“ইয়াহাঁ দেখিয়ে ইসা পূর্ব করীব ২৫০০ সাল তক পহলা স্টেজ কে মনুষৌঁকী বাস থী। উসকে বাদ ইসা পূর্ব করীব ১৪৫০ তক কুল সাত স্টেজোঁ মে ইয়াহাঁ বাস হুই থী।” ধোলাভিরার গাইড ‘রৌজিভাই’ পাথরে গাঁথা জলের রিসর্ভরে দাগ দেখিয়ে আমাদের বোঝালেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে দুপুরে রোদের তেজ আমাদের তাতিয়ে দিচ্ছে কিন্তু আমরা মন দিয়ে ভারতের এই নবতম আবিষ্কৃত এবং সব থেকে বড় ‘হরপ্পা-সভ্যতার’ কালের শহরের কাহিনি শুনছি।
শুধু যে স্কুল-পাঠ্য ইতিহাসের বইয়ে ধোলাভিরার উল্লেখ নেই তাই নয়, উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্যক্রমেও এর কথা এখনও স্থান পায়নি। এর কারণ এই জায়গার আবিষ্কার যে.পি.জোশি ১৯৬৭-৬৮ করলেও ১৯৯০ সাল থেকেই আর.এস.বিস্ট এবং তাঁর সহকারী কে.সি.নৌরিয়ালের খনন কার্যের ফলেই এর কথা লোক সমক্ষে আসতে পেরেছে। আমাদের গাইড রৌজিভাই শ্রী বিস্ট-এর কাছেই প্রায় ২০ বছর সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করার দৌলতে এখানকার সমস্ত কিছু তাঁর নখদর্পণে।
গুজরাটের কচ্ছ জেলার উত্তর-পূর্বে ‘গ্রেট রান অব্ কচ্ছ।‘ এর উত্তরে ‘খাদির’ নামে এক দ্বীপ। সেই দ্বীপের এক স্থান এই ‘ধোলাভিরা’।
চিত্র-১: ধোলাভিরার অবস্থান মানচিত্র
খাদিরের চারপাশ বর্ষায় সমুদ্রের জলে ভরে যায়, আর তখনই খাদির, দ্বীপের আকার নেয়। তবে এই সমুদ্রের জল অগভীর, আর তাই বর্ষার সময় শেষ হয়ে গেলে এই লবণাক্ত জল শুকিয়ে গিয়ে ভূমি লবণের সাদা স্তরে ঢেকে যায়। একেই বলে ‘রান’ আর এই অঞ্চলে এই রানের আকারের কারণে বলা হয়ে থাকে ‘গ্রেট রান।’ এই রানের সম্পর্কে স্কুলের ভূগোলে আমরা পড়েছি। ধোলাভিরায় বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে আসতে গেলে এই ‘লবণের সমুদ্র’ পার হতে হয়। এও এক অপরূপ ও অভিনব অভিজ্ঞতা।
ধোলাভিরায় আমরা প্রথমেই দেখলাম ‘আরকিওলজিকাল মিউজিয়াম।’ মিউজিয়ামে আছে খননের ফলে পাওয়া কলসি, জলের কুঁজো, শস্য রাখার জালা, শিল মোহর, বাটখারা, চুড়ি ও মালা, নানা রঙের ও চেহারার পুঁতি, পাথর ও তামার তৈরি হাতুড়ি ও কুড়ুল ইত্যাদি বিভিন্ন যন্ত্র, মানুষ-পুতুল, পশু-পাখির পুতুল ইত্যাদি এবং বেশ কিছু ছবি।
চিত্র-২
চিত্র-৩
চিত্র-৪
মিউজিয়ামে রাখা বিভিন্ন জিনিসের ছবি (ছবি- আশা অধিকারী )
এই ছবির প্রথম দুইটিই হল ফটোর ফটো। এখানে পাওয়া অনেক জিনিসই দিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালায় রাখা আছে। রৌজিভাই দুঃখ করে বললেন যে ‘ট্রঙ্ক ভর ভরকে দিল্লি কী মিউজিয়াম মে লে চলা গয়া।’ ওনার বলার ভঙ্গিতে মনে হল যেন ওনার পৈত্রিক সম্পত্তি অন্য লোকে ছিনিয়ে মিয়ে গেছে। আসলে আমার অবশ্য ধারনা হল যে ঐতিহাসিক বস্তুর নিরাপত্তার কারণেই এমন করা হয়েছে।
চিত্র-৫: ধোলাভিরার পরিচয় ফলক (ছবি - সুজিত কুমার ঘোষ)
মিউজিয়ামের পাশেই রয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগের অফিস আর সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান আর পার্কিং স্পেস। এই সব পার করে সামনে পেলাম ধোলাভিরার পরিচয় ফলক এবং তার পর ঊষর জমি। সেখানে দু স্তরে মোটা বড় ইটের আকারে পাথর দিয়ে গাঁথা পাঁচিলে ঘেরা ঢিবি। এটাই ছিল শহরাধিপতির দুর্গের আকারে নিবাসস্থল, ‘সিটাডেল।’ ।
চিত্র-৬: সামনে সিটাডেল, ডান দিকে ঝোলা হাতে রৌজিভাই
চিত্র-৭: কাছ থেকে সিটাডেল (ছবি- আশা অধিকারী)
এই রাজপ্রাসাদের মধ্যে স্নানঘর, জল-নিকাশির ব্যবস্থা, পাকা রাস্তা ইত্যাদি ছিল। কাছেই কর্মচারীদের বাসস্থানও ছিল। সেই অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘bailey।’ রাজপ্রাসাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার, দুই স্তরে মোটা দেয়াল (চিত্র-৮: সিটাডেল সংরক্ষণের দেয়াল)। এ ছাড়া শহরের সর্বোচ্চ জায়গায় নির্মিত। আমার মনে হল এই ব্যবস্থা কি রাজার প্রাধান্য দেখাতে না বহিঃশত্রু বা এমন কি অন্তর্বিদ্রোহ থেকে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার্থে?
চিত্র-৮: সিটাডেল সংরক্ষণের দেয়াল
চিত্র-৯: মধ্য ও নিম্ন শহরের মাঝে (ছবি- ধীরেন কুমার কর্মকার)
রাজবাড়ির উত্তর দিকে ক্রমশ নিচু হয়ে যাওয়া স্তরে ‘মধ্য-শহর’ ও উত্তর-পূর্ব দিকে ‘নিম্ন-শহর’ ছিল যেখানে সাধারণের জন্যে বাসস্থান আর কারখানা ও সেখানে কাজ করার কর্মচারীদের বাসস্থানের মধ্যে পরিষ্কার সীমারেখা লক্ষণীয়। কারখানায় বিভিন্ন রকমের মূল্যবান পাথরের পুঁতি, পাথর ও তামার হাতুড়ি, কুড়ুল, মানুষ ও পশু-পাথির পুতুল ইত্যাদি তৈরির প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং এও জানা গেছে যে এখানকার সঙ্গে সমুদ্র-পথে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এই সমস্ত সামগ্রীর ব্যবসায়িক লেন-দেন হতো। মধ্য- ও নিম্ন-শহরের মধ্যে বেশ চওড়া গাড়ি চলার মত রাস্তাও বোঝা যায়।
হরপ্পা, যাকে আগে সিন্ধু-সভ্যতা বলা হতো, সেকালের অন্যান্য শহরের মতোই এই শহরও জ্যামিতিক নক্সার ভিত্তিতে এবং স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান মেনে পাকা ও ঢাকা নর্দমা সহ নির্মিত (চিত্র-১০: পয়ঃ-প্রণালীর মুখ)। এটা উল্লেখনীয় যে এই অঞ্চল ও আশপাশ যা গুজরাটের কচ্ছ বলে পরিচিত, সেখানকার মানুষ প্রধানত সমুদ্রপথে ব্যবসায়ে জড়িত। এই যে বিভিন্ন জিনিসের উৎপাদন হতো এখানে, সেগুলি সমুদ্রপথে চালান যাবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমার বক্তব্য যে সেই হরপ্পা সভ্যতার কাল থেকেই এখানকার মানুষ এই ব্যবসায়ে লিপ্ত। এখন অবশ্য কচ্ছের মানুষ কাঠের ব্যবসায়ের দিকে বেশি ঝুঁকেছেন। অন্তত বাংলায় যা Saw mill আছে তার অধিকাংশ প্যাটেল পদবীধারী দের, যাঁরা আসলে কচ্ছের অধিবাসী। প্রসঙ্গক্রমে সমুদ্রপথে ব্যবসা সম্পর্কে কথা বলাতে মনে পড়ে গেল কাছাকাছিই সেই সময়কার সমুদ্রপোতের কথা। লোথাল এখান থেকে খুব একটা দূরে অবস্থিত নয়। যাক এখন এ প্রসঙ্গ আর নয়।
আবার ফিরে আশি ধোলাভিরা পরিদর্শনে। একটা বেশ বড় ও আর একটা তুলনায় ছোট গ্যালারি সহ ঘেরা মাঠ পাওয়া গেছে। মাঠে ঢোকার জন্যে সিটাডেল থেকে সোজা পাঁচিলে ঘেরা রাস্তার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। এ নিশ্চয় বিশেষ, অর্থাৎ রাজবাড়ি থেকে আসা দর্শকদের জন্যে ব্যবহার হতো। সাধারণের জন্যেও মাঠে ঢোকার ব্যবস্থা চোখে পড়ে। মাঠ কি খেলা-ধুলার জন্যে ব্যবহার হতো না কি আমোদ-আহ্লাদের জন্যে, হলে কি সব হতো, তা কিছু জানা নেই। এ সব ঐতিহাসিকগণ ভাববেন।
আগেই রৌজি ভাইয়ের কথা থেকে জেনেছেন এই শহরের পর্যায়ক্রমে মানুষ বসবাসের সময়-কালের কথা। এবং এও জানেন যে হরপ্পা-সভ্যতা অন্ত হবার এক প্রধান কারণ ছিল জলের অভাব, যা নাকি মনে করা হয় সরস্বতী নদীর গতি পরিবর্তন ও শুকিয়ে যাবার কারণে ঘটে ছিল। এই জলের অভাব মেটাবার জন্যেই সম্ভবত এখানে শহরের প্রান্তে বিরাটাকার ৭মিটার গভীর ও মোট ৭৯মিটারের ১৬টি জলাধার ক্রমশ উঁচু থেকে নিচের তলে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রত্যেকটির মধ্যে নিচেতে ‘ভাল্ভ’-এর সাহায্যে সংযোগ করা ছিল। প্রত্যেকটি জলাধারে নিচে নামবার জন্যে সিঁড়ি আছে (চিত্র-১১ ও চিত্র-১২)। যেহেতু এখানে প্রথম বসবাস কালেই (খ্রিষ্ট-পূর্ব ২৫০০) এই জলাধার নির্মিত হয় তাই অনুমান করা যায় যে তখন থেকেই এখানে জলাভাব লক্ষণীয় হয়েছিল। এছাড়া পয়ঃ-প্রণালি থেকে দেখা যায় যে বর্জ্য জলেরও রিসার্কুলেট করার ব্যবস্থা ছিল।
চিত্র-১১ একটি জলাধারের মধ্যে ১
চিত্র-১২ একটি জলাধারের মধ্যে ২ (ছবি- আশা অধিকারী)
হরপ্পা সভ্যতার কালের শহরে বাড়ি নির্মাণ করার জন্যে পোড়া-মাটির ইট ব্যবহার হয়েছিল। একমাত্র এখানেই বড় ইটের আকারে পাথর দিয়ে নির্মাণ কার্য লক্ষণীয় (চিত্র-১৩)।
চিত্র-১৩: ঘরের দেয়াল, পাথরের ইটের ব্যবহার লক্ষণীয় (ছবি- আশা অধিকারী)
আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে এই শহরের। পৃথিবীতে সম্ভবত এখানেই প্রথম Notice-board ব্যবহার হয়েছিল সর্বসাধারণের জন্যে। তবে সেই বোর্ডে লেখা আমাদের জানা ভাষায় কি ছিল তা বলতে পারা যায় না, কারণ এখনও ওই সময়ের লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। বোর্ডটি কেমন ছিল অনুমান করা যায়। অন্তত ৯মি. দৈর্ঘ্যের কাঠের পাটাতনে পরস্পর দশটি ৩০X২০সেমি.২ ক্ষেত্রফলের তামার ফলকে সিলমোহরের মতো চিহ্ন লাগানো ছিল (চিত্র-১৪: নোটিস বোর্ডের লেখা) যা শহরের উত্তর দিকে দাঁড় করানো অথবা কোনও তোরণে লাগানো ছিল। কোনও কারণে পাটাতনটি পড়ে যায়, কালক্রমে কাঠ নষ্ট হয়, কিন্তু চিহ্নের ব্লক গুলো থেকে যায়। ১৯৯০-এর পরে খননের পর উদ্ধার পায়। চিহ্নের ব্লক গুলো দিল্লির মিউজিয়ামে রাখা আছে।
চিত্র-১৪: নোটিস বোর্ডের লেখা (ছবির সূত্র - ইন্টারনেট)
নীচের Youtube-এর এই ভিডিও ক্লিপ আপনাকে ধোলাভিরায় virtual world-এ সাময়িক ভাবে নিয়ে যেতে পারবে।
একটা ব্যাপার উল্লেখ্য, এখানে কোনও কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। যদিও অনেকগুলো সমাধির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোনও অজানা কারণে ২০০৫ থেকে খনন বন্ধ আছে। বেশ কিছু জায়গা খননযোগ্য বলে চিহ্নিত আছে (চিত্র-১৫: চাপা দেওয়া খননের জায়গা, SAM_0366, ধীরেন কুমার কর্মকার)। আবার কাজ আরম্ভ হলে হয়ত এই অভাবের সুরাহা এবং আরও অনেক কিছু জানা যাবে। আমি খোঁজ পাইনি যে আবার খনন আরম্ভ হয়েছে কি না।
চিত্র-১৫: চাপা দেওয়া খননের জায়গা (ছবি- ধীরেন কুমার কর্মকার)
রৌজিভাই অবশ্য আমাদের কিছুদিন আগে বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে গিয়ে ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া মানুষের হাড় মাটির স্তরে বেরিয়ে এসেছে দেখালেন। মাটিতে সেই ‘হাড়গুঁড়ো’ এমন ভাবে মিশে ছিল যে ছবিতে তা বোঝানো অসম্ভব। যে হেতু এখনো পর্যন্ত জায়গাটি সাধারণ ভ্রমণার্থীদের কাছে বিখ্যাত হয়নি, তাই তেমন ভাবে ভিড় হয় না, সেই কারণে খুঁজলে মাটিতে তখনকার দিনের তৈরি পুঁতি ইত্যাদি এখনো পাওয়া যায়। চলার পথে উনি একটি এজেট পাথরের পুঁতি খুঁজেও পান ও আমাদের দেখান।
চিত্র-১৮: নিম্ন শহরের প্রাকার আর দূরে রান দেখা যাচ্ছে (ছবি- আশা অধিকারী)
রচনার প্রায় শুরুতেই বলেছি যে ধোলাভিরায় আসবার সময় ‘গ্রেট রান অব্ কচ্ছ’ পার হওয়ার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা আপনার উপরি পাওনা হবে যদি আপনি বর্ষা কাল বাদ দিয়ে এখানে যান। আপনার মনে হবে আপনি দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউহীন স্থির দুধের সমুদ্রের উপর দিয়ে যাচ্ছেন (চিত্র-১৬ ও চিত্র-১৭)। নিম্ন শহরের প্রাকার থেকে দূরে দিক্চক্রবালে গ্রেট রানের অল্প অংশ দেখাও যায় (চিত্র-১৮)।
নীচের Youtube-এর এই ভিডিও ক্লিপটি আপনাকে এর রোমাঞ্চ কিছুটা ভোগ করাতে পারবে আশা রাখি।
কি করে পৌঁছবেন: ভুজ ও আমেদাবাদ থেকে ধোলাভিরা পৌঁছানো যায়। ভুজ থেকে খভদা হয়ে ১৪০কিমি আর রাপার হয়ে ২৪০কিমি। দ্বিতীয় রাস্তা অনেক ভাল। আমেদাবাদ থেকে রাপার হয়ে ৪৪০কিমি। যদি ভুজে আসেন ট্রেনে, তা হলে ভুজ পৌঁছানোর আগেই সামাখিলিইয়ায় নেমে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। বাস আছে তবে নিজের গাড়িতে সুবিধা হবে এটাই স্বাভাবিক।
কোথায় থাকবেন: ভুজ ও আমেদাবাদে বিভিন্ন মানের ও দামের অনেক হোটেল আছে। রাত্রিবাসের জন্যে গুজরাতে রাস্তার ধারে অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আশ্রম আছে। গাড়ির ড্রাইভার আপনাকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। ধোলাভিরায় গুজরাত ট্যুরিজিমের বাংলো, ‘তোরাণ’ আছে। যোগাযোগ করতে পারেন (ভুজ: ০২৮৩২২২৪৯১০ আর ধোলাভিরা: ০২৮৩৭২৭৭৩৯৫)।
লেখক পরিচিতি - শিক্ষাবিদ। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন বহু বছর। নেশা হচ্ছে ভ্রমণ। অবসর-এর একজন নিয়মিত লেখক।