ছবিতে ভ্রমণ
নভেম্বর ১৫, ২০১৪
আমার এই চোখ মেলাতেই আনন্দ
বিজন বন্দ্যোপাধ্যায়
আমি কোনদিনই ভ্রমণ নিয়ে তথ্য প্রধান কিছু লিখতে পারি না। তাই আমার এই লেখাতে না আছে গন্তব্য স্থানের পথের হদিস, না আছে সেখানে থাকার হোটেলের লিস্টি। আমি শুধু এক নতুন অচেনা পাহাড়ি গ্রামে এসে রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ (নাকি অনুকরণ ?) করে বলতে চেয়েছিলাম “আমার এই চোখ মেলাতেই আনন্দ”। সেই আনন্দের একটকু ছোঁয়াও এই লেখা যদি আপনাদের মনকে রাঙ্গাতে পারে – তা হলেই আমার এই লেখা সার্থক ।
খুবই অখ্যাত এক পাহাড়ি গ্রাম – নাম সিলেরি গাঁও । এখানে বসতি বলতে ৩০ টি পরিবারের বাস – তারা প্রায় সবাই একে অন্যের আত্মীয়। কালিম্পং থেকে গাড়ীতে ঘণ্টা খানেকের পথ। পেডং এর খুব কাছে। গন্তব্যে পৌঁছোবার আগে পথে কিছু দ্রষ্টব্য দেখলাম। প্রথমটার নাম cross hill view point। যেখানে আমার দাঁড়ালাম , তার একদিকে বিরাট খাদ। তার অপর পারে পাহাড়ের ধাপে ধাপে সিকিম রাজ্যের বসতি দেখা যায় । সেখানে হাল্কা মেঘের সাথে এই ছোট ছোট ঘরগুলোর কোলাকুলি। মনে একটা নেশা ধরায়। তবে জায়গাটা খুব নির্জন নয় – হলে আরও উপভোগ করতাম।
সিলেরি গ্রাম যাবার শেষ ৪ ১/২ কিলোমিটার রাস্তার নাম উদয় শঙ্কর সরণি হলে উপযুক্ত হত। রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে – পাথরের ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে যেতে হয়। এই রাস্তাতে দেখলাম silence valley। বুঝলাম না কেন শুধু এই জায়গাকে silence valley বলে – কারণ এই ৪ ১/২ কিলোমিটার রাস্তাটা পুরটাই একেবারে শুনশান ।বিশাল বিশাল পাইন গাছ পাহাড়ের গড়ান গায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে পরে সত্যজিৎ রায়ের সেই গান
“হেথা ঊর্ধ্বে উঠায়ে মাথা দিল ঘুম
যত আদিম মহাদ্রুম”
“হেথা ঊর্ধ্বে উঠায়ে মাথা দিল ঘুম -যত আদিম মহাদ্রুম”
এরই এক পাশে রাস্তার ধারে কিছুটা অংশে আর এক অপরূপ দৃশ্য । বিশাল বিশাল পাইন গাছের এক লম্বা সারি – মনে হয় পরস্পরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে একটা সুউচ্চ প্রাচীর তৈরি করেছে। তাদের পা থেকে মাথা অবধি পাতার অবগুণ্ঠনে ঢাকা । সেই অবগুণ্ঠনে গাছগুলোর মেরুদণ্ডটাও হারিয়ে গেছে। মনে হয় নারীর এক দল আজানুলম্বিত কেশে সারা গা ডেকে লজ্জা নিবারণ করছে । আমি অনেক পাহাড়ে ঘুরেছি – অল্প বয়স থেকেই । কিন্তু এরম দৃশ্য আগে দেখিনি।
পাইনের সেই সুউচ্চ প্রাচীর
অবশেষে পৌঁছলাম সিলেরি গাঁও । এখানে কোন হোটেল নেই – আছে শুধু কিছু home stay। আমরা যে home stay তে ছিলাম –তার নাম sillery green valley। এখানে সব কিছু ৫ তারা । থাকার জন্যে একটা ২ তলা কাঠের বাড়ী । তার নীচে ২ টি আর ২ তলাতে ২ টি ঘর। একান্ত প্রয়োজনীয় সুবিধার বেশি এখানে কিছুই নেই।
আমাদের ৫ তারা আবাসন
একটু বর্ণনা না করলে এই ৫ তারা আবাসনের কদর ঠিক বোঝা যাবে না। আমরা ছিলাম ২ তলার ২ টি ঘরে। ply board এর মেঝে। রাতে ২ তলার ঘরে এই মেঝের ফাঁক দিয়ে এক তলার ঘরের আলোর জ্যোৎস্না উঁকি মারে। ঘরের দেওয়ালে কিছু পেরেক পোঁতা আছে। জামা কাপড় তাতেই ঝোলাতে হয় – অর্থাৎ ওটাই wardrobe। সৌভাগ্যক্রমে –
১) বাথরুমে কল আছে আর তাতে জলও আসে – তবে একটা ছোট বালতি ভরতে মাত্র মিনিট ২০ লাগে।
২) আমার মত ৭০ ঊর্ধ্ব লোকের যেটা সব থেকে দরকার – সেই western w.c. আছে।
রাজকীয় শয্যাঘর
বাথরুমে আয়না নেই। দুটি ঘরের সামনে একটা টানা বারান্দা – একটা আয়না সেখানে ঝুলছে। তাই বারান্দাতে এসে প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে দাড়ি কামাতে হয়। মেয়েদের প্রসাধনের জন্যেও এই আয়নাই ভরসা।
গরম জলের ব্যবস্থা অতি আধুনিক । সত্যজিৎ রায়ের জয় বাবা ফেলুনাথের কথা মনে পরে – running hot and cold water। প্রথম বার গরম জলের জন্যে notice period প্রায় ২০ মিনিট। house keeping কে ফোনের বদলে চেঁচিয়ে বলতে হয়। তখন মালকিন বড় উনুনে কাঠ দিয়ে আগুন ধরান – আর তাতে বিরাট পাত্রে চাপন হয় জল। গরম হলে বালতি করে সে জল ঘরে দেওয়া হয়। পরের বালতি গরম জলের notice period খুবই কম –কারণ তখন উনুনে গরম জল তৈরি । তবে গরম জল দেবার বালতি একটাই । তাই স্নানের ব্যবস্থা serial – parallel নয় ।
অত্যাধুনিক বিশাল geyser
৫ তারা এই হোটেলের বিশাল পাকশালা – তাই একে হেঁসেল বলে ছোট করা ঠিক হবে না। একটা ১০ x ৮ ঘরের এক অংশে এই পাকশালা – আর এক অংশ মালিকদের বসার/শোবার ঘর। বাকিটা অতিথিদের dining hall। এই পাকশালাতে মালকিন একটা কাঠের উনুনে রান্না করেন – মালিক তাকে করেন সাহায্য। আমাদের খাবার দেওয়া হত এই dining hall এর একটা table এ – মাপ প্রায় ২ x ৪। পায়াগুলো অবশ্য সামান্য একটু নড়বড়ে।
একেই বলে ৫ শালা পাকশালা
পাকশালার লাগোয়া মালিকদের বসার/ শোবার ঘর
আহা!
এই সেই royal dining table
সকালে মেলে লুচি আর তরকারি বা আলু পরোটা । বিকেলে নিরামিষ মোমো। দুপুরে ভাত বা রুটি, ডাল, আলু আর পাঁপড় ভাজা, একটা তরকারি আর ডিমের ডালনা । রাতের খাবার একই – শুধু ডিমের বদলে মুরগির ঝোল ।
আমাদের থাকার জায়গার এত বিবরণ দেবার কারণ এই অতি অতি সাধারণ ব্যবস্থা মনকে চারিপাশের প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে এক করে দিতে যে এত বড় একটা বড় ভূমিকা পালন করে – সেটা আগে আমার জানা ছিল না।
এখানে আরও কিছু home stay আছে – তাদের মান এর থেকে কিছুটা উন্নত। তবে এই home stay র সামনে আর কোন ঘর নেই – আছে শুধু অনন্ত প্রকৃতি । তাই এটাই আমাদের পছন্দ হল। বারান্দাতে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে দেখা যায় প্রায় ২৭০ ডিগ্রি ঘিরে পাহাড় আর গাছ। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও তার পাশাপাশি অনেক বরফের টুপি পরা পাহাড়ের চূড়া। তবে মেঘের কল্যাণে আমদের ভাগ্যে খুব অল্প সময় তাদের দেখা মিলল । এখানের সূর্যোদয়ের ছবি দেখলাম – মনকে মাতাল করে দেয়। তবে আমাদের ছবি দেখেই খুশী থাকতে হল – সূর্যোদয়ের সেই মনোহরণ করা রূপ দেখার সৌভাগ্য হল না ।
Home stay র সামনের দৃশ্য
তবু যা দেখলাম তাতেই প্রকৃতি আর মন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল – সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। এই মেলবন্ধন মনকে একধারে উদাস আর অন্য ধারে মাতাল করে দিল। সে অনুভূতি কোন দিন ভুলবো না। নিজের বেসুরো গলার বাধা মানে নি মন – আমার গানের ঝর্ণাতে সব কিছু গেল ভেসে। অনুভবে সব ফাঁক ভরিয়ে হৃদয় হল পূর্ণ – পুণ্যও বটে। তাই “কি পাই নি তার হিসাব” মেলাই নি – যা পেয়েছি তাকেই চোখ মেলে দেখেছি আর মন ভরিয়ে নিয়েছি।
Home stay র পেছনের দৃশ্য
আমাদের থাকার প্রথম দিন এই home stay তে আর কোন অতিথি ছিল না। তাই রাতের গভীর সুন্দর নির্জনতাকে শব্দবাণে কেউ দূষিত করে নি। গাছের ফাঁক দিয়ে বাতাস বয়ে যাবার শব্দের সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের যুগল সঙ্গীত এক অপূর্ব ও মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
Home stay থেকে আমার মত ৭০ পেরোনো মানুষের পায়ে ১ ঘণ্টা দূরে একটা view point। নাম romiti view point। আমার হাঁটুতে সম্প্রতি বেশ সমস্যা হয়েছে। তাই প্রথমে এখানে যাব কিনা – এই নিয়ে একটু দোটানাতে ছিলাম। পরে মনে হোল – হাঁটু থাক হাঁটুর মত আর আমি থাকি আমার মত। মন বলল “আমাকে আমার মত থাকতে দাও”। তাই knee cap পরে রওনা দিলাম। আমরা ৪ জন ছাড়া সাথে ছিল এক পথ প্রদর্শিকা। পথে কানে আসছিল কিছু পাখির ডাক আর দিনের বেলাতেও কিছু ঝিঁঝিঁর শব্দ – দুই মিলিয়ে সে এক অপূর্ব তান। কোথায় গেল হাঁটুর ব্যথা – রাস্তার ওপর দিয়ে আমি যেন ভেসে চললাম। পথ প্রদর্শিকা এক মিষ্টি নেপালি গান ধরল – সে গানে মহুয়ার নেশা (যদিও এখানে মহুয়ার দেখা মেলে না)। গলা থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল “আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”।
পথের ধারে হঠাৎ চোখে পড়লো এক জংলি গাছ। তাতে এক অবাক করা নাম না জানা এক ফুল – বা ফল জানি না। কিন্তু সে তার চারিদিক আল করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক সুন্দর ফুলের নাম শুনেছি – কিছু দেখেছিও। কিন্তু এর অপরূপ সৌন্দর্য যেন তাদের সকলকে একেবারে ম্লান করে দিয়েছে।
ফুল না ফল?
একেই কি বলে বনের পারিজাত
Romiti point এ পৌঁছলাম অবশেষে । এটাকে প্রায় একটা lands end বলা যায়। যে পথ দিয়ে এখানে এসেছি – সে দিক ছাড়া বাকি ৩ দিকে গভীর খাদ। সামনে অনেক অনেক নিচে এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে তিস্তা – মনে হয় ৩ টে নদী ৩ দিক থেকে এসে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
Romiti point থেকে দেখা তিস্তার রূপ
বাঁ দিকে পাহাড়ের গায়ে দূরে ধাপে ধাপে দেখা গেল এক শহর – পথ প্রদর্শিকা বলল সেটা দার্জিলিং না কার্শিয়ং কি যেন একটা। আমার নামে উৎসাহ নেই – তাই সে কথা শুনে বা মনে রাখার চেষ্টা করে এই কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়া মনকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তলার চেষ্টা করিনি। শুধু মন আর চোখ এক করে চারিদিকে তাকিয়ে থেকেছি। ডান দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর আরও অনেক সাদা মাথা পাহাড়ের দেখা মেলে । কিন্তু মেঘের কল্যাণে সে রূপ আমাদের অদেখাই থেকে গেল। পাহাড়ের মাথাতে নানা আকারের ঢেউ খেলান মেঘের ও তো এক অপূর্ব রূপ আছে – তাই মন ভরে দেখলাম। ঘণ্টা দুয়েক এখানে বসে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেলাম। তার পর আবার সেই স্বপ্নালু পথ ধরে ফিরে এলাম।
পরের দিন ফেরার পালা । স্বর্গ রাজ্য থেকে নিলাম বিদায়।
এই লেখার ফাঁকে ফাঁকে কিছু ছবি লাগিয়েছি । ছবিতে সেই অপরূপ রূপ দেখার অনুভূতি পাওয়া দুষ্কর। তবু ছবি হয়ত এই আনন্দ-যজ্ঞের সামান্য ছোঁয়া দিয়ে পাঠকদের মনকে রাঙ্গাবে – এই আমার আশা।
লেখক পরিচিত - শুনেছি বছর ৫০ আগে আমি নাকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছিলাম – যাদবপুর থেকে। কয়েক বছর আগে হঠাৎ লেখক হবার ক্ষ্যাপামি চাপলো মাথাতে । অবসর সে সুযোগ ও দিল । সেই সুযোগের সুবিধাটা নিয়ে মতামত আর আলোচনা বিভাগে গোটা দশ আর ভ্রমণ বিভাগে গোটা তিন লেখা অবসরের পাতাতে জায়গা পেল আর অনেক পাঠকদের মতামত পাওয়া গেল এই সব লেখাতে । এতে উৎসাহ পেয়ে আবার কলম ধরেছি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।