পরিবেশ
অগাস্ট ১৫, ২০১৫
আরবান এগ্রিকালচার
পার্থ মুখার্জি
আজ রবিবার অনিমেষের স্কুল ছুটি, কিন্তু সকাল থেকে সে খুব ব্যস্ত। আসলে তার ঠাকুমা তাকে একটা কাজ দিয়েছে, তাই ছুটির দিন সকাল থেকে নাওয়া খাওয়া ভুলে সে মেতে রয়েছে। কাজটা কিন্ত খুব কঠিন বা খুব আপিরিচিত নয় আমাদের কাছে। ঠাকুমার একটা সখের বাগান আছে, না না সাধারণ বাগান নয়, একটু আলাদা যাকে বলে “কিচেন গার্ডেন”। আজ সেখানে গাছগুলিতে সার দেওয়ার হচ্ছে-না কোনও রাসায়নিক সার নয়। ঠাকুমা কিছুদিন আগে একটা বইতে পড়েছে বাড়ির “কিচেন গার্ডেন” এর সার নাকি বাড়িতেই তৈরি করা যায়। কি ভাবে? গত সপ্তাহে যত সবজি আর ফল এসেছে বাড়িতে তার সমস্ত খোসা জমা করা হয়েছে বাগানের এক পাশে আর তা থেকেই তৈরি হয়েছে সার।
আমরা উপরে যে ছোট্ট ঘটনাটা পড়লাম এই প্রক্রিয়া কিন্তু একেবারেই নতুন নয়। এই ভাবে জমা জঞ্জাল বা ঘরোয়া জঞ্জাল থেকে জৈব সার উৎপাদন করা আমাদের সমাজে বহুদিন আগে থেকে চলে আসছে। উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের ভারতবর্ষেও এই প্রকার বিকল্প কৃষি ব্যবস্থার গাদাগাদা উদাহরন আছে। আমাদের শহর কলকাতার আশেপাশে বেশ কিছু জায়গায় জঞ্জাল ব্যবহার করে কৃষিকার্য করা হয়ে থাকে, তার মধ্যে ধাপা, টিটাগড় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এই প্রবন্ধে আমরা টিটাগড়ে এই বিশেষ প্রকার কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করব। কলকাতা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত টিটাগড় একটি ছোট শহর যা টিটাগড় পুরসভার অন্তরগত। ২০১১ সালের জনগনগা অনুযায়ী টিটাগড়ের জন সংখ্যা প্রায় ১১৮৪২৬ যার মধ্যে পুরুষ ৫৪% এবং মহিলা ৪৬%, স্বাক্ষরতার হার ৮১%। এখানকার ভারি শিল্পের মধ্যে পেপার মিল, টিটাগড় ওয়াগন, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর কুটির শিল্পের মধ্যে ধাতু প্রক্রিয়াকরণ, রঙ আর ব্যাটারি ইত্যাদি বিখ্যাত। খড়দা স্টেশন থেকে নেমে রেললাইনের পাশ দিয়ে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই দেখা যাবে এই কৃষি ক্ষেত্র যার পরিমাণ প্রায় ২৮ হেক্টর। এই জায়গাতেই শহরের কঠিন এবং তরল বর্জ্য ব্যবহার করে কৃষিকার্য সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এই কৃষিক্ষেত্রের প্রায় মাঝখানে রয়েছে একটি “জল পরিশোধন কেন্দ্র” যা পৌরসভার দ্বারা পরিচালিত হয় (চিত্র ১)। এর পরিশোধন ক্ষমতা হল ৯ মিলিয়ন গ্যালন প্রতিদিন। জল পরিশোধন কেন্দ্র থেকেই পাওয়া যায় তরল বর্জ্য। কঠিন বর্জ্যের জন্য কৃষকদের নির্ভর করতে হয় স্থানীয় পৌরসভার ওপর। এই কঠিন এবং তরল বর্জ্য কিন্তু অবশ্যই ঘরোয়া বা কোনও বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়। কোনও প্রকার শিল্পজাত বর্জ্য এখানে ব্যবহার করা হয়না।
চিত্র ১- টিটাগড়ের আরবান এগ্রিকালচার প্রক্রিয়ার হাতে আঁকা মানচিত্র।
এবার টিটাগড়ের কৃষি প্রক্রিয়া সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাক। প্রথমে কঠিন বর্জ্য কি ভাবে ব্যবহার করা হয় তা দেখা যাক। পুরসভার গাড়ি জমির পাশে জঞ্জাল রেখে যায় এবং তারপর তাকে সেইভাবে এক সপ্তাহ ফেলে রাখা হয় (চিত্র ২)।
চিত্র ২- কৃষি জমির পাশে কঠিন বর্জ্য জমা করে রাখা হয়েছে।
তারপর থেকে ২-৩ দিন অন্তর জঞ্জালের ঢিপি উলটে পালটে দেওয়া হয়। ঘরোয়া আর বাজারের বর্জ্যের মুল উপাদান হল তরি তরকারি, ফল, মাছ, মাংস ইত্যাদির অবশিষ্ট। বেশ কিছুদিন এদের এক ভাবে ফেলে রাখলে ক্রমশ ব্যাকটিরিয়া দ্বারা জঞ্জাল উপাদানগুলি পচে যায় এবং গাছের জন্য দরকারি সার বা নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম তৈরি হয়। এই ব্যাকটিরিয়া ঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে তাপ নির্গত হয় যার জন্য জঞ্জালের ঢিপি থেকে মাঝে মধ্যেই ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। যাতে এই প্রক্রিয়া পুর বর্জ্য পদার্থের মধ্যে সমান ভাবে ঘটিত হয় তার জন্য জঞ্জালের ঢিপিকে ২-৩ দিন অন্তর উলটে পালটে দিতে হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগে। এরপর তাকে দেখতে ঝুরঝুরে মাটির মত তবে তা মাটির থেকে খুব হাল্কা হয় কারন এতে জৈব উপাদানের পরিমান খুবই বেশি। এরপর জঞ্জাল থেকে প্লাস্টিক, পাথর ইত্যাদি উপাদানগুলি আলাদা করা হয়। সব শেষে জঞ্জাল থেকে তৈরি এই জৈব সার বা কম্পপোস্ট জমিতে দেওয়া হয় (চিত্র ৩)।
চিত্র ৩- জমিতে কঠিন বর্জ্য ব্যাবহার করা হয়েছে।
আধুনিক বিশ্বে প্রচুর গবেষণা হয়েছে কঠিন বর্জ্যের উপাদান এবং তার কার্যকারীতা নিয়ে এবং তাতে দেখা গেছে কঠিন বর্জ্যের মধ্যে প্রভূত পরিমানে পরিপোষক (নিউট্রিয়েন্ট) বর্তমান। টিটাগড়ের কঠিন বর্জ্যের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে পাওয়া পরিপোষক এর মাত্রা হল নাইট্রোজেন-০.৪%, ফসফরাস-০.৪% , পটাসিয়াম-০.১৫% ।প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ২০০-২৫০ টন কঠিন বর্জ্য ব্যাবহার করা হয়।
এবার আসা যাক তরল বর্জ্যের ব্যাবহারে। আমরা আগেই বলেছি যে টিটাগড়ের জল পরিশোধন কেন্দ্রর পরিশোধন ক্ষমতা হল ৯ মিলিয়ন গ্যালন প্রতিদিন। এখানকার কৃষিতে তরল বর্জ্য দুটি কাজ একসাথে করে, এক-জলের প্রয়োজন মেটায় আর দুই-জলে দ্রবীভূত পরিপোষক যোগান দেয় যা ফসলের তাতক্ষনিক বৃদ্বিতে সাহায্য করে। তবে শহরের তরল বর্জ্যকে ফসলে দেওয়ার আগে প্রাথমিক ভাবে পরিশোধন করে নেওয়া হয় না হলে অতিরিক্ত পরিপোষক থাকার কারনে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। পরিশোধন কেন্দ্র থেকে প্রাথমিক ভাবে পরিশোধিত জল (তরল বর্জ্য) জমিতে পৌঁছান হয় নালার মাধ্যমে। প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ৫০০০০ লিটার তরল বর্জ্য ব্যাবহার করা হয়।
স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায় এখানে মূলত ক্যাশ-ক্রপ বা স্বল্প সময়ের ফসল যেমন পালং শাক, লেতুস, বাধাকপি, ফুলকপি, ধনেপাতা, পেয়াজ শাক ইত্যাদি ফলান হয়।এই সমস্ত ফসল এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে ফলান সম্পূর্ণ হয়। এই জমিতে উৎপাদিত ফসল কিছু কলকাতায় এবং বাকিটা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। এখানে উতপাদিত ফসলের পরিমান বছরে ৩০০০ টন। এখানে বলে রাখা ভাল যে জৈব সারের সাথে সাথে স্থানীয় কৃষকরা অল্প পরিমান রাসায়নিক সার ব্যাবহার করে।
এবার স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলার সূত্রে পাওয়া কিছু তথ্যের ওপর আলোকপাত করা যাক। এই স্থানে জৈব সার ব্যাবহার করে বিগত প্রায় ৮০-৯০ বছর ধরে কৃষিকাজ চলে আসছে এবং পূর্বে কেবল মাত্র জৈব সারই ব্যাবহার করা হত। আগে ধান, ডাল, বেগুন ইত্যাদি সব্জি সহজেই জমিতে ফলান যেত কিন্তু এখন আর তা যায়না। ফসলের এই চরিত্রগত পরিবর্তন গবেষণার একটি উৎকৃষ্ট বিষয় হতে পারে। পুরান এবং বর্তমানে চলতে থাকা বেশ কিছু গবেষনালব্ধ ফল থেকে পাওয়া যায় যে এখানে মাটি আর উৎপাদিত ফসলের মধ্যে কিছু বিষাক্ত ধাতু যেমন ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, লেড ইত্যাদি স্বল্প পরিমানে উপস্থিত রয়েছে। কিছু গবেষকের মতে ফসলের চরিত্র পরিবর্তন এর মুল কারন এইসমস্ত ভারি ও বিষাক্ত ধাতুর উপস্থিতি। কিন্তু মাটিতে আসা এই ধাতুর উৎস কী? কারন আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে এখানে কেবল মাত্র ঘরোয়া জঞ্জাল ব্যাবহার করা হয়, কোনও শিল্পজাত জঞ্জাল ব্যবহার করা হয়না। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে বেশ কিছু জায়গায় কুটির শিল্প থেকে উৎপাদিত বর্জ্য (কঠিন ও তরল) ঘরোয়া বর্জ্যের সাথে মিশে যাচ্ছে এবং ধাতুর উৎস হিসাবে কাজ করছে। এইভাবে চলতে থাকলে মাটি ও ফসলের মধ্যে ধাতুর পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকবে এবং পরিশেষে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানাবিধ রোগ ব্যাধির সৃষ্টি করবে। তবে কিছু পরিকল্পনা করে কাজ করলে এই ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে, যেমন
১) কিছু গভীরতা (২ ফুট) অবধি মাটি কেটে ফেলে দেওয়া।
২) কঠিন ও তরল বর্জ্যের নিয়মিত রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা এবং ব্যাবহার যোগ্য পরিমান নির্ণয় করা যাতে অতিরিক্ত বর্জ্যের ব্যাবহার বন্ধ হয়।
৩) কৃষি বিজ্ঞানীর সাহায্য নিয়ে ফসল নির্বাচন করা ও নিয়মিত মাটির পরিক্ষা করা।
৪) শিল্প এবং ঘরোয়া বর্জ্যের মিশ্রণ বন্ধ করা।
এত কথা বলতে বলতে অনিমেষের কাজ কিন্তু প্রায় শেষ। ঠাকুমার নির্দেশ মত প্রতিটা গাছের গোড়ায় সার দেওয়া সারা। কাজ শেষ হওয়া মাত্র পু্রস্কার হিসাবে পাওনা হল ঠাকুমার হাতে তৈরি আমের আচার।
লেখক পরিচিতি : গবেষক। মূল গবেষণার বিষয় অ্যানালিটিকাল কেমিস্ট্রি এবং পরিবেশ বিজ্ঞান। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি। ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে
টি সি জি লাইফ সায়েন্স-এ এবং বর্তমানে জুবিল্যান্ট কেমসিস-এ সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।