ভ্রমণ কাহিনী
মার্চ ১৫, ২০১৬
শ্বেত-মরুর দেশে
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
(১)
বৈচিত্র্যময় এই ভারতে মানুষ কত না উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্রমণ করে। কেউ চায় ঐতিহাসিক বা পুরাণের ঐতিহ্যময় এই দেশকে জানতে, কারো বা আগ্রহ প্রকৃতি- মরু, পাহাড়, সমুদ্র, বনভূমি আর বন্যজন্তু দর্শনে। কেউ চায় ধর্ম বা তীর্থভ্রমণ তো কারো আগ্রহ নগর ও প্রাসাদে। এ দেশ কিন্তু কাউকেই বিমুখ করে না। তবে এ দেশে এক শ্রেণীর ভ্রমণের এখনও তেমন আগ্রহ দেখা যায় না, তা হল বিজ্ঞান-ভ্রমণ বা বিজ্ঞানের দিক থেকে আশ্চর্যজনক স্থানগুলির দর্শন। একটু অবাক লাগছে ভাবতে, তাই না? জানেন কি, ভারতে জ্যোতিষচর্চার শুরু আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, আর্যভট্টের হাত ধরে, অথচ তাঁদের তৈরি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক শঙ্কু, যষ্টি-যন্ত্র সংরক্ষিত হয়নি। অনেক দেরিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় জ্যোতিষ-চর্চার প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক মানমন্দির তৈরি করেন অম্বরের রাজা জয়সিংহ, জয়পুর, উজ্জয়িনী, বারাণসী ও দিল্লীতে? হ্যাঁ, জন্তর-মন্তরের কথা বলছি। আরো জানেন কি, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগে মহারাষ্ট্রের বুলঢানা জেলার লোনারে এক উল্কাপাতে ভূ-পৃষ্ঠে একটি বিশাল গহ্বর তৈরি হয়, যা এখন একটি হ্রদ? সে জলে কিন্তু একটি পোকাও বসতে পারে না, তার কারণ তার তীব্র ক্ষারকতা (১০.৫ pH)। জানেন কি আসামের জাটিঙ্গায় কিছু বিশেষ স্থানে আগুন জ্বালালে একধরণের পাখি তাতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে? এসব ঘটনা বা স্থানকে দৈব-মাহাত্ম্য দিয়ে না বিচার করে যুক্তিবোধ আর শিশুর কৌতূহল নিয়ে দেখাকেই আমি মনে করি বিজ্ঞান-ভ্রমণ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই দেশে এর প্রয়োজন কিন্তু অপরিসীম।
কচ্ছের মানচিত্র
আচ্ছা, ধান ভানতে এসে এতটা শিবের গাজন কেন গাইলাম বলুন তো? ঠিকই আন্দাজ করেছেন, কিছুদিন আগেই এমন এক ভ্রমণ সেরে এলাম, যাকে লোকসংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অবাক করা কিছু দৃশ্য, বন্য-প্রাণী দর্শন ছাড়াও আর একটি নামে আখ্যায়িত করা যায়- এক ভৌগোলিক বা বৈজ্ঞানিক বিস্ময়। ছোটবেলা থেকে ভূগোলের বইয়ে গুজরাটের পাকিস্তান সীমাঞ্চলে কচ্ছপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে স্থিত রাণ বা কর্দমাক্ত মরুর কথা পড়ে আসছি। সেখানে নাকি এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে স্যাঁতসেঁতে জনমানবশূন্য জলা-প্রান্তর আছে, বড় দুর্গম সে স্থান। সে সময় কচ্ছের সীমার বাইরে বীরমগাম পর্যন্ত রেলপথ ছিল, পরে তা এগিয়ে গান্ধীধাম ও আরও পরে ভুজ পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। ইদানীং সড়ক-পথেরও প্রভূত উন্নতি হওয়ায় গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর আগ্রহে ও চেষ্টায় ২০০৮ সালে এই রাণ-সংলগ্ন বান্নি-তৃণাঞ্চলের একপ্রান্তে ধোরডো গ্রামে শুরু হয় এক অনবদ্য পর্যটন প্রকল্প ‘রাণ-উৎসব’। কি এই রাণ-উৎসব? সবিস্তারে জানার যদি কৌতূহল থাকে তাহলে আর অহেতুক অপেক্ষা না করিয়ে শুরু করি আমাদের যাত্রা-কাহিনী।
রাণ গ্রামের প্রবেশ-তোরণ, ধোরডো, কচ্ছ |
গুজরাটের বৃহত্তম জেলা কচ্ছ যার উত্তরে ও পশ্চিমে পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশ, দক্ষিণে আরবসাগর ও পূর্বে কচ্ছ-উপসাগর ও গুজরাটের খেড়া, মহেসানা, সুরেন্দ্রনগর ও মোরবি জেলা। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কর্দমাক্ত মরুভুমি যাকে হিন্দিতে রাণ বলা হয়। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া ৩-৪ মাস ব্যাপী কচ্ছের রাণ-উৎসবের কথা কয়েকবছর ধরে শুনে আসছি, তবে এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ যাবার সুযোগ হয়ে গেল। এ কালের অর্ধাঙ্গিনীরা ‘পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য’ কথাটিতে বিশ্বাস রাখেন না, তাছাড়া আনন্দের মুহূর্তগুলো ভাগ করলে বাড়ে এই আপ্তবাক্য মনে রেখে দুজনে একদিন মুম্বাই-ভুজ এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম।
(২)
সকাল ন’টায় ভুজ স্টেশানে এসে পৌঁছেছি। গুজরাটি, বিশেষতঃ কাচ্ছিরা বাইরের খাবার খুব একটা পছন্দ করেন না, তাই সে অঞ্চলের ট্রেনেও চা ছাড়া আর প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না। তবে ঘণ্টাখানেক আগে গান্ধীধাম স্টেশনে গাড়ি বেশ কিছুক্ষণ থেমেছিল, প্রাতঃরাশ সেরে ফেলেছিলাম সেখানেই। ভুজ কচ্ছের সদর হলেও রেলস্টেশনটি অপেক্ষাকৃত ছোট। বাইরে বেরিয়েই দেখতে পেলাম রাণ উৎসবের স্বাগত-শিবির। স্বাগত জানালেন এক বাঙালী রিসেপশনিস্ট, নাম সম্ভবতঃ মঞ্জিল চ্যাটার্জী। সেখানে চা-জলখাবার খাওয়ানো হল। তার ঘণ্টাখানেক পরে একটা মাহিন্দ্রা ভ্যান আমাদের ক’জনকে নিয়ে মরু-শিবিরের উদ্দেশে রওনা দিল। রাস্তায় শাহরুখ খানকে দেখা গেল একটি সিনেমার শ্যুটিং করতে। অথচ সেদিনই খবরের কাগজে কচ্ছের জনগণের বিক্ষোভ প্রদর্শনের ফলে স্যুটিং বাতিল করে শাহরুখের মুম্বাই ফিরে আসার খবর পড়েছি। জানিনা সংবাদ কিভাবে তৈরি হয় ও কারা কি উদ্দেশ্যে সেটা তৈরি করে!
রাণ উৎসবের মঞ্চ |
আমরা ভুজ ছাড়িয়ে উত্তর পশ্চিমে ঢুকে পড়েছি বিস্তীর্ণ তৃণাঞ্চল ‘বান্নি’ সংরক্ষিত অরণ্যে। জঙ্গল নামেই, শুধু শুকনো ঘাস আর কাঁটাঝোঁপের ছড়াছড়ি। মাঝে একটা জলাভূমিতে দেখা গেল কিছু পরিযায়ী পাখি, ছুটে পালালো দুটি কৃষ্ণসার হরিণ(black buck) আর নীলগাই। তবে কচ্ছের বিখ্যাত বিরল প্রজাতির বন্য-গাধা বা wild ass(Equus hemionus khur) চোখে পড়ল না, জানা গেল তা কচ্ছের পূর্বোত্তরের লিটল রানে দেখতে পাওয়া যায়। শোনা যায় ভারতের অবশিষ্ট চিতার প্রজাতি এই অঞ্চলেই এখনও সংরক্ষিত রয়েছে, যদিও রাস্তার ধারে তাদের দেখা পাই নি, আশাও করি নি। আরেকটা মারাত্মক খবর শুনলাম যে নাকি গ্যাণ্ডা বাবুল (Prosopis juliflora) নামে একধরণের কাঁটাগাছ ১৯৭০-৭৫এর মধ্যে বনদপ্তর দ্বারা লাগানো হয় এখানকার জমিতে লবন-আগ্রাসন রোধ করতে, কিন্তু পরে দেখা যার এই আগাছা দ্রুত বিস্তার লাভ করে ভূমির উর্বরতাই নষ্ট করে biodiversity ও ecosystem কে তছনছ করে দিচ্ছে। ১৯৯০ সালে এই গাছ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাটার অধিকার দেওয়া হয়। তারা এর থেকে জ্বালানী কয়লা বা চারকোল তৈরি করে। কিন্তু তাতে দেখা দেয় আরেক বিপদ। কয়লার ধোঁয়ায় মৌমাছিরা পালাতে থাকলে সেখানকার মধু-শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর বাবুল গাছ কাটার নামে কিছু লোভী লোক অন্যান্য গাছও নির্বিচারে কাটতে থাকে। যাক, এসব দুরূহ সমস্যা নিয়ে চিন্তা শেষ হল যখন আমাদের
গাড়ি ভুজের ৮৪ কিলোমিটার উত্তরে ধোরডো রাণোৎসব গ্রামে এসে পৌঁছল।
বাতানুকূল শিবির, উৎসব গ্রাম, ধোরডো, কচ্ছ |
সে এক এলাহী ব্যাপার। পুরো ক্যানভাসের তাঁবু ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি বিশাল রিসর্ট ও এই উৎসব গুজরাট সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের পরিকল্পনামাফিক শুরু হয় ২০০৮-এ। প্রথমে তা সরকারী নিয়ন্ত্রণেই থাকে, তবে দু-তিন বছর ধরে বেসরকারি ভ্রমণ-ব্যবসায়ীরা এর স্বত্ব সরকারের কাছ থেকে মূল সরকারী প্রকল্পটি বজায় রেখে ইজারা নেয়, ও তাতে এর ব্যবসায়িক দিকটার উন্নতিই ঘটে। আমরা প্রথমেই ইন্টারনেটে বুক করা রসিদ দেখাই রিসেপশনে, সামনে চৌমাথায় দাঁড়িয়ে উৎসব সংস্থা পরিচালিত কয়েকটি ব্যাটারি-চালিত রিক্সা, একটি এসে আমাদের ‘ডি’ ব্লকে পৌঁছে দিল, হ্যাঁ, বিনা ভাড়ায়। ক্যানভাস-নির্মিত এ-সি তাঁবুতে এসে দেখি আমাদের জিনিষপত্র আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। একটা বৃত্তাকার মাঠের চারিদিকে বসানো প্রায় ১২০ তাঁবুর এক-একটি ঘেরাটোপ, এরকম দশটি ব্লক নিয়ে পুরো গ্রামটি। ও হ্যাঁ, একটি ভি-আই-পি ব্লকও আছে যেখানে মাসদুই আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমগ্র দেশের ডিজি পুলিশদের নিয়ে থেকেছেন ও দু-দিনের হাই-পাওয়ার মিটিং বা কনফারেন্স করেছেন। এছাড়াও আছে কনফারেন্স হল, ডাইনিং হল, ব্যায়ামাগার ও বিনোদন হল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে মুক্তমঞ্চ, চিকিৎসালয়। আছে পাকা রাস্তা-ঘাট, রান্নাঘর, জল-নিকাশ ও পয়ঃপ্রণালীর উন্নত ব্যবস্থা, কিছু ক্যুরিও ও স্যুভেনিরের জন্যে দোকান-পাট আর পথের দুধারে বেশ কিছু মূর্তি ও আনুষঙ্গিক সাজ-সজ্জা। সঙ্গে কিছু ছবি দিলাম, একটা মোটামুটি ধারণা পওয়া যাবে তাতে।
রাণ উৎসব গ্রামের পথসজ্জা- না, আসল নয়!
শ্বেত-মরু, কচ্ছ |
সেদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুম। ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ হিসেবে বেশ গরম, এসি চালাতে হল। সাড়ে চারটেয় হাই-টি সেরে বাসে ও উটের গাড়িতে চেপে হাজির হলাম পাঁচ কিলোমিটার দূরের শ্বেত-মরু অঞ্চলে। সামনে মাইলের পর মাইল প্রান্তর জুড়ে বরফ-সাদা মরু-প্রান্তর। না, বালি নয়, ভিজে মাটির উপর কে যেন লক্ষ লক্ষ টন সামুদ্রিক লবন ছড়িয়ে রেখেছে। কে করেছেন এই অসাধ্য-সাধন? আনন্দীবেন প্যাটেল, না নরেন্দ্র মোদী? না কি ঈশ্বর স্বয়ং? ভারত-পাক সীমান্তের স্পর্শকাতর এলাকা না হলে হয়ত এখানে মরুতীর্থ হিংলাজ বা দেবী জ্বালামুখী ধরণের কোনও তীর্থ তৈরী হয়ে যেত এখানে এই অলৌকিক সৌন্দর্যের ব্যাখ্যারূপে। ভাগ্যক্রমে সে সব হয়নি এখনও, তাই এর বৈজ্ঞানিক বা ভৌগোলিক ব্যাখ্যা সম্বন্ধে একটু ভাবা যেতেই পারে।
লবণের দানা (Crystal) দিয়ে তৈরি এই রাণ |
হ্যাঁ, তীর্থস্থান বইকি! তবে দেবীমাহাত্ম্য নয়, এই অঞ্চল এককালে সমুদ্রের নীচে ছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা, যার ফলে এখানকার বেলে মাটি লবনে সংপৃক্ত(saturated)। এখন রাণের নীচু জমিতে(সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ মিটার)বর্ষাকালে হয়ত দু-চারদিনই বৃষ্টি হয়, তবে মাটির নিশ্ছিদ্রতার ফলে খুব কম জলই ভূ-গর্ভে চুঁইয়ে যায়। আগে ঘাগ্গর নদী রাজস্থান হয়ে এখানে এসে জল নিঃশেষ করে দিত, এখন তার জল রাজস্থানের থর মরুভূমিতেই শুকিয়ে যায়। তবে লুনি, রুপেন ও বানস নদী এখানে এসে শেষ হওয়ায় সমস্ত প্রায় ৩০,০০০ বর্গ কিঃমিঃ ক্ষেত্রফলের (ছোট রাণ, বড় রাণ ও বান্নি অঞ্চল মিলে) রাণ অঞ্চলের বেশীর ভাগই ছোট ছোট অগভীর হ্রদে পরিণত হয়। একসময় সিন্ধুনদের অববাহিকা রাণের পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে যেত, তবে ১৮২৯এর ভূমিকম্পে তা পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে। ফলে এখন সেই অগভীর হ্রদগুলোতে যেটুকু জল জমে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত তা শুকিয়ে গেলে নুনের স্ফটিক বা কেলাস(crystal) বালির স্তরে ভেসে উঠে। এই লবনে ভরা বিশাল অঞ্চল নভেম্বর থেকে মে মাস অর্থাৎ পরবর্তী বর্ষাকাল পর্যন্ত শ্বেতমরু বা white sand রূপে দৃশ্যমান হয়। আমরা পৌঁছোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যাস্ত হল। অস্তরাগের আলো যখন শ্বেতমরুর উপর পড়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল, সমস্ত এলাকায় এক অপরূপ স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে বেশিক্ষণ থাকা গেল না। পাক সীমান্ত কাছে বলে সীমা-সুরক্ষা দলের নিয়মে সূর্যাস্তের পরে আর সেখানে থাকা চলে না, তাছাড়া পূর্ণিমা ছিলনা বলে চন্দ্রালোকে প্রতিভাত রাণকে আর দেখা হল না, নেট থেকে পাওয়া ছবি দেখেই শান্তি।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাণ-গ্রাম |
রিসর্টে ফিরে ডিনার সেরে মুক্তমঞ্চে কিছুক্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখলাম। সবই কচ্ছ বা কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলের লোকগীতি বা লোকনৃত্যের উপর পরিবেশিত, তাই পরিবেশের সাথে সাযুজ্যের ফলে আরো ভাল লাগছিল। খুব একটা উচ্চস্তরের অনুষ্ঠান না হলেও আয়োজকদের উদ্যম ও সততা দেখে মুগ্ধ হলাম। রাত্রি সাড়ে দশটায় একটি ব্যাটারি-চালিত রিক্সা চেপে তাঁবুতে ফিরে এলাম। এখন আবার হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা, রুম হীটার জ্বালিয়ে শুতে হল।
গান্ধীর গ্রাম, কচ্ছ |
পরদিন সকাল ছটায় বেড-টি খাইয়ে আবার নিয়ে যাওয়া হল ঐ একই স্থানে সূর্যোদয় দেখাতে। কিছু ইতর-বিশেষ বুঝলাম না, তবে ভাল লাগল। ফিরে এসে প্রাতরাশ করে আর একপ্রস্থ ঘুম হল। মধ্যাহ্নভোজনের পর দুপুর আড়াইটায় আরামদায়ক বাসে চেপে রওনা হলাম কচ্ছের সবচেয়ে উঁচু জায়গা কালা ডুংগরের দিকে। রাস্তায় পড়ল ‘গান্ধী-নু-গাম’ বা গান্ধীর গ্রাম যেখানে ২০০০এর ভূমিকম্পে গৃহহারা বেশ কিছু স্থানীর কলাকারদের সরকারি সাহায্য দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। গ্রামটির উদ্ঘাটন করেন ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী অটলবিহারীজী। হস্তশিল্পীরা তাঁদের হাতের কাজ
সেখানে পর্যটকদের বিক্রী করে থাকেন। অবাক হয়ে দেখলাম ডাঃ অমর্ত্য সেনের নামে একটি স্কুলও আছে সেখানে।
মোদিজীর রোপণ করা গাছ, কালা ডুঙ্গর |
কালা ডুঙ্গর বৃহৎ রাণের দক্ষিণ প্রান্তে একটি পর্বত-শৃঙ্গ, ৪৬২ মিটার উচ্চতায় এটি কচ্ছের সর্বোচ্চ অঞ্চল। এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে পাক-সীমান্ত, শ্বেত-রাণের মধ্য দিয়ে রাস্তা চলে গেছে সীমান্ত বরাবর, পাহাড়ের
নীচেই দেখা যায় লবন-জলের হ্রদ ও পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। দেখা যায় বিখ্যাত ভারত-সেতু (India Bridge) আর শ্বেত-মরুর দিক্চক্রবালে সূর্যের অস্ত যাওয়ার অপরূপ দৃশ্য। পাহাড়ের উপর শ্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের হাতে রোপন করা গাছটিও আছে। আর আছে ভগবান দত্তাত্রেয়র মন্দির, তিনি নাকি ঐ অঞ্চলের ক্ষুধার্ত শেয়ালদেরকে নিজের অঙ্গ কেটে খাইয়েছিলেন, সেই স্মৃতিতে গড়ে ওঠা। নাবার সময় বাসের গতি হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছিল, নাকি পাহাড়ের চৌম্বক আকর্ষণে। তবে মনে হয় এটা ভ্রান্ত বিজ্ঞান, যদিও ম্যাগনেট কথার উৎপত্তি ম্যাগ্নেসিয়া অঞ্চলের পাহাড় থেকে যার উপর পায়ে নাল বাঁধা ঘোড়া চড়তে পারত না, চৌম্বক-আকর্ষণে তাদের পা যেত আটকে। তবে এখানে seismic survey তে কোনও লৌহ-আকরিকের উপস্থিতির কথা জানা যায় নি। যাই হোক, রাত আটটায় আমাদের বাস রিসর্টে ফিরল।
ভ্রান্ত-বিজ্ঞান নয়, এবার আরেকটা সত্যি বিজ্ঞানের প্রসঙ্গে আসি। শ্বেত-মরুর রহস্য তো প্রকাশ হল, কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা যে রাণ অঞ্চলে সন্ধ্যের পর হঠাৎ হঠাৎ জ্বলন্ত অগ্নি-গোলক আকাশে লাফিয়ে উঠতে দেখেন, যাকে তারা ‘চির-বাত্তি’ বা ভৌতিক আলো বলে থাকে সেসব কি তাহলে সত্যিই ভৌতিক? না, তাহলে হয়ত তার ছবি তোলা যেত না। ‘বিজ্ঞাপনে কান দেবেন না’- এগুলি জলা জায়গায় marshy land) জমে থাকা মিথেন গ্যাস ও তার হাইড্রেট ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে ছবিতেই যা দারুন লাগছিল, স্বচক্ষে দেখা হল না বলে আফশোস থেকে গেল।
(৩)
অতিথি পাখির দল, মাণ্ডবী সাগর-বেলা |
পরদিন প্রাতরাশ সেরে চেক আউট করে আমরা দুজনে একটা ট্যুরিস্ট ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কচ্ছের অদেখা অঞ্চলগুলো দেখার উদ্দেশ্যে, এটা ট্যুর প্রোগ্রামের বাইরে। কচ্ছের দক্ষিণ প্রান্তে আরব সাগর উপকূলে প্রাচীন শহর মাণ্ডবী, সৈকতের বালি কিছুটা পিঙ্গলবর্ণের, তবে পরিষ্কার।
সমুদ্র-উপকূল, মাণ্ডবী |
আবার দেখা গেল বেশ কিছু অতিথি পাখি সমুদ্রে খেলা করছে। ভাল লাগল দেখে যে উপস্থিত পর্যটকরা তাদের বিরক্ত করছেন না। বেশ কিছু হাওয়া-কল (wind-mill) আছে দেখলাম সমুদ্র-তীরে, হাওয়াও দিচ্ছে ভালই, কিন্তু একটাকেও জানিনা কেন ঘুরতে দেখলাম না। সম্ভবতঃ পাওয়ার গ্রিডটিই কাজ করছিল না। এরপর এলাম জাদেজা-রাজকুমার বিজয়রাজির ১৯২০ সালে নির্মিত বিজয় বিলাস প্রাসাদে। তিনি এই বিশাল রাজভবনটির নির্মাণ করেন রাজপরিবারের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান হিসেবে।
বিজয় মহল প্রাসাদ, মাণ্ডবী, কচ্ছ |
গাইড জানালেন এখানে বলিউডের হিট ছবি ‘লাগান’ ও ‘হাম দিল দে চুকে সনম’এর স্যুটিং হয়েছিল। ফেরার পথে ৮০ একর জমির উপর গড়ে ওঠা বিখ্যাত জৈন-মন্দির ৭২-জিনালয় দেখে নিলাম আদানিদের শহর মুন্দ্রার পথে। ভুজের বিশাল স্বামীনারায়ণ মন্দির ও প্রাগ-মহল আয়না মহলের সংগ্রহশালা দেখে সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টায় ভুজের একটি হোটেলে আশ্রয় নিলাম। তবে তার আগে ট্যাক্সি-ওলা আহ্মেদ আমাদের ভুজের থেকে আট কিলোমিটার দূরে হস্তশিল্পের জন্যে বিখ্যাত ‘ভুজোডি’ গ্রাম দেখিয়ে আনতে ভোলেনি। তবে সেখানকার শামজিভাইএর নিজস্ব তাঁতে বোনা পশমী শালের কারুকার্য না দেখলে হয়ত ঠকতাম।
স্বামীনারায়ণ মন্দির, ভুজ |
অন্তরে অতৃপ্তি তবু থেকে যায়। এবার দেখা হল না নারায়ণ-সরোবর সহ পশ্চিম-কচ্ছ, ছোট-রাণ, বন্য-গাধা ও গ্রেট বাস্টার্ড অভয়ারণ্য এবং হরপ্পা-সিন্ধু সভ্যতার স্মৃতি-বিজড়িত পুরাতাত্বিক ‘ঢোলাবীরা’ অঞ্চল। জানিনা আবার কবে আসা হবে। গুজরাত রাজ্য পর্যটন বিভাগের প্রোমোশন-এম্বাস্যাডার হিসেবে মাণ্ডবীতে দাঁড়িয়ে বিগ-বি বলেছিলেন- ‘কচ্ছ নেহি দেখা তো কুছ নেহি দেখা’। তাই আপাততঃ আক্ষেপ নেই, ‘কুছ’ দেখা ত হল!
লেখক পরিচিতি - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো ও অবসর) প্রকাশিত ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।