সুমিতদা, দেখা হল না

সাত বছর আগের ঘটনা। ভাস্করের ফোন বাঙ্গালুরু থেকে, সুমিতদা চান তোমার রামায়ণের উপর আশ্রিত রচনাটা অবসরে প্রকাশ করতে। কোন সুমিতদা, বিকাশ রায়ের ছেলে? আমি অবাক। যদিও জানতাম, যে তাঁর নিজস্ব একটা পরিচয় আছে যা তার নিজস্ব ঔজ্জ্বল্যেই দীপ্তিমান। ধীরে ধীরে জেনেছি তাঁর আর সুজনদার (দাশগুপ্ত) কম্প্যুটারে বাংলা অক্ষর নিয়ে মৌলিক কাজের কথা। সুদূর আমেরিকায় বসে বাংলা নেট পত্রিকা ‘অবসর’-এর কল্পনা আর রূপরেখা তাঁদের নিজেদের হাতে আঁকা, তিলে তিলে গড়ে তোলা। আরো অনেক গল্পকথা শুনেছি অবসর গ্রুপের বন্ধুদের মুখে। তাহলে তিনি এই অখ্যাত, ফেসবুকের দৌলতে লিখতে শেখা মানুষেরও লেখা পড়েন, তারিফ করেন! সুজনদার সঙ্গে কিছুটা আলাপ হয়েছিল, তিনিও অন্য জ্যোতিষ্কের বাসিন্দা, কিন্তু স্বভাবগুণে তা আমাদের বুঝতে দেন না তাই ইতিমধ্যে তাঁকে ফেসবুকে পেয়ে গেছি। এবার সুমিতদাকেও কপাল ঠুকে দিলাম বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়ে। রেডিলি অ্যাক্সেপ্টেড!

তার পরের বছর। তখন উনি গীতবিতান আর্কাইভের সাইটটি তৈরি করে ফেলেছেন, বিশ্বের সঙ্গীতপ্রিয় বাঙ্গালির কাছে যা এক অমূল্য সম্পদ। একদিন কুয়েতে অবসর সময়ে ‘দীপ নিভে গেছে মম’ গানটার সুর নিয়ে একটু খটকা লাগতে নেটে গানটি খুলে চমকে উঠি। গানটির আলোচনা-পর্বে দেখি আমার ছেলেবেলায় এই গানটির চর্চা নিয়ে, শ্রদ্ধেয় প্রসাদ সেনের সান্নিধ্যে একটি দুর্লভ মুহূর্ত নিয়ে ফেসবুকে লেখা কিছু স্মৃতিচারণ। অবশ্যই নামোল্লেখ ছিল সঙ্গে। [যে স্বীকৃতিটুকু পেয়েছিলাম, তার ওয়েব-লিঙ্ক- http://gitabitan.net/top.asp?songid=1087] মনে পড়ল, একদিন এ সম্বন্ধে সামান্য আলোচনা হয়েছিল বটে, তখন বুঝিনি তাঁর উদ্দেশ্য।

আমার কন্যা গেল পড়তে বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা সেখানে বেড়াতে গেলাম ২০১৭তে। সুমিতদা থাকেন বাফেলোর কাছেই বার্ট অঞ্চলে, আমার মেয়ের বাসা বা নিয়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে বড় জোর ৩০-৪০ মিনিটের ড্রাইভ। যাওয়া হল না, ফোন করে জানলাম উনি তখন কানাডায় কন্যাগৃহে। বছর দুই পরে আবার গেলেও সেবার আর সময় করে উঠতে পারিনি। চলে গেলেন সুমিতদা, দুঃখ রয়ে গেল চিরজীবনের মত।

সুমিতদার শেষ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েছেন তাঁর সন্তানেরা, বিজ্ঞান আর মানবসেবায় নিয়োজিত হয়েছে তাঁর নশ্বরদেহ। আর পুষ্পস্তবকের পরিবর্তে গীতবিতান ওয়েবসাইটির পুনর্বিন্যাস ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে শুভানুধ্যায়ীদের থেকে ইচ্ছানুসারে কিছু শ্রদ্ধার্ঘ্য, স্মৃতিতর্পণ-রূপে। তিনি রয়ে যাবেন এসবেরই মাঝে, তাই আবার বলি তিনি নেই এ কথা যেন কখনও না ভাবি।

 

জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে বেদান্ত তেল কোম্পানি, রাজস্থানে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিন ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো, অবসর, ঋতবাক, জয়ঢাক, ম্যাজিক ল্যাম্প, কুলায় ফেরা, ছুটির ঘণ্টাতে ও মুদ্রিত পত্রিকা যুগ, বম্বে ডাক, পশ্চিম ঘাটে প্রকাশিত। স্বরচিত দুটি ছোটগল্পের সংকলনও প্রকাশিত- আড্ডা আনলিমিটেড ও বরাহ-নন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *