নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মরণে

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মরণে

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

সত্তর আশি দশকের কথা – মার্কিন মুলুকে বেল ল্যাব-এ চাকরি করছি। অবসর সময় কিছু অধ্যাপক বন্ধু আর সহকর্মীদের সঙ্গে লজিক পাজল নিয়ে মেতে থাকি। ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ ম্যাগাজিনে মার্কিন গার্ডনারের কলাম ‘ম্যাথম্যাটিক্যাল গেমস’ নিয়মিত পড়ি, আর ভাবি সহজ করে ওই ধরণের কিছু বাংলায় লিখলে কেমন হয়, কিংবা লজিক পাজল নিয়ে দুয়েকটা প্রবন্ধ? এগুলো ভাবা সহজ, লেখাও হয়তো খুব একটা কঠিন নয়, কিন্তু ছাপবে কে? এদিকে ইমেলের সুবিধাও তখন ছিল না।* লেখা পাঠাতে হবে ডাকে, সেটা পোঁছবে কিনা জানি না। তার ওপর দেশের পত্রপত্রিকার সম্পাদক কাউকেই চিনি না – কেন তাঁরা ছাপতে যাবেন?

সালটা ঠিক মনে নেই, আশি দশকের প্রথম দিকে ‘ইত্যাদি প্রকাশনী’র প্রচারের জন্য নিউ জার্সিতে এসেছিলে সংস্থার কর্ণধার অশোক চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মী চিত্ত বিশ্বাস। আমাদের বন্ধু আলোলিকা মুখোপাধ্যায় তখন তাঁদের পত্রিকা, ‘পরিবর্তন’-এর নিয়মিত লেখক। আমি কিশোরদের জন্য লজিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে আগ্রহী শুনে লেখা পাঠাতে বললেন। যদ্দুর মনে পড়ছে চুরাশি সালে কলকাতায় গিয়ে পরিচয় হল ‘ইত্যাদি’ সংস্থার পত্রিকা ‘কিশোরমন’-এর সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে। সেই যাত্রাতেই আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে একটা কাজে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল আনন্দমেলা-র সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনিও আমি কী নিয়ে লেখার কথা ভাবছি শুনে বললেন, আমরা ছাপতে চাই। শুরু হল আনন্দমেলায় আমার লেখালেখি। ‘কিশোর মন’-এ পাঠাতাম মূলত ধাঁধা, আনন্দমেলায় লজিক ও রিক্রিয়েশানাল ম্যাথম্যাটিকস-এর প্রবন্ধ। এঁদের উৎসাহ না পেলে বাংলা লেখালেখির জগতে আমার হয়তো আসা হত না।

এখন নীরেনবাবুর কথা একটু বলি। ওঁকে আমি কবি হিসেবেই জানতাম, কিন্তু উনি যে বিজ্ঞান-বিষয়ক আলোচনাও এতো মন দিয়ে পড়েন বুঝিনি। প্রতিবার দেশে গিয়ে যখন ওঁর অফিসে বসে গল্প করতাম, উনি আমার লেখার প্রসঙ্গে যেসব আলোচনা করতেন, তাতে ভালোভাবেই বুঝতাম বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও আমার লেখার প্রত্যেকটি লাইন পড়ে ও বুঝে তারপর ছাপতে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে বেশ বড়ো একটা লেখা পাঠালাম ‘ধাঁধাপুরীর গোলকধাঁধা।’ নীরেনবাবু তখন আমার লেখা নিয়মিত পুজোবার্ষিকীতে ছাপছেন, ভেবেছিলাম এটাকে হয়তো ধারাবাহিক হিসেবে বার করবেন। কিন্তু নীরেনবাবু ঠিক করে ফেলেছেন এটা আনন্দ পাবলিশার্স সরাসরি বই হিসেবে প্রকাশিত করলে ভালো হবে। আনন্দ পাবলিশার্স-এর কর্ণধার তখন বাদল বসু। তিনিও তাতে রাজি। খবরটা আমি জানতাম না। আমার স্ত্রী, শমীতা, অন্য একটা কাজে কলকাতায় গিয়ে খবরটা শুনল। ‘ধাঁধাপুরীর গোলকধাঁধা’ই ছিল আনন্দ পাবলিশার্সে ছাপা আমার প্রথম বই। পরের বছর দেশে এসে ওঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ধারাবাহিক না করে, ওটা বই করলেন কেন? আমাকে বোঝালেন, লেখাটা একসঙ্গে না পড়লে মজা থাকবে না।

কথাটা ভুল নয়, পুরো বইটাই ছিল বিভিন্ন লজিক পাজলের ওপর ভিত্তি করে একটা সম্পূর্ণ উপন্যাস। প্রতি সংখ্যায় একটু একটু বের হলে পুরো মজাটা পাওয়া যেত না। লেখার মূল্যায়নের ব্যাপারে নীরেনবাবু ছিলেন সত্যিকারের জহুরী। দেশের নানান পত্র-পত্রিকায় বইটা ভালো রিভিউ পেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বইটি কিনে বিভিন্ন স্কুল লাইব্রেরিতে পাঠিয়েছিলে, ফলে বিক্রি মন্দ হয়নি। বাদলবাবুর নিশ্চয় একটু দুর্ভাবনা ছিল – নীরেনবাবুর চাপে পড়ে একটা অখ্যাত লেখকের অদ্ভুত বই, যেটা না-ধাঁধা না-উপন্যাস, ছেপে লস না খান! সেটা ঘটেনি। ফলে আমার আরও বেশ কিছু বই বাদলবাবু ছেপেছিলেন।

একেনবাবুকে নিয়ে আমার গোয়েন্দাকাহিনি লেখাও নীরেনবাবুর উৎসাহেই শুরু হয়েছিল। একেনবাবুর গল্পগুলোতে মারামারি খুনোখুনির বদলে প্রাধান্য ছিল লজিকের। একেনবাবু ছিলেন একজন ‘আর্ম-চেয়ার’ গোয়েন্দা। গল্পগুলো ছিল ‘হাউ টু ক্যাচেম’ আর ‘হু ডান ইট’-এর হাইব্রিড। স্থান ম্যানহাটন, অতি-বিরক্তিকর চরিত্রের বাঙালি এক গোয়েন্দাকে নিয়ে নতুন ধাঁচের রহস্য কাহিনি। সেখানে একদম শেষে ‘হু ডান ইট’-এর হঠাৎ চমক নেই। দোষী কে অনুমান করা খুব কঠিন নয়, কিন্তু কী করে তাকে ধরা হল, সেখানেই মজা। নীরেনবাবু সেই স্টাইল পছন্দ করেছিলেন নিশ্চয়। একেনবাবুর দুটো উপন্যাস আর বেশ কিছু গল্প তিনি ছেপেছিলেন।

আনন্দমেলার অফিসে পাশাপাশি অনেকের বসার ডেস্ক ছিল। সম্পাদকের ঘর লাগোয়া, কিন্তু আলাদা। প্রাইভেসির জন্য ওঁর অফিস-ঘরের ঘরের দরজা বন্ধ থাকলেও অফিসে বসে নীরেনবাবু অন্য কথা বিশেষ বলতেন না। ওঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত, কিন্তু বুঝতাম প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। আমিও চাপ দিতাম না। তখন নব্বই দশকের গোড়ার দিকের কথা। মনে হত উনি সম্পাদনার কাজ করতে করতে একটু যেন ক্লান্ত। পিছনে হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক কিছু চাপও ছিল। একবার উনি একটু খাপছাড়া ভাবেই বললেন, ‘সুজনবাবু, আপনি তো আমাদের একটি কম্পিটিটারের পত্রিকাতেও নিয়মিত লেখেন।’

বুঝলাম, ‘কিশোরমন’-এর কথা বলছেন। বললাম, ‘হ্যাঁ, তাতে কি আপনার কোনও সমস্যা আছে?’

উনি একটু লজ্জিত হলেন, ‘না না, আমার কোনও সমস্যা নেই। মাঝে মাঝে প্রশ্ন ওঠে তাই বললাম।’

আরেকবার একটু স্বগতোক্তি করলেন, ‘আমি কতদিন এই পদে থাকব জানি না।’

‘সেকি! আপনার সম্পাদনায় আনন্দমেলা তো এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে!’

‘আসলে আমি বিজ্ঞাপন নেবার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। যে-কোনও বিজ্ঞাপন আনন্দমেলা ছাপা হোক আমি চাই না, এটা ছোটোদের পত্রিকা। কিন্তু অনেকের তাতে সমস্যা।’

‘আপনি চলে গেলে কে আসবে? শ্যামল?’

কবি শ্যামলকান্তি দাস ছিল নীরেনবাবুর রাইট-হ্যান্ড ম্যান।

‘সম্ভবত, দেবাশিস।’

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি চিনতাম না। তবে নীরেনবাবু চলে যাবার পরে আনন্দমেলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। একেনবাবুর গোটা দুই উপন্যাস আনন্দমেলার অফিসে ছাপার অপেক্ষায় ছিল। সেগুলো বহুদিন ছাপা হচ্ছে না। একবার গিয়েছিলাম খোঁজ করতে। দেবাশিসের ব্যবহার অত্যন্ত ভদ্র। কিন্তু ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কোনও উত্তরই পরিষ্কার করে দিলেন না। শুধু বললেন, আরও লেখা দিন না। হতে পারে একেনবাবু ওঁর ভালো লাগেনি। শ্যামলের কাছ থেকে একেনবাবুর উপন্যাস দুটো ফেরত নিয়ে চলে এলাম।

‘কিশোরমন’ উঠে গেছে, আনন্দমেলায় নীরেনবাবু নেই, সুতরাং কিশোর-কিশোরীদের জন্য আমার লেখায় ইতি পড়ল। নিজের কাজ চাপও বেড়েছে। নীরেনবাবুর সঙ্গে আমার আরও একবার দেখা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে মোবাইল ফোনের জন্য যখন রেডিও স্পেকট্রাম নিলাম হচ্ছে, তখন AT&T কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে বছর দেড়েক দিল্লীতে ছিলাম। আমার কাজ, যারা এই পরিষেবা দিতে যাচ্ছে তাদের ‘টেকনিক্যাল আডভাইস’ দেওয়া। দিন চারেকের জন্য কলকাতায় গিয়েছিলাম। ভাবলাম নীরেনবাবুর সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। নীরেনবাবু তখন গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে আলাদা একটা ঘরে বসেন। ঘরে একাই ছিলেন। আমি কী করতে দেশে এসেছি শুনে যা বললেন তার সার কথা হল – মোবাইল ফোন বড়োলোকি ব্যাপার! আমি টেলিফোনের লোক, দেশের এই অকেজো টেলিফোন ব্যবস্থাকে যদি আমেরিকার মতো উন্নত করতে সাহায্য করতে পারি – সেটা কাজের কাজ হবে।

আমি ওঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম মোবাইল টেকনোলজির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে। মনে হল না, ওঁকে বোঝাতে পারলাম। সেদিন আমার তাড়া ছিল, নইলে আমি নিঃসন্দেহ উনি ব্যাপারটা বুঝতেন।

আমরা যারা শখের লেখক, অর্থাৎ লেখা ঠিক আমাদের জীবিকা নয়, নিয়মিত লেখালিখি করা আমাদের হয়ে ওঠে না। আমরা লিখি যখন কোনও সম্পাদকের কাছে লেখার জন্য উৎসাহ পাই। ভালো হচ্ছে, পাঠকরা পছন্দ করছে, পড়তে চাইছে, ইত্যাদি বলে আরও লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। লেখার জগতে ধীরে ধীরে টেনে আনেন। বলতে চাইছি, সত্যিকারের দক্ষ সম্পাদক শুধু লেখার মান বিচার করেন না, লেখক তৈরিও করেন। আগে নীরেনবাবুকে একজন বড়ো কবি হিসেবে দেখতাম, কিন্তু তিনি যে একজন দক্ষ সম্পাদক, সেটা আনন্দমেলার সঙ্গে যোগাযোগের পরে বুঝেছিলাম। উনি ছিলেন বলেই আমার মতো একজন সাধারণ টেকনোলজিস্ট ‘ধাঁধাপুরীর গোলকধাঁধা’ বা একেনবাবু লেখার সাহস পেয়েছিল। এই সুযোগে ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানালাম।

————

*দেশে ইন্টারনেটই চালু হয়েছিল নব্বই দশকের মাঝামাঝি। পত্রপত্রিকার অফিসে ইমেল চালু হতে হতে আরও বেশ কয়েক বছর।

সদ্য প্রয়াত সুজন দাশগুপ্ত ছিলেন পাঁচ দশকের বেশি আমেরিকা প্রবাসী। গোয়েন্দা একেনবাবু-র মানস-পিতা এবং অবসর.নেট-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন সম্পাদক। রম্যরচনা, ধাঁধা, উপন্যাস ও রহস্যকাহিনীর ওপর গোটা পঁচিশেক বই আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *