প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ কাহিনী

জুন ৩০, ২০১৬

 

সপ্তাহান্তের মোহিত পাহাড় সফর

সুমন মাইতি


গাড়ির তেলের গন্ধের একটা আলাদা মাদকতা রয়েছে – প্রত্যেকবার গ্যাস স্টেশনে তেল ভরবার সময় মনে হয় এই বেরিয়ে পড়ি, সব ছেড়েছুড়ে একদম সটান পথ যেদিকে টানে সেদিকেই ঘুরুক স্টিয়ারিং হুইল। বেরোনোর আনন্দ আর মুক্তির খুশী একাকার হয়ে নিজেকেই অচেনা লাগে - ছন্নছাড়া বোহেমিয়ান মানুষটা রক্তে দ্রিমি দ্রিমি তাল তোলে। বসন্ত প্রায় শেষের দিকে, গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হতে তখনো কিছুটা বাকী – এমন সময় পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো দিন তিনেকের ছুটি পাওনা হলো। আপিসের কেতাদুরস্ত ই-মেইল মেসেজে মানবসম্পদ দপ্তর এত্তেলা পাঠালো হয় ছুটি নাও নাইলে তাফাত যাও, সব ছুটি তামাদি  হবে যদি অমুক দিনের মধ্যে না নিতে পারো। বোঝো ব্যাপারখানা – আমার ছুটি আমি নেবো কিনা তার আবার জবাবদিহি করতে হবে নইলে ঘ্যাচাং; মগের মুলুক থুড়ি মার্কিন মুলুক-ই বটে। হোক্কারি করে যখন বলেই দিয়েছে তখন মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী – এরা আবার নিয়মের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান ভক্তপ্রহ্লাদ তাই ইতরবিশেষ হেরফের হবার জো নেই। অনেক ভেবেচিন্তে ছুটি নিয়ে নেওয়াই মনস্থ করলাম। শুক্কুরবার ধরে শনি-রবি তারসাথে সোম-মঙ্গল বাড়তি হকের ধন মিলিয়ে দিন পাঁচেকের সফর। প্রথম তিন দিন ঘোরা – পরের দুদিন বিশ্রাম।

দিন তো মিলল, এবার যাই কোথা? এমন ঝটতি সফর – হোটেল ঠিক করা, প্লেনের টিকিট ইত্যকার ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে কোথায় ঠাঁই নাড়া যায়? বহু ইমোশনাল দরদস্তুর শেষে স্থির হলো লং ড্রাইভে অস্টিনসকাশে বেরোন হবে। এয়ার-বি-অ্যান-বি ওয়েবসাইট ঘেঁটে কাছাকাছি একটা পেয়িংগেস্ট হিসেবে আস্তানা পাবার বন্দোবস্ত করে ফেল্লুম যাওয়ার ঠিক আগেরদিন রাতে। তার পরদিনই সক্কাল সক্কাল গাড়ীতে তেল ভরতে ভরতে অকস্মাৎ এই গভীর সন্দর্শনসহ জ্ঞানবোধি উন্মোচিত হলো। রক্তে আছে যে আদিম ডাক, পথের সাথী ধুলোর ঘূর্ণিতে, রাস্তার বাঁকে সে নেশা মাদলের ডাক তোলে – অমোঘ – যার বাজে সেই বোঝে – আমার সেই দশা – মনের ভেতরে কুলকুল চাপা উত্তেজনার নদী।

যদিও শহর ছেড়ে বেরোবার অপেক্ষা ঠিক ষোলাআনা রাস্তার নয় অনেকটা মানসিকতার পরীক্ষাও বটে। পুরো শহরটাকে ঘিরে রয়েছে দুটো ইন্টারস্টেট লুপ। বেরোনোর আগেই যদি ট্রাফিকের ভীড়ে আটকে লুপে ঘুরপাক খেয়ে খেই হারিয়েছ তবে হয় সে পালাবার ইচ্ছা আরো জবরদস্ত হবে নচেৎ একেবারে লেজ গুটিয়ে “বাড়ী ফেরত চল; অনেক হয়েছে বাছা আর না”– এই দুটোর একটা আপনি ভাববেন। বার দুয়েক এক্সিট মিস করে আমার রক্তচাপ তখন উর্ধ্বমুখী। বেপরোয়া আমি এই বিশাল মেগাপোলিসের নাগপাশ কাটাতে অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিই – সামনের গোটা তিনেক গাড়ীকে ওভারটেক করে এক্সিট  নিয়ে এবার সো-ও-ও-জা অস্টিনের পথে। মাঝে ঘন্টাখানেক যে শামুকের গতিতে (আজ্ঞে হ্যাঁ ইন্টারস্টেটেও জ্যাম হয়) চলতে গিয়ে কিছুটা বেলা বেড়ে গেছে সে খেয়াল ছিল না। চমক ভাঙ্গল দূরের পাহাড়ের স্বপ্নে। কখন হিউস্টনের চপল ব্যস্ততা আর ফ্ল্যাট ল্যান্ডস্কেপ পেরিয়ে উচ্চাবচ হিল কান্ট্রিতে ঢুকে পড়েছি। মেন ইন্টারস্টেট থেকেই দূরের পাহাড় আর তার ওপরের আলগা লেগে থাকা মেঘের সারিতে চোখ আটকে গেল। এই মেঘের সারিই পরে আমাদের বিড়ম্বনার কারণ হবে - আসছি সে প্রসঙ্গে।

বেলাবেলি পৌঁছলাম এনচ্যান্টেড রক সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। খুব একটা গাড়ী দেখলাম না – কয়েকটা ফ্যামিলি পার্কিং লট থেকে অলসভাবে হেঁটে রেঞ্জার অফিসের দিকে যাচ্ছে। অনুসরণ করে আমারাও ভেতরে ঢুকলাম। ডেস্কের ওপাশে বেশ গম্ভীর একজন অল্পবয়েসী রেঞ্জার, সদ্য জয়েন করেছে মনে হয় –আমাদের দেখে মাপা কিন্তু মিষ্টি হাসিতে অভ্যর্থনা জানালো। ওখানকার একটা ম্যাপ দিয়ে দেখিয়ে দিল কাছাকাছি কোন কোন ট্রেইল রয়েছে। জানতে চাইল আমরা এখানে রাত্তিরে থাকব কিনা?

বললাম- “কাল আবার আসবো - পুরো পার্কটাকে দেখার খুব ইচ্ছে আমাদের”।

সে আশায় জল ঢেলে দিয়ে জানালো- “কাল ওপরে ওঠার সব রাস্তাগুলো বন্ধ থাকবে – যা দেখার আজকেই দেখে নাও নাহলে পস্তাতে হবে”।

প্রসঙ্গত বলে রাখি গোটা পাহাড়টাই একটা আস্ত গ্রানাইট রক প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু, আশেপাশে আরো গোটা তিনেক এরকম টিলামতো রয়েছে কারুর নাম লিটল রক, কারুর নাম টার্কি পিক কিন্তু এটাই সবথেকে উঁচু আর সহজে অ্যাকসেসেবল। যদিও জায়গায় জায়গায় বেশ খাড়াই কিন্তু অনেকটা লম্বা স্লোপ থাকায় সাধারণ ভিজিটারেরা একেবারে চুড়ো অব্দি উঠতে পারে। আমার মতো জন্ম আলসেরাও পারে। যাইহোক রেঞ্জারের চেতাবনি শুনে মনটা একটু দমে গেল – সত্যি একবার পাহাড় বেয়ে জলের ধারা নামতে শুরু করলে হড়কা বানের সম্ভাবনা প্রবল...তখন ওঠার ঝুঁকি কে নেবে। ঠিক করলাম আজকেই যা দেখার দেখে নিতে হবে। শুনেছি ওপর থেকে পুরো ভিস্টা নাকি অসাধারণ লাগে। যায় যদি যাক ঠ্যাং, এ ভিস্টা দেখিব কহে যে পরাণ! অ্যাডমিশন ফি দিয়ে পার্কি লট থেকে বেরিয়ে সানরাইজ ট্রেইল ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। পাশে পাশে অনেকেই হাঁটছে – বাবা-মার সাথে গুটি গুটি পায়ে বাচ্চা, রিটায়ার্ড কাপল আর সঙ্গে পিঠে নেওয়া পোষ্য, সদ্য প্রেমে পড়া কলেজ পড়ুয়া – বেশ লাগছিল সবার মাঝে হাঁটতে। চারিদিক সোনালি রোদে ভেসে যাচ্ছে, কে বলবে কালকেই অতিবর্ষণের সতর্কতা জারী রয়েছে! জীবনের মতো এখানেও কাল কি হবে সে দুর্ভাবনায় সময় নষ্ট না করে সামনে যতটুকু পাচ্ছি সেটাকে উপভোগ করা মনস্থ করলাম। ধীরে ধীরে ওপরে উঠছি, পিঠে পড়ছে রোদ, চারিদিকের দৃশ্য আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে – হাল্কা হাওয়া দেওয়ায় ঘাম খুব একটা হচ্ছে না...দেখতে দেখতে প্রায় অর্ধেকটা উঠে গেলাম – পেছনে ঘুরে দেখি অনেকটা নিচে গাড়ীগুলো প্রায় খেলনা গাড়ীর মতো লাগছে। দর্শনার্থীরা গুটি গুটি পায়ে উঠে আসছে। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার ওঠা শুরু করলাম। যত ওপরে উঠছি হাওয়ার জোর ততো বাড়ছে, মাথা থেকে টুপি উড়ে যাবার উপক্রম। কিন্তু এতকাছে এসে গেছি আর থামার কথা মাথায় নেই তখন।

চূড়ায় দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকিয়ে ওপরে ওঠার কষ্ট এক লহমায় ভুলে গেলাম। দিকচক্রবালজুড়ে ছড়িয়ে আন্দোলিত পাহাড়... কোনটা গাঢ় সবুজ, কোনটা ঈষৎ ধূসর, সুদূরে বিলীয়মান ফিতের মতো পড়ে আছে রাস্তা। মাথার ওপরে সুনীভ নীলাকাশ, পাক দিচ্ছে চিল। নির্জন দেখে একটা প্রান্তে গিয়ে বসলাম দুজনে। আগের রাতে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে পাথরের ছোট ছোট খাঁজে জল জমেছে...কিছু কিছু পুলে লাইকেন গজিয়েছে, পাথুরে রঙের ওপরে জীবনের আভাষ, জলের ওপরে পড়ছে আকাশের ছায়া, উঠছে ছোট ছোট ঢেউ। জলের প্রান্তে নাম না জানা বুনোফুল ফুটেছে, হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে। মনটাকে ক্যানভাস বানিয়ে শুষে নেওয়া যায় এই ছবিগুলো –একলা বসে দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দেওয়া যায় গোটা দিন; কিন্তু পেছনে ধেয়ে আসছে মন্দ্র জলদরাশি – তিষ্ঠোবার উপায় নেই। ঘন্টা দুয়েক বসে মনটাকে হারিয়ে যেতে দিলাম দিগন্তে, তারপর তোড়জোড় শুরু করলাম নীচে নামবার। ওপরে থাকতে থাকতেই লাঞ্চটা  সেরে নিয়েছিলাম। চারিদিক খোলা, মাটির পৃথিবীর বহু উঁচুতে বসে খাওয়ার এই অভিজ্ঞতা কোন রেস্তোরাঁ দিতে পারবে না!

ওঠার সময় যতটা সহজ ছিল নামবার সময় সমস্যা একটু বেশী হচ্ছিল – সাবধান না হলে পিছলাবার সম্ভাবনা ষোলআনা। ম্যাপেই দেখে নিয়েছিলাম দূরের একটা ছোট লেক রয়েছে - নাম মস লেক- যেতে হবে একো ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে। ট্রেইলটা মডারেট ডিফিকাল্টির বলছে ম্যাপ। ঠিক করলাম নামার পথে ওদিক দিয়ে যাবো – হিসেবে একটু ভুল ছিল আমাদের। প্রথমে উতরাই পাওয়াতে অসুবিধে হচ্ছিল না কিন্ত পরে যতই ক্যানিয়নের ভেতর এগোচ্ছি দুপাশের পাথরগুলো যেন চেপে দিতে আসছে, আস্তে আস্তে বেশ সরু হয়ে গেছে পথটা; দুজনের পাশাপাশি চলা তো দূর, একজনের পক্ষেও সামলে চলা মুশকিল। গোদের ওপর বিষফোঁড়া বেশ কয়েকটা ক্যাকটাস গজিয়েছে এখানে সেখানে, অসাবধানে পা পড়লেই হয়েছে... জায়গায় জায়গায় জল পড়ে বিপজ্জনকভাবে পিচ্ছিল হয়ে আছে পাথরগুলো – ঠিকমতো দেখে পা না ফেললে পিছলানো শুধু সময়ের অপেক্ষা। ভাবতে ভাবতে এদিকে অনেকটা নেমে এসেছি ক্যানিয়নের ভেতরে, একবার পেছন ফিরে দেখলাম ফেলে আসা পথটা প্রায় ৫৫ ডিগ্রী খাড়াই – এটা নাকি মডারেট ট্রেইল – এ যদি তার নমুনা হয় তাহলে আর এগিয়ে কাম নাই, কিন্তু ফেরতও যেতে পারছি কৈ? ভীষণ এবড়ো খেবড়ো বোল্ডার, রাস্তা বলে কিছু নেই; হাতে ক্যামেরা, পিঠে ভারী রুকস্যাক নিয়ে তাল সামলে ঐ পথে ফেরা অসম্ভব – অতএব এগিয়ে চল! সেটাই ভবিতব্য। ম্যাপটা আরেকবার দেখে বুঝলাম সামনে একটা জায়গায় পথটা দুইভাগ হয়ে যাবে – একটা দিক চলে গেছে লেকের দিকে, আরেকটা ট্রেইল পাহাড়টা বেড় দিয়ে প্রাইমারী ট্রেইলে মিশেছে।

ক্যানিয়নের ঠিক শেষপ্রান্তে এসে রাস্তাটা হঠাৎ চওড়া হয়ে গেছে, একটা বিশাল বড় প্রাগৈতিহাসিক পাথর, তার তলা দিয়ে ঝিরঝির করে একটি ঝরনা বয়ে চলেছে, বালিতে পা ফেললে জল বেরিয়ে আসে। সেখানে দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছি, দেখি উল্টোদিক থেকে একটা ফ্যামিলি আসছে, এতক্ষণে এঁদেরকেই একমাত্র এ পথে দেখলাম। হাত তুলে অল্প হাসলাম। দাদু-দিদিমা আর বছর বারোর নাতি- সারাদিন প্রজাপতির ছবি তুলে, গুহায় ঘুরে ক্লান্ত। দাদুকে জিজ্ঞেস করি লেকের দিকে গেছিলেন কিনা।

– “না আবহাওয়া দ্রুত খারাপ হয়ে আসছে এখন আর কোনদিকে না গিয়ে আলো থাকতে থাকতে আমাদের ফিরতে হবে, রাতে এপথে যাতায়াত করা প্রায় অসম্ভব। তোমরাও যত তাড়াতাড়ি পারো ফিরে যাও; একবার আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করলে রক্ষে থাকবে না”।

বেশ বন্ধুবৎসল মানুষটি, আমাদের ম্যাপে দেখিয়েও দিলেন কয়েকটা মার্কার পয়েন্ট।

“গোটা টিলাটাকে বেড় দিয়ে রয়েছে বেস ট্রেইল। এখান থেকে ডানে ঘুরে এগোলে সেটায় গিয়ে উঠবে, তারপর ঐ রাস্তায় মাইলখানেকের মধ্যে একদম ডাইনে পড়বে টার্কি পাস ট্রেইল, সেইটে ধরে নীচে নেমে গেলে প্রায় ঘন্টা দেড়েক সময় বাঁচবে। জোরে পা চালালে আলো প্রায় থাকতে থাকতে অন্ততঃ অর্ধেক পথ নেমে যেতে পারবে”- বললেন উনি। এরপর উনিও আর বেশী দাঁড়ালেন না, আমরাও দেরী না করে গলাটুকু ভিজিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।

ক্যানিয়নে সন্ধ্যা নামে খুব তাড়াতাড়ি, সবসময় মনে হয় এই বুঝি রাত নামল...  কাজেই ভেতরে যতক্ষন ছিলাম কমে যাওয়া আলো নিয়ে খুব একটা চিন্তা করিনি কিন্তু বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারলাম সময় বেশী নেই...ছায়ারা দীর্ঘতর হচ্ছে, সূর্য প্রায় দিগন্তের কাছে, দুপুরের রোদ ঝলমলে জায়গাগুলোতে চাপ চাপ অন্ধকার জমছে... মোবাইল ফোন সুইচ অন করতে গিয়ে দেখি বারগুলো সব ভ্যানিশ। একটু চিন্তায় পড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালালাম – বিপদের একটা আশংকা না চাইতেই মনের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছে। ষষ্ঠেন্দ্রিয়? হবেও বা – অত ভাবার সময় নেই। হাঁটছি আর কিছুক্ষণ পরপর ম্যাপ মিলিয়ে নিচ্ছি। অস্তগামী সূর্যের আলোয় জায়গাগুলো অন্যরকম লাগছে। শেষ বিকেলে পাখিদের ঘরে ফেরার আওয়াজে সরগরম– ছোটোছোটো ফুলে বনতল ঢেকে গেছে, অল্প অল্প হাওয়ায় দুলছে তাদের মাথাগুলি। মাঝখান দিয়ে সরু একটা রাস্তা– উচ্চাবচ বোল্ডার এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, ডানদিকে চিরকালীন স্তব্ধতায় স্থাণুবৎ গ্রানাইটের পাহাড়। পুরো ট্রেইলে শুধু আমরা দুজন। যেন সৃষ্টির আদিপর্বে সময়ের উজান বেয়ে পৌঁছে গেছি। মাঝে মাঝে কিছুদূর অন্তর অন্তর ফুট তিনেক উঁচু একেকটা খুঁটি পোঁতা। মাথার ওপরে রং দিয়ে সিম্বল আঁকা ট্রেইল মার্কার দেখে রাস্তা মিলিয়ে নিচ্ছি, আবার হাঁটছি। একবার পথ ভুল করে এক গুহার সামনে উপস্থিত – গ্রানাইটের গা বেয়ে উঠে গেছে খাড়া পাকদন্ডী, সত্তর-আশী ফুট ওঠার পর খেয়াল হলো – “ও হরি পথটা তো উল্টোদিকে যাচ্ছে”। নেমে আবার আগের জংশনে ফিরে নতুন করে চলা। হাঁপিয়ে গিয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। দেড় লিটার জলের শেষ তলানিটুকু বিপদে লাগতে পারে ভেবে রেখে দিয়েছি। কারুর মুখেই কথা নেই, কেবল ভারী শ্বাস নেওয়ার শব্দ আর জুতোর আওয়াজ। মাঝে মাঝে মনে হয় লোকেদের কথা বলার আওয়াজ শুনছি কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে সেরকম কাউকে দেখতেও পাচ্ছি না, দুয়েকবার ডেকেও সাড়া পেলাম না, আর এখানে কোন ক্যাম্প সাইটও নেই যে কেউ এসে থাকবে। হয়ত কোন বনচর পশুই হবে। এনচ্যান্টেড রক কি আর সাধে বলে? সূর্য প্রায় পাটে বসার তোড়জোড় শুরু করেছে – ধূসর আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে যাচ্ছে জঙ্গলে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ততঃ বাঁকটায় পৌঁছতে না পারলে সমূহ বিপদ –আপসেই চলার গতি বাড়িয়ে দিই। কোথায় সেই বাঁক?

দুপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি হঠাৎ পেছন থেকে শুনি ‘ইউরেকা’ – ঘুরে দেখি ও দাঁড়িয়ে একগাল হাসি নিয়ে ইঙ্গিত করেছে। সামনে কয়েক পা এগিয়ে দেখি ছোট একটা ঝোপের আড়ালে অল্প ঢাকা পড়েছে কিন্তু নামটা পড়া যাচ্ছে – টার্কি পাস ট্রেইল ...এক ঝলক স্বস্তির নিঃশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে এল। বাকি একমাইল সেটাও হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। পথ দিয়ে নেমে আসছি দেখি সামনে কিছুটা খোলামতো জায়গা - পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে পড়ে রুক্ষ্ম পাথুরে জমিটা একটু সমতলমতো হয়েছে। থোকা থোকা ফোটা হলুদ ফুলের গালিচা বিছানো। রূপকথার মতো রাতে এখানে নিশ্চয় পরি নামে! বাতাসে একটা নেশাধরানো বুনোফুলের গন্ধ। চ্যাপ্টা পাথরগুলো দেখে জিরিয়ে নেবার লোভ সামলাতে করতে পারলাম না, চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। উপরে খোলা আকাশে দুপুরে দেখা দুটো চিল তখনো চক্কর কাটছে – বহুদূর থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ ভেসে এলো মনে হয়। ঠান্ডা বাতাসে সারাদিনের ক্লান্তিতে অজান্তেই চোখদুটো কখন বুজে গেছে। কী শান্তি। চটক ভাঙল মোনোটনিক যান্ত্রিক আওয়াজে – তাকিয়ে দেখি অনেকটা উঁচু দিয়ে একটা মোনোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে দেখি প্রায় সাতটা বাজতে যায়, ভালই করেছে জাগিয়ে দিয়ে নাহলে আজ আর নামা যেত না, এখানেই হয়ত রাত কাটাতে হত। এবার আর কোথাও থামাথামি নয়, একদম সোজা নিচে নামা। কিছুটা নামবার পর একটি ধাপকাটা অংশে এসে পড়লাম, দেখি দূরে রেঞ্জারদের অফিস দেখা যাচ্ছে-এযাত্রায় বোধহয় আর কায়োটের খাদ্য হতে হবে না। এই রাস্তাটা সামনে যেখানে ফ্রন্টসাইড ট্রেইলটায় মিশেছে সেটার তার এককোণে মাঝারিমাপের পুকুর রয়েছে- নাম যদিও ফ্রগ পন্ড কিন্তু দাদুরীদের ডাক শুনতে পাইনি। চোখে পড়ল পুকুরের দিক থেকে দুজন এদিকেই আসছে, কাছে আসলে দেখি এক মহিলা সঙ্গে তাঁর ছেলে। হাত নেড়ে দুজনকে “হাউডি” বললাম। বেশ খুশী হলেন। প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর্বে জানলাম ওঁরা পার্কের অন্যদিকে দুদিন আগে ক্যাম্প করেছেন। আজকে এদিকে ঘুরতে এসেছিলেন। আমাদের জিজ্ঞেস করলেন- “তোমরা এখনো ওপরে ছিলে নাকি? রাত হয়ে গেলে ওপরে থাকা একদমই বারণ ; রেঞ্জাররা জানতে পারলে সমস্যায় পড়তে”।

সে আর বলতে... আমরা পথহারানো পথিক কাম ত্রস্ত-অভিযাত্রী শুনে হেসে ট্রেইলমিক্স অফার করলেন। গল্পে গল্পে বাকি পথটুকু পেরিয়ে এলাম। চলে যাবার আগে আমাদের শুভসন্ধ্যা জানিয়ে গেল মা-ছেলে। আমরাও ফিরলাম নিজেদের পথে। এবার গন্তব্য সেই পার্কিং লট। একবার পেছনে ঘুরে দেখি অস্তগামী সূর্যের গাঢ় কমলা আভায় দূরে দাঁড়িয়ে এনচ্যান্টেড রক, মহাকালের সাক্ষী; আমরা সেখানে দুদিনের অতিথি বই তো নয়। তবু ছোট্ট অভিযানের স্মৃতিআলেখ্য লেখা রইল মনের মধ্যে বহুবর্ণে...সেটুকুই সংগ্রহে নিয়ে গুন-গুন করতে করতে গাড়ীর দিকে এগোলাম। কাল আবার ব্লুমিং ব্লু-বনেট ট্রেইল দেখতে যাব। সে এক অন্য গল্প।


লেখক পরিচিতি - জন্ম- পড়াশুনো-প্রথম যৌবন হাওড়া আর তার দোসর কলকাতায়। উচ্চতর গবেষণায় মার্কিন মূলুকে আসা। ডক্টরেট করার পর বর্তমানে কর্মসূত্রে টেক্সাসনিবাসী। শখের রাঁধুনি, হবি বলতে ইতিহাসের বই আর হপ্তা শেষের রোড ট্রিপ। 

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।