যাঁদের দেখেছি ...
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫
অজিত চট্টোপাধ্যায়
বিমোচন ভট্টাচার্য
আজ একজনের কথা বলি আপনাদের। অভিনেতা ছিলেন। অন্য কিছু করতেন না। শুধুই অভিনয়। ওঁকে আপনারা দেখেছেন অনেক ছবিতে। থিয়েটারেও অভিনয় করতেন। মূলতঃ রংমহল থিয়েটারে। ওঁর নাম অজিত চট্টোপাধ্যায়। মনে পড়ছে কারুর কারুর? কৌতুকাভিনেতা ছিলেন উনি। খুব পপুলার দুটি ছবির কথা বলি যে দুটি ছবিতে উনি অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটি হল"সাড়ে চুয়াত্তর"। এমন এক ছবি যেটা দেখেন নি এমন বাঙালী সারা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ওই ছবিতে মেস এর একজন ছিলেন আমাদের অজিতকাকা। তখন কম বয়েস। মনে করে দেখুন উত্তম কুমার রাস্তায় সুচিত্রা সেন এর সঙ্গে দেখা করছেন। পেছনে তিনজন ফলো করছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় (জহর রায় পড়ে গেলেন একবার, কি ন্যাচারাল সেই পড়ে যাওয়া) আর তৃতীয় জন হলেন অজিত চট্টোপাধ্যায়, আমাদের অজিতকাকা। ভ্রান্তিবিলাস ছবিতে "ওঝা" চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। গর্ব করে বলতেন সেই কথা।
অজিত কাকা ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা। হরবোলা ছিলেন।জীবজন্তু, পাখির ডাক, ট্রেন বা প্লেনের শব্দ অবিকল করতে পারতেন মুখ দিয়ে। আমি নিজে দেখেছি একটি অফিস ক্লাবের নাটকে পুরো মুখ দিয়ে সাউন্ড এফেক্ট করে দিয়েছেন। নাক দিয়ে গীটার আর সানাই বাজাতে পারতেন। দুই হাঁটু বাজিয়ে মুখে তবলার আওয়াজ করে গানের সঙ্গে বাজাতে পারতেন। গান গাইতে পারতেন।"মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি।"এই অতি বিখ্যাত গানটি গাইতেন"মৌমাছি..... মৌমাছি.... কোথা যাও..... পাঁ পাঁ পাঁ.... (এই পাঁ পাঁ পাঁ টি মিউজিক, সানাই নাক দিয়ে বাজাতেন) নিখুঁত সুর লাগাতে পারতেন। ছোট ছোট কমিক স্ট্রিপ করে ফাংশন করতেন। এক কথায় অজিত চট্টোপাধ্যায় ওয়াজ আ কমপ্লিট এন্টারটেনার।
আমার বাবাকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতেন, আমাদের বলতেন - "প্রথম যেদিন রংমহল থিয়েটারে গেছিলাম অভিনয় করতে প্রভাত সিংহী তো আমাকে দেখেই বলে দিলে এ ছোকরা তো সিনেমা করে হে, ও বিধায়ক, এ আবার থিয়েটার করবে কি। তখন, বুঝলি লোকে থিয়েটার থেকে সিনেমায় যেত, তা তোদের বাবা বললেন - আরে একটা সুযোগ না দিলে বুঝবে কি করে। ছেলেটার অভিনয় আমি দেখেছি। নিয়ে নাও। ব্যাস, সেই আমি সেট হয়ে গেলাম রংমহলে"।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা অজিতকাকার জবানীতে শুনুন-"বুঝলি, একদিন সন্ধেবেলায় চলে গেলাম রবীন্দ্রনাথকে দেখবো বলে।কাছেই থাকতাম। গিয়ে দেখি উদোম ভীড়। কিছু ছিল মনে হয় বা রোজই ওই রকম ভীড় হয়। জানি নে বাপু, বন্ধু বললে, চল ফিরে যাই,আমি বললাম, দাঁড়া, তুই শুধু আমার পিছু পিছু আয়। মাথাটা নীচু করে কুকুরের বাচ্চার ডাক শুরু করলাম, ভীড় হাল্কা হতে শুরু করলো।সবাই কুকুরের বাচ্ছা খুঁজছে আর আমি গিয়ে সোজা রবি ঠাকুরের পায়ের ধুলো নিয়ে নিলুম। উনিও ভাবছেন কুকুরের বাচ্ছা কোথা থেকে এল। বললাম- গুরুদেব, আমি সখের হরবোলা আপনার পায়ের ধুলো নেব বলে এই কান্ড করেছি। উনি হেসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল"।
পাঠক, যদি এর পরে অজিত চট্টোপাধ্যায়কে দেখেন, দেখবেন, এক অদ্ভুত কথা বলার ভঙ্গী ছিল ওঁর। ব্যক্তিজীবনেও কথা বলতেন ওই রকম করেই। আজীবন উত্তর কলকাতার বাসিন্দা অজিতকাকা রাস্তায় বেরোতেনও লুংগী আর শার্ট/ গেঞ্জী পরে। আমার ওপরের দাদা(দু বছরের বড়)আই ও বী র অফিসার ছিল। কিছুদিন শ্রীমানী মার্কেট ব্রাঞ্চে ছিল। অজিত কাকার ওই ব্রাঞ্চে একাউন্ট ছিল। তো ব্যাংকেও আসতেন ওই পোষাক পরে। দাদাকে ওখানে দেখে খুব খুশী হয়েছিলেন। খুশী হয়েছিলেন আমরা সবাই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি শুনে। আমাদের বাড়ীতে যাঁরাই আসতেন আমার মা তাদের কাছে ছিলেন আদর্শ নারী। মা নেই শুনে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন।দাদাকে বলেছিলেন- যাহ...তোরা সবাই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হলি আর বৌদিই চলে গেল।
অজাতশত্রু মানুষ ছিলেন অজিত চট্টোপাধ্যায়। শেষ দিকে বয়েসের কারণে বেশী কাজ করতেন না। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম অজিত কাকাকে নিয়ে লিখবো। লিখে ফেললাম আজ। বেশ ভাল লাগছে লিখতে পেরে। কয়েকজন বাকী থাকলেন যাঁদের কথা লিখবো ভাবি প্রায়ই।
তাঁদের কথা অন্য কোনদিন।
লেখক পরিচিতঃ নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের ছোট ছেলে। লেখালিখি সিরিয়াসলি শুরু করেছেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের চাকরী থেকে ২০১০ সালের অবসর নেয়ার পর। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হয়েছে। কবিতা ছাপা হয়েছে দেশ এবং শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।