পরশু খবরটা শুনে কিছুক্ষণ শূন্যতা বোধ করছিলুম। সম্পূর্ণ ‘অদেখা’ একজন মানুষ, সাক্ষাৎ কথাবার্তা কমই হয়েছে। যখনই কথা হয়েছে ফোনে, তিনি মনে করিয়ে দিতেন তাঁর শ্রবণ যন্ত্র তেমন সহযোগিতা করে না। একটু উচ্চকিত স্বরে কথা বলতে হত হয়তো। তবু কথা হত মাঝে মাঝেই। নয়তো অন্যান্য মাধ্যমে। যে ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পারতুম, আমার প্রতি তাঁর স্নেহ, ‘অপাত্রে হলেও’ অবিরাম বর্ষিত হয়ে যায়। এই প্রাপ্তি আমার জন্য বিধাতার অনুকম্পা। সেই ঝরনাধারা হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে গেলে দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার হবার অনুভূতি আচ্ছন্ন করে দেয়।
তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল লেখালেখির সূত্রে। বাংলা লাইভের ‘মজলিশ’ পাতার সঙ্গে তাঁর সংলিপ্তি ছিল। সম্ভবত এগারো-বারো সাল নাগাদ সেখানে এক বাইশে শ্রাবণে পত্রস্থ হয়েছিল কবিকে নিয়ে আমার একটি লেখা ‘মৃত্যুরাখাল ও সদানন্দ।’ সেই লেখাটি পড়ে সুমিতদা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নানা কথা হত মাঝে মাঝেই, বিশেষত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। ‘তখন কে তুমি, তা কে জানত।’ পনেরো সালে বন্ধু ঈশানী আমাকে ‘অবসর’ পত্রিকায় লিখতে বলে। ‘শরদিন্দু স্মৃতি’ সংখ্যার লিংকটিও পাঠায় আমাকে। সেখানে পড়তে গিয়ে আমি সুমিতদার এলেমটি টের পাই। তখনও সুজনদার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই এই ‘চমক’টি আমার জন্য ছিল এক মনোরম প্রাপ্তি। পনেরো সালেই ‘অবসরে’র কবিপক্ষের সংখ্যাটিতে প্রকাশের জন্য আমি ‘হননবৈশাখ ও কবি’ নামে লেখাটি সুমিতদাকে পাঠাই। কবি ও জালিয়াঁওয়ালাবাগের ইতিহাস ও ঘটনাক্রম নিয়ে আলোচনা ছিল সেখানে। পাঠপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সুমিতদা ‘পোনু’ নামের আড়ালে যা-তা প্রশংসা করে আমাকে বেশ নার্ভাস করে দেন। এর আগে অবশ্য বন্ধু নিনা আমাকে সুমিতদার সম্বন্ধে নানা গল্প বলে ‘প্রস্তুত’ করে রেখেছিল। সে জন্যই সুমিতদা লেখার সঙ্গে ছাপার জন্য আমার পরিচয় লিখে দিতে বললে আমি কাজটা নিনার স্কন্ধলগ্ন করে দিই। অত কঠিন কাজ আমার দ্বারা হয় না। তা পরিচয় লিখতে গিয়ে নিনা বিহারি বন্ধুপ্রীতির এমন একটি নিদর্শন রাখে, যে সুমিতদা বলেন যে এই পরিচয় পড়ার পর ‘বন্ধুত্ব রাখা মুশকিল।’ সত্যিই নিনা এমন বাড়াবাড়ি করেছিল যে পড়লে বিহারিরও লজ্জা হয়। শুধু এই জন্যেই এক বিরল কীর্তি বলা যায় তাকে।
তবে ততদিনে সুমিতদার রসবোধের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ হয়ে গিয়েছিলুম আমি। তাঁকে লিখি –
সুমিত’দা, আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। কিন্তু নিনার কাছে অনেক কথা শুনেছি। বিশেষত আপনার কলকাত্তাই নাগরিক রসবোধের কথা। সেই নিমজ্ঞান থেকে থেকে বিনম্র প্রশ্ন, এইটুকু স্বাধীনতা যাচ্ঞা করি। আপনি কি রেগে গেলে ইংরিজি বলেন? তাহলে ভবিষ্যতে সাবধান থাকবো।
এসব আলাপ চলতেই থাকত নিয়মিত। ‘অবসরে’ লেখালেখিও। বেশ কিছুদিন কথা না হলে বুঝতুম শরীর জুৎসই নেই। আবার ভালো লাগলেই কথা শুরু। তার কিছুদিন পরে আমার গাওয়া নিধুবাবুর একটি বাংলা টপ্পা শুনে তিনি স্নেহের বাঁধনের উপর আরেকটি রজ্জু যোগ করে দিলেন। যাকে বলে ‘ফেভিকল কি জোড়।’ লেখালেখির সঙ্গে গান নিয়েও আলাপ আলোচনা চলতে থাকে সমানে।
পরশুদিন তাঁকে নিবেদন করা আমার গানটি শুনে সুজনদা যখন মন্তব্য করলেন, ‘…সুমিত-দা তোমার লেখা আর গান দুটোই খুব পছন্দ করত… তুমি ছিলে সুমিত-দা’র ‘আত্মার আত্মীয়।’
বুঝতে পারি, আমার প্রাপ্তির মূল্যটি আসলে কত মহার্ঘ।
২
সুমিতদাকে নিয়ে আমার ডাউন মেমরি লেন পড়তে গিয়ে ‘চলচিত্ত-চঞ্চরি’ নাটকে ইশানের বিখ্যাত সংলাপটা মনে পড়তে পারে অনেকের ‘আত্মম্ভরী অহঙ্কার, আত্মনামে হুহুঙ্কার, তার গতি হবে না হবে না…’
‘আত্মনাম’ এসেই যাবে। কারণ সুমিতদাকে আমি নিজের আয়নায় যেমন দেখেছি, তার প্রতিচ্ছায়াই বারবার আসবে এই লেখায়। ব্যক্তি আমি আর ব্যক্তি সুমিতদার কথাই থাকবে এখানে। সুমিতদা যত বড়ো মানুষই হোন না কেন, আমার মত অভাজনের সঙ্গে সিংহাসনের আসন থেকে নেমেই প্রতিভাত হয়েছিলেন। লেখালেখি, গান-বাজনা, রহস্যালাপ বা ব্যক্তিগত সংলাপ সবই থাকবে এর মধ্যে। আমিও বিশ্বাস করি যা কিছু ব্যক্তিগত, তাই পবিত্র। তাই আত্মনাম থাকলেও আত্মম্ভরিতা নৈব নৈব চ।
‘অবসরে’ আমার নিয়মিত লেখালেখি শুরু হয় পনেরো সাল নাগাদই। অতদিনে আমার আরেক প্রিয় মানুষ সুজনদার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেছে। তখন পক্ষকালের ‘অবসর!’ প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই লিখি। কিন্তু অত লেখার জোগান দেওয়া ভার। যাঁরা আমার তুচ্ছ লেখাপত্র পড়েছেন, তাঁরা হয়তো জানেন লেখার জন্য আমাকে বড়ো মেহনত করতে হয়। চ্যাংড়ারা বলে, শিবাংশুদা চার লাইন লিখতে চল্লিশ পাতা বই পড়ে।
বৈশাখ মাসেই ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ উপলক্ষে একটি লেখা পাঠাই – ‘সদ্ধর্ম-সপর্যা।’ তখন ‘অবসরে’র সম্পাদকীয় দায়িত্ব সুমিতদার থেকে অনেকটাই সুজনদার হাতে চলে এসেছিল। এই সুজনদা। গ্ল্যামর কোশন্ট সুমিতদার মতই। কিন্তু দুজনের ইমেজ একেবারে আলাদা। একজন ফ্ল্যমবয়ান্ট, অন্যজন অন্তর্মুখ। দুজনের বোঝাপড়ার মধ্যে অদ্ভুত এক ছন্দ ছিল। ‘ছিল’ শব্দটা এখনও মানতে পারছি না। তবু হয়তো আর ‘আছে’ হবে না। তা বুদ্ধ’কে নিয়ে লেখাটি পড়ে সম্পাদক হয়তো একটু বিব্রত হয়েছিলেন। আমিও মানি, লেখাটির ভর ছিল ব্ল্যাকহোলের থেকেও ভারী। কিন্তু শাক্যমুনি বুদ্ধ বা তাঁর উপদেশ ও সংস্কৃতি কি আর অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ থেকে টুকে দেওয়া যায়? যদিও বাংলায় ওই স্টাইলটাই চলে। ‘অবসরে’ কতজন পড়েছিলেন, জানিনা। তবে সুমিতদা লেখাটি পড়ে আমাকে জানান, ‘কেন যে লোকে তোমার লেখাকে শক্ত বলে, বুঝি না।’ ভাবি, মেহনত বিফল হয়নি। কিছু প্রিয়বন্ধু সর্বক্ষণ যে আমার লেখাকে ‘কটিন-কটিন’ বলে চিমটি কাটে, সেটা বয়স্যপ্রীতিতে উপেক্ষা করাই যায়।
পনেরো সালের শরৎকাল নাগাদ। তখনও আমি পুরোদস্তুর চাকুরিজীবী। ষোলো ঘন্টা, আঠেরো ঘন্টা পাপক্ষয় করি। সুমিতদার সঙ্গে বিনিময় হলেই জানতে চান আমার অবসর নিতে আরও কতদিন? আমি বলি, হয়ে এল। সে রকম একটা সময়ে সুমিতদার ইংরেজিতে সংক্ষিপ্ত একটি বার্তা ইনবক্সে।
Shibanshu, please send me your phone number and a preferred time to call. I’d like to talk to you about something of possible mutual interest.
আমি জানি, বাঙালি সিরিয়স কথা বলতে গেলে ইংরেজি বলে, আর গাল দিতে হিন্দি। আর সুমিতদা যখন ‘ইংরেজি’ লিখছেন, তখন ব্যাপারটা সত্যিই সিরিয়স। আমি নম্বর পাঠিয়ে দিই। সুমিতদার ফোন যখন আসে আমি তখন বাজারে। চারদিকের হট্টগোলের মধ্যে কথা বলা যাচ্ছিল না। আমি অনুরোধ করি দু-তিন ঘন্টা পরে যদি করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আরে আমার তো কোনো অসুবিধে নেই। তোমরা ঘুমিয়ে পড়বে।’ আমি জানাই, আমরা চন্দ্রবংশীয়। আকাশে চাঁদের জেল্লা যেমন বাড়ে, তেমনই বাড়ে আমাদের এনার্জির গ্র্যাফ।
বারোটা নাগাদ ফোন এল। যথারীতি আমাকে অকারণে নানা সাধুবাদ দিয়ে বললেন, ‘অবসর নেবার পর তুমি ‘অবসরে’র হবে।’ বুঝতে পারি তিনি কী বলতে চাইছেন। আরও বলেন, ‘আমার বা সুজনের পক্ষে এতটা ভার বহন করা ক্লেশ হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে একা করতে হবে না। ভাস্কর থাকবে। খুব ভালো ছেলে। আরও যদি কাউকে চাও, তাও ভেবে দেখা যায়।’ আমি সবিনয় অসহায়তা থেকে বলি, ‘সুমিতদা, লেখালেখি করি বটে। কিন্তু ‘সম্পাদক’ হবার এলেম নেই আমার। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, লেগে থাকার ক্ষমতা, তাড়া দেবার তাকত, একেবারেই ‘শূন্য।’ দ্বিতীয়বার বলতে হয় না। এত প্রাজ্ঞতা ছিল তাঁর বিবেচনায়। তিনি সেই বিষয়টি ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। এ নিয়ে আর কোনো আলাপ হয়নি তাঁর সঙ্গে।
গত পয়লা বৈশাখের দিন ‘এরা পরকে আপন করে’ গানটি উৎসর্গ করেছিলুম বন্ধুদের প্রতি। আমার গানে সুমিতদার ‘প্রেম চিহ্ন’টি সেখানেই শেষ দেখতে পাই। তারপর আর তাঁর সঙ্গে আমার কোনো বিনিময় হয়নি। মনটি সা-জওয়ান থেকে গেলেও শরীরের নিজের ধর্ম আছে। কোনো মানুষই তা জয় করতে পারে না। সুমিতদাও পারেননি। চলে যেতেই হল।
কিশোর বয়স থেকে নীরেন্দ্রনাথের এই কবিতাটি সত্ত্বার গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে। সুমিতদার চলে যাওয়ার পর আবার তার পুনরাবৃত্তির সময় এল।
মৃত্যু কি সকলই নেয়? মৃত্যু কি সকলই নিতে পারে?
তা হলে কী নিয়ে বাঁচে, নেয়নি যাদের মৃত্যু, তারা
অর্থাৎ যে যায় সেও সমগ্রত যায় না ওধারে
চোখের আড়ালে গিয়ে বন্ধুদের হৃদয়ের কড়া ধরে নাড়ে
বারে বারে
দেখে যায় সব চেয়ে বেশি করে কে রেখেছে মনে
অর্থাৎ স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থেকে নিয়ত সে মৃত্যুকেই মারে।
ভালো থাকবেন সুমিতদা। আমরা নিশ্চিত, মৃত্যু-রাখাল আপনাকে জয় করতে পারবে না…
সম্পাদকীয় টীকা –
সুমিত রায়ের প্রয়াণের পর এই লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘অবসর’ পত্রিকার ফেসবুক গ্রুপ – ‘অবসর পত্রিকা – Abasar Patrika’ তে। ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্য লেখাটি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। পুরো লেখাটি পড়তে যারা আগ্রহী, তাঁদের পত্রিকার ঐ গ্রুপে গিয়ে পড়ার আমন্ত্রণ রইল। #সুমিতেষু দিয়ে খুঁজলেই লেখাগুলি পাওয়া যাবে।