যাঁদের দেখেছি ...
অগাস্ট ১৫, ২০১৫
পীযূষকান্তি সরকার
বিমোচন ভট্টাচার্য
২৫শে বৈশাখ এলেই আমার পীযূষদার কথা মনে পড়ে। পীযূষকান্তি সরকার। মনে পড়ে পীযূষকান্তি কে? সেই যে নব্বই দশকের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। কেউ সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন। কেউ সাদরে গ্রহণ করেছেন। আমি দ্বিতীয় দলে।
১৯৯৫ সালে নজরুল মঞ্চে একক রবীন্দ্রসংগীত শুনতে গিয়েছিলাম প্রথম। প্রায় তিন হাজার শ্রোতা ছিলেন সেদিন। মোট ৩৫ টি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন সেদিন। সত্যি বলছি, মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি, আমার স্ত্রী।
ঠিক পরের দিন আমাদের দোতলায় এসেছিলেন পীযূষকান্তি। আমি এমনিতে যেচে কারুর সংগে কথা বলি না। কিন্তু আগের দিনের মুগ্ধতার রেশ ছিল। দোতলার বাবুদা( কল্যাণ মিত্র) এসে ডাকাতে গেলাম। প্রথম দর্শনে এবং কথাবার্তা শুনে আমার ভীষণ অহংকারী মনে হয়েছিল ওঁকে। সেই ভুল ভাঙতে খুব দেরী হয় নি।অচিরেই পীযূষ কান্তি সরকার হয়ে গেলেন আমার পীযূষদা।
ওঁর বাড়ি খেলাৎবাবু লেনে। খুব দূরে নয় আমাদের বাড়ি থেকে। আমি প্রায়ই যেতাম ওঁর বাড়ি। উনি তো যখন তখন চলে আসতেন আমাদের বাড়ি। সামনে শুধু একটা হারমোনিয়াম থাকলে আর দেখতে হত না। একের পর এক গান গেয়ে চলতেন। একদিন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। পীযূষদা ধরলেন"শ্রাবণঘন গহন মোহে"। আহা কি সুন্দর যে বাতাবরণ তৈরী হয়েছিল সেদিন! এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে/শুনতে পাই।
এমনি করে দিন যায়। আমি যাই, পীযূষদা আসেন। গান ছাড়াও আরো অনেক আলোচনা হয়। পীযূষদার বাড়ী গেলে পারুলবৌদি বলেন - বিমোচন, তুমি একটু বেশী বেশী করে এস তো, একমাত্র তুমি এলেই তবু একটু চুপ করে তোমার কথা শোনে, না হলে তো গলাটা বিশ্রামই পায় না।। হয় গান, নয় বকবক"। আমি হাসতাম। ঋতুপর্ণ ঘোষ "এবং ঋতুপর্ণ"তে, পীযূষদাকে ডাকলেন। আমি বল্লাম - যদি আপনাকেও তুই বলে?
-টেনে একটা চড় মারবো, পীযূষদার তাৎক্ষণিক উত্তর। ফিরে এসে বললেন- না হে, ছেলেটি পড়াশোনা করেছে প্রচুর। আমাদের বাড়িতে বসে সেই অনুষ্ঠান দেখলেন।
দু হাজার এক সালের জুলাই মাসে একদিন সন্ধেবেলায় ফোন পেলাম পীযূষদা বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথার পেছনে আঘাত পেয়েছেন।"ড্যাফোডিল"নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন। সংগে সংগে ছুটলাম লেকটাউনের "ড্যাফোডিল" নার্সিং হোমে। শুনলাম অপারেশন হবে সেই রাত্রেই। ঠায় বসে আছি। প্রায় রাত্তির দেড়টার সময় শুনলাম এই নার্সিং হোমে অপারেশন হবে না। অনেক বিখ্যাত মানুষ তখন সেখানে। বিখ্যাত দাঁতের ডাক্তার অমিত রায় ফোনে ব্যবস্থা করে দিলেন। ডাঃ প্রুস্তির আন্ডারে পীযূষদা ভর্তি হলেন সি এম আর আই তে। রাত্তির প্রায় দুটোর সময় যখন পীযূষদাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ড্যাফোডিল থেকে, দেখলাম পীযূষদাকে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কথা বলছেন পীযূষদা। পীযূষদাকে নিয়ে এম্বুলেন্স চলে গেল সি এম আর আই আর আমরা চলে এলাম বাড়ি।
পরের দিন পীযূষদার অপারেশন করলেন ডাঃ প্রুস্তি। বললেন - আর কথা বলতে বা গান গাইতে পারবেন কি না উনি কয়েকদিন পরে বলবেন। পীযূষদা সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। আমি একদিনও ওপরে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করি নি। প্রচুর ভি আই পি আসতেন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে।
একদিন শুনলাম পীযূষদাকে জেনারেল বেডে শিফট করা হবে। খুব তাড়াতাড়ি ছেড়েও দেওয়া হবে। এক শুক্কুরবার সাড়ে তিনটে নাগাদ গেলাম সি এম আর আই তে। বেড নম্বর জানতাম, লিফটে করে উঠে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই নেই আমার কাছে। একজন ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কেন দাঁড়িয়ে আছি? বললাম, পীযূষকান্তি সরকারের সঙ্গে দেখা করতে চাই কিন্তু ভিজিটিং কার্ড বা অন্য কিছুই নেই আমার কাছে। কে হন আপনি? উনি জানতে চাইলেন। আমি বল্লাম - ভাই; আচ্ছা, দাঁড়ান বলে চলে গেলেন উনি। ফিরে এসে বললেন - যান, কিন্তু বেশী কথা বলবেন না। ভেতরে গিয়ে দেখলাম একটা ইজি চেয়ারে বসে আছেন। আমায় দেখেই একগাল হাসলেন ( বিরল দৃশ্য,আমি খুব বেশী দেখি নি), কথা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল। তাও উনি কথা বলে যাচ্ছিলেন, বললেন- তুমি কোনদিন ক্যাথিটার নিয়েছো? বড় কষ্ট হে। তুমি তো একদিনও ওপরে আসো নি।তোমার বৌদি বলছিল - রোজ নীচেই বসে থাকতে। শোন,বুধবার আমাকে ছেড়ে দেবে।ওইদিন অফিস যেও না। আমি যেন বাড়ি ফিরে তোমায় দেখতে পাই ( শেষ কথাটি ইংরিজীতে বলেছিলেন, আমি আমার জীবনে খুব কম মানুষকে অত ভাল ইংরিজী বলতে শুনেছি)। কিছুক্ষণ থেকে বাড়ি চলে এসেছিলাম সেদিন প্রফুল্ল মনে।
রাত্তিরে পারুলবৌদিকে ফোন করে বললাম আমি গিয়েছিলাম আজ। উনি বললেন - খুব খুশী হয়েছে তোমায় দেখে। আমাকে বললো সে কথা। শোন, বুধবার ওকে ছাড়বে। তুমি এসো সেদিন।
পীযূষদা কথা রেখেছিলেন। বুধবারই ফিরেছিলেন তবে ফুলে ফুলে ঢাকা হয়ে, কাঁচের গাড়িতে, শব হয়ে। আমিও অফিস যাইনি সেদিন। আমার পীযূষদার শেষ যাত্রার সঙ্গী হব বলে।ভীষণ ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার।খেলাৎবাবু লেনের ছোট্ট রাস্তা তখন লোকে লোকারণ্য। কিন্তু আমি কিছু দেখছিলাম না। শুধু একদৃষ্টে দেখছিলাম পীযূষদার মৃতদেহ। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না পীযূষদা আর নেই। চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাচ্ছিলাম পীযুষদা আমার বাড়িতে বসে একা একা আমাকে শোনাচ্ছেন আমার সেই অতি প্রিয় গান (নীচে ক্লিক করুন)-
"ওরে জাগায়ো না, ও যে বিরাম মাগে নির্মম ভাগ্যের পায়ে।
ও যে সব চাওয়া দিতে চাহে অতলে জলাঞ্জলি
না,না, না,ওরে জাগায়ো না।
আজ সকাল থেকে পীযূষদার গাওয়া গান শুনছি । সকাল থেকেই ভাবছিলাম পীযূষদাকে নিয়ে লিখি আজ। লিখে বড় ভাল লাগছে।
আজ ২৫শে বৈশাখ, সেদিন থেকে প্রত্যেক পঁচিশে বৈশাখ আমি পীযূষদার গান শুনি।প্রত্যেক পঁচিশে বৈশাখ আমি পীযূষদাকে নিয়ে থাকি।পীযূষদার কথা ভাবি সারাদিন।এই রকম করেই প্রতি বছর এই দিনে পীযূষকান্তিকে সঙ্গে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আসেন আমার বাড়ী । মন ভারি হয়।"চক্ষে জল আসে".......।
লেখক পরিচিতঃ নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের ছোট ছেলে। লেখালিখি সিরিয়াসলি শুরু করেছেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের চাকরী থেকে ২০১০ সালের অবসর নেয়ার পর। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছে। কবিতা ছাপা হয়েছে দেশ এবং শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।