ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি

সাহসিনী

বেঁটেখাটো চেহারা। চোয়ালের দিকটা উঁচু। চুলটা টানটান করে বেঁধে রাখত বলে কপালটাও চ‌ওড়া লাগত। গলায় একটা মাদুলি পরত চ্যাপ্টা মত। মাদুলির ভেতরে কোন ঠাকুরের ফুল আছে জিজ্ঞেস করলে গম্ভীর হয়ে যেত। অন্যসময় মুখে একটা রোদ-ভেজা হাসি নিয়ে হয়ে যেত চ্যাটার্জি বাড়ির ‘ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি’।

চ্যাটার্জি বাড়িতে একটা নারকেল গাছ ছিল। ইয়া মোটাগুঁড়ি। বাড়ির পূর্ব দিকের কোণে যখন তাকে লাগানো হয়েছিল তখন‌ও সে বাড়ির কর্তা-গিন্নি ভাবেননি বাড়িটা একদিন বাড়তে বাড়তে গাছ অবধি পৌঁছে যাবে। একতলার ছাদ ঢালাই করে দোতলা তিনতলা হবে। নারকেল গাছটা কিন্তু কাটা হয়নি। দোতলার রান্নাঘরের মাঝখান দিয়ে সেই গাছ উঠে গেছিল ছাদ পর্যন্ত। ছাদের ওপর খাঁজকাটা পাতাগুলো আনন্দে দোল খেত। মনে হত নারকেল গাছটা পা ডুবিয়ে বসে আছে বাড়ির মধ্যে, বাড়ির দেহের‌ই একটা অংশ।

‘ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি’ কোন ছোটবেলায় এসেছিল একটা ময়লা পুঁটুলি নিয়ে। তারপর চ্যাটার্জিবাড়িতে বড় হল। এই বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর ঘুমের দায়িত্ব নিল। ‘ঘুমপাড়ানি’ যখন একটা লম্বা, টানা, লাল মেঝের ঘরে বাড়ির আটটি কচিকাঁচার ঠিক মাঝখানে শুয়ে থাকত, তখন তাকে অবিকল নারকেল গাছটার মত লাগত। ওর গলায় কী যে সুর ছিল ভগবান জানেন! সেই সুর ঘুম নদীর ধার থেকে লাল চেক গামছা ভিজিয়ে ঠান্ডা জল নিয়ে আসত আর চেপে ধরত দস্যি ছেলেমেয়েগুলোর চোখে। সব থেকে ছোটজন আবার অসম্ভব ভীতু। সে শুতো ‘ঘুমপাড়ানির’ গলা জড়িয়ে। ঘুমপাড়ানি জিজ্ঞেস করত, “কিসের জন্য ওমন গলা জড়িয়ে থাকিস?” মেয়েটা পিটপিট চোখে বলত, ” দত্যি-দানো আছে জানো না! তাদের কুলোর মত কান, মুলোর মতো দাঁত, গায়ে বড় বড় লোম। তারা অন্ধকারে বেরিয়ে আসে। ওই পেয়ারা বাগানে, ফলসা গাছের নিচে, ঘাপটি মেরে বসে থাকে। “‘ঘুমপাড়ানি’ হাসত, তারপর একটা ছড়া কেটে বলত, “ভয় তুমি কার? যে পাবে তার।” তাও মেয়েটার ভয় ভাঙত না।

একদিন সেই মেয়েটার ভীষণ জ্বর হল। পাড়ার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল বাবা। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিল। আবার সাতদিন পর দেখল। জ্বর ভালো হয়ে গেল, কিন্তু মেয়েটা ভালো হল না। দিন দিন একটা জন্তুর ডানা তার ওপর ছায়া ফেলতে লাগল। তার মুখের পাপড়ি থেকে লালের আভা হারাতে শুরু করল। বামুন ঠাকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দুটো ফুলকো লুচি পাতে তুলে দিলে ছুট্টে পালিয়ে যায়, বাগানের মালি হলুদ ছিটে দেওয়া পাতাবাহারের ডাল দিয়ে বানানো সুন্দর ফুলের তোড়া দিলে ছিঁড়ে ফেলে দেয়, অকারণে ঘরের কোণে লুকিয়ে কাঁদে। মা ভাবে, ‘ভীতু মেয়ে, রাক্ষস খোক্ষসের গল্প পড়ে আবার ভয় পেয়েছে।’

‘ঘুমপাড়ানি’র বিশ্বাস হয় না কথাটা। একদিন রাতে মেয়েটা বুকের কাছে লেপ্টে, ফিসফিসিয়ে বিশ্বস্ত কানটাকে বলল, ‘সে রাক্ষস দেখেছে! রাক্ষসের কুলোর মতো কান নয়, মুলোর মতো দাঁত‌ও নয়, সে অন্ধকারে থাকে না। তার গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলে, সে কোলে তুলে শুইয়ে দেয় বিছানায় তারপর পর্দা টেনে দিয়ে তার সমস্ত শরীর জুড়ে সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি খুঁজে বেড়ায় – আঙ্গুল দিয়ে খোঁজে!’

‘ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি’ নিঝুম হয়ে শুনল। কানে গুলির আওয়াজ আসছিল। ১৯৪৬ সাল, ‘ঘুমপাড়ানি’র বয়স তখন বারো। তেভাগা আন্দোলনে উত্তাল সমস্ত গ্রাম। বাড়ির মেয়ে ব‌উরাও পথে নেমেছে। মাঠে যে তারাও বোনে সোনার ফসলের বীজ। ঘাম দেয়, রক্ত দেয় বীজের গোড়া খুঁড়ে খুঁড়ে কিন্তু ফসলের দুই ভাগ নিয়ে যায় জমিদার। তাদের জন্য পড়ে থাকে এক ভাগ আর সারা বছরের অনটন। বর্গা-চাষীদের বিদ্রোহ। তারা তিনভাগের মধ্যে দুই ভাগ চায়। জমিদার শুনবে কেন? শোষকের কোন জাত হয় না। ইংরেজ কিংবা ভারতীয়। তারা শুধু অন্যের অধিকার পিষে ফেলতে জানে। গ্রামে গ্রামে পুলিশের বন্দুকের সামনে নিরস্ত্র মানুষের ভিড়। ভিড়ে শহিদ হল একটা ব‌উ। ব‌উটা তখন গর্ভবতী। তার রক্ত যেখানে পড়ল সেখানকার মাটি গ্রামের মানুষ ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখল। রোজ সন্ধ্যেবেলায় কেউ-না-কেউ প্রদীপ জ্বালিয়ে আসত সেখানে। ওই মাটিই মাদুলি ভরে পরা আছে ‘ঘুমপাড়ানি’র গলায়। ব‌উটা ছিল ওর আপন বৌদি।

ননী ডাক্তার! যে দুবেলা আহ্নিক করে, খাওয়ার আগে অন্নজল পাতের দু’পাশে উৎসর্গ করে ইষ্ট দেবতাকে, পাড়া শুদ্ধ লোক যাকে ধন্বন্তরি বলে, বয়স্করাও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। সেই ননী ডাক্তারের মধ্যে এত রক্তাক্ত কাদা! ‘ঘুমপাড়ানি’র আর ঘুম এল না সেই রাতে, তারপরের রাতেও। বুকের মাদুলিটা শক্ত করে চেপে রইল। তাকে যে পারতেই হবে। অনেক কুসুমবন নষ্ট হবে না হলে।

চেম্বারে বসেছে ননী-ডাক্তার। চশমাটা বুকের কাছে ঝুলছে। কাঠের বেঞ্চিতে বসা অনেক রুগী। কালবৈশাখীর মত ঢোকে ‘ঘুমপাড়ানি।’ তারপর একটানে সরিয়ে দেয় বুকের আঁচল – দুটি স্তন‌ জ্বলে ওঠে, “আয়, সাহস থাকলে আমার দিকে এগো, ছুঁবি না আমাকে? ওদের থেকে বেশী মাংস আছে আমার! …আয়…আয়!”

ননী ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। গলা তুলে ডাকে, “ওরে, কে কোথায় আছিস, পাগলিটাকে বের কর!” ‘ঘুমপাড়ানি ‘হাঁপাচ্ছিল! কিন্তু ততক্ষণে চেম্বারে বসে থাকা আটবছরের আরেকটা অমল বালিকা দাঁড়িয়ে পড়েছে। কে যেন ওর গলায় মন্ত্রপূতঃ জলের মতো সাহস ঢেলে দিয়েছে। ছোট ছোট আঙুলগুলো ননী ডাক্তারের দিকে তুলে ধরে চেঁচাচ্ছে, “ও পাগলি নয়, ও ঠিক বলেছে। তুমি খারাপ লোক, ভীষণ খারাপ।”

তারপর আস্তে আস্তে ওই পাড়ার সব পাঁচ, ছয়, সাত, আটের শিশুকন্যারা চেনালো সুদর্শন ননী ডাক্তারের পাকানো নখ, কুলোর মত কান, মুলোর মতো দাঁতগুলো। সে পালাল। ‘ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি,’ মানে মালতি হাসদার চওড়া কপালে সেদিন একটা ত্রিনয়ন দেখা যাচ্ছিল। যে নয়ন শুধু দেবীকেই মানায়! একমাত্র দেবীকেই।

মালতি হাসদা আজ‌ও আমার ছোটমাসির কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বীরাঙ্গনা।

———-

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ অন্তর্জাল। 

রুমি বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর স্নাতক এবং ম্যানেজমেন্টের স্নাতকোত্তর। লেখালেখির শুরু লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে। কয়েকটি মুদ্রিত‌ সংকলনে গল্প এবং কবিতা স্থান পেয়েছে। ‘পুরাণকথা পরণকথা’, ‘শেষ চিঠি’, ‘বরফকাঠি জমজমাটি’, ‘কবিতা তোমায় ভালোবেসে’, ‘অণুতে অসীম’, ‘ফ্যান্টাসায়েন্জা’ এমন কয়েকটি সংকলন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *