প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ

সেপ্টেম্বর ১৫,২০১৬

 

কাশ্মীর- কিছু স্মৃতি

অভীক দত্ত


এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। রাত ন’টা। শ্রীনগর, কাশ্মীর।

রাজুকাকার বাইকের পিছনে বসে যাচ্ছি। গন্তব্য কাশ্মীরি শালের গোডাউন। জায়গাটা পুরনো শ্রীনগরে।
দিনটা রবিবার। সকালে সোনমার্গ থেকে ফিরেছি। ভূমিকম্প হয়েছে দুপুর নাগাদ। তারপর থেকে উদ্বিগ্ন অনেকেই ফোন করেছে কেমন আছি জানার জন্য। তাদের জানানো হয়ে গেছে যে ভূমিকম্পের কিছুই বুঝতে পারিনি, আমরা তখন বরফের উপত্যকায় ছিলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা চোরা টেনশন কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। যেদিন থেকে কাশ্মীরে এসেছি সেদিন থেকে রাস্তাঘাটে, ধাবার ছাদে, ক্ষেতের ভিতরে নিরাপত্তাবাহিনীর বাহুল্য দেখে শঙ্কিত হয়েছি, রাস্তার মাঝখানে ম্যাপে কোথায় আছি জানতে গেলে দেখেছি গুগল ম্যাপ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে নিরাপত্তার কারণে এই জায়গা সম্পর্কিত কোনরকম তথ্য দেওয়া যাবে না।


সিন্ধু নদ, সোনমার্গ

সোনমার্গ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় দেখেছি কেউ লুকিয়ে চুরিয়ে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” লিখে চলে গেছে কোন দেওয়ালে। কোথাও বা “আজাদি” চেয়েছে। ঊর্দুতে না, ইংরেজিতেই, যাতে পর্যটকদের কাছে স্পষ্ট বার্তা যায়।


পহেলগাম ১


পহেলগাম ২

একে ভূমিকম্প, তায় সারাদিন এসব দেখে এসেছি, আর এর মধ্যেই মা পাঠিয়ে দিয়েছে রাজুকাকার সাথে ওদের শালের গোডাউন থেকে বেশ কিছু শাল নিয়ে যেতে। রাজুকাকার নাম মহম্মদ ইসমাইল বেগ। আমাদের ওখানে শাল বিক্রি করে। বলেছিল, শ্রীনগরে এলে ফোন করতে। মা ফোন করতেই হোটেলে হাজির।
এসেই ঝরঝরে বাংলাতে বলে দিল, পরের বার কাশ্মীরে এলে কোনভাবেই যেন শ্রীনগরে না থাকি। শ্রীনগর একটা থাকার জায়গা নাকি! দু’ তিনদিন পহেলগাম, একদিন গুলমার্গ, একদিন সোনমার্গে থাকলেই হয়। শ্রীনগর একটা বাজে শহর।


ডাল লেক, শ্রীনগর্গ

রবিবার আমরা সোনমার্গ থেকে ফেরার পর রাজুকাকা আমাদের হোটেলে এসে ওদের শাল ফ্যাক্টরির কথা বলল। মা আমাকে বলল “যা না, একবারে খালি হাতে ফিরব? কয়েকটা শাল অন্তত নিয়ে আয়”। রাজুকাকা আমাকে বলল “চল ভাগ্নে, তুই চ।”

আমি রাজুকাকাকে প্রথম দেখছি। বাংলা বললেও কাশ্মীরি তো বটেই। আর রাস্তাঘাটের যা হাল! হোটেল থেকে বেরোলে পাঁচ মিনিট পরপর আর্মি ক্যাম্প। ঠিক ভরসা হল না। আমতা আমতা করতে লাগলাম। মাও আমাকে ছাড়তে চাইল না।

রাজুকাকা হেসে বলল “ভয়ের কোন ব্যাপার নেই দিদি। এখানে এটাই নর্মাল। ভাগ্নেকে নিয়ে না গেলে পছন্দের ব্যাপারটা আমি অতটা বুঝব না। তোমাকেও নিয়ে যেতাম, কিন্তু এখন ন’টা বেজে গেছে।”

অগত্যা মা আর না করতে পারল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হোটেল থেকে বেরিয়ে রাজুকাকার বাইকের পেছনে বসলাম। ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে চারদিকে। মাফলার কানে ঢাকা দিলাম।



কাশ্মীরের টিউলিপ ১



কাশ্মীরের টিউলিপ ২



কাশ্মীরের টিউলিপ ৩



কাশ্মীরের টিউলিপ ৪

একটা শহরের ভেতরে যেমন আরো অনেক শহর থাকে, আমাদের হোটেলের পাড়া ক্ষেমচক থেকে বেরিয়ে তেমনি পুরনো শ্রীনগরের মধ্যে যেতে যেতে আরও অনেক শ্রীনগর দেখতে শুরু করলাম। রবিবার বলে প্রায় সব দোকান বন্ধ, শুধু কাবাবের দোকানগুলো খোলা আছে, সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যাবার সময় রাজুকাকা চেনাল “এই দ্যাখ, এখানে আমি আর তোর মামী বিয়ের পরে সিনেমা দেখতে আসতাম। এখন আর্মি নিয়ে নিয়েছে।”
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম এদের বেঁচে থাকা, খাওয়া দাওয়া, মত প্রকাশের অধিকার সবই আসলে রাষ্ট্র নিয়ে নিয়েছে। এরা কোনমতে বেঁচে আছে। চাকরি নেই বললেই চলে, পর্যটন শিল্প কোনমতে বেঁচে আছে, তাও উপত্যকা যখনই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন কোন পর্যটক ভুলেও পা রাখে না, তখন জীবিকা নির্বাহই প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে।

বাড়িতে বাড়িতে আর্মি পাহারা, তিন বছরের বাচ্চারও স্কুলে ঢোকার আগে ব্যাগ চেক হয়, পাকিস্তানের ইন্ধনও সব সময় লেগেই আছে, অসীম হিন্দু-বিদ্বেষ এবং রাষ্ট্র-বিদ্বেষ পথে হাঁটলেই টের পাওয়া যায়... এপ্রিলেই বুঝতে পারছিলাম কাশ্মীর আসলে একটা বারুদের স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

সাড়ে ন’টা নাগাদ পুরনো শ্রীনগরে রাজুকাকার শালের ফ্যাক্টরিতে পৌঁছলাম। বড় বড় শালকাঠ দিয়ে তৈরি তোরণ, একেকটা বাড়ি একেকটা দুর্গের মত। হিন্দি সিনেমায় দেখানো সন্ত্রাসবাদীদের আস্তানার মত বাড়ি। ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম। তিন তলায় পৌঁছে দেখি, সে আরেক কাশ্মীর। যে কাশ্মীর শিল্প সৌন্দর্যের কথাও বলে আসলে। কেউ কার্পেট দেখাচ্ছে, কেউ বা শাল, শালের ওপরে অসামান্য সব কাজ, পশমিনা সেতো স্বর্গীয় পরিধান...!
আমার মনে হচ্ছিল এই যে এত টেনশন, এত কিছুর মধ্যেও এরা এত অপূর্ব সব কাজ করে যাচ্ছে, পেটের তাগিদে না হয় বুঝলাম, কিন্তু পেটের তাগিদেই বা ক’জন এরকম সোনা ফলাতে পারে?

মনে পড়ে যাচ্ছিল আগের দিনের কথা। যেদিন গুলমার্গ থেকে ফেরার সময় কয়েকজন মহিলা রাস্তা অবরোধ করেছিলেন তাদের এলাকায় জল বিদ্যুতের অভাবের জন্য, আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাদের অবরোধ তুলে দেওয়া হয়েছিল লাঠির বাড়ি মেরে।

যে অধিকার ভারতের বাকি রাজ্যে আছে, কোন কোন রাজ্যে দিনের পর দিন জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখলেও কারও খুব একটা গায়ে লাগে না উলটে সেটাই জাতীয় বীরত্বের স্বীকৃতি পায়, তার ঠিক বিপরীত চিত্র দেখে গেলাম ক’দিন ধরে। কারও প্রাইভেসী বলে কিছু নেই, রাস্তায় বেরোলে উত্তর দিয়ে যেতে হয় একের পর এক প্রশ্নের। মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু নেই।

সাড়ে দশটা নাগাদ হোটেলে ফিরে রাজুকাকা মাকে বলল “দিদি ভাগ্নেকে সহি সলামত পৌঁছে দিলাম কিন্তু।” বুঝতে পারলাম, রাজুকাকাও আমাদের ভিতরের চোরা টেনশনটা বুঝেছিল।

পরের দিন নেমন্তন্ন ছিল রাজু কাকার বাড়ি। দরিদ্র এক শালওয়ালা, যার বছরের অধিকাংশ সময় কাটে ভিনরাজ্যে, তাদের বাড়িতে গিয়েও চমকে গেলাম। তারা গরীব হতে পারে, কিন্তু তাদের খাবার দেবার ধরণ, অতিথি আপ্যায়ন অত্যন্ত অভিজাত। রাজুকাকা ছাড়া তার মা, স্ত্রী, এক মেয়ে, ছেলে কেউই হিন্দিও বলতে পারে না। কিন্তু আতিথেয়তার উষ্ণতার কাছে ভাষা কবেই বা গুরুত্ব পেয়েছে?

ভাত, ল্যাম্ব রোগান জুস, কাবাব খাওয়ানোর পর একগাদা আখরোট মা-র ব্যাগে দিয়ে দিলেন রাজুমামী। মা রাজুমামাকে ছেলেমেয়েদের জন্য টাকা দিতে গেলে রাজুমামা হাত জোড় করে বললেন “দিদি টাকা দেবেন না, আমি যখন যাব তখন ওদের জন্য কিছু কিনে দেবেন।”

সারাটা দিন এক কাশ্মীরি পরিবারের সান্নিধ্যে থেকে এটুকু বুঝলাম, যতই তাদের বেঁচে থাকা দিনের পর দিন কঠিন হয়ে যাক, তাদের আত্মসম্মান এখনও অটুট। তাতে কেউ একফোঁটা চিড় ধরাতে পারেনি।
যে ট্রাভেল এজেন্সীর সাথে গেছিলাম, তারা একদিন আগেই জম্মু রওনা দিল। মা বৈষ্ণোদেবীর উদ্দেশ্যে। আমাদের আর এই যাত্রায় বৈষ্ণোদেবী যাওয়া হল না। পরের দিন প্লেনে ফেরার কথা আমার অফিসের তাড়ার জন্য। একটা দলের সাথে গেছিলাম। তারা চলে যেতে একটু যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম, এখন অস্বীকার করব না। কিন্তু রাজুমামা সেটা আমাদের বুঝতে দিল না। দুপুর নাগাদ খেয়ে দেয়ে হোটেলের গাড়িতে তুলে দিল।
শ্রীনগর এয়ারপোর্ট অনেকটা দূরে ক্ষেমচক থেকে। যে গাড়ির ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল, বকবক করে যাচ্ছিল তার মত। অনেকটা যাওয়ার পর আর একটা গাড়ির সঙ্গে দেখা হল। একথা সেকথার পর আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আমায় বলল ওই গাড়িটায় চলে যেতে। ওটা হোটেলেরই গাড়ি। ওই গাড়িটাকেও এয়ারপোর্টে ঢুকতে হবে। ভ্যালিড টিকিট না থাকলে ওই গাড়িটা এয়ারপোর্টে ঢুকতে পারবে না। একজন সওয়ারি হলেই হবে।

আমি ওর কথায় কান না দিয়ে গাড়িতেই বসে থাকলাম। অচেনা অজানা জায়গায় কাউকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। গাড়ির ড্রাইভার কিছুক্ষণ অনুরোধ করার পর বুঝল আমি কিছুতেই মানব না। তারপরে আবার গাড়ি স্টার্ট দিল।

আমাদের সবাইকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেবার পর সে শুধু একটা কথাই বলেছিল,
“আপনারা কেউ আমাদের বিশ্বাস করেন না, আমরা কেন আপনাদের বিশ্বাস করব বলতে পারেন?”

লেখক পরিচিতি - পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আর ভালবাসা সাহিত্য। 'আদরের নৌকা' লিটল ম্যাগের সম্পাদক। মূলত গদ্যকার। প্রকাশিত গ্রন্থ- এক কুড়ি গল্প, কেউ কোথাও যাবে না।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।