জীবনে এক একটা এমন সময় আসে যখন নিমেষের জন্য চলমান জগত যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। যখন জীবন থেকে কোনো প্রিয়জন বিদায় নেন, তখন এক একটা মুহূর্ত খুব নিষ্ঠুর মনে হয়। সুমিতদার চলে যাবার খবর পেয়ে আমার ঠিক সেই রকমই মনে হয়েছিল। মনটা অসাড় হয়ে ছিল কিছুক্ষণ।
জীবনে তো কত মানুষের সাথেই দেখাশোনা হয়, কথাবার্তা হয়, সৌজন্য বিনিময় হয়। কিন্তু এক একজন মানুষ মনের মধ্যে সুন্দর ছবি এঁকে যান, যা আজীবন স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকে।
খুব বেশি বছর তো নয়। তবু মনে হয় যেন কতদিন থেকে জানি মানুষটিকে। সুমিতদার সাথে আমার প্রথম পরিচয় যখন আমার প্রাচীন ভারতের রানিদের নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ‘রানী-কাহিনী’ ‘অবসর’-এ প্রকাশিত হয়। সম্ভবত ২০১৩ সালে। সেই প্রবন্ধে সুমিতদা একটি প্রশংসা সূচক মন্তব্য করেন। আমার বিশেষ বন্ধু ভাস্কর বসু, যে আমাকে প্রথম ‘অবসর’-এর সাথে পরিচয় করিয়েছে, সে বলে, ‘ওহে, তুমি জানো কে তোমার প্রবন্ধ ভালো বলেছেন?’ সেই প্রথম জানতে পারলাম মানুষটি কে। তারপর অজস্র স্মৃতির ঢেউ, লিখতে গিয়ে যা এখন মনের মধ্যে আছড়ে পড়ছে। আমি তাঁকে সারা জীবন ‘অগ্রজপ্রতিম’ বলে ডেকেছি ও তিনি ভ্রাতৃস্নেহে আমার অনেক আবদার মেনে নিয়েছেন। বয়সের ব্যবধান কোনোদিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
তাঁর কাছে প্রশংসা যেমন পেয়েছি, স্নেহভরা বকুনিও খেয়েছি। সুকুমারী ভট্টাচার্য স্মরণে অবসর ‘প্রাচীন ভারত’ সংখ্যা বের হবে ২০১৫ জুন মাসে। সম্পাদনার ভার আমার ওপর। যোগাড়যন্ত্র করে বেশ কিছু ভালো লেখাও আনতে পেরেছি, যাঁদের মধ্যে আছেন রোমিলা থাপার, পদ্মশ্রী দিলীপ চক্রবর্তীর মত মহাপণ্ডিতেরা ও সুকুমারীদির বিশেষ বন্ধু বিজয়া গোস্বামী। এসব নিয়ে আমি তখন লাফাচ্ছি। তাই একটা ব্যাপারে বিশেষ জোর দিইনি – সুকুমারী ভট্টাচার্যের জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু লিখিনি, দায়সারা ভাবে কাজ সেরেছি। আমার কর্তব্যে গাফিলিতি সুমিতদার চোখ এড়ায়নি। যথারীতি বকুনি খেলাম ও জীবনী অংশটি আবার নতুন করে লিখলাম, যতক্ষণ না তাঁর পছন্দ হচ্ছে।
‘অবসর’-এর বিশেষ বিজ্ঞান সংখ্যা বের হবে ২০১৭-র গোড়াতে। সুমিতদা ও আমার ওপর সম্পাদনার ভার। সুমিতদাকে বহুমুখী প্রতিভাশালী বলে সবাই জানে। তাঁর সাথে সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়ে আমি খুব খুশি। কিন্তু তিনি কতো বড়ো মাপের মানুষ তা জানতে বাকি ছিল। সম্পাদনার কাজ চলাকালীন আমার একটি ব্যক্তিগত সমস্যা দেখা দেয়। ‘অবসর’-এর দিকে সময় দেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। সেটা সুজনদাকে কোনোমতে ভয়ে ভয়ে বলি। তারপরের দিনই সুমিতদার মেসেজ, কোনো চিন্তা নেই – আমি একাই সামলে নেব। যে কাজটা করতে আমরা দু’জন হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম, তিনি সেটা অনায়াসে একা নিজের ঘাড়ে তুমি নিলেন। আমি সেদিন ধন্যবাদ দিতে পারিনি, কারণ ধন্যবাদ শব্দটা অনেক ছোটো ছিল তাঁর মহত্ত্বের কাছে।
মানুষ চিনতে পারতেন তিনি। খুব সম্ভবত ‘অবসর’-এ শরদিন্দু সংখ্যায় (এপ্রিল ২০১৫) আমার ‘ইতিহাসের কথাকার’ পড়ে আমাকে বলেছিলেন আমার হাতে না কি রোমান্টিক গল্প ভালো জমবে। বিশ্বাস করিনি, আমি প্রবন্ধ লেখার লোক, কী করে রোমান্টিক গপ্পো লিখব? তারপর একদিন সুমিতদার উৎসাহ স্মরণ করে দুগ্গা বলে হাত লাগিয়েছিলাম। জনতার বাহবা শুনে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, আর ভাবছিলাম তাঁর কথা।
একটা ঘটনার পর থেকে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে সুমিতদাকে না দেখিয়ে প্রবন্ধ ফাইনাল করব না। ‘অবসর’-এর জন্য ‘প্রাচীন ভারতে গোমাংস’ লিখছি ২০১৬ সালে। মাস ছয়েক ধরে প্রচুর খাটাখাটুনি করে, অনেক প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্র আর সাহিত্য ঘেঁটে, প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদটি দু’জন খ্যাতনামা ইন্ডোলজিস্টদের দেখিয়ে তারপর ‘অবসর’-এ পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছি। সেটা পড়ে সুমিতদা এক জায়গায় একটা মূল্যবান মন্তব্য করলেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম, আর ভাবতে লাগলাম তাঁর জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে। অবশ্যই সেই জায়গাটি বদলে দিয়েছিলাম তাঁর কথামত।
দুর্গার ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক বিবর্তন নিয়ে ‘দুর্গা যুগে যুগে’ লিখছি ২০১৯ সালে, দেশ পত্রিকার জন্য। পাঠাবার আগে একবার সুমিতদাকে না দেখিয়ে নিলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি তখন কোনো কাজে খুব ব্যস্ত, তার মাঝেই দেখে দিলেন ও একটা টাইম-লাইন জুড়ে দিতে বললেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার খবর তাঁকে জানাতে লিখেছিলেন, “Congratulations! Cream rises to the top।” পড়ে আমার বুক আনন্দে ভরে গিয়েছিল। বিবাহিতা হিন্দু নারীদের সিঁদুর পরার ইতিহাস ও তাৎপর্য নিয়ে ‘সিঁদুরের সাতকাহন’-এর প্রথম খসড়া লিখেছিলাম কয়েক বছর আগে, তাতে সুমিতদার মন্তব্য পাবার পর সমস্যাটিকে নতুন করে ভাবতে বসি ও পুরোপুরি খোলনলচে বদলে নতুন করে লিখেছিলাম।
এমন বহুমুখী গভীর জ্ঞানী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আজকাল মেকি জ্ঞানীরা একপাতা না পড়েও বিরাট বিরাট কথা বলে। আর সুমিতদাকে কোনোদিন তাঁর গভীর জ্ঞানের কথা যেচে কাউকে বলতে শুনলাম না। কেবল জিজ্ঞাসু ব্যক্তিরাই জানতে পারতেন তাঁর গভীরতা।
এখন কেবল মনে হচ্ছে, এবার কার কাছে পাঠাবো আমার বাংলা প্রবন্ধগুলি রিভিউ করে দিতে। আমার একজন ভরসা চলে গেলেন। জীবনের একটা বড়ো জায়গা খালি হয়ে গেল।
‘অবসর’-এ ‘বিকাশ রায়’ সংখ্যার (সেপ্টেম্বর ২০১৫) ব্যাপারে আমাকে ফোন করেছিলেন কিছু আলোচনার জন্য। বাড়ি ছিলাম না, তাই ফোনে ভয়েস মেসেজ দিয়েছিলেন। তাঁর সুন্দর Baritone গলার রেকর্ডিং, মেসেজটা ডিলিট করনি। রেখে দিয়েছিলাম বহুদিন, যতদিন না আমার ফোনটা বদলাতে হয়েছিল। এখন তাঁর গলার আওয়াজ আর কোথায় পাবো? তিনি তাঁর এই জন্মের জড়দেহখানি রেখে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে জন্মান্তরের দিকে চলে গেলেন। আমার মতো অগনিত মানুষের মাঝে তিনি চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন।