ইউসুফ ভাই ও একটি বাংলা ছবি

ইউসুফ ভাই ও একটি বাংলা ছবি

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘টনসিল’ অবলম্বনে ছবি করার সময় তপন সিংহের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। তার পর চার দশক ধরে তিনি তাঁর ‘ঘরের লোক।’ অভিব্যক্তি প্রকাশে সংযত তপনবাবুও তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন ‘একটি ধূমকেতু।’ তাছাড়া বলেছিলেন ‘গৌরকিশোর ঘোষ এক বিরল মানুষ, বিরল শিল্পী, বিরল বন্ধু।’ মানু রায়ের পুলিশ ছাড়া বাকি পৃথিবীও তাঁর সম্বন্ধে একই কথা বলত। এমার্জেন্সির সময় একদিন খুব ভোরবেলা তপন সিংহের বাড়ির সামনে কেউ বার বার হর্ন বাজাচ্ছিল। তিনি বেরিয়ে দেখেন উদভ্রান্ত অবস্থায় সন্তোষকুমার ঘোষ দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, ‘আজ ভোর রাতে পুলিশ গৌরকে ধরে নিয়ে গেছে। জানেন, গৌরের খুব শরীর খারাপ। জেলে ও বাঁচবে না। হার্টের অবস্থা মোটেই ভালো নয়।’ বাঙালির সৌভাগ্য, গৌরকিশোর জেল থেকে বেঁচে ফিরে এসেছিলেন।

গৌরকিশোর ঘোষ
তপন সিংহ

তপন সিংহের বিদেশি বই পড়ার নেশা ছিল। একদিন গৌরকিশোর তাঁকে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘শুধু বিদেশি বই পড়বে? আমাদের তরুণ সাহিত্যিকদের লেখা পড়বে না?’ এই বলে তিনি এনে দিলেন মতি নন্দী, দিব্যেন্দু পালিত, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা। এঁদের লেখা পড়ে তপন সিংহ অবাক। এঁদের ‘সততা, সাহস, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, নতুন কিছু করার চেষ্টা’ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। গৌরকিশোরের লেখা ‘সাগিনা মাহাতো’ উপন্যাসটিও। ‘সাগিনা মাহাতো’ ছিল আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। নিজের ভাষায় তপন সিংহ বলেছিলেন ‘…আমি পলিটিকস বুঝি না। রাজনীতি থেকে কয়েক’শ মাইল দূরে জীবন কাটিয়েছি বলে সাহস হচ্ছিল না। এবার ভাবলাম একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক।’

উনিশ’শ ষাট সালে লেখা ‘সাগিনা মাহাতো’ বাংলা ‘রাজনৈতিক’ কথাসাহিত্য শাখার একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষদের নেতৃত্ব দেবার বিড়ম্বনাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছিল এই উপন্যাসটি। ভূমিস্তর থেকে উঠে না আসা, শহুরে মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষজনের নিহিত স্বার্থ রক্ষার জন্য বঞ্চিত সমাজের মানুষদের যে নিদারুণ মূল্য দিতে হয়, তার আখ্যান লিখেছিলেন গৌরকিশোর এই উপন্যাসে। সঙ্গতভাবেই তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিক সমাজতন্ত্রী রাজনৈতিক দলব্যবস্থার প্রেক্ষিতে বিষয়টি বিশেষ ভাবে বিতর্কিত ও পরিত্যাজ্য ছিল। তা নিয়ে পরে বেশ জল ঘোলাও হয়েছিল।

যদিও উপন্যাসটির পটভূমি ছিলো স্বাধীনতা-পূর্ব ব্রিটিশ আমলে তিনধরিয়া লোকোশেডে রেলশ্রমিকদের নিপীড়ন, আন্দোলন ও তাদের ব্যবহার করে কলকাতা-কেন্দ্রিক শ্রমিক নেতাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা। মালিকপক্ষের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সাগিনা মাহাতো নামের একজন স্থানীয় শ্রমিক নেতাকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে লেবার অফিসার করে দেওয়া হয়েছিল। তার পর শুরু হয় এক স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা। এক ধরনের যান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা মেনে চলা, দলবদ্ধ রাজনীতির পরিমণ্ডলে ব্যক্তির এই ‘চ্যুতি,’ যে বিষম ট্র্যাজেডি ডেকে আনে, তাকে নিয়ে লেখা গৌরকিশোরের এই উপন্যাস।

এই সংকট শুধু আমাদের দেশের নয়। সারা বিশ্বেই শ্রমিক সংগ্রামের মুখ্য পাত্রদের বিভ্রান্ত করে শোষক শ্রেণি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। শোষকদের মধ্যে শুধু পুঁজিপতিরাই নয়, তাদের দালাল, মধ্যস্বত্ত্বভোগী এবং তথাকথিত রাজনৈতিক নেতৃত্বও সমান ভাবে সংলিপ্ত থাকে। নিপীড়িত দরিদ্রদের বঞ্চনা করতে কেউই পিছিয়ে থাকে না। মানবিক মূল্যবোধের এই অবনমনের প্রতি সহমর্মী শিল্পী-সাহিত্যিকরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। কায়েমি স্বার্থভোগী শ্রেণির স্বরূপ উন্মোচিত করেন। সমাজের প্রতি সেটাই তাঁদের মূল দায়বদ্ধতা।

হেমেন গাঙ্গুলি ছিলেন রাঁচির লোক। বিহারের আদি ধনী পরিবারের মানুষ। তাঁর মধ্যে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর যুগ্ম অবস্থান ঘটেছিল।  নানা রকম ব্যবসায়িক উদ্যমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার মধ্যে ছিলো একটি চলচ্চিত্র পরিবেশন সংস্থাও।

রাঁচি শহরে তাঁর মালিকানায় সেকালে তিনটি সিনেমা হল চলত। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন। তার পর আবার সংস্কৃত সাহিত্যেও এম এ হয়েছিলেন প্রথম স্থান অধিকার করে। তাঁর বাড়িতে ছিল প্রবাদপ্রতিম গ্রন্থ সংগ্রহ। স্বভাবে ইংরেজ, হৃদয়ে বাঙালি। সর্ব অর্থে সম্পন্ন, সুদর্শন এই মানুষটি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর সুনম্র আচরণের জন্য। ব্যবসার প্রয়োজনে প্রতি সপ্তাহান্তে তিনি রাঁচি থেকে কলকাতায় আসতেন। গ্র্যান্ড হোটেলে তাঁর জন্য একটি স্যুট স্থায়ীভাবে নেওয়া থাকত।। হঠাৎ একদিন তিনি ফোন করলেন তপন সিংহকে। দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে। শুধু টেলিফোনে কথা বলেই শ্রী সিংহ গাঙ্গুলি মশায়ের ভদ্রতাবোধ দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে হেমেন গাঙ্গুলি প্রস্তাব দেন রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি নিয়ে তিনি একটি ছবি প্রযোজনা করতে আগ্রহী। যদি তপন সিংহ সম্মত হন, তবেই। 

হেমেন গাঙ্গুলি

তপন সিংহ ভাবতেই পারেননি ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ নিয়ে কোনও সিনেমা তৈরি করা যায়। তিনি বিবেচনা করার জন্য সময় চেয়ে নেন। বার বার পড়তে থাকেন গল্পটি। সে সময় খোঁজ পান সেকালের বিখ্যাত নাট্যকার মন্মথ রায় গল্পটির একটি নাট্যরূপ দিয়েছেন। মন্মথ রায়ের সংক্ষিপ্ত নাট্যরূপটি অনুসরণ করে তপন সিংহ ছবির চিত্রনাট্যটি তৈরি করে ফেলেন। পরিচালনায় তিনি নিজে, সঙ্গীত পরিচালনায় উস্তাদ আলি আকবর খান। বাংলা ছবির ইতিহাসে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ছবি সেকালে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রযোজক হিসেবে হেমেন গাঙ্গুলি তপন সিংহ ছাড়া আর কোনও পরিচালকের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। বলেছিলেন, তিনি অপেক্ষা করবেন। করেও ছিলেন দশ বছর।

আগেই লিখেছি, তপন সিংহ ভাবতেন তিনি ‘রাজনৈতিক’ ছবি করার এলেম রাখেন না। যদিও গৌরকিশোরের ‘সাগিনা মাহাতো’ উপন্যাসটি পড়ে অনেক দিন ধরেই তাঁর ছবি করার ইচ্ছে। কিন্তু ‘সাহস’ পেতেন না। অনেক ভেবে একদিন হেমেন গাঙ্গুলিকে প্রস্তাব দিলেন যদি তিনি ছবিটি করেন, তবে হেমেনবাবু কি প্রযোজনা করবেন? কারণ ছবিটি ‘সফল’ নাও হতে পারে। হেমেন গাঙ্গুলি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। তার পর তপনবাবু প্রস্তাব করলেন নাম ভূমিকায় দিলীপকুমারকে নেওয়া যায় কি না? প্রসঙ্গত, সে সময় দিলীপকুমার এদেশের সব চেয়ে মহার্ঘ তারকা। আবার তিনিই ছিলেন এদেশের প্রথম সিনেমা অভিনেতা, যিনি এক সঙ্গে একটির বেশি ছবি করতেন না। তপন সিংহের পরিচালনায় কাজ করার জন্য ইচ্ছুক দিলীপকুমার কয়েকবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাঁকে। হেমেনবাবু তাতেও রাজি। দু’দিন পরে তাঁর ফোন এল। তিনি একদিন পর তপনবাবুকে নিয়ে মাদ্রাজ যাবেন। কারণ তিনি ইতিমধ্যে দিলীপকুমারের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা করে নিয়েছেন। দিলীপকুমার মাদ্রাজে অন্য একটি ছবির স্যুটিং করছেন তখন। তিন মাস পরে হাতের ছবিটি শেষ হলেই তিনি নতুন ছবিতে যোগ দিতে পারবেন।

অভিনেতা দিলীপকুমার সম্বন্ধে দিস্তা দিস্তা লেখা পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যক্তি দিলীপকুমার সম্বন্ধে তেমন আলোচনা দেখা যায় না। আমাদের ধারণা আছে চিত্রতারকারা গজদন্তমিনারের অধিবাসী। তাঁরা ‘মূঢ়’ দর্শকদের জন্য ‘মূঢ়তর’ সিনেমা তৈরি করেন। বাস্তব যাপনের সঙ্গে যার কোনও সম্বন্ধ নেই। বহুযুগ আগে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে যখন ‘সাগিনা মাহাতো’ প্রদর্শিত হয়, রাশান টিভি থেকে ভারতীয় সিনেমার বস্তুস্থিতি বিষয়ে দিলীপকুমারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। দিলীপকুমার বলেছিলেন, আমাদের দেশে ‘ভালো ছবি’ তখনই করা সম্ভব, যখন মানুষ তা চাইবেন। ভালো ছবি চাওয়ার সঙ্গে শিক্ষার সম্বন্ধ আছে। ভারতে প্রকৃত শিক্ষার এতো অভাব যে সেখানে সে অর্থে ‘ভালো ছবি’ অধিকাংশ দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য বোধ হয় না। প্রযোজকরা সে সব ছবিতে টাকা লাগাতে চান না। বাধ্য হয়ে আমাদেরও গরিব, অশিক্ষিত, অসহায় মানুষের কাছে অবাস্তব স্বপ্ন বিক্রি করতে হয়।

এই ধরনের বক্তব্য যখন ভারতীয় মূলস্রোত সিনেমার প্রবাদপ্রতিম প্রধান অভিনেতার থেকে আসে তখন তার অভিঘাত অন্যরকম হয়। দিলীপকুমারের চিন্তাভাবনার জগৎকে চিনতে তাঁর এই অবস্থানটি আমাদের সাহায্য করে। সেকালের চিত্র অভিনেতাদের মধ্যে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল সব চেয়ে বেশি। কিন্তু বাংলা ছবি করতে এসে তিনি নামমাত্র সাম্মানিক নিয়ে কাজ করেছিলেন। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তিনি বলেছিলেন তপন সিংহের ছবিতে তিনি টাকা রোজগার করতে আসেননি। ‘সাগিনা মাহাতোর’ কাজ চলাকালীন স্থানীয় পাহাড়ি মানুষদের থেকে কিছু অর্থ সাহায্য করার অনুরোধ আসে। তাঁদের জরাজীর্ণ ইশকুলটি সংস্কার করার জন্য হাজার পাঁচেক টাকা পেলে উপকার হয়। তিনি নিজে ও সায়রা বানুর তরফ থেকে দু হাজার টাকা দিয়ে বাকিদের অনুরোধ করলেন, তিনি নিজেই হয়তো পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু যদি সবাই এই কাজে সাহায্য করে তবে তাঁর খুব তৃপ্তি হবে। খুব সহজেই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। যত্ন করে বাংলা শিখেছিলেন। অনর্গল বাংলায় কথা বলতে পারতেন। তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থ সংগ্রহটি ছিল বিপুল। অভিনয়ের বাইরে প্যাশন বলতে ছিলো বই পড়া ও ফুটবল। রোভার্সে খেলেছিলেন নিজে। বম্বের শেরিফ থাকাকালীন একবার তাঁকে দন্তচিকিৎসা বিষয়ে বই পড়তে দেখে তপনবাবু যখন প্রশ্ন করেছিলেন, উত্তর আসে তাঁকে দন্তচিকিৎসকদের একটি সভায় বক্তৃতা দিতে যেতে হবে। পরিচালকরা দেখতেন একই শট তিনবার তুললে তিনি তিনরকম ভাবে অভিনয় করতেন। শুধু সহ অভিনেতাদের যাতে অসুবিধে না হয়, তিনি সংলাপের ধরতাই ও ছাড়ার অংশটি অপরিবর্তিত রেখে দিতেন। ইংরেজি আর উর্দু’তে অনুপম বক্তৃতা করতে পারতেন। এই দুই ভাষার সাহিত্যে ছিল তাঁর গভীর অধিকার। চিন যখন ভারত আক্রমণ করেছিল, লালকেল্লায় আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় প্রধানমন্ত্রী নেহরু দিলীপকুমারকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সভায় দিলীপকুমারের মর্মস্পর্শী বক্তৃতা বহু দিন ধরে মানুষের স্মৃতির অংশ হয়ে গিয়েছিল। তপন সিংহ তাঁকে বলতেন ভারতের ‘তোশিরো মিফুনে,’ অর্থাৎ, কুরোসাওয়ার সব ছবির সেই মহান অভিনেতা।

তা, তপন সিংহ ও হেমেন গাঙ্গুলি তো গেলেন মাদ্রাজে। দিলীপকুমারের সঙ্গে ‘সাগিনা মাহাতো’ নিয়ে কথা বলতে। ফোন করতেই জানা গেল দিলীপকুমার বম্বে চলে গেছেন। দেখা হবে না। দুজনেই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে এলেন নিজেদের হোটেলে। হেমেন গাঙ্গুলি বললেন চলুন আজই কলকাতা ফিরে যাই। হঠাৎ দরজায় মৃদু করাঘাত। খোলার পর দেখা গেল স্বয়ং দিলীপকুমার সহাস্য মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, ‘কেমন ঠকালাম? আপনারা আমার বাড়িতে চলুন। ওখানেই খাওয়াদাওয়া সেরে আলোচনা করা যাবে।’

দিলীপকুমার সম্বন্ধে বলা হয় তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে। নিজের সময় ভারতবর্ষের সব চেয়ে সমাদৃত ও মহার্ঘ অভিনেতা ছিলেন তিনি। কিন্তু একসঙ্গে একটির বেশি ছবিতে অভিনয় করেননি। নিয়মিত ভাবে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, আর দাবা খেলতেন। প্রথম জীবনে নীতিন বসু, অমিয় চক্রবর্তী, আর বিমল রায়ের সান্নিধ্যে থাকার ফলে জন্মসূত্রে পঠান হলেও রুচিবোধে ছিলো বাঙালি ধরন। বাংলা সাহিত্য, বাঙালি চিত্র পরিচালকদের প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। বলতেন, বাঙালিরা এতো ভালো চিত্র পরিচালনা শিখল কী করে? শুধু পরিচালক নয়, বাংলার অভিনেতাদের সম্পর্কেও খুব উঁচু ধারণা ছিলো তাঁর। বলতেন অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতা বম্বেতে নেই। যে কোনো বিষয় নিয়ে ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পারতেন। পণ্ডিত নেহরুর কাছের মানুষ ছিলেন। কিন্তু নিজের কাছাকাছি কাউকে খুব বেশি আসতে দিতেন না। খুব মেজাজি মানুষ। শোনা যায়, স্যুটিঙে আসতেন নিজের ইচ্ছেমতো। পছন্দ না হলে অভিনয় করবেন না। ‘সাগিনা মাহাতো’ স্যুটিঙের সময় একদিন আউটডোরে পাঁচ ঘন্টা কাজ করার পর সহ-পরিচালককে বলেছিলেন ‘আমাকে দিয়ে এতো কাজ করালে আমি বম্বে পালিয়ে যাবো।’ আবার যেদিন মেজাজ থাকতো, সেদিন ইউনিটের সবাইকে ক্লান্ত করে ফেলতেন। একদিন সকাল থেকে সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত কাজ করে যখন প্যাক আপ করার ঘোষণা হল, তখন দিলীপ বললেন, আরও ঘন্টা চারেক কাজ করা যায় কি? সকালে যে সিনটা করেছি ওটা আরেকবার অন্যভাবে করতে চাইছি।’ নিজে বাকি সহ-অভিনেতাদের অনুরোধ জানালেন। রাত দশটা পর্যন্ত আবার কাজ চলল সেদিন। ভালো লাগলে একটা শটে আলাদা আলাদাভাবে তিন-চার রকম অভিনয় করতেন। পরিচালক নিজের মতো বেছে নিতেন। নিপুণ মেথড অ্যাক্টর ছিলেন তিনি। তপন সিংহ ‘সাগিনা মাহাতো’ করার সময় তাঁকে মাঝে মাঝে ইনস্টিংক্ট দিয়ে অভিনয় করতে বলতেন। সেটাও তিনি করতেন নিখুঁত ভাবে। এই ছবিতে তাঁর সহ-অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেছেন, তিনি ইউনিটের সবাইকে বলেছিলেন তাঁকে প্রথামাফিক ‘স্যার’ না বলে ‘ইউসুফভাই’ বলে সম্বোধন করতে।

ছবির পোস্টার
ছবির দৃশ্যে দিলীপকুমার ও সায়রা বানু
"অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতা বম্বেতে নেই"

‘সাগিনা মাহাতো’ গল্পটির কেন্দ্রে ছিলো দার্জিলিং পাহাড়ের তিনধরিয়ায় রেলের লোকো শেড। স্যুটিং হয়েছিলো গয়াবাড়ি নামের একটা জায়গায়। কার্শিয়ঙের ঠিক নীচের উপত্যকা। কংগ্রেস নেতা ও শিল্পপতি ইলা পালচৌধুরীর একটি সুন্দর বাংলো আছে সেখানে। সেই বাড়িতেই ‘সাগিনা মাহাতো’র পুরো ইউনিট থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানেই থাকতেন দিলীপকুমার, সায়রা বানু, ও তাঁর মা নসিম বানু। পাহাড়ি জায়গায় মাঝে মাঝেই আকাশে মেঘ করে বৃষ্টি নামত। স্যুটিং বন্ধ। তখন ‘ইউসুফ-ভাইয়ে’র উদ্যোগে শুরু হতো আড্ডা, খুনসুটি, লেগপুলিং-এর আসর। প্রথম দিকে ইউনিটের বাকি লোকেরা দিলীপকুমারের থেকে সমীহপূর্ণ দূরত্ব রেখে চলতেন। কারণ তিনি তখন এদেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শুধু নন, উজ্জ্বলতম তারকা। কিন্তু আন্তরিক ব্যবহারে তিনি সব সহকর্মীদের মন থেকে দূরত্ব মুছে দিয়েছিলেন। তাঁকে বাংলা শিখিয়েছিলেন সাহিত্যিক-চিত্র পরিচালক নবেন্দু ঘোষ। ছবির জগতে তাঁকে চিনিয়েছিলেন পরিচালক অমিয় চক্রবর্তী। তার পর নীতিন বসু, বিমল রায়, ও হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য তাঁকে বাংলা ভাষা ও মানসিকতার ঘনিষ্ঠ করে ফেলেছিল। বলতেন, যা কিছু শিখেছি, সব বাঙালিদের কাছে। নীতিন বোস, বিমল রায় আমার গুরু। প্রতি কথায় উদ্ধৃত করতেন লাগসই উর্দু শ্যের। নয়তো ইংরেজি কবিতা। একই সঙ্গে নির্ভুল বাংলায় কথা বলতেন সবার সঙ্গে। তাঁর ভিতরে বাস করত একটি শিশুসুলভ চঞ্চল মন। চারপাশের মানুষজনকে মুগ্ধ করত তাঁর সারল্য। ‘সাগিনা মাহাতো’ পর্বে তাঁর মধ্যে ‘স্টার’জাতীয় আত্মম্ভরিতা কেউ কখনও দেখেনি। তপন সিংহ বম্বে গেলে থাকতেন হয়তো হোটেলে। কিন্তু আহারাদি সব সময় দিলীপকুমারের আতিথ্য, আমন্ত্রণে সম্পন্ন হত।  

দেবদাস ছবির সেট - বিমল রায়, সুচিত্রা সেনের সাথে
হৃষীকেশ মুখার্জি
নবেন্দু ঘোষ
নীতিন বসু

তপন সিংহ ‘সাগিনা মাহাতো’ তৈরি করার কথা যখন ভেবেছিলেন, তখন তাঁর মনে বেশ দ্বিধা ছিল। কারণ তিনি মনে করতেন এই ছবিটিকে আদ্যন্ত একটি ‘রাজনৈতিক’ ভাবধারার প্রতিচ্ছবি হবে। কিন্তু তিনি নিজে নাকি রাজনীতি ‘বোঝেন’ না। তখন কলকাতায় চরম অশান্তির কাল। মানু রায়ের আমল। জল্লাদ পুলিশ আর ঘরছাড়া ছেলেমেয়েদের যন্ত্রণার ইতিকথায় ভরা এক দুঃসময়। তপন সিংহও শাসানি শুনেছেন তথাকথিত বিপ্লবীদের থেকে। কিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বাংলার দর্শকের গুণগ্রাহিতায় প্রেক্ষাগৃহে তার সুবর্ণজয়ন্তী হয়েছিল। এই সাফল্যের পিছনে গৌরকিশোর ঘোষ, দিলীপকুমার না তপন সিংহ, এই তিন মনস্বী মানুষের মধ্যে কার কৃতিত্ব বেশি সে প্রশ্ন মানুষের মনে ওঠেনি। শাস্ত্রীয় সিম্ফনির মধ্যে তিনটি হারমনির পর্দার মতো এই তিন নমস্য শিল্পী নিজেদের প্রকাশিত করেছিলেন। অনেকেই এই জন্য মূল স্রোত বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটা অনন্য মাইল ফলক হিসেবে ‘সাগিনা মাহাতো’কে চিহ্নিত করে থাকেন।

হয়তো ঠিকই করেন।

তথ্যসূত্র 

জামান, লায়লা। (২০২১, মার্চ ৬)। ‘মানবতন্ত্রী গৌরকিশোর ঘোষ।’ কালি ও কলম। kaliokalam.com/মানবতন্ত্রী-গৌরকিশর-ঘোষ/ 

সিংহ, তপন। (১৯৯৫)। মনে পড়ে। কলকাতাঃ আনন্দ পাবলিশার্স।  

সিংহ, তপন। (২০০৯)। কিছু ছায়া, কিছু ছবি। কলকাতাঃ এম সি সরকার।

সেনগুপ্ত, রুদ্রপ্রসাদ। স্মৃতিচারণ।  

ছবিঃ লেখকের সংগৃহীত। 

শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *