কার্ল মার্ক্সের প্রেমের কবিতা: তপ্ত ভালের দীপ্তি ও মেঘের গভীর ছায়া

কার্ল মার্ক্সের প্রেমের কবিতা: তপ্ত ভালের দীপ্তি ও মেঘের গভীর ছায়া

“প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে / কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে”- এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই৷ ধনী দরিদ্র, সৎ-অসৎ, বিখ্যাত-অখ্যাত, বুর্জোয়া-প্রোলেতারিয়েত, প্রগতিবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল, বুদ্ধিজীবী-শ্ৰমজীবী – প্রেম কোনো ভেদাভেদ, কোনো শ্রেণী বিভাগই মানেনা। যে কোনো মানুষের জীবনে, যে কোন পরম-সন্ধিক্ষণে সে এসে উপস্থিত হয় কখনো “প্রবল বিদ্রোহে,” “মহাসমারোহে,” আবার কখনো “নিঃশব্দ চরণে।” প্রেম যদি আসে, তবে সেই প্রেমের প্রকাশও অবশ্যম্ভাবী৷ কবিত্ব শক্তির অধিকারী প্রেমিক (বা প্রেমিকা) যে তাঁর কবিতার মাধ্যমে তাঁর প্রেমের অনুভূতিকে প্রকাশ করবেন – এও তো স্বাভাবিক! কিন্তু এই স্বাভাবিকতা যখন প্রহত হয় কোন বিশেষ মতবাদদ্বারা – তখনই আসে বিতর্ক।  বিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্ব থেকেই বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিকার দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বিশেষতঃ রুশ ও চীনা বিপ্লবোত্তর পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই মতবাদের অনুসারী দেশনায়কেরা কাব্য-সাহিত্যের ব্যাপারেও নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ ও কবি সাহিত্যিকদের সরাসরি লাগাম লাগানোর পক্ষপাতী ছিলেন।  তাঁদের মতে, যে কোন শিল্প-সাহিত্য হওয়া উচিত শোষিত সমাজের বঞ্চনা ও শোষণের দর্পণ-স্বরূপ এবং সেই সঙ্গে বিপ্লবের হাতিয়ার। কাব্য-সাহিত্যে প্রেম-ভালোবাসার মতো ভাবাবেগের প্রকাশ, তাঁদের মতে অবক্ষয়ী বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়ের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই না। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ বিতর্কের সূত্রপাত – যা আমাদের আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের প্রশ্ন – সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের অবিসংবাদিত জনক রূপে যিনি বিশ্বখ্যাত, সেই কার্ল মার্কসও কি একই ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন? তাঁর নিজের জীবনে কি প্রেম এসেছিল? সেই প্রেম কি তাঁকে যৌবনে অনুপ্রাণিত করেছিল আরো বহু সাধারণ-অসাধারণ মানুষের মতো প্রেমের কবিতা রচনা করতে? কেমন ছিল সে কবিতা? উত্তর সন্ধান করা যাক তাঁর জীবন আর রচনাবলীতে। 

(১)

১৮৪৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্বের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঐ দিনই প্রকাশিত হয় ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ নামক একটি নাতিদীর্ঘ পুস্তিকা। ধনতন্ত্রের উত্থান ও শ্রমিকশ্রেণীর শোষণের স্বরূপ উদঘাটনের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ প্রদর্শক যুগান্তকারী এই পুস্তিকাটির মাধ্যমে কার্ল মার্কস নামক ব্যাক্তিটির নাম জনসাধারণের মধ্যে প্রথম ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এর এগারো বছর পর প্রকাশিত হয় এই লেখকের একটি পূর্ণাঙ্গ পুস্তক: A Contribution to the critique of Political economy. আর এই বইযের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখক উপর্যুপরি রচনা করেন তিন খণ্ডে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Das Kapital। যদিও তাঁর জীবদ্দশায় সে বইয়ের শুধুমাত্র প্রথম খণ্ডেরই মুদ্রিত রূপ দেখে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু শুধু এই একটি খন্ডই প্রকাশিত হবার তিন বছরের মধ্যে তার প্রথম সংস্করণ এবং আগামী এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সংস্করণ নিঃশেষিত হয়। এছাড়াও তাঁর স্বদেশের পাশাপাশি রুশদেশের জনগণের দাবিতে এই বইয়ের রুশ অনুবাদ প্রকাশিত হয় এবং অতি দ্রুত তিন হাজার কপি নিঃশেষিত হয়।

বলাই বাহুল্য, তাঁর রচনাবলীর এই গগনচুম্বী সাফল্য তাঁর অনুগামী গোষ্ঠীর কাছে ক্রমশঃ তাঁকে এক ঈশ্বর প্রতিম ব্যক্তিত্বে উন্নত করে এবং দেশ কালের যাবতীয সীমারেখা অতিক্রম করে বিশ্বের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং সর্বোপরি সমাজতন্ত্রবাদের জনক হিসেবে তিনি স্থান করে নেন বিশ্ব ইতিহাসের পাতায়।

কিন্তু ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে। সাধারণত: যে কোনো মহান ব্যক্তিত্বের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেই ব্যক্তির নিজস্বতা বিকাশের পেছনে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের বিশেষ প্রভাব থাকে – কবির ভাষায় যাকে বলা চলে child is the father of the man। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বোধহয় ঠিক ততটাই সত্যি যতটা সত্যি নয়। শৈশব ও যৌবনের শিক্ষা ও মানসিকতা পরবর্তী জীবনের বীক্ষা ও অভিজ্ঞার স্পর্শে কিভাবে আমূল পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সম্ভবতঃ কার্ল মার্ক্সের জীবন। এতটাই গভীর এই পরিবর্তন যে পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামী ও অন্ধ অনুসারী গোষ্ঠীর তা বিশ্বাস ও ধারণা তো বটেই, সম্ভবতঃ কল্পনারও অতীত৷ পরবর্তী জীবনে ঘোর নিরীশ্বরবাদী, দ্বান্দিক বস্তুবাদের পূজারী, মেহনতী মানুষের শোষণের স্বরূপ উদ্ঘাটক ও শ্রেণী সংগ্রামের পথপ্রদর্শক চরম বাস্তববাদী মানুষটির সঙ্গে প্রথম জীবনের ধর্মবিশ্বাসী, কল্পনাপ্রবণ, রোমান্টিক, ও প্রেমিক চরিত্রটিকে মেলানো আপাত দৃষ্টিতে অসম্ভব বলেই মনে হয়।

(২)

জার্মানির (তদানীন্তন প্রুশিয়া) দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে, প্রায় লুক্সেমবুর্গ সীমান্তে ছোট্ট শহর ট্রিয়ার৷ মোজেল নদীর তীরে, আঙুরলতায় ঢাকা, লাল পাহাড়ের কোলে অরণ্যানীর ছায়ায় ঘেরা ছবির মতো অপূর্ব নৈসর্গময়৷ একই সঙ্গে এই শহর বহন করে চলেছে হাজার বছরেরও পুরোনো রোমান ইতিহাসের স্মৃতি – এখানে ওখানে ছড়ানো প্রাচীন রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন৷ এই সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের অপরূপ সংমিশ্রণে গড়া শহরেই ১৮১৮ সালের ৫ই মে জন্ম হয় কার্ল মার্ক্সের। তাঁর পিতা হার্শেল লেভি ছিলেন জন্মসূত্রে ইহুদি এক সম্ভ্রান্ত নাগরিক৷ জীবন ও জীবিকার স্বার্থে এবং ইহুদি ধর্মের গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতায় বিরক্ত হয়ে লেভি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর নতুন নাম হয় হাইনরিখ মার্কস্৷ পিতার ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করার পর যেহেতু কার্লের জন্ম, তাই জন্মসূত্রে কার্ল ছিলেন ক্যাথলিক খ্রীষ্টান৷ পরিবারিক সূত্রে পাওয়া এই ধর্মবিশ্বাস পরিণত বয়সের চিন্তাবিদ কার্লের কাছে গুরুত্বহীন হলেও কৈশোর ও প্রথম যৌবনের কবি কার্লের মননে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

১। জন্মস্থানের পূর্বোল্লিখিত প্রাচীন ঐতিহ্য ও অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য – যা স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন সুকুমার প্রকৃতির মানসিকতায় কাব্যপ্রেম জাগিয়ে  তোলার সহায়ক৷

২। পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মবিশ্বাস। আগেই বলা হয়েছে কার্লের পিতা বংশানুক্রমিক ইহুদি ধর্মের আচার-সর্বস্বতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-স্বরূপ খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন যুক্তিবাদী ধর্মমনস্ক ব্যক্তি। ধর্মকে তিনি দেখতেন আমাদের মহাভারতে সংজ্ঞায়িত ধর্মের প্রতিরূপ হিসেবে – ধর্মং য ধারয়তি। অর্থাৎ ধর্ম তাঁর কাছে ছিল নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের সমার্থক। কার্লের মানসিকতাতেও শৈশব থেকেই ধর্ম সংক্রান্ত এই ধারণা রোপিত হয়, যা তার কাব্যবোধ ও সৃজনশীলতাকেও প্রভাবিত করে।

৩। ট্রিয়ার শহরে মার্কস পরিবারের প্রতিবেশী ছিলেন ভেস্টফালেন পরিবার- কার্লের পরবর্তী জীবন ও চিন্তাধারার বিকাশে যাঁদের প্রভাব ছিল অতি-সুদূরপ্রসারী৷ এই পরিবারের কর্তা লাডভিগ ফন ভেস্টফালেন ছিলেন কার্লের পিতা হেনরিখের সুহৃদ এবং শহরের বিদগ্ধ-শ্রেষ্ঠদের অন্যতম। কার্লের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীল এবং তাঁর প্রভাবে ও আন্তরিক সাহচর্যে তরুণ কার্ল জার্মান, গ্রিক ও ইংরেজি ধ্রুপদী সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী পাঠক হয়ে ওঠেন। গ্যেটে, শিলার, দান্তে, হোমার, শেক্সপীয়ারের রচনাবলী তরুণ কার্লের হৃদয়কে উদ্বেলিত করত। বিশেষতঃ গ্যেটে ও শেক্সপীয়ারের রচনায় তিনি ছিলেন বিশেষ ভাবে মুগ্ধ। তাঁর কন্যা লরার স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, এই মুগ্ধতা তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল এবং জীবন- উপান্তে উপনীত হয়েও তিনি গ্যেটে ও শেক্সপীয়ারের নির্ভুল আবৃত্তি করে যেতেন। জার্মান, ইংরেজি, গ্রীক ধ্রুপদী সাহিত্যের পাশাপাশি কার্লের ছিল গণিত ও দর্শন শাস্ত্রের প্রতিও অপরিসীম আকর্ষণ আর সেই সঙ্গে ছিল তার স্বাভাবিক অধ্যয়ন-স্পৃহা।

৪। পিতৃপ্রতিম লাডভিগ ছাড়াও ভেস্টফালেন পরিবারে ছিলেন লাডভিগের পরমাসুন্দরী কন্যা জেনি – যিনি কার্লের দিদি সোফিয়ার বান্ধবী। জেনির ভাই এডগার ছিলেন আবার কার্লের বন্ধু – যে বন্ধুত্ব তাঁদের রয়ে গিয়েছিল আজীবন৷ এই সূত্রেই কার্লের জেনির সঙ্গে পরিচয় এবং কার্লের জীবনে আবির্ভাব হয় তাঁর জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেমের। পরবর্তীকালের জীবনসঙ্গিনী জেনির আগমন কার্লের জীবনের এক সন্ধিক্ষণ বলা যেতে পারে। জেনি ছিলেন কার্লের চেয়ে বছর চারেকের বড়৷ একে বয়সের অসাম্য, অন্যদিকে দুই পরিবারের অর্থনৈতিক অসাম্য৷ ভেস্টফালেন পরিবার ছিলেন ধনাঢ্য এবং মার্কস পরিবারের তুলনায় সামাজিক মর্যাদায় উচ্চতর। কিন্তু এইসব যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে তুছ করে দূর্বার, অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলে কার্ল ও জেনির  গভীর প্রেমধারা  যা পরবর্তীকালে কার্লের জীবনকে এক পলিময়, উর্বর ভূমিতে পরিণত করে। সমান্তরাল ভাবে, প্রেমের এই সংঘাতময় গতিপথ কার্লের সৃজনশীল সত্ত্বাকে উজ্জীবিত করে এবং জন্ম দেয় বহু সার্থক প্রেমের কবিতার।

(৩)

জীবনের প্রথম সতেরটি বসন্ত কার্ল অতিবাহিত করেন তাঁর জন্মস্থান ট্রিয়ার শহরে। এরপর ১৮৩৫ সালে কার্ল পিতার নির্দেশে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান উচ্চতার শিক্ষার উদ্দেশ্যে। যাবার আগে কার্ল গোপনে জেনির সঙ্গে তাঁর বাগদান পর্ব্বটি সেরে যান৷ এরপরে অবশ্য আরো আট বছর তাঁদের দুজনকে অপেক্ষা করতে হয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার জন্য। কিন্তু এই গোপন বাগদান কার্লের প্রেমের তীব্রতা এবং তার কাছে এই প্রেমের গুরুত্বকেই তুলে ধরে।

একদিকে দূরবর্তী প্রেমের বিচ্ছেদ জনিত অস্থিরতা, অন্যদিকে নব যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে জীবনের সঠিক পথ অন্বেষণে বিভ্রান্তি – সব মিলিয়ে কার্ল এই সময় এক অস্থির মানসিকতার অধিকারী। এই সঙ্গেই চলছে কাব্য-সাহিত্যের জোয়ার – জাৰ্মান-গ্ৰীক ইংরেজী ক্লাসিক সাহিত্যের পঠন-পাঠন আর অন্যদিকে রাজনীতি – অর্থনীতি – দর্শনের আলোচনা ও বাক্-বিতন্ডা। তবে সব কিছুর মধ্যেই অনিবার্যভাবে অবস্থান করেছে ধ্রুবতারার মতো দেদীপ্যমান জেনির অপ্রতিরোধ্য প্রেম সম্ভার।

পিতা হাইনরিখ পুত্রের কাব্যপ্রেমের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং খুশিই ছিলেন। কিন্তু তিনিও উপলব্ধি করছিলেন যে শুধুমাত্র কাব্য বা সাহিত্যচর্চার জন্য কার্লের জন্ম হয়নি। ধনতান্ত্রিক শাসনের থেকে বিশ্ববাসীর মুক্তির জন্য তাঁর বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক মতবাদই যে একদিন একমাত্র সূত্র ও দলিল রূপে পথপ্রদর্শক হবে – এতদূর ধারণা করতে না পারলেও তাঁর পুত্রের অন্তরের প্রজ্বলন্ত দাবানল যে শুধুমাত্র কাব্য-সাহিত্য-দর্শনের স্নিগ্ধ ধারায় প্রশমিত হবার নয় এটুকু অনুধাবন করতে তাঁর বিলম্ব হয়নি। এমতাবস্থায় কার্লকে তিনি বন থেকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন আইন পড়ানোর উদ্দেশ্যে – বলাই বাহুল্য, যা তার জীবিকা অর্জনের সহায়ক হবে।

এক বছরের মধ্যেই বন থেকে কার্ল এসে উপনীত হলেন বার্লিন শহরে। বার্লিন শহরের পরিবেশ ট্রিয়ার বা বন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। শিল্পাঞ্চল  পরিবেষ্টিত, জনবহুল এক শহর বার্লিন – স্বাভাবিক ভাবেই এখানকার বৌদ্ধিক পরিবেশও অনেক উন্নত৷ বার্লিনে এসেও প্রথম দিকে কার্লের কাব্য ও দর্শন চর্চ্চার স্রোত একই রকম প্রবল ছিল। কিন্তু বার্লিনে বিভিন্নমুখী মতবাদ ও ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শ তাঁর মনোজগতে ধীরে ধীরে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে৷ একসময় হেগেলিয় দর্শনের অন্ধ ভক্ত কার্ল এই সময় ব্রুনো ব্রাউয়েল, ভেভিড স্ট্রাউস প্রমুখ নব্য-হেগেলবাদীদের সংস্পর্শে আসেন। এর ফলস্বরূপ ধর্মসংক্রান্ত তাঁর চিরাচরিত ধারণা তাঁর নিজের কাছেই প্রশ্নাকীর্ণ হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে তাঁর চেতনা ঈশ্বরবাদ এবং যাবতীয় ধর্মীয় সংস্কার এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তির পথে এগিয়ে চলে। কিন্তু এই নব্য-হেগেলবাদ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রধর্মের কাছে স্বভাবতঃই প্রীতিদায়ক ছিলনা এবং এর পরিণতি হিসেবে চার্চ্চের চাপে প্রুশিয়া সরকার শাস্তি-স্বরূপ ব্রুনোকে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ থেকে অপসারিত করে। কার্ল ও অন্যান্য নব্য-হেগেলবাদীদের মননে এই ঘটনার অভিঘাত হয় অত্যন্ত ব্যাপক। কার্লের চিন্তাধারার   গতিমুখ এরপর বহুল পরিমাণে পুনঃ-নির্দেশিত হয় এবং ঈশ্বর, মানবিকতা, আত্মচৈতন্য লাভ – এই জাতীয় অন্তর্মুখী আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক আলোচনা পরিত্যাগ করে তাঁর দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয় রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের সম্পর্কের ওপর৷

এইভাবেই পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর প্রভাবে কার্লের মনোজগতে  এক নতুন  বিপ্লবের সূচনা হয়৷ কাব্য-সাহিত্যের  পেলবতাকে  অতিক্রম করে তাঁর চিন্তাধারা ক্রমশঃ  ধনতন্ত্র ও রাষ্ট্রের হাতে সাধারণ মানুষের নানাবিধ  বন্ধনের স্বরূপ এবং তার থেকে মুক্তির পথনির্দেশের দিকে প্রবাহিত হতে  শুরু করে। প্রায় এই সময়েই ১৮৩৮ সালে কার্লের ব্যক্তিগত জীবনে নেমে আসে  আর এক আঘাত – পিতৃবিয়োগ৷

হ্যাঁ, কার্লের কাব্যচর্চ্চা ও সাহিত্য বিকাশের স্রোতধারাও বস্তুতঃ  এখানেই স্তব্ধ। সাহিত্য রচনা থেকে  সম্পূর্ণ সরে এসে এরপর কার্ল নিজের চিন্তা ও রচনাকে ক্রমশঃ নিয়োজিত করেন তাঁর বৃহত্তর জনমুখী লক্ষ্যে৷  তবে একথাও অনস্বীকার্য যে, নিজস্ব কাব্য বা সাহিত্য রচনার পরিসমাপ্তি ঘটলেও কাব্য সাহিত্যের রসগ্রহণ থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করতে পারেননি বা চাননি কখনোই৷ বিভিন্ন সময়ে রচিত বিভিন্ন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রবন্ধাবলীতে তাঁকে দেখা যায় নিজের বক্তব্য প্রকাশে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে। এমনকি ভবিষ্যৎ সমাজে কাব্য-শিল্প-সাহিত্যের স্বরূপ কেমন হবে বা হওয়া উচিত সেই বিষয়েও তিনি তাঁর সুচিন্তিত মতামত জানিয়ে গেছেন বহু নিবন্ধে, পত্রে এবং  সাক্ষাৎকারে। এই প্রসঙ্গে এটুকু উল্লেখ  করাও বোধহয় অপ্রসাঙ্গিক হবে না, যে পরবর্তীকালে মার্কসের অনুগামীরা শিল্প-কাব্য -সাহিত্যের আদর্শের যে ব্যাখ্যাই করে থাকুন না কেন বা এ বিষয়ে যতই অন্তর্দ্বন্দে মত্ত হোন এবং শিল্পের জগতে “বুর্জোয়া” এবং “বিপ্লবী” শ্রেণীবিভাগ আরোপের চেষ্টা করুন না কেন, স্বয়ং মার্কসের কিন্তু কাব্য সাহিত্যের ‘রস’ বস্তুটা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ছিল৷ তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বের কালজয়ী মহান সাহিত্যিকরা (অর্থাৎ, পরবর্তী কালে তাঁর অনুগামীদের মতে তথাকথিত “বুর্জোয়া” সাহিত্যিকরা) বিপ্লবী না হয়েও তাঁদের ক্রান্তদর্শী অন্তদৃষ্টির সাহায্যে শ্রেণীসমাজের ভেতরের দ্বন্দগুলি এমন সার্থক ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন যা ঐতিহাসিক বা অর্থনীতিবিদদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী৷ বিভিন্ন পত্রে ও নিবন্ধে কার্ল  তাঁর এ-সংক্রান্ত মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে গেছেন।

(৪)

কার্ল মার্ক্সের প্রকাশিত যে কটি কাব্যসংগ্রহ পাওয়া যায় সবই বছর দুয়েকের ব্যবধানে রচিত। ১৮৩৬ থেকে ৩৭ সালের মধ্যে – অর্থাৎ কার্লের বন ও বার্লিন জীবনের একেবারে  সূচনাপর্বে। এর মধ্যে ১৮৩৬ সালে দুটি এবং ৩৭ সালে  একটি কাব্যসংগ্রহ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত সংকলন ছটির নাম ছিল “প্রেমের কবিতা – প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড” এবং তৃতীয় সংকলনটি ছিল “গীতিগুচ্ছ” তিনটি বইয়েরই উৎসর্গপত্র  ছিল এইরকম:-

এরপর ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত হয় কার্লের নতুন একটি কবিতা সংগ্রহ, “পিতাকে নিবেদিত।” বাবার উদ্দেশে লেখা এক গুচ্ছ কবিতার সঙ্গে কার্ল এখানে তাঁর পূর্বতন দুটি কাব্যসংগ্রহের যাবতীয় কবিতাও অন্তর্ভুক্ত করে দেন।
কার্লের কাছে তার কবিতাগুলি, বিশেষ করে জেনিকে নিবেদিত প্রেমের কবিতাগুলি, রচনাকালে যতই মূল্যবান হয়ে থাকুক না কেন পরবর্তী জীবনে, পরিণত মানসিকতায় এগুলির মূল্য যে তাঁর কাছে কানাকড়িও ছিলনা সেকথা জানা যায় কার্ল-কন্যা লরা লাফার্জের স্মৃতিচারণায়। লরা লিখেছেন,

“বাবার কাছে তাঁর কবিতাগুলির বিন্দুমাত্র সম্মান ছিলনা। যখনই বাবা-মা এই কবিতাগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করতেন, তখনই দুজনকে দেখতাম প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়তে।”

জেনিকে নিবেদিত কার্লের তিনটি প্রেমের কবিতার সংকলন অনুধাবন করলে দেখা যায়, সেখানে প্রবলভাবে উপস্থিত কবির প্রেমিকা জেনি। রোমান্টিক কবিতার সঙ্গে কার্লের কবিতার প্রতিতুলনায় স্পষ্টই দেখা যায় এখানে কবি তাঁর প্রেমকে কখনোই প্রেমাস্পদকে অতিক্রম করে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণের সুযোগ দেন নি। কবির প্রেম প্রায়শঃই মর্ত্যের সীমানা ছেড়ে অমর্ত্যের পথে পাখা মেলেছে ঠিকই, কিন্তু সেখানেও মরমী পাঠক যথার্থভাবে কবির অনুগামী হলে স্পষ্টই অনুভব করবেন যে কবির যাত্রাপথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মহীয়সী নারী। অর্থাৎ প্রেমাস্পদ তাঁর কাছে গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা, বিকেলের নক্ষত্রের কাছে দূরতম কোন দ্বীপ নয় – কবির শুধু সুরগুলিই নয়, কবি স্বয়ং যেন তার প্রিয়তমার চরণে ঢেলে দিচ্ছেন তাঁর প্রাণের অর্ঘ্য। কার্লের কবিতা তাই দেহাতীত হয়েও দেহজ – স্বর্গলোকের হয়েও মর্ত্যের।

কার্লের কবিতার আর একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হল কবির তৎকালীন ধর্মবিশ্বাস। এর আগে আলোচনায় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ১৭-১৮ বছর বয়সী কার্ল তার পিতার ধর্মবোধের প্রভাবে কিভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন। মুক্তমনা খ্রীষ্টান ধর্মবোধের প্রভাব তাঁর কবিতার নানাভাবে ছড়িয়ে আছে। বারবার তাঁর কবিতায় সত্য -শুভ-সুন্দরের প্রতীক হিসেবে ‘আত্মা’, ‘স্বর্গীয় বীণার ঝংকার’ – এই ধরণের চিত্রকল্পগুলি উঠে এসেছে। মূল্যবোধের অবনতি বোঝাতে ‘আত্মার নীচে নেমে যাবার’ কথাও তাঁর কবিতার পাওয়া যায়৷ এমনকি প্রিয়া মিলনের আনন্দ ও শান্তির তুলনা হিসেবে ভারতীয আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘মহাসমাধির অনন্ত শান্তি’র উল্লেখও পাওয়া যায় তাঁর কবিতায় যা সম্ভবতঃ কার্লের দর্শনশাস্ত্রে গভীর অধ্যয়নের ফলশ্রুতি।

এর পাশাপাশি বন ও বার্লিনের জীবনের সূচনাপর্বে কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কার্লের যে মানসিক অস্থিরতার কথা ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে, বেশ কিছু কবিতার কবির সেই মানসিক উদভ্রান্তির প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায় (জেনির জন্য শেষ সনেটগুচ্ছ- তৃতীয় কবিতা, কিংবা ‘আকাঙ্ক্ষা, একটি রোমান্স’)।

বর্তমান পরিসরে কার্লের “প্রেমের কবিতা – প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড” এবং “গীতিগুচ্ছ” থেকে মোট সাতটি কবিতার অনুবাদ সন্নিবেশিত হল। অনুবাদ – বর্তমান নিবন্ধকারের। তবে সবিনয় স্বীকার – জার্মান ভাষায় ব্যুৎপত্তির অভাবে বর্তমান অনুবাদগুলি সবই মূল কবিতার ইংরেজী অনুবাদের বঙ্গানুবাদ৷ জার্মান-ইংরেজী এবং ইংরেজী-বাংলা – এই দ্বি-স্তরীয় বিচ্যুতির বিঘ্ন অতিক্রম করতে গিয়ে কার্ল মার্ক্সের মূল কাব্যরস কতটা বিঘ্নিত হল সে বিচার যুগপৎ জার্মান ভাষায় অধিকারী এবং কার্ল মার্কসের মূল কবিতার রসগ্রাহী পাঠকের ওপর ন্যস্ত রইল৷ যোগ্য ব্যক্তির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যে কোন উপদেশ বা পরামর্শ সাদরে এবং নির্দ্বিধায় গৃহীত হবে।

ইংরেজি অনুবাদগুলি ক্লিমেন্স পালমে দত্ত (১৮৯৩-১৯৭৫) কৃত – যিনি তাঁর ভাই রজনী পালমে দত্তর সঙ্গে যৌথভাবে মার্কসবাদী ও মার্কসবাদ অনুধ্যায়ীদের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত নাম। জন্মসূত্রে বঙ্গজ, আজন্ম ইংল্যান্ড- প্রবাসী এই দুই ভাই ব্রিটেনে কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা ও প্রচারে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯২৫ সালে Great Britain Communist Party (CPGB) প্রতিষ্ঠিত হলে ক্লিমেন্সই তার প্রথম প্রধান হন। কম্যুনিস্ট আন্দোলনের পাশাপাশি খোদ লন্ডনে বসে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনেও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রচুর নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। মার্কস্ ও এঙ্গেলসের সম্পূর্ণ রচনাবলীর ইংরেজি অনুবাদ এঁদেরই জীবনব্যাপী সাধনার ফসল।

তথ্যসূত্র ও ঋণ স্বীকার:

১। Collected works of Marks and Engels – Translated by Clemens Palme Dutt- Wildside Press- USA

২। To the Finland Station: A Study in the Writing and Acting of History- by Edmund Wilson- Double day & Co. Publication- USA

 ৩। কার্ল মার্কস মানুষটি কেমন ছিলেন- জাকির তালুকদার- ঐতিহ্য প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ

 ৪। মার্কস ২০০: একুশের ভাবনা। সম্পা: শোভনলাল দত্তগুপ্ত – আনন্দ পাবলিশার্স (সংকলনের বিভিন্ন প্রবন্ধ)

৫। মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব – নিত্যপ্রিয় ঘোষ : এক্ষণ শারদীয়া

৬৷ সন-তারিখ ও মার্কসের জীবনী সংক্রান্ত তথ্য: বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে (প্রধানতঃ Encyclopaedia Brittanica এবং Marxists.org)

কয়েকটি কবিতা প্রেমের কবিতা -১ /২ থেকে

জেনির জন্য শেষ সনেটগুচ্ছ

(১)

এ গান তোমার পায়ে আমার প্রেমের নম্র নিবেদন-এই সব গান তুমি নাও।
যেখানে আমার আত্মা বীণার সুরেলা ঝংকারের ডানায় 
ভর করে উড়ে চলে উচ্ছল সোনালী রোদের মুক্তিতে
আঃ! সেই সুরের অনুরণন যদি
আমার কবিতায় আনে আকাঙ্ক্ষা-ঘেরা মধুর মূর্চ্ছনা, 
আমার হদয়ে আনে আবেগের তীব্র স্পন্দন
তোমারই গর্বিত হৃদয়ের উল্লসিত দোলনের ছন্দে,
তবে আমি দূর থেকে শুধু দেখে যাব -
জয়গৌরব কিভাবে তোমার চলার পথে
আলোক শিখা বয়ে নিয়ে চলে।
তারপর যোদ্ধা হব আমি-
আরো বেশি দৃপ্ত, সাহসী- আমার গান
আরো বেশি গগনবিহারী,
আরো বেশি মুক্ত, স্বেচ্ছাচারী-
বীণার করুণ সুর বেয়ে গুঞ্জরিত হবে কানে কানে।

(২)
তোমার চোখের তারায় চেয়ে চেয়ে
খুঁজে পাই আমার খোলা আকাশের উজ্বল নীল।
দেশ- জাতির সীমানা ছাড়িয়েও কোন খ্যাতি
ততদূর পারেনা পৌঁছতে।
সেই খ্যাতির জন্য অন্ধ উন্মাদনা অর্থহীন বোধ হয -
তোমার চোখের তারায় চেয়ে চেয়ে।
খুশির উচ্ছ্বাসে কাঁপা তোমার হৃদয
কিংবা গানের আবেশে ঝরা অশ্রুমুক্তা কণা
প্রতিটি প্রশ্বাসের সঙ্গে উড়ে চলে
আমার আত্মার একেকটি অংশ -
বীণার সুরেলা ঝংকারের সাথী হয়ে।
আর, যাবতীয আনন্দ-বেদনার সম্ভার নিয়ে
তোমার মাঝে মিশে যেতে যেতে
আমি লাভ করি সহাসমাধির অনন্ত শান্তি।
(৩)
দেখে নিও, আমার এই উড়িয়ে দেওয়া পাতাগুলো
কত সহজে, কাঁপতে কাঁপতে
পৌঁছে যাবে তোমার কাছে।
তোমাকে হারানোর বেদনা আর নির্বোধ ভয়
আমার আত্মাকে কত নীচে ঠেলে দেয়।
নিজের কাছেই বিভ্রান্তিকর যত উদ্ভট খামখেয়াল ঘুরে মরে দুঃসাহসী অলিগলিতে।
উচ্চতম শিখরে পৌঁছনো আমার আর হয়ে ওঠেনা।
হারিয়ে যেতে বসেছে শেষ আশাটুকুও।
বহুদুর থেকে ফিরে এসে এই বাসনা-ঘেরা ঘরে
হয়তো দেখব তোমাকে অন্য কারো গর্বিত বাহুবন্ধনে।
আমার ওপর দিয়ে বয়ে যাবে শুধু
দুঃখ আর বিস্মৃতির বজ্র-বহ্নিশিখা। 


 "গীতিগুচ্ছ" থেকে জেনিকে
(১)
শব্দগুলো শুধু ছায়া - ফাঁপা আর মিথ্যে ছাড়া আর কিছু নয়।
চারিদিকে জীবনের বেড়ে চলা কোলাহল
তোমার রক্তের ভিতরে খেলা করে মৃত্যু ও ক্লান্তি -
আমার যাবতীয় অনন্ত উচ্ছ্বাস কি তবে ঢেলে দেব তোমার ভেতরে?
তবু পৃথিবীকে হিংসে করা দেবতারা চিরকাল
মানুষের ভেতরের আগুনকে বুঝে নিতে চেয়েছে
তাদের সবটুকু প্রজ্ঞা নিয়ে
আর আবহমান কাল পৃথিবীর যত হতভাগ্য তাদের অন্তরের আলোর সাথে
যোগসূত্র রচেছে শুধু শব্দ দিয়ে।
কারণ,যদি কামনার শিখা জেগে ওঠে- সাহসী ও কম্পমান -
আত্মার মধুর উজ্জ্বলতায়,
তবে সে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেবে তোমার পৃথিবীকে
তুমি হারাবে তোমার সিংহাসন, আর নেমে যাবে আরো নীচে
ছড়িয়ে পড়বে হাওয়ার উদ্দাম নৃত্য,
আর শেষ মেষ তোমাকে ছাপিয়ে তৈরি হবে অন্য এক জগৎ -
তোমার কাজ হবে তাকে শুধু আরো দৃঢ় করে গড়ে তোলা।

(২)
জেনি! জানতে চাও কি, কেন এই "জেনিকে" উদ্দেশ করে আমার এই গীতিগুচ্ছ?
যখন শুধু তোমার কথা ভেবেই আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়,
যখন তোমার জন্যই আমার সব গানে ছেয়ে থাকে হতাশার সুর,
আবার তোমার জন্যই সে-গানে হয় নতুন প্রাণ সঞ্চার,
যখন সেই গানের প্রতিটি শব্দবন্ধ তাদের নীরব স্বীকারোক্তিতে উচ্চারণ করে শুধু তোমারই নাম,
আর তুমিই তাদের উচ্চারণকে করে তোল সঙ্গীতময়,
যখন তোমার নামের সঙ্গে নির্গত আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস
পথ চিনে উড়ে চলে শুধু ঈশ্বরেরই দিকে?
কারণ তোমার নামের ধ্বনি এত সুমধুর!
এর মূর্চ্ছণা আমাকে যে কত কথা বলে যায়!
এর ধ্বনি এত সমৃদ্ধ - যেন কোন অলৌকিক আত্মার স্পর্শ,
কোন স্বর্ণময় বীণার ঝংকার-
কোন আশ্চর্য, মোহময়ী সঙ্গীত যেন!

(৩)
আমি শত সহস্র খন্ড গ্রন্থাবলী ভরে ফেলতে পারি
প্রতিটি লাইনে শুধু 'জেনি' শব্দটি লিখে।
তবু তার মধ্যেও গোপন রয়ে যাবে না-বলা -কথার একটা গোটা পৃথিবী,
অনেক চিরন্তন কীর্তি, অনেক দৃঢ় সঙ্কল্প,
কোমল আকাঙ্খায় ঘেরা অনেক মধুর কাব্যপংক্তি,
অনেক স্বর্গীয় দীপ্তি আর উজ্বলতা,
বেদনার্ত হৃদয়ের কান্না আর অপরূপ আনন্দ,
সবটুকু জীবন আর প্রজ্ঞা আমার৷৷
এ সবই আমি পডতে পারি দূর আকাশের নক্ষত্রমালায়
বসন্ত বাতাসের সাথে তারা ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে -
উন্মত্ত, বন্য ঢেউয়ের অশনি গর্জন হয়ে।
আমি শুধু ভাবীকালের জন্য তাদের ধরে রাখি আমার খাতার পাতায়,
আমার গানের ধ্রুবপদ করে …
"ভালোবাসাই জেনি, জেনিই ভালোবাসার নাম"

আকাঙ্ক্ষা: একটি রোমান্স

"তোমার বুক জুড়ে কেন এত দীর্ঘশ্বাস?
কেন তোমার শিরা-উপশিরা জ্বলছে দাউদাউ করে?
এ যেন রাত্রির অসহ্য ভার ৷ যেন ভাগ্যের কশাঘাতে দীর্ণ তোমার আকাঙ্খা গুলি
খড়কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছে প্রবল ঝড়ের মুখে।"

"দেখাও তোমার দুটি চোখ, গীর্জার ঘণ্টার মতো শান্ত ও পবিত্র
আকাশের রামধনুর মতো বর্ণময়
উজ্জ্বলতা যেখানে নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে
বাতাস যেখানে উচ্ছ্বসিত, সঙ্গীতময়
আকাশে তারারা সাঁতার কাটে আপন আনন্দে"

"এখানে আমার স্বপ্নগুলি বড় যন্ত্রণাময়,
ভাষায় বর্ণনার অতীত
মস্তিষ্ক শূন্য, হৃদয় অসাড়-
সামনেই অপেক্ষমাণ সমাধি বেদী।"

"ওগো ইতস্ততঃ ছড়ানো স্বপ্নগুলি,
দূর দেশে তোমরাই কি হাতছানি দাও?
এখানে দুকূল ছাপিয়ে আসে জোয়ার
আর চোখের সামনে ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্রের মতো চলে যায় আশা।"

"ঘোড়সওয়ার এখানে শূন্যতা, নেই কোন আগুন
কিন্তু দেখো, দূরে আলোর এক ক্ষীণ আভা।
আমার চোখ বাঁধা, পুড়ে যাচ্ছি আকাঙ্খার আগুনে -
মনে হয়, গভীর অতলে ডুবে গেলেই পারো শান্তি।"

সে চোখ তুলে ওপরে চাইল - চাউনি উজ্জ্বল।
শরীরের প্রতি অঙ্গে জাগালো ঝাঁকুনি
পেশীগুলো উঠলো ফুলে,হৃদয় ভারহীন -
আত্মাও যেন তাকে ছেড়ে চলে গেছে বহ দূর৷৷
জন্ম, চেতনার উন্মীলন, শৈশব, কৈশোর, ও যৌবনের অতিবাহন - সব কিছু কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮তে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলে (Electrical Engineering) স্নাতক। বর্তমানে কর্মসূত্রে গুরগাঁও, হরিয়ানা নিবাসী। পেশাগত জীবনের বাইরে ব্যক্তিগত জীবন বলতে স্ত্রী ও এক কন্যা সহ পারিবারিক দিনযাপন আর গান-কবিতা-সাহিত্য সমৃদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি কেন্দ্রিক নিজস্ব সময় যাপন। অবসর সময়ে সামান্য লেখালেখি - কিছু কবিতা এবং কিছু প্রবন্ধ। প্রবন্ধের প্রিয় বিষয় বাংলা গান এবং গীতিকবিতা। কবিতা ও প্রবন্ধের প্রকাশ মূলতঃ বিভাব, প্রমা, মিলেমিশে, একুশ শতকের মতো ছোটো পত্রিকা আর সানন্দার মতো বাণিজ্যিক পত্রিকায়।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Debjani Adhikari , August 12, 2021 @ 8:12 pm

    Kato notun katha janlam Marks ke niye. Apnar boktobyo khub sundor prakash peyeche lekhatite.

    • Tathagata Bhattacharya , October 21, 2022 @ 8:38 am

      ধন্যবাদ। পরিশ্রম-সাধ্য একটা লেখার পরিণামে সার্থকতা তখনি আসে, যখন কেউ মন দিয়ে সেটি পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ লেখকের ক্ষেত্রেই মনোযোগী পাঠক পাঠিকা অধরা থেকে যায়! সৌভাগ্যবশত:, আমি একজন হলেও তেমন পাঠিকা পেলাম। আবারো ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *