আমার রবীন্দ্র শিক্ষক

প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটা দিন আসে যে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তখন অবশ্য সে সেটা বুঝতে পারে না। কিন্তু যতই দিন গড়ায় সেই দিনের মাহাত্ম্য তার কাছে বাড়তে থাকে, গাঢ় হয় অনুভূতি। সে বারংবার ফিরে দেখতে চায় তার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিকে।

আমার জীবনের সেই রকম দিনটি ছিল ২০১৩ সালে। এখন খুঁজে দেখছি ছিল – ৭ই মে ২০১৩। ভেবে দেখছি কী আশ্চর্য সমাপতন! ইংরেজি মতে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটি ছিল ৭ই মে, ১৮৬১। আর সেদিন আমার জীবনে যে অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল, তার মূলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রসঙ্গীত তো ছোটবেলা থেকেই শুনছি। ভালোও লাগে। আমাদের বাড়িতে ওই গানেরই চল ছিল বেশি। ষাটের দশকে আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন সদ্য সদ্য রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর কল্যানে আবার রবীন্দ্রনাথের পুনরুত্থান হয়েছে। আমাদের সময় বাড়িতে হিন্দি গান একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। শুধুই বাংলা গান। রেকর্ডও ছিল বাংলা গানেরই, বেশির ভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীতের।

পরবর্তী কালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধুর্য আরো বুঝতে পেরেছি, আরো গভীরে গিয়ে চেষ্টা করেছি একটু অনুসন্ধান করতে। আসলে আমাদের প্রবাসী ক্লাবের বিভিন্ন সাঙ্গীতিক অনুষ্ঠানে ভাষ্য রচনার দায়িত্ব থাকত আমার ওপর। সেই কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে আরো একটু পঠন পাঠনের প্রয়োজন পড়ত। এরকমই এক সময়, একটি গানে দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে অন্যদের গানের বাণীর তফাৎ চোখে পড়ল। দেবব্রত গাইছেন “সকল স্বপন” আর অন্যরা গাইছেন, “সফল স্বপন।” নিজেও একটু ভেবে দেখলাম। কিন্তু রবীন্দ্র রচনাবলীতে ও পেলাম “সফল” কথাটি। ইতিমধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলীর একটি ইন্টারনেট সংস্করণ ও বার হয়েছে – http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/। তাতেও ওই “সফল” আছে। কিন্তু সেখানে লেখা ছিল যে ভুল দেখলে সংশোধনের জন্য লেখা যেতে পারে। আমিও তাই একটি ইমেল ছেড়ে দিলাম, আমার মত জানিয়ে –

যদিও গীতবিতানে আছে, “মম দু:খবেদন মম সফল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম” – কিন্তু সম্ভবতঃ “সফল” এর জায়গায় “সকল” হওয়া উচিত! রবীন্দ্র গবেষকদের মতামত নেওয়া যেতে পারে!

আমার বক্তব্য শুনে ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক শ্রী অনুপম বসু লিখলেন, “ঠিক! আপনার এই reference-এর পরে ভরসা পাচ্ছি রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যেতে।” তখন অবশ্য জানতাম না, এই আধিকারিক আমার কলেজের সিনিয়র অনুপমদা।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। তারপর জবাব এল সুমিত রায় নামে এক প্রবাসী ভদ্রলোকের কাছ থেকে। উনি জানিয়েছিলেন,

ভাস্কর:

“তুমি রবে নীরবে” গানটির প্রথম প্রকাশ ১৮৯৬ সালে, কাব্যগ্রন্থাবলী বইতে। রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহশালায় তার যে কপিটি আছে সেখানেও দেখা যাচ্ছে “সফল স্বপন” ব্যবহার হয়েছে। যদিও পাণ্ডুলিপি দেখলে তবেই এই ব্যাপারের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে পারে, কিন্তু হাতের কাছে তা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আমাদের মনে হয় রবীন্দ্রনাথের মতো খুঁতখুঁতে লোক দুটি বইতে ছাপার ভুল সহ্য করতেন না। অতএব এখনকার মতো “সফল স্বপন”-টাই শুদ্ধ ধরে নিতে হবে।

কাব্যগ্রন্থাবলী-র দর্শন পেয়ে (পৃষ্ঠাটির কপি জুড়ে দিলাম এই ইমেলে) আপনার ইমেলের উত্তর দিতে এতো দেরি হল, আশা করি কিছু মনে করবেন না। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আপনার গভীর চিন্তার জন্য সাধুবাদ জানাই।

নমস্কারান্তে, সুমিত রায়, Webmaster, gitabitan.net

যে ছবিটি দিয়েছিলেন সেটি নীচে দেওয়া হল

সেটা আমার খুব বড় প্রাপ্তি মনে হয়েছিল। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়। ২০১৩ সালের মে মাসের কবিপক্ষে উনি আমার সঙ্গে ওঁর আলোচনা ওয়েবসাইটেও নথিভুক্ত করেন। এ ছিল আমার কাছে আর এক বড় প্রাপ্তি।

সেই শুরু। ধীরে ধীরে জানলাম, ওঁর সৃষ্ট বিশাল ওয়েবসাইটটি সম্পর্কে – www.gitabitan.net! জানতে পারলাম বহু অজানা তথ্য ও আরো বহু বইয়ের নাম।

এরপর আবার একটি গানে সংশয় জাগে – “বাহিরে ভুল ভাঙবে” না – “বাহিরে ভুল হানবে!” আবার সুমিতবাবুকে পত্রাঘাত, উনি সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করলেন – বিস্তারিত গানের আলোচনা করে মূল যা বলেছিলেন তা হলঃ

“সুপ্রযুক্তি”র ব্যাপারে দুটি দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। “অরূপরতন”-এ সুরঙ্গমা একা গাইছে (“হানবে”), সেখানে “তুমি” হচ্ছেন রাজা আর “সে” হচ্ছেন অনুপস্থিত সুদর্শনা, যিনি এখুনি এসে জুয়াড়ি সুবর্ণকে রাজা বলার ভুল করবেন এবং সে ভুলের অশুভ আঘাত হবে দূরপ্রসারী। সুরঙ্গমার প্রশ্ন এই যে বাইরের জগত্‍‌ থেকে এই ভুল যখন সুদর্শনাকে আঘাত “হানবে” তখন কি তার অন্তরের ভুল (রাজাকে সুন্দর দেখতে চাওয়া ইত্যাদি) ভেঙে যাবে?

পরিমার্জিত “শাপমোচন”-এ গানটি রাজা স্বয়ং গাইছেন মহিষীকে শুনিয়ে। মহিষীর জেদে রাজাকে স্বরূপ প্রকাশ করতে হবে, এবং মহিষী এতোক্ষণ কুশ্রী নর্তকের ওপর চটে যাবার যে ভুলটি করছিলেন সেটি ভাঙবে, কারণ সেই নর্তকই রাজা। রাজা প্রশ্ন করছেন যে সে ভুল ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে বহিরঙ্গের সৌন্দর্যে ভুলে থাকার যে ভুলটি বাসা বেঁধে আছে মহিষীর মনে, সে ভুলটিও কি ভাঙবে? অবশ্যই না, এবং “অরূপরতন”-এর রূপক প্রশ্নের থেকে এই সরাসরি প্রশ্নটি আরো মর্মন্তুদ। শাপমোচন পরিমার্জনের সময় রবীন্দ্রনাথ এই পার্থক্যটি লক্ষ্য করেন ও গানটিকে বদলান। একটু খেয়াল করলে গানটির দুটি রূপে আরো কিছু প্রভেদ দেখতে পাবেন।”

আরো লিখেছিলেন,

“শুধু সংখ্যা গুণে, কিন্তু বিশেষ করে ওপরের ৫নং তথ্যের সাক্ষ্য দেখে আমার মতে গান হিসেবে দেখলে “হানবে”-টাকেই স্বীকৃতি দিতে হবে। নাটকের প্রয়োজনে “শাপমোচন” নাটকে কবি সেটির পরিবর্তন করেছিলেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সামান্য একটি কথার পরিবর্তন করে অন্তর্নিহিত ভাবটিতে কী বিরাট পরিবর্তন কবি অনায়াসে এনে দিলেন তা দেখেই আমরা মুগ্ধ!”

এ যাবৎ আমি কোনো গানের এত গভীর ও বিস্তারিত আলোচনা পাইনি। বিষটি আমার খুবই প্রিয়, কাজেই এই ব্যাপারে একজন এইরকম শিক্ষক পাওয়ার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছিলাম।

উনি আমার লেখা সংক্রান্ত ব্যাপারে জানতে চাইলে খুব সঙ্কোচের সঙ্গেই আমার দু’তিনটি লেখা পাঠালাম। আসলে এই লেখাগুলি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে লেখা, তার পিছনে কিছু ভাবনা চিন্তা থাকলেও সেরকম গভীর পড়াশুনো ছিল না। লেখাগুলি ছিল রবিঠাকুরের গান, সলিল চৌধুরী, ও সুধীন দাশগুপ্তের গানের ওপর। লেখাগুলি আমাদের স্থানীয় পুজোর স্যুভেনিরে প্রকাশ হয়েছিল, কিন্তু ব্যস ঐ পর্যন্তই।

সুধীন দাশগুপ্তের ওপর “সুরে ঢাকা কথা” লেখা পড়ে উনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, এই ব্যাপারটি (গীতিকার সুধীন) ওঁরও সেরকম ভাবে নজরে আসেনি। লিখেছিলেন,

আর শেষরাত্রের মারটি হল সুধীন দশগুপ্তের ওপর রচনাটি। যারা গীতিকার সুধীনকে চেনে না, সেই আম জনতার দলে আমিও আছি, কাজেই আপনার লেখাটি চমকপ্রদ এবং মধুর। তারপর আপনার লেখার প্রসাদগুণও আছে। সুন্দর ভাবে গুছিয়ে, মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথকে এনে, আপনি সুধীনের লেখার সৌকর্য নিয়ে বলেছেন, বাণিজ্যিক ভিত্তির অসুবিধাটির দিকও আপনার নজর এড়ায়নি। তথ্যভারাক্রান্ত হয়ে লেখার সুষমা নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে জেনেও ইচ্ছে হয় গানগুলির প্রথম লাইন, কে গেয়েছেন আদি কিছু খবর থাকলে ভালো হোতো।

সেখানেই জানিয়েছিলেন ‘অবসর’-এর কথা। লিখেছিলেন,

আপনি আরো লিখুন। www.abasar.net বলে একটি তথ্যভিত্তিক ওয়েবজিনের (প্রচলন বেশ ভালোই) সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, সেখানে আপনি যদি মাঝে মাঝে এ ধরনের লেখা কিছু পোস্ট করতে চান তাহলে আমাকে জানাবেন।

আপনার এবং আপনার লেখনীর উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।

প্রীত্যন্তে, সুমিত

সুমিত বাবুর সূত্রেই পরিচয় হল সুজন দাশগুপ্ত ও তাঁর “অবসর” পত্রিকার সঙ্গে। খুলে গেল আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায়। সুজনদার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি একটি মেলে। মেলটির তারিখ ছিল ৮ই অক্টোবর, ২০১৩। আমাদের ব্যাঙ্গালোরে তখন জোর কদমে পুজোর প্রস্তুতি চলছে। মেলটিঃ

ভাস্কর:
এই ইমেলটির মাধ্যমে আমার সোদরপ্রতিম ডঃ সুজন দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। সুজন হলেন abasar.net-এর জনক ও প্রতিপালক। আমি হলাম তার ছ-আনার দোয়ার্কি। আপনার এই “শব্দ” নিয়ে লেখাটির (এবং এর পরের অন্যান্য সব লেখাও) ইউনিকোড ভার্শান সুজনকে পাঠিয়ে দেবেন সরাসরি, ও অবসরে সময়মতো পোস্ট করে দেবে। আমার মনে হয় সুধীন দাশগুপ্তের লেখাটা বেশ জমবে, ওটা শেষ করে ফেলুন। আর রহস্যকাহিনির ইউনিকোডীকরণ তো চলছে নিশ্চয়ই।

শারদীয়া শুভেচ্ছা জানবেন।

প্রীত্যন্তে, সুমিত

এরপরে সুজনদা একদিন পুজোর মিটিং এর পর ফোন করে যোগাযোগ করলেন আর শুরু হল আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। তবে সম্ভবতঃ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও অনেকেরই জানা ছিল না যে সুমিতবাবুর মাধ্যমেই আমি সুজনদাকে চিনেছি। তাঁদের কাছে এই ব্যাপারটি হয়তো আশ্চর্যজনক লাগবে।

প্রসঙ্গত অনেকদিন অবধি আমি জানতাম না যে উনি বিকাশ রায়ের ছেলে, সুজনদার কাছেই পরে জেনেছি। সুজনদা আরো জানিয়েছেন যে উনি নাকি শ্যাম পিত্রোদার ক্লাসমেট, উনি অবশ্য নিজে জানাননি। সুজনদা জানিয়েছিলেন উনি এসব পরিচয় সচরাচর দিতে চান না।

আমার কাকা বিকাশ বসু ছিলেন অতীব রবীন্দ্রমনোভাবাপন্ন মানুষ। আগেই লিখেছি তাঁর কথা। ওঁর সম্পর্কে এসে আমিও বিভিন্নভাবে আবিষ্কার করেছি রবিঠাকুরকে। তাই আমার বিভিন্ন লেখাতে কিছু না কিছু ভাবে “ঠাকুরমশাই” টুক করে ঢুকে পড়েন। আমার লেখাগুলি পড়ে সুমিতবাবুর খুশি হওয়ার আরো কারণ ছিল যে উনি ধরেছিলেন যে ওঁর মত আমিও “টেগোরাইটিস”-এ রীতিমত আক্রান্ত।

সুজনদার সঙ্গে পরিচিতি বাড়ছে। আমারও সাহস বাড়ছে। সুজনদা বলেছেন, নিজেকে ‘অবসর’-এর একজন ধরে নাও।

২০১৩র পুজোর সময়ে চলে গেলেন আমার প্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ব্যাঙ্গালোরে একটি স্মরণসভাতে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে একটি লেখা ছিল। সেটি সুমিতবাবুকে পড়িয়েছিলাম। ওঁর বেশ ভালো লেগেছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য আমার সুনীল প্রীতি নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিল।

একবার কথায় কথায় আমি ওঁকে বোঝাতে গিয়েছিলাম যে সুনীলের রবীন্দ্রপ্রীতি কম নয়। উনি একটি বই ও লিখেছেন – “রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার ও পুনরাবিষ্কার।” আরো বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলামঃ

“প্রসঙ্গতঃ আমার বন্ধুরা আমার “সুনীল-দৌর্বল্য” নিয়ে খোঁচা দিতে ছাড়ে না। সুনীলের ওই বইটি কিন্তু একটি প্রবন্ধ নয়, অনেক প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতার ভিত্তিতে লেখা। কিছু উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা

“রবীন্দ্রনাথ একটি নয়, অনেক গুলি নোবেল প্রাইজের যোগ্য।

“রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ভিক্টর হুগোর চেয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা অন্ততঃ দশগুণ বেশি।

“সারা জীবনে তিনি হাজার হাজার পাতা লিখেছেন, সব হয়তো সমান উৎকর্ষের নয়, কিন্তু কিছুই ফেলে দেবার নয়। এ শতাব্দীতে যদি বিশ্বের একমাত্র লেখকের নাম করতে হয়, তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ

“রবীন্দ্রনাথ ২৪-২৫ টি দেশভক্তির গান লিখেছেন। সমসাময়িক প্রয়োজনে যে গানগুলি লেখা হয়েছিল, তা হয়ে গেল চিরকালীন। বাংলা সাহিত্যর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত ঘটনা।

“প্রথম আলোতে সুনীল যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে মূল  চরিত্র রূপায়িত করেছেন, তা এক কথায় অসাধারণ।”

এটা পড়ে সুমিতবাবু রীতিমতো মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। উত্তরে লিখেছিলেন,

ভাস্কর:

সুনীল গাঙুলীর রবীন্দ্রপ্রীতি নিয়ে আমাদের আলোচনা না হওয়াই ভালো, মতান্তর মনান্তরে গড়াতে পারে। আপনি সুনীলের যে যে রচনা পড়ে দেখতে বলেছেন, সেগুলি পড়েছি। উত্তেজিত হয়ে দেশ পত্রিকার সম্পাদককে একটা চিঠি লিখে ফেলেছিলাম, তার একটি কপি সেঁটে দিলাম, না পড়ে যদি ফেলে দেন তাতেও ক্ষতি নেই। আপনি কিন্তু আমার অনুরোধ রাখবেন, সুনীল-সম্পাদিত “রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা” উল্‌টে পাল্‌টে দেখবেন।

তাঁর “দেশ” পত্রিকার চিঠি।

“দেশ” সম্পাদক সমীপে, মাননীয়েষুঃ

দেশ পত্রিকার পাতায় সম্প্রতি সুনীল গঙ্গোপাধায় মশাইয়ের উপস্থিতি (অন্তত নিম-উপস্থিতি) দেখতে পাচ্ছি, এটা বড়োই আনন্দের কথা। সুখপাঠ্য, সহজপাঠ্য, — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা যেন সিল্ক কাট সিগারেট, মসৃণ, বিজ্ঞাপনের ভাষায় smooth.

ওঁর ‘প্রবাসী বাঙালীঃ সার্থকতা ও পরের প্রজন্ম’ (দেশ, সতেরোই আষাঢ়, ১৪১০) অবশ্যই ব্যতিক্রম নয়, পা পিছলোতে পিছলোতে পড়ে নেওয়ার বেশ কিছু পরে খেয়াল হোলোয়ামেরিকার প্রবাসী বাঙালী চর্মব্যবসা আর যোগশিক্ষা ছাড়া লেখাপড়ার জগতেও খুব একটা খারাপ করেননি। ভালো করেছেন, বেশ ভালোই করেছেন। রাজচন্দ্র বসু তো ছিলেনই, তাছাড়া আরো অনেক নাম মনে আসছে, যথা, সুদীপ চক্রবর্তী, সুগত বসু, পল্লব ভট্টাচার্য, রবি ভট্টাচার্য, মুকুল মজুমদার, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভ্যাক। সায়েবি ‘বর পুত্রসঙ্ঘ’রা এঁদের মানপত্রাদি দিয়ে থাকে। তবে একথা ঠিক যে এঁদের অনেকেই ‘পথের নেশায় পাথেয়’ করেছেন ‘হেলা’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে জগতে ঘোরাফেরা করেন এঁরা হয়তো সে জগতের লোক নন। কিন্তু দস্তুরমতো রিসার্চ করে লেখেন – যথা ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ –বলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম আছে, তাই আর একটু রিসার্চ করে দুয়েক কলাম ইঞ্চি এঁদের জন্য দিলে লেখাটি সর্বাঙ্গসুন্দর হোতো। তাঁর কলম একটু আধটু প্রিয়তোষণ করুক, আমাদের তাতে আপত্তি নেই কিন্তু তাঁর দাক্ষিণ্যের ছোঁয়া থেকে যেন অকিঞ্চনরাও বঞ্চিত না হয়, এই আমাদের প্রার্থনা।

তবে খিদের কথা যদি বলেন, তাহলে সিল্ক কাট কেন, কোনো সিগারেটেই খিদেটা ঠিক মেটে না; তার ওপর আবার বৈদ্যদের সব ভয়ানক সতর্কবাণী আছে। রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকীর কাছাকাছি ২০শে বৈশাখ, ১৪১০ – এর দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার ও পুনরাবিষ্কার’ প্রবন্ধটি ধরা যাক। ধূম্রপায়ী উট সদৃশ অনবদ্য প্রচারলিপি jacket blurb- এর কথা ছেড়ে দেওয়া গেল। গৌরচন্দ্রিকা হচ্ছে পাপোশলুন্ঠিত রবীন্দ্ররচনাবলীর কথা দিয়ে। তারপর সুখটান দিতে দিতে আমরা তিন কলম পড়ে ফেললাম। এর মধ্যেই কত কথা সুনীল আমাদের জানালেন – – অচিন্ত্যবাবুর কবিতার ছত্র, বুধদেব – প্রেমেন্দ্র প্রমুখের গুপ্ত রবীন্দ্রপ্রীতি, সাবিত্রীপ্রসন্নর নামে রাস্তা, রাবীন্দ্রিকতাস্পর্ধীদের কথা, সাহিত্যে গুরুবাদের অচলতা, বর্ণাশ্রম প্রথা ও রবীন্দ্রনাথ, গুরুদেব নামের মালা খুলে ফেলায় রবীন্দ্রনাথের অনীহা, ইত্যাদি। আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতে খেয়াল হোলো, এসবের সঙ্গে বেচারী রচনাবলীর কী সম্পর্ক? পাপোশ কোথায় গেল? একটা মার্কিন প্রবাদ মনে পড়ছে – – কুমীরব্যূহবেষ্টিত হয়ে আমরা ভুলে যাই আমরা এসেছিলাম খাল সেঁচতে, when you are up to your eyeballs in alligators, you tend to forget that you came here to drain the pond. এর মধ্যে জানা গেল যে, যে খাটে বসে সুনীল এল এস ডি চেখেছিলেন, সেখানেই বইয়ের পাহাড়, আর সাবালক সুনীলেরা ততদিনে হাত ও পায়ের আপেক্ষিক অপবিত্রতা বিষয়ে ছেলেবেলার কুশিক্ষা ভুলতে পেরেছেন অতএব রচনাবলীতে এক আধবার লাথি লেগে তো যেতেই পারে। এইবার আমরা ধান ভানারই গীত শুনতে পাচ্ছি, জানতে পারছি রবীন্দ্রনাথ কবিতার সহজ ব্যাকরণও মানেন নি। সুনীল লিখেছেন ‘দৈর্ঘ্য যদি দীর্ঘসূত্রী হয় —–’ । আমাদের বরাতক্রমে ‘দৈর্ঘ্য’ দীর্ঘসূত্রী’ হয় কী করে (‘যজ্ঞের আবার দাস কী?’) এই জটিলতর প্রশ্নে হোঁচট খেয়ে পড়বার আগে সুনীল আমাদের রবীন্দ্রনাথের গানের জগতে পৌঁছে দিয়েছেন, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের গোস্পদে তাবৎ বাংলা গানের বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। গান নিয়েও উনি বেশ ওয়াকিবহাল, এটা প্রশংসার্হ।

আর কথা বাড়াবো না। সুনীলের শেষ কথা হোলো যে তিনি অতি মূর্খ নন, আরো বড় মূর্খও নন। যদিও এ সত্য নিয়ে আমাদের মনে কোনো কোনো সন্দেহই ছিলো না। তবে সুখপাঠ্য, সহজপাঠ্য এবং সুপাঠ্য – আমাদের মত কিছু মূর্খের জন্য রবীন্দ্রনাথ আছেন ও থাকবেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আমাদের গলার কাছে ব্যথা ব্যথা করবে, ঘষা রেকর্ডে নির্মলেন্দু লাহিড়ীর কন্ঠে ‘আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে’ শুনে আমাদের চোখে জল গড়াবে, মঞ্চে মিত্র দম্পতীর মারফৎ বলা কবির ‘দে দোল দোল’ মনে করে আমরা রোমাঞ্চিত রুদ্ধবাক হয়ে বসে থাকবো। সুনীল লিখছেন ‘এখন বারবার ফিরে যাই রবীন্দ্রনাথের কাছে’। তার মানে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পাপোশ থেকে প্রাণে এসেছেন। এ কৃতির জন্যো তো তাঁকে গুরুদেব না হোক রকের বাণীতে গুরু বলা যায়। এটা আমাদের উপরি লাভ।

তবে মুস্কিলটা হচ্ছে কী, অতিরিক্ত ধূমপানে ক্যান্সার হয় এটা প্রমাণিত সত্য আর এ রোগের নিরামক বৈদ্য যিনি ছিলেন তাঁর নাম সাগরময় ঘোষ, তিনি গতাসু। তিনি পাহারায় থাকলে অন্তত ’অচলায়তন’ – এ বসে ‘তির’ বিদ্ধ (যল্লিখিতং) হতে হোতো না।

নমস্কারান্তে, ভবদীয়,

সুমিত রায়, নিউ জার্সি

1. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই দুটি লেখাই অতি বিস্তৃত, তাই ইচ্ছে থাকলেও এখানে দেখানো গেল না। তাছারা কপিরাইটের দায়ও আছে।
2. দেশ পত্রিকা চিঠিটি ছেপেছিলেন বেশী বিলম্ব না করে। শেষ অনুচ্ছেদটি দেশ পত্রিকা আর ছাপাননি। এঁরা অতি ঘুঘু সাংবাদিক গোষ্ঠী।

(সম্পাদকীয় টীকা – বানান অপরিবর্তিত)

ব্যস! আর ঘাঁটাইনি। বুঝে গেলাম, সুমিতবাবু আমার কাকা বিকাশ বসুর এক প্রতিচ্ছবি। সুনীল সম্পাদিত বই সম্পর্কে তিনিও খুব খুশি ছিলেন না।

এরপরে আরো একটি গান নিয়ে তাঁর কাছে এক চমৎকার ব্যাখ্যা পাই। এই গানটি – “মেঘ বলেছে যাব যাব।” তাঁর ব্যাখ্যা ছিল নিম্নরূপ –

মেঘ বলেছে যাব যাব” প্রসঙ্গে আমার মত যে এটি রবীন্দ্রনাথের দর্শনচিন্তার সারাত্‍‌সার। বেদান্ত সর্বব্যাপী ব্রহ্মের কথা বলছে, আত্মার কথা বলছে, ব্রহ্মে আত্মার শেষ মিলন হল মোক্ষ, তার কথা বলছে। তার পর কট্টর বেদান্তবাদীরা বলছে বাকি যা কিছু সব মায়া, সব পরিহার্য, কেননা এসব মোক্ষলাভের পথের বাধামাত্র।

রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের কবি, কাজেই তিনিও এই ব্রহ্মা, আত্মা, মিলন এসবের কথা বলেছেন। মেঘের মতো অসার থেকে আরম্ভ করে আমার অহং পর্যন্ত সব কিছুই কোথাও এসে মিলিয়ে যায়। কিন্তু ওই মায়াবাদকে নস্যাত্‍‌ করে তিনি বলেছেন যে এই যাত্রাপথে যা পাচ্ছি, তাকে মায়াই বলুন বা যাই বলুন, তা আমার জন্যই সৃষ্ট, তা বড়ো সুন্দর, তা অপরিহার্য, বেদান্তবাদীদের মুখে আগুন দিয়ে আমি তাই উপভোগ করে যাই। মাটিতে, আকাশে ইন্দ্রিয়সুখের উত্‍‌সব, প্রেমের কালজয়ী অনুভূতি, এসবের মধ্য দিয়েই জীবন চলছে সমাপ্তির কাণ্ডারীর নির্দেশে। তাঁর অধিকাংশ লেখাতেই এই প্রাপ্তির বিস্মিত স্বীকার।

এই হল আমার ব্যখ্যা।

প্রীত্যন্তে, সুমিত

তখন মান্না দে সদ্য প্রয়াত। তাঁকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হবে আমাদের ক্লাবে। একটি বিশেষ গান নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তাঁর মতামত চেয়ে চিঠি লিখলাম।

এবার আমাদের “মান্না দে – শ্রদ্ধার্ঘ্য” তে একটি গান সম্পর্কে লিখেছিলাম –

নারী কন্ঠঃ – তিনি ও তাঁর স্ত্রী আজীবন রবীন্দ্র ভক্ত, বাড়িতে আপনমনে দুজনে গাইতেন অজস্র রবীন্দ্রসঙ্গীত। পুলক বাবুকে একবার তো একটু অনু্যোগের ভঙ্গিতেই মান্না দে বলে ফেলেছিলেন –

পুরুষ কন্ঠঃ – “আপনারা মশাই গান লেখেন, ভালোই লেখেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা, কবিতার ভাষা একবার পড়ে দেখুন তো। – ভেবে দেখেছেন – কীভাবে উনি শব্দ চয়ন করেছেন, কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন উনি একটি দৃশ্যের নিখুঁত ছবি ওঁর কবিতায়-“!

পুলকবাবু বেশ অনুপ্রাণিত হয়ে লিখে ফেলেছিলেন – ছয় ঋতুর ছয়টি গান – এই বসন্তকালে আমাদের নির্বাচন তাই বসন্তের গানটি ই। বসন্তে প্রকৃতি যেন এক সুসজ্জিতা, সুরূপা রমণী – যাকে দেখতে দেখতে আমদের চোখের পলক পড়েনা –

গান টি হল – “কে তুমি তন্দ্রা হরনী”

গানটি যে বসন্তের তা নিয়ে একটু মতভেদ হচ্ছিল । আমার মনে হচ্ছিল – মান্না দের কথায় বিব্রত হয়ে পুলকবাবু একটু বসন্তের অপ্রচলিত রবীন্দ্র- সঙ্গীত শোনার কথা ভাবতে থাকেন, একটি গান বেশ মনে ধরে। গানটি হল –

নিবিড় অমা-তিমির হতে বাহির হল জোয়ার-স্রোতে
শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।
ভরিল ভরা অরূপ ফুলে, সাজালো ডালা অমরাকূলে
আলোর মালা চামেলি-বরনী॥
তিথির পরে তিথির ঘাটে আসিছে তরী দোলের নাটে,
নীরবে হাসে স্বপনে ধরণী।
উৎসবের পসরা নিয়ে পূর্ণিমার কূলেতে কি এ
ভিড়িল শেষে তন্দ্রাহরণী॥

Parjaay : Prakriti / Basanta Taal : Jhampak Raag : Behag Written On : 1931

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এর গান – অন্ত্যমিল গুলো লক্ষনীয়। চামেলী-বরণী থেকে চম্পা-বরণী (চম্পা -চামেলী —)

কে তুমি তন্দ্রাহরণী,
দাঁড়িয়ে আমার চোখের আগে,
রাঙালে এ মন পুষ্পরাগে….
কে গো চম্পাবরণী …
আজ তোমায় দেখে মনে মনে
ভেবে ছিলেম মনের কোণে
তোমার কাছেই কূল হারালো
আমার স্বপ্নতরণী…

তুমি বোঝ না কি তুমি বোঝ না কি
গানের বিরাম জানেনা আমার মনের পাখি
তুমি শোননা কি তুমি শোননা কি
ঐ ভ্রমর আঁখির গুঞ্জরণে
ফুল ফোটে তাই মন পবনে
মিলন মায়ায় হয় একাকার
সাধের স্বর্গ-ধরণী ।

বসন্তে সুসজ্জিতা, সুবেশা, রঙ্গিন প্রকৃতি ই গীতিকার দ্বয়ের প্রেমিকাস্বরুপ। সেই তন্দ্রাহরণী যে উৎসবের পসরা নিয়ে “পূর্ণিমার কূলেতে কি এ ভিড়িল শেষে” (রবি) আর দাঁড়িয়ে আমার চোখের আগে, রাঙালে এ মন পুষ্পরাগে..(পুলক)..

এ সম্পর্কে আপনার মতামত জানলে ভালো লাগবে।

শুভেচ্ছান্তে,

ভাস্কর

 

অনতিবিলম্বেই উত্তর এলঃ

ভাস্কর:

কেমন আছেন? আপনার “অবসর”-এর লেখা তো বেশ  জনরঞ্জন করছে, এটা খুব ভালো লাগলো। tandra.pdf-এ ভালোই বলেছেন তবে আমার মনে হয় পুলক বাঁড়ুজ্যের প্রেরণা রক্তমাংসের মানবী, তিনি গান শোনেন অথচ বোঝেন না (বা অমন কোনো combination), চোখ পিট্‌পিট্‌ করেন (“আঁখির গুঞ্জরণ”-টা কেমন ব্যাপার?) ইত্যাদি। আর “তন্দ্রাহরণী”-র মায়ায পড়লে বরণী, তরণী, ধরণী না এসেই পারে না।

তবে “ভরিলে ভরা” — এ মশায় এক রবীন্দ্রনাথই পারেন!

প্রীত্যন্তে, সুমিত

“প্রীত্যন্তে” – আমি এর আগে শুনিনি। বেশ নতুন শেখা হল।

সুজনদার অনুপ্রেরণাতে প্রথম সম্পাদনা করলাম ‘অবসর পত্রিকা’র একটি বিশেষ রবীন্দ্র সংখ্যা।
ঘটনাচক্রে এটি ছিল ‘অবসর’ পত্রিকার প্রথম বিশেষ সংখ্যা। যথারীতি সুমিতবাবুকে অনুরোধ করে একটি লেখা যোগাড় করলাম। উনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা নিয়ে একটি লেখা করবেন বলেছিলেন। নামের শীর্ষক সম্পর্কে আমার মতামত উনি সানন্দে মেনে নিলেন। বলেছিলাম – ‘আচ্ছা, ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’ এর থেকে নিয়ে ‘যত শুনিয়েছিলেম গান’ এরকম নামকরণ করলে কেমন হয়? আপনার প্রবন্ধের বিষয়টি তো – এই ‘যত’টি ‘কত?’ ওঁর সানন্দ সম্মতি খুব বড় আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল।

এরপরে কোনরকম রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে প্রশ্ন এলে – সেই বিখ্যাত বাংলা প্রবাদবাক্যটি মনে পড়ে – “হাতে পাঁজি, মঙ্গলবার?” কাজেই পরবর্তী সময়েও যখন কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, নির্দ্বিধায় ওঁর দুয়ারে পৌঁছে গেছি এবং কাঙ্ক্ষিত উত্তরও পেয়ে গেছি।
আমার সম্পাদিত অবসরের বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যাতে চমৎকার কিছু লেখা দিয়ে আমাকে বিশেষ কৃতজ্ঞ করেছেন।
২০১৭ সালে আমার একবার মার্কিন মুলুক যাওয়ার সুযোগ ঘটে। তিনি এর আগে বলেছিলেন এখানে এলে ওঁর কাছে যাওয়ার কথা। তখন উনি থাকেন নায়গ্রার কাছেই। আমি আর কিছু বলিনি। আসলে সদলবলে ভ্রমণ, সব কিছু কি আর নিজের ইচ্ছাতে করা চলে?
ফেরার পর জানতে পেরে উনি বেশ মর্মাহত হয়েছিলেন। জানিয়েছিলাম, ২০২০ তে অবসর নিয়ে বেশিদিনের জন্য গেলে নিশ্চয়ই যাব। খুব খুশি হয়েছিলেন।

এরপরে নতুনভাবে ‘অবসর’ পত্রিকা প্রকাশ করার সময় ওঁর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। বেশ কয়েকবার কথা হল। খুব খুশি হয়েছিলেন শুনে যে আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। প্রথম দুটি সংখ্যাতে আমার উদ্যোগেই তাঁর দুটি লেখা প্রকাশ হল। দ্বিতীয় লেখাটিতো একদম জোরজার করেই। এমন আড়ালে থাকা মানুষ, তিনি কি আর নিজের কীর্তির কথা ঢাক পিটিয়ে বলবেন? সুজনদাকে দিয়ে আবার তাগাদা দেওয়ানো। সুজনদা বললেন – ‘তোমাকে কিছু বলেননি, আমাকেই বকাবকি!’ এটা অবশ্য বরাবরই। ওঁকে লেখার জন্য মেল পাঠিয়ে দিয়ে সুজনদার পায়ে পড়া আমার চিরকালের বদ অভ্যাস। সুজনদা রেগেও যেতেন – ‘আরে, তুমি সম্পাদক, তুমি বল!’ আমি অজুহাত দিতাম –‘আরে আমার ফোন নম্বর নেই। – আগে কথা বলিনি। – তুমিই তো বল মুডের ব্যাপার। – বললে যে ওঁর এখন শোনার সমস্যা,’ ইত্যাদি। সুজনদা তাগাদা দিত, বকাবকিও খেত। একবার আমাকে বলল, ‘সুমিতদা বোধহয় আর সম্পর্ক রাখবে না।’

শেষবার ফোনে কথা বলার সময় নিমন্ত্রণের কথা মনে করিয়ে দিলেন। সেটা গত আগস্ট সেপ্টেম্বরের কথা। ওঁর শরীরের কথা জিজ্ঞেস করাতে বললেন – “দিব্য আছি। আমার বাড়ির এখান থেকে দূরে নৌকা দেখা যাচ্ছে। বেশ মনোরম – একেবারে ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই, এমন তরণী বাওয়া।’ তুমি পরের বার নিশ্চয়ই এসে যেও, একসঙ্গে বসে দেখা যাবে।”

তা আর হয়ে উঠল না। তাঁর সঙ্গে বসে ‘তরণী বাওয়া’ আর আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। তিনি চলে যাওয়ার পর শুধু গুঞ্জরিছে,

যেখানে হল না খেলা সে খেলাঘরে
আজি নিশিদিন মন কেমন করে।
হারানো দিনের ভাষা…স্বপ্নে আজি বাঁধে বাসা,
আজ শুধু আঁখিজলে পিছনে চাওয়া॥

 

জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, অন্যদেশ, পরবাস ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। সম্প্রতি নিজের একটি ব্লগ চালু করেছেন – www.bhaskarbose.com

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • BHASKAR SINHA , June 20, 2021 @ 8:04 am

    অবসর-এর সুমিত রায় স্মরণ সংখ্যায় প্রকাশিত তোমার সুদীর্ঘ স্মৃতিচারণা একাধারে খুব‌ই মূল্যবান এবং চিত্তাকর্ষক লেগেছে আমার। সুমিত রায়ের সঙ্গে যোগাযোগের পেছনের কালানুক্রমিক ঘটনাবলী, রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক মেল-বিনিময়, তোমার নিজের রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীত সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের যথার্থ appreciation সুমিত রায়ের মত রবীন্দ্র- বিশেষজ্ঞের তরফ থেকে, তোমার রবীন্দ্রসংগীতের ‘কথা’ নিয়ে সমস্ত জিজ্ঞাসার নিবারণ সুমিত রায়ের নানান সরস মেল-এর মধ্যে দিয়ে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে তোমাদের আদর্শগত মতভেদ ও পারস্পরিক প্রীতি বজায় রেখে তার mutual handling, ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সুনীলের প্রবন্ধ নিয়ে সুমিত রায়ের সুদীর্ঘ চিঠি (অসাধারণ লেগেছে), তোমাদের মধ্যে আস্তে আস্তে এক অন্য রঙের গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠা এবং এই সম্পর্কের চরম পরিপূর্ণতা স্তরে উত্তরণ, ওঁর মৃত্যুতে তোমার ‘শিক্ষা জীবনে’ বিরাট একটা void সৃষ্টি হ‌ওয়া — এই সব এত চিত্তাকর্ষকভাবে তোমার কলমে উঠে এসেছে যে পুরো লেখাটা রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেছি গতকাল রাত্রে। সুমিত রায়ের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কী অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল সেটা বুঝতে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে তোমার স্মৃতিচারণা। তোমার লেখাটা সব দিক দিয়ে সার্থক ও সফল মনে হয়েছে আমার এবং আমি বলব এর সাহিত্যিক মূল্য‌ অপরিসীম। অভিনন্দন জানাই তোমাকে এমন মূল্যবান একটি স্মৃতিচারণা লেখার জন্য।

    ∆ ভাস্কর সিংহ | ভোপাল | মধ্য প্রদেশ | ভারত

  • SHIBANSHU DE , June 22, 2021 @ 11:23 am

    চমৎকার, সপ্রাণ লেখা। খুব ভালো লাগলো…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *