প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

জুলাই ৩০, ২০১৫

 

পূর্ব- ও উত্তর-তাজ

শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী


যে কোনও সৌধের মালিককেই আমরা সেই সৌধের নির্মানকারী বলে থাকি। সেই বিচারে আমরা বলতে বাধ্য যে তাজমহলের নির্মানকারী সাহজাহান। তবে এটা তো সন্দেহ করতেই পারি যে তাজের গঠন কেমন হবে সে সম্পর্কে সাহজাহানের নিজের ধারণা কেবল মাত্র দারুন যেন কিছু হয় এইটুকুই ছিল। তবে মান্ডু সম্পর্কে Archaeological Survey of India, New Delhi এক পরিচায়ক পুস্তিকাতে কিছু বর্ণনায় আছে যার থেকে তাঁর বাস্তু নির্মাণ শৈলী বিষয়ে কিছু ধারণা থাকা সম্পর্কে আশা করা বিচিত্র নয়। এই বিষয়ে কিছু পরে আবার আসা যাবে। যাই হোক নিশ্চয় তিনি তাঁর কাছের মানুষদের এমন এক অকল্পনীয় স্থাপত্য শৈলীর সৌধের সঠিক নির্মাণকারী বিশেষজ্ঞদের খুঁজে বের করতে বলেন। এই সম্পর্কে তাজ মহলের Official Website (www.tajmahal.gov.in) থেকে জানতে পারা যায় যে পারস্যদেশের বেনারুস নিবাসি পুরু ছিলেন স্থপতিদের প্রধান আর সেই দেশেরই ওস্তাদ ইসা ও ইসা মহম্মদ এফেন্দি স্থাপত্যকাররুপে প্রধান। তবে এই সাইটের লেখা অনুযায়ি ওস্তাদ ইসা ও ইসা মহম্মদ ভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে হয়। এনাদের নাম ছাড়া বেশ কিছু আরও নাম নির্মাণের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ রূপে উল্লেখ আছে। শেষে সারনির বাইরেও তিনটি নামের উল্লেখ আছে নির্মাণ সংক্রান্ত কাজের তত্ত্বাবধানের আধিকারিক হিসাবে।

Ismail Afandi (a.ka. Ismail Khan) of the Ottoman Empire Designer of the main dome.
Ustad Isa and Isa Muhammad Effendi of Persia Credited with a key role in the architectural design.
'Puru' from Benarus, Persia Mentioned as a Supervising Architect.
Qazim Khan, a native of Lahore Cast the solid Gold Finial.
Chiranjilal, a lapidary from Delhi The Chief Sculptor and Mosaicist
Amanat Khan from Shiraz, Iran The Chief Calligrapher
Besides the above, Muhammad Hanif, a supervisor of masons and Mir Abdul Karim with Mukkarimat Khan of Shiraz handled finances and management of daily production.

তাজ নির্মাণের নক্সা রচনা করতে গিয়ে পারস্য দেশের ও মোগল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত পূর্বতন কয়েকটি সৌধের নির্মাণ শৈলীর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের অনুসরণ করার ছাপ পড়েছে তা লক্ষ করা যায়। যেমন সমরকন্দে নির্মিত মোগল বংশের প্রথম পুরুষ তৈমুর-লং-এর সমাধি-সৌধ “গুর-এ-আমির”, আর ভারতে মোগল সম্রাটদের নির্মিত দিল্লির হুমাউঁর সমাধি-সৌধ, আগ্রার ইত্মাদ-উদ-দৌল্লার সমাধি-সৌধ ও সাহজাহানের নিজেরই নির্মিত দিল্লির “জামা-মসজিদ” উল্লেখ করা যায়।

কোন কোন স্থানে কী কী আবেশ তাজে এই সমস্ত সৌধগুলি থেকে পড়েছে সে সমস্ত তাত্ত্বিক আলোচনা অনেক ঐতিহাসিক-স্থাপত্যবিদগণ করেছেন, আমার সে বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা নেই কাজেই আর এই পথে গিয়ে নিজের অজ্ঞানতার প্রমাণ বাড়াচ্ছি না। তার বদলে আমি আমার এই পরিপ্রেক্ষিতে এক সাধারণ জিজ্ঞাসা আর তার সম্ভাব্য উত্তরের কথা আলোচনা করি।

প্রায় দশ বছর আগে আগরা বা দিল্লি থেকে মাত্র প্রায় ৯০০কিমি দূরে মালওয়া অঞ্চলে মান্ডও (অধিক পরিচিত মান্ডু নামে) বেড়াতে গিয়ে এক সমাধি সৌধের পরিসরে পাথরে লেখা এই ফলকটি দেখি (চিত্র-১)।


চিত্র-১, হোশঙ্গশাহ সমাধি-সৌধে লেখা

পাথরের এই ফলকটির ছবি হ্যান্ডিক্যামে তোলা ভিডিও থেকে grab করে এখানে দেখাচ্ছি, কাজেই ছবির গুণগত মান ভাল নয়।

কী বৈশিষ্ট্য আছে এই ফলকে? প্রথম প্যারাগ্রাফের শেষ অংশটিতে লেখা আছে যে তাজের সঙ্গে জড়িত স্থপতি ওস্তাদ হামিদ ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে এখানে তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। কিছু আগেই আমরা তাজ নির্মাণের কাজে বিভিন্ন আধিকারিকদের নামের তালিকাতে দেখেছি যে ওস্তাদ হামিদ নামের কোনও স্থপতি বা কর্মকর্তার উল্লেখ নেই। অবশ্য মুহাম্মদ হানিফ বলে একজন আছেন। ফলকে হয়তো এনার নামই ভুল লেখা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে আমার খুবই সন্দেহ হয় এই ফলকের reliability নিয়ে। প্রথমত এই ফলক কে বা কারা এবং কবে স্থাপন করেছেন তার কোনও উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত এটা নিশ্চয় ১৬৫৯-এর কাছাকাছি সময়ের নয়, কেন না তা হলে এটি লেখা হতো আরবি বা ফার্সি ভাষায়। তবে মান্ডু সম্পর্কে Archaeological Survey of India, New Delhi এক পরিচায়ক পুস্তিকাতে কোনও প্রমাণ না দেখিয়ে এর ২০০৪-এর সংস্করণের ৮ পাতায় লেখা আছে, “As a prince Shah Jehan visited Mandu twice and subsequently four of his court architects made a pilgrimage in A.D. 1659 to pay their homage to the master builders of the place. An inscription in the tomb of Hoshang Shah testifies to this fact; and it mentions Ustad Hamid, one of the four architects, who was closely associated with the building of the Taj at Agra. In view of the visits of this succession of Mughal emperors and their lively interest in the Mandu monuments, it may indeed be worthwhile to study and compare them together with the famous monuments at Agra and ascertain the possible influences of the former over the latter.”

এর পর আবার এই বই-এর ৩৯ পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, “On the right jamb of the door is an inscription recording that the four architects of Shah Jahan visited the place in A.D. 1659 to pay homage to the builders of the tomb. Of them, it may be noted, one was Ustad Hamid who was closely associated with the building of the famous Taj at Agra.” পাঠক আশা করি লক্ষ করেছেন ওস্তাদ হামিদ ইত্যাদিদের মান্ডু আসার সময় কিন্তু তাজ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে।

পরে কৌতূহল বশত ভোপালের ASI অফিসের আধিকারিককে e-mail করে এই ফলকের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাই। তাঁর কাছ থেকে যা উত্তর পেয়েছি তার থেকে ফলকটি যে পরে স্থাপন করা হয়েছে বোঝা যায়, কিন্তু সত্যই আরবি ভাষায় একটি অত্যন্ত ছোট (7"X4.5") ফলক পাশেই আছে যা আমি দেখতে পাইনি। তবে সেই আধিকারিক আমাকে Yazdani, G, “Mandu: The Inscriptions of Dhar and Mandu” বই থেকে সেই ফলকের কথা এবং তার একটি ছবির প্রতিলিপি পাঠিয়েছেন। পাঠকের জ্ঞাতার্থে চিত্র-২ ও চিত্র-৩-এ তা দেখিয়েছি। পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন ফলকের সম্পর্কে পূর্বের লেখাগুলোর, বিশেষ করে এর ঠিক ওপরের প্যারাগ্রাফটির প্রয়োজনীয়তা কোথায়। আমার মনে হয়েছে যে ওস্তাদ হামিদের নামে কিছু বিভ্রান্তি আছে ASI-এর মান্ডুর পরিচয় পুস্তিকা আর তাজের official website, (www.tajmahal.gov.in)-এর মধ্যে। এটা দেখানোর জন্যেই পূর্বের লেখাগুলোর প্রয়োজনীয়তা।


চিত্র-২: ফলক ও তার ইংরাজি তর্জমা ও কিছু তথ্য


চিত্র-৩: ফলকের প্রতিলিপির ছবি

যাই হোক, এবার এই সৌধের সঙ্গে তাজের কি সম্পর্ক হতে পারে দেখা যাক। তাজ নির্মাণ সম্পূর্ণ হবার দু’শো বছরেরও আগে, মালওয়া অঞ্চলে মান্ডও বা মান্ডু বিন্ধ পর্বতমালার মধ্যে প্রায় ৬৩৫মি. উচ্চ পাহাড়ের ওপর এক দুর্গ-শহর ক্রমশ গড়ে ওঠে। এই শহর গড়ে ওঠার পিছনে ১৩০৫ খ্রিষ্টাব্দের আগেই অন্তত হাজার বছরের বেশি ইতিহাস আছে কিন্তু এই রচনায় ইতিহাসের সেই অংশের সম্পর্কে জানার বিশেষ প্রয়োজন নেই। তবে এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে হিন্দু রাজাদের মধ্যে পারমার বংশের বিখ্যাত ভোজরাজও ছিলেন। এই বছর, অর্থাৎ ১৩০৫-এ মান্ডু বা মান্ডওএর হিন্দু রাজত্ব শেষ হয় আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি আইনুল-মুল্ক-এর কাছে মাহ্‌লক দেবের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে। আর মান্ডু, দিল্লি সুলতানেটের অংশ হয়। এর পর মহম্মদ-বিন-তুঘলকের কালে দিলেওয়ার খান ঘোরি মান্ডুর রাজ্যপাল নিযুক্ত হন কিন্তু দিল্লিতে অরাজকতার সুযোগে ১৪০১ খ্রিষ্টাব্দে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং মান্ডুর বদলে কাছাকাছি ‘ধার’-এ রাজধানী স্থাপন করেন। ১৪০৫-এ দিলেওয়ার খানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আল্প খান সিংহাসনে আরূঢ় হয়ে রাজধানী ধার থেকে পুনরায় মান্ডুতে স্থানান্তরিত করেন আর হোশাঙ্গ শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। আফগানি উৎসের এই শাহ যোদ্ধা সহ ভালই বাস্তুকার ছিলেন। যেমন তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্বকালে মান্ডুর পরিসীমা বাড়িয়েছিলেন তেমনই বেশ কিছু অতি সুন্দর নির্মাণ কার্যও করেছিলেন অথবা নির্মাণের শুরু করেছিলেন। এই সমস্ত নির্মাণের মধ্যে আছে দুর্গ-শহরের প্রাকার সম্পূর্ণ করা, মান্ডুর জামা-মসজিদ আর দিল্লি গেট। প্রাকারের দৃঢ়তা ও এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ফিরিস্তা ও জাহাঙ্গীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত হল তাঁর নিজের জন্যে নির্মিত সমাধি-সৌধ, যে বিষয়ে আমার এই আলোচনা। অবশ্য এই সৌধ নির্মাণের কিছু অংশ তাঁর মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ হয়।

বিশেষজ্ঞের চোখ ও জ্ঞান দিয়ে নয়, সাধারণের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখা যাক এই সৌধের কোন বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাজ গঠনের কোন অংশের মিল আছে। হোশঙ্গশাহর সমাধি-সৌধ নির্মাণে ভারতের মধ্যে সর্বপ্রথম মর্মর ব্যবহার হয়েছে। এরপরই মর্মর ব্যবহার হয়েছে তাজে। যে সমস্ত সৌধের গঠন শৈলী অনুকরণ করে তাজ নির্মিত হয়েছে বলা হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে আর কোনও সৌধের নির্মাণে মর্মর ব্যবহার হয়নি। দুটি সৌধেরই কেন্দ্রীয় গম্বুজ (dome) অর্ধগোলাকার (চিত্র-৪)। তাজের শীর্ষ অবশ্য কিছুটা শঙ্কুর আকার নিয়েছে। তাজের গম্বুজের তুলনায় হোশঙ্গশাহের সৌধের গম্বুজের আকার বেশ ছোট।


চিত্র-৪, হোশাঙ্গশাহ সমাধি-সৌধ, সামনে থেকে

তাজের গম্বুজের আকার অনেক সময় পেঁয়াজের আকারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। প্রত্যেক বিষয়েই তাজের আকার অনেক গুন বড়, স্বাভাবিকভাবে মোট নির্মাণ ব্যয় দুয়ের মধ্যে কোন তুলনাই করা যায় না। গম্বুজের শীর্ষে চুড়ার (spire) গঠন একই প্রকারের আর গম্বুজের চার ধারে চারটি ছোট গম্বুজের আকারও অনেকটা এক, এমনকি দুই ক্ষেত্রেই পেঁয়াজের আকারের সঙ্গে তুলনীয়। দুই সৌধই বর্গাকার উঁচু ভিতের ওপর স্থাপিত। এ ছাড়া আরও কিছু মিল পাওয়া যায়। অন্যান্য তুলনা বিশেষজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দিয়ে কেবল মাত্র আর একটি বিষয়ে বলি, দুটি সৌধেই পাথরে খোদাই অতি সুন্দর জালির ব্যবহার (চিত্র-৫)।


চিত্র-৫, সমাধি-সৌধে পাথরে খোদিত জালি

হোশাঙ্গশাহের সমাধি-সৌধ দেখতে পৌঁছলাম বিকালে, তখন সামনের দিকের প্রধান প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে পাশের ছোট প্রবেশ পথ তখনও খোলা, দারোয়ান আমাদের সেখান হয়ে প্রবেশ করবার অনুমতি দিল। বিকেলের সোনালি রোদে মর্মরে নির্মিত সৌধ প্রায় সোনার রং-এ রাঙ্গানো হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে হ্যান্ডিক্যাম ব্যবহার করতে শুরু করে দিলাম। তখন আমার ডিজিটাল ক্যামেরা নেই, ফিল্ম ক্যামেরায় ছবি তুলতে একটু সময় লাগবে, তা ছাড়া পরের দিন এখানেই থাকবো, কাল তোলা যাবে। কিন্তু সেই কাল আর হল না। সৌধের পরিসরের মধ্যেই অনেকটা দৈর্ঘ্য এবং বেশ প্রস্থ বারান্দা। বারান্দার ছাদ দুই সারি থাম ধরে রেখেছে। চিত্র-৬-এ এই দুই সারি থামের এক সারি দেখানো হয়েছে। এই বারান্দা ঘেরা জায়গা ‘ধর্মশালা’


চিত্র-৬, ধর্মশালার বারান্দা

নামে পরিচিত এবং বলা হয় এর নির্মাণ-শৈলীতে হিন্দু শিল্পের ছাপ আছে। কারণ হিসাবে বলা হয় যে এর নির্মাণ সামগ্রী স্থানীয় হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে আনা হয়। অনেকের মতে নাকি এই সমাধি-সৌধও ভোজ রাজ নির্মিত শিব মন্দির ধ্বংস করে সেই ভিতের ওপর নির্মিত।

সৌধ চত্বরে যদিও কিছুক্ষণ কাটালাম কিন্তু বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসতে হল কেন না চত্বর বন্ধ হবার সময় পার হয়ে গিয়েছিলো। এর মাঝেই কয়েক মিনিট চলচ্চিত্রায়ন করে নিলাম, সেই চলচ্চিত্র দেখুন ইউটিউবের এই ক্লিপে।

এই সৌধের নির্মাণ কবে আরম্ভ হয়েছিল ঠিক মতো জানা নেই তবে নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছিল সম্ভবত ১৪৩৬ খ্রিষ্টাব্দে। আর তাজ মহলের প্রধান অংশের গঠন সম্পূর্ণ হয় ১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে, যদিও আশপাশের বাগান ও অন্যান্য গৃহাদির নির্মাণ সম্পূর্ণ হতে আরও প্রায় পাঁচ বছর লাগে অর্থাৎ তাজের সাজসজ্জা সহ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। অর্থাৎ হোশাঙ্গশাহের সমাধি-সৌধ ও মমতাজের সমাধি-সৌধের বয়সের পার্থক্য দুশো বছরেরও বেশি। এই আলোচনার ভিত্তিতে তাজের পূর্বসূরি হোশাঙ্গশাহের সমাধিকে বলতেই পারি। এই কারণেই আমি হোশঙ্গশাহের সমাধি-সৌধকে পূর্ব-তাজ আখ্যা দিয়েছি। অবশ্য এর গঠন-কালে তাজের কোনও অস্তিত্ব কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

...................................................................................................

এবার দেখা যাক তাজের উত্তরসূরি বা উত্তর-তাজ আছে কি না। মাতা ও কন্যার রূপে সম্পূর্ণ মিল না থাকলেও কিছু অন্তত থাকে, তাই দেখে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়। অনেক সময় আবার মাতা-কন্যায় এতটাই মিল হয় যে কেবল মাত্র শারীরিক ওজনের নিরিখেই দুজনের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায়। তাজ যখন মাতা, কন্যা ‘বিবি-কা-মকবরা’র ওজন অর্থাৎ শারীরিক বহর তুলনা করলে তবেই সম্পর্ক বোঝা যায়। দেখা যাক তা হলে।

আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তাঁর বিবি, অর্থাৎ দিলরস্‌ বানু বেগম বা রাবিয়া-উদ-দৌরানির কি বিশেষ সম্পর্ক তাদের পুত্র আজম শাহ লক্ষ করেছিলেন জানি না তবে তাঁর আম্মিজানের মকবরা নির্মাণ করার সময়ে তাঁর দাদীজানের মকবরার শকল দেবার ইচ্ছা হল। তবে এটা ঠিক যে আজম তাঁর দাদীজানের মকবরা কেবল মাত্র প্রেমের প্রতীক রূপেই ভেবেছিলেন তা হয়তো নয়, মন পসন্দ এক সৌধ হিসাবে বিচার করেই এমনটি করার ইচ্ছা হয়ে থাকতে পারে। অনেকেই ‘বিবি-কা-মকবরা’-কে তাজের অসফল নকল হিসাবে বর্ণনা বা বিচার করে থাকেন। আমার মনে হয় এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তাজের জন্যে যা খরচ করা হয়েছিল, তা করার আজমের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই এই মকবরা তাজের তুলনায় বেশ কিছুটা ছোট বা কম আকারে গড়া হয়েছে। আর একই গঠন শৈলী হলেই কী নকল বলতে হবে নাকি? এখানে উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে আওরাঙজেব এই ‘মক্‌বরা’ নির্মাণ করতে মাত্র ৭লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, আর গুলাম মুস্তাফা তাঁর রচনা ‘তারিখ-নামা’-য় লিখেছেন যে মোট খরচ হয়েছিল ৬,৬৮,২০৩ টাকা ৭ আনা। এই সুযোগে তাজ নির্মাণের খরচ কত হয়েছিল মনে করা যেতে পারে। বলা হয় এর মান নাকি ৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। আর একটা কথা ভাববার আছে। আজমের বদলে আওরঙ্গজেব খরচ নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন কেন তা জানি না। হয়তো সেই কারণেই অনেকে বলে থাকেন আওরাঙ্গজেবই নাকি ‘বিবি-কা-মকবারা’-র নির্মাতা। দরকার নেই আমাদের সে কথা নিয়ে তর্ক করতে। আমরা চেষ্টা করি ‘মা-মেয়ের’ মিল ও অমিল বিচার করতে, তবে সাধারণের চোখ দিয়ে, কোনও বিশেষজ্ঞের চোখ বা বিচার বুদ্ধি দিয়ে নয়। প্রথমেই সৌধের সামনে থেকে ছবি দেখে নিই (চিত্র-৭, বিবি-কা-মকবরা ও চিত্র-৮, মমতাজ-কা-মকবরা)।


চিত্র-৭, বিবি-কা-মকবরা


চিত্র-৮, মমতাজ-কা-মকবরা

এবার আমি পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি দুটি সৌধের ছবি একই দূরত্ব থেকে তোলা হয়নি বলে। তেমন হলে দুটির মধ্যে তুলনা করতে সুবিধা হতো। একই দূরত্ব থেকে না হবার কারণের মধ্যেই অবশ্য দুইয়ের একটা পার্থক্য বোঝাতে পারা যাবে। তুলনায় তাজের সামনের ঝিলের দৈর্ঘ্য অনেক বেশি। বিবি-কা-মকবরার সম দূরত্ব থেকে ছবি তুলতে হলে আমাকে off-centre হয়ে যেতে হতো। অবশ্য ছবির এই পার্থক্য নেহাতই ‘বাইরের’, ‘ভিতরের’ নয়। প্রধান যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হল দুটি সৌধের মধ্যে বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক অনুপাত যা গঠনের সামঞ্জস্য বা সুবিন্যাস প্রকাশ করে সেই সম্পর্কে। কেন্দ্রীয় গম্বুজ ও তার নিচের অংশ মিলিয়ে যে ensemble তার সঙ্গে পাশের দুদিকের ছোট গম্বুজ সহ গঠনের সাযুজ্যতা লক্ষ করুন, আপনার মনে হবে যেন বিবি-কা-মকবরায় কেন্দ্রীয় ensemble-কে চেপে ধরে আছে পাশের দুই গম্বুজ সহ দণ্ড। সেখানে তাজে যেন দুই ছোট বোন বা দুই যমজ কন্যা বড়দি বা মাকে জড়িয়ে পরম নিশ্চিন্তে আছে। মিনার চারটির ক্ষেত্রেও তাদের শরীর কেমন যেন বেমানান কেন্দ্রীয় অংশের সঙ্গে বিবি-কা-মকবরায়। তাজে মিনার চারটি মনে হয় সম্রাজ্ঞীকে মাঝে এবং সম্মানীয় দূরত্ব বজায় রেখে দণ্ডায়মান আছে, সেখানে বিবি-কা-মকবরার মিনার চারটি যেন চার দৈত্য এক ছোট মেয়েকে শাসন করে চেপে ধরে আছে।

যদিও সৌধ নির্মাণের সময় এর গঠন করা হয়নি, তা হলেও বিবি-কা-মকবরার বাঁ দিকে হায়দ্রাবাদের এক নিজাম এক মসজিদ নির্মাণ করে সৌধের সামঞ্জস্যের হানি ঘটিয়েছেন। সৌধের সামনে সবুজায়নের ঘাটতি আছে, অবশ্য জানা নেই যে প্রথম থেকেই এই অবস্থা ছিল কি না। পরিসরের কেন্দ্রে সৌধ গঠনের যে মোগল রীতি চালু আছে দুইয়েরই ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। তাজের পিছন দিকে যমুনা আর বিবি-কা-মকবরার ক্ষেত্রে যদিও কিছু দূরে, শাহয়াদ্রি বা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অংশ রয়েছে।

এই সমস্ত তুলনামূলক বর্ণনা দুটি সৌধকে কিছুটা দূর থেকে দর্শন করার ফলে। একেবারে কাছে চলে আসলে দেখবো তাজের শরীরে অসংখ্য, যদিও বিশেষ করে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে বিদেশি লুটেরারা খামচে নিয়ে গেছে, তা হলেও মূল্যবান গহনার জায়গায় অন্তত মেকি গহনা পরানো আছে। দিলর্‌স বানু বেগমের মকবরার শরীরে তুলনায় অনেক কম গহনা দেখা যায়। দুটি ছবি (চিত্র-৯ ও চিত্র-১০) দেখাই উদাহরণ স্বরূপ।


চিত্র ৯ ও ১০, বিবি-কা-মকবরার দুই দেয়ালে



চিত্র-১১ ও ১২, তাজের দুই দেয়ালে

তুলনা করার জন্যে তাজের দেয়ালের দুটি মোটিফ তুলে ধরলাম (এই ছবি ইন্টারনেটে en.wikipedia.org/wiki/Taj_Mahal থেকে নেওয়া)। পাঠক বিচার করবেন এর গুণগত পার্থক্য। আমি তো আগেই খরচের বহরের কথা বলে দিয়েছি। তবে চিত্র-৯-এ যে মোটিফটি দেখিয়েছি, তা প্লাস্টারে করা। ডাডোর ওপর থেকে গম্বুজের নিচ পর্যন্ত বাসাল্ট পাথরে গেঁথে তার ওপর মার্বল ফিনিশিং দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে বিবি-কা-মকবরাতে। চিত্র-১০-এর কাজটা পাথর বসিয়ে, অর্থাৎ inlay work কি না, আমার জানা নেই। বিবি-কা-মকবরায় calligraphy-র অভাব, মমতাজ-কা-মকবরায় এই শিল্প অপরূপ।

তাজের স্থপতিদের বিষয়ে রচনার প্রথমেই আলোচনা করেছি, আওরাঙ্গাবাদের সৌধের প্রধান স্থপতি নিয়োজিত হয়েছিলেন আতা উল্লাহ। ইনি তাজের স্থপতি ওস্তাদ আহমাদ লাহাউরির পুত্র। নির্মাণকার্যের (Engineering) ব্যবস্থাপনায় ছিলেন হাঁসপত রাই। সৌধের নির্মাণ কাল দশ বছর ১৬৫১ থেকে ১৬৬১, অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই খুশদমন ও বহুর সমাধি সৌধ গঠিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে যে খুশদমনকে প্রাথমিক ভাবে অন্য যায়গায় (বুরহানপুর) দফন করা হয়েছিল, বেশ কয়েক বছর পরে তাজ নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে কফন এখানে নতুন করে প্রোথিত হয়। বহুর ক্ষেত্রে তা হয়েছিল কি না আমার জানা নেই।

যদিও দুই ক্ষেত্রেই সমাধি ভিতের নিচে, কিন্তু তাজে সেখানে পৌঁছাতে গেলে নিচের ঘরে যেতে হয়, কিন্তু দিলর্‌স-বানু-বেগমের সমাধি প্রধান ঘরেই আছে, অবশ্য ওপরের বারান্দা থেকে দেখতে হয়। এনার জন্যে কোনও false-সমাধি করা নেই। এই সমাধির ওপর কোনও কারু-কার্য করা আছে কি না বোঝার উপায় নেই কেন না সম্পূর্ণ সমাধি বিরাট চাদরে আচ্ছাদিত। মমতাজ ও সাহজাহানের সমাধিদ্বয়ের ওপর অপরূপ কারু-কার্যের কথা তো জানা। হ্যাঁ, আওরাঙ্গজেবকে দিলরস্‌-বানু-বেগমের পাশে সমাধিস্থ করা হয়নি, আওরাঙ্গাবাদ শহরের কাছেই খুবই সাধারণ সমাধি-সৌধে সমাধিস্থ আছেন।

আমার এই রচনা আদতে ভ্রমণ সম্পর্কীয়। তাই এর সম্পূর্ণতা দিতে গেলে বিবি-কা-মকবরায় আমার ভ্রমণের কথা বলতেই হয়। তাজে ভ্রমণের কথা এখানে আনছি না। তার কারণ তাজে ভ্রমণ জল-ভাত, শুধু শুধু পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করছি না। ২০১৩ সালে আমরা অনেক জন মিলে মহারাষ্ট্রের বেশ কিছু জায়গায় ঘুরতে গিয়ে আওরঙ্গাবাদেও গিয়েছিলাম। বিবি-কা-মকবরায় পৌঁছলাম দুপুরে। অক্টোবর মাসে বর্ষা শেষে রোদের তেজ বেশ ছিল, কিন্তু ভ্রমণে বেরিয়ে সে কথা ভাবলে চলবে? উপভোগ করলাম বিবি-কা-মকবরার চত্বরে ঘুরে। যথারীতি ভিডিও ছবি নিলাম আর আপনাদের জন্যে উপস্থিত করলাম।

আমার মনে হয় যে এই ক্লিপ দেখার পর এই ভ্রমণের ভাষায় বর্ণনা খুবই বিরক্তিকর লাগবে।


লেখক পরিচিতি - শিক্ষাবিদ। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন বহু বছর। নেশা হচ্ছে ভ্রমণ। অবসর-এর একজন নিয়মিত লেখক।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।