন্ম গ্রহণ করে ওস্তাদ গণেশ প্রসাদ মিশ্রের তালিমে হয়ে ওঠেন এক দক্ষ সংগীত শিল্পী। ছোট বয়েসেই বিয়ে হয়ে যায়। অসম্ভব মনের জোরে, সংসারের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক হন বিয়ের নয় বছর পরে। শিক্ষকতা- কালে বি এড ডিগ্রী অর্জন করেন আরও নয় বছর পর। নান্দনিক শিল্পের সব কটি বিভাগই ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়.. রন্ধনবিদ্যা, আলপনা, বয়ন ও সূচীকর্মে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভ্রমণের শখ পূর্ণ করতেন স্বামীর উৎসাহে, সহকর্মীদের সংগে বেরিয়ে পড়ে। লিপিবদ্ধ করে ফেলতেন তাঁর অভিজ্ঞতা। এটিই ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত ওঁর প্রথম লেখা।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।