প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

জুলাই ৩০, ২০১৫

 

এবং ধীরে বহে রাইন

সোমেন দে


প্রাচীন রোমানরা ভাবতো একদিকে রাইন নদী আর একদিকে হারসিনিয়ার জঙ্গল এই হচ্ছে সভ্য জগতের সীমানা। এর ওপারে আর কোনো সভ্যতা নেই। রোম নামের ছোট্ট দেশের সম্রাটরা কব্জা করে নিয়েছিল তাদের ধারণার সভ্য জগতের অনেকটাই। প্রায় পাঁচশো বছর ইয়োরোপ ও এশিয়ার অনেক খানি দখল করে জমিয়ে রাজত্ব করেছিল তারা। তার পর অনেক জল গড়িয়ে গেছে এই সুইজারল্যন্ডের আল্পস থেকে নেদার ল্যান্ডের নর্থ সি অবধি বিস্তৃত রাইন নদী দিয়ে। অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ ,,অনেক রক্তপাত, অনেক সাম্রাজ্যের উত্থান পতন , অনেক সম্রাটের জয়-পরাজয় , অনেক বিখ্যাত প্রেম , অনেক কুখ্যাত ঘৃণা , অনেক অসির ঝনঝনানি , অনেক কামানের গর্জন , অনেক বোমা বৃষ্টি, অনেক নরহত্যার উল্লাস, এসবের নীরব সাক্ষী থেকেছে এই রাইন। কোলরিজের ‘কোলোন’ নামের একটি কবিতায় তাই ছায়া পড়েছে সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের – 

In Kohln, a town of monks and bones,
And pavements fang’d with murderous stones
And rags, and hags, and hideous wenches;
I counted two and seventy stench,

তবু এ সব পেরিয়ে আজ পশ্চিম ইয়োরোপের ইতিহাস , ভুগোল , অর্থনীতি , সংস্কৃতি সব কিছুর মধ্যেই আছে রাইনের অনিবার্য উপস্থিতি।

এমন নদীর সামনে দাঁড়িয়ে আমার উত্তেজনাটা অনেকটা লালমোহন বাবুর রাজস্থানে গিয়ে প্রথমবার উটে চড়ার মতন হল যখন আমরা কোলোন নামের দু হাজার বছরের পুরোনো শহরের বুক চিরে ধীরে বহমান রাইনের ধারে দাঁড়ালাম। অষ্টোত্তর শতনাম নাহলেও এ নদীর দেশে দেশে ভিন্ন নাম। জার্মানরা বলে Rhein , ডাচ রা বলে Rijn , ফরাসিরা বলে Rhin,  রোমানরা বলতো Rhenus। আমরা নাহয় ইংরেজদের মত করে রাইন নামেই ডাকি। রাইনল্যান্ড, মানে যে সব দেশের ভিতর দিয়ে এই নদী গেছে সেই সব দেশের লোকেদের এই নদী কে নিয়ে বিস্তর আবেগ। অনেক কল্পকাহিনী আছে , কাব্য আছে , গান আছে। আমাদের গঙ্গা যমুনা ব্রহ্মপুত্রের মত। বিশেষ করে জার্মানরা তো রাইন নিয়ে প্রবল অভিমানী। কারণ জার্মান দেশের অধিকাংশ বড় শহরই এই রাইনের ধারে। তার মধ্যে একটি হল এই শহর কোলোন।

ইউরোপের সব পুরোনো শহরের বিন্যাসের একটা চেনা প্যাটার্ন আছে । কিছু ক্যাথিড্র্যাল , স্কোয়ার , ক্যাসেল ও মিউজিয়াম এই সব নিয়ে এক ধরণের নগর পরিকল্পনা। তবু তার মধ্যেই কিছু কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। আর আছে আলাদা আলাদা ইতিহাস। যেমন আছে এই কোলোন শহরের।

খৃস্ট পূর্ব কয়েক বছর থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর কিছুটা সময় অবধি এই শহর ছিল রোমানদের দখলে। প্রায় গোটা রাইনল্যান্ডেই তখন রোমানদের রমরমা । ১৭৯৪ এর ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনের সময় কোলন শহর চলে যায় ফরাসিদের দখলে। ১৮০০ সালে এ শহরের নাগরিকদের ফরাসী নাগরিক বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়। ১৮০৪ সালে স্বয়ং নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তাঁর বেগম সাহেবাকে নিয়ে আসেন এ শহরে। কিন্তু ১৮১৪ সালে এ শহরের দখল নিয়ে নেয় প্রুসিয়ান আর রাশিয়ানরা মিলে। ১৮১৫ সালে এ শহর প্রুশিয়ার অংশ বলে ঘোষনা করা হয়। তারপর ১৯২৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ আর্মি অফ রাইন দখল নিয়ে নেয় কোলোনের। বিশ্বযুদ্ধের পরে ট্রিটি অফ ভারসিলিজ অনুযায়ী রাইনল্যান্ড এর দখল ছেড়ে দেয় এলিজ পাওয়ার বা মিত্র-শক্তি। কোলোন এই সময় ফিরে আসে জার্মানদের হাতে। হিটলারের নেতৃত্বে নাজিদের উত্থান হয়। এ শহরে কমিউনিস্ট এবং ক্যাথলিকদের আধিপত্য থাকায় নাজিরা এই শহরের ব্যাপারে বেশ চিন্তিত ছিল। কিন্তু ১৯৩৩ সালের ভোটে নাজিরা কায়দা করে বেশি ভোট পেয়ে এ শহরের দখল নেয়। তার পর সব বিরোধী পক্ষের নেতাদের জেলে পাঠিয়ে দেয়। সে সময় এ শহরে প্রায় বিশ হাজার ইহুদি বাস করত। নাজিরা দখল নেওয়ার পরে অনেকেই কোলোন ছেড়ে চলে যায়। যারা রয়ে গেছলো , ১৯৪১ সালে হিটলারের আদেশে নাজিরা তাদের পাঠিয়ে দিয়েছিল কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। তখন যুদ্ধ চলছে জোর কদমে। হিটলারের ভয়াবহ জয়যাত্রার পর অবশেষে মিত্র-বাহিনী ঘুরে দাঁড়াল। ১৯৪২ এর ৩০শে মের মধ্যরাত্রে বৃটিশ নিয়ন্ত্রিত রয়াল এয়ার ফোর্স প্রবল বোমাবাজি শুরু করল এই কোলোন শহরের উপর। শহরের ৯০ ভাগ বাড়ি ধংসস্তূপে পরিণত হল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার লোক এক রাত্রির মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়লো , হতাহত হল পাঁচ হাজার লোক। যুদ্ধ চলতে লাগলো। একদিকে মাঝে মাঝে চলতে থাকল বোমা বর্ষণ । অন্যদিকে চলতে থাকল নাজিদের দ্বারা নাজি-বিপক্ষদের খুঁজে বার করে রাস্তার মোড়ে ফাঁসি দেওয়া। ১৯৪৫ সালে এ শহরের লোক সংখ্যা ৭,৭০,০০০ থেকে কমে দাঁড়ালো কুড়ি হাজারে। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ এর ৪ঠা মার্চ  ইউ এস আর্মি এসে পৌঁছালো কোলোন শহরের সীমানায়। ৬ই মার্চ আধ বেলার যুদ্ধে পতন হল জার্মান বাহিনীর। পিছু হটবার সময় তারা শেষ চেষ্টা করলো ইউ এস বাহিনীকে আটাকাতে , রাইন নদীর উপরের হোহেনজোলের্ন সেতুটি ভেঙ্গে দিয়ে। তাতে বিশেষ লাভ হল না। কোলোন শহরের মালিকানা আবার বদল হোলো। যুদ্ধ শেষ হল। গোটা ইউরোপ জুড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হল। ততদিনে অবশ্য এ শহর "world's greatest heap of debris" বলে বিখ্যাত হয়ে গেছে। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় এই ঘূর্ণায়মান জাগতিক নাগরদোলায় আর একবার সৃষ্টির পালা এলো। Rudolf Schwarz নামের এক স্থপতির নেতৃত্বে এ শহর কে নির্মাণ কাজ শুরু হল ১৯৪৭ সালে। স্থপতির মাথায় ছিল এ শহরের ঐতিহ্যের কথা। মাথায় ছিল যুদ্ধের চিহ্ন মুছে দেওয়ার কথা। সে ভাবেই পুরাতন কে নূতন করে সাজিয়ে দিলেন। আমরা সেই সাজানো শহর দেখতেই পৌঁছালাম কোলোনে।

সেদিন বৃষ্টি বড় বদ রসিকতা করছিল। থেকে থেকেই তার ছিঁচ কাঁদুনি চলছিল। তার ওপর গাড়ি পার্কিঙ করার জায়গা অনেকটা দূরে। সেখান থেকে আমাদের গন্তব্য জায়গায় পৌঁছতে আবার ট্রামে উঠতে হল। এ শহরের সব চেয়ে বড় আকর্ষণ কোলোন ক্যাথিড্রালে পৌঁছেই আগে একটা পেল্লাই ছাতা কেনা হল। ক্যাথিড্র্যালের প্রধান দুটি মিনারের অসাধারণ গথিক স্থাপত্য। ১৫৭ মিটার উঁচু। শহরের যে কোনো জায়গা থেকে চোখে পড়ে। এটির নির্মাণ শুরু হয় ১২৪৮ সালে আর শেষ হয় ১৮৮০ সালে। ভাবা যায় ৬৪০ বছর ধরে একটা নির্মাণ। তাও বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল। সে গুলো যথাযথ মেরামত করে এটির আসল চেহারা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো কিছু কিছু মেরামতি চলছে । রোববার বলে ভিতরে কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছিল। তাতে অবশ্য দর্শকদের আটকানো হয় নি।

এ শহরে আছে ৩৬ টি নানা সাইজের মিউজিয়াম। কিন্তু হাতে সময় বড় কম। মডার্ন আর্ট , প্রাচীন আর্ট থেকে শুরু করে চকলেট এবং পারফিউমের মিউজয়াম কোনো কিছুই বাদ নেই। পারফিউম বলতে মনে পড়লো অ ডি কোলনের কথা। ছোট বেলার জ্বর হলে মাথায় জলপটি দেওয়া হত যে অ ডি কোলন দিয়ে সেটি এই শহরের নামেই। ১৭০৯ সালে সৃষ্ট এই পারফিউম টি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো পারফিউমের মধ্যে একটি।

ক্যাথিড্র্যাল দেখে আমরা রাইন নদীর ধার দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। রাইন এর উপর হোহেনজোলের্ন  সেতু কে পিছনে ফেলে আমরা গুটি গুটি এগিয়ে গেলাম।  একটু এগিয়ে আর একটি প্রাচীন চার্চ সেন্ট মেরিনা। রোমান দের তৈরি করা। বিশ্বযুদ্ধের সময় এটিরও অনেকটাই ধংস হয়েছিল। এই চার্চের পাশ দিয়ে এগিয়ে আমরা দেখে নিলাম হিউ মার্কেট , Schmitz-Säule , টাউন হল , অস্টারমেন ফাউন্টেন এই সব।

পুরোনো কোলোনের রাস্তা ঘাট খুব একটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয় । এখানে ওখানে কিছু ভিক্ষুকও চোখে পড়লো। তবে এদের ভিক্ষাবৃত্তির কারণ ড্রাগ এডিকশন ও হতে পারে। ফুটপাথ দখল করে বসে থাকা কালো পোষাক পরা পাঙ্ক দেরও দেখা গেল। গোটা একটা বিয়ারের বোতল হাতে ট্রামে ওঠা প্যাসেঞ্জারও চোখে পড়লো। প্রাচীন শহরে এটাও বোধহয় স্বাভাবিক। বিশেষ করে একটা শহর যখন এত ধংসের মধ্যে দিয়ে গেছে তার কিছু অভিঘাত তো থাকবেই।

কে জানে কত শত শতাব্দীর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তবু এমন ধীরে বয়ে চলেছে রাইন।

কবি কোলরিজের কবিতাটির কথা প্রথমে উল্লেখ করেছিলাম তার শেষ লাইন গুলি এই রকম –

‘... The river Rhine, it is well known,
Doth wash your city of Cologne;
But tell me, Nymphs, what power divine
Shall henceforth wash the river Rhine? ’

মনে হল আমাদের শিবদাস ব্যানার্জীর লেখা গানের কথার সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল আছে -

 বিস্তীর্ণ দু পারে / অসংখ্য মানুষের /হাহাকার শুনেও / নিঃশব্দে নীরবে/ ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন ?

গঙ্গাই হোক আর রাইনই হোক ,তার সামনে একই প্রশ্ন রাখা যায় বোধহয়।

ছবি - লেখক


লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।