নারীবাদী পথিকৃৎ – রোকেয়া

নারীবাদী পথিকৃৎ – রোকেয়া

রোকেয়া খাতুনকে ভারতবর্ষ এখনও ভালো করে চেনে না। অন্যদের দোষ দিতে পারি না – বহুদিন অবধি আমিও জানতাম না উনি কে। আমার পক্ষে এই অজ্ঞানতা খুবই লজ্জার, কারণ আমি ওঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়েছি। স্কুলে পড়ার সময় দেখেছি দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিঙে, যেখানে বড়সড় ডিসপ্লে বোর্ডে ‘দিনের বাণী’ আর ভালো ভালো গল্প-ছবি-উপদেশ টাঙানো থাকত, তারই পাশে ডিসেম্বর মাসে উদয় হত এক মহিলার ছবি। ‘হবল’ করে শাড়ি পরা, কাঁধে ব্রোচ আটকানো, ঘোমটা মাথায় ছোটোখাটো এক মূর্তি, মুখে মৃদু হাসি, হাতে বই। নিচে লেখা – বেগম রোকেয়া। অন্য সময় ছবিটা অদৃশ্য হত। কখনো কোনো অনর্থ ঘটিয়ে থাকলে হেডমিস্ট্রেস শান্তিদির (শান্তি ব্যানার্জি) ঘরে ডাক পড়ত, দেখতাম ছবিটা ওঁর চেয়ারের পেছনে দেয়ালে ঝোলানো। দেখেছি এই মাত্র, মহিলার সম্বন্ধে জানতে খুব একটা কৌতূহল বোধ করিনি। ব্যাপারটা পাল্টে গেল একদিনের ঘটনায়।

                  বেগম রোকেয়া

তখন আমি স্কুল-ক্যাপ্টেন। নিজেকে বেশ হোমরাচোমরা লাগছে। মনে হল স্কুলের জন্যে একটা কিছু অভিনব করা দরকার। ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ভাবলাম সব স্কুলে সরস্বতী পুজো হয়, শুধু আমাদের ছাড়া। তা কেন? অনেক সাহস টাহস জমিয়ে শান্তিদির কাছে গিয়ে অনুরোধ জানালাম – ‘এবারে স্কুলে আমরা সরস্বতীপুজো করতে চাই।’ টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে, কাগজে কী যেন লিখছিলেন শান্তিদি। মুখ না তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”

এই রেঃ! পুজোর স্বপক্ষে কিছু যুক্তি মনেমনে সাজিয়ে এনেছিলাম, তাই উগড়ে দিলাম। ‘আমরা ছাত্রী – অতএব বিদ্যার দেবীকে পুজো করব, তা স্বাভাবিক নয় কি?’ শান্তিদি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের এই স্কুল কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জানো?” ব্যাস, ফান্ডায় ভূমিকম্প – মুখ বন্ধ। এতটুকু বিরক্ত না হয়ে শান্তিদি পেছনের ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “বেগম রোকেয়া। নিজেদের শিক্ষার জন্যে কাউকে যদি শ্রদ্ধা জানাতে চাও, এঁকে নয় কেন? ইনিই তো তোমাদের বিদ্যার দেবী।” বলা বাহুল্য, সরস্বতীপুজো হয়নি।

শান্তিদির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর থেকে বেগম রোকেয়া সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করেছি। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতায় বসে সামান্য তথ্যই পেয়েছিলাম। পরে আমেরিকায় এসে, নারীবাদীদের অবদান আর তাঁদের লেখা সাহিত্য পড়তে গিয়ে বেগম রোকেয়াকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। জানতে পারলাম আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বসমাজেও তাঁর অবদান অসামান্য। ইদানীং বেগম রোকেয়া সম্পর্কে গবেষণা আর লেখালেখি বেড়েছে,[i] কিন্তু তাঁর কাজের সম্পূর্ণ মূল্যায়ন এখনও হয়নি।

কে ছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন? আসলে তাঁর নামটাও আমরা সঠিকভাবে উল্লেখ করি না। অনেকে বলে ‘বেগম রোকেয়া,’ আবার অনেকে ‘বেগম রোকেয়া [সাখাওয়াত] হোসেন।’ ইসলামিক সংস্কৃতিতে ‘বেগম’ শব্দটি মহিলাদের বিবাহিত হিসেবে চিহ্নিত করে – ইংরেজিতে ‘মিসেস’ বলার মতন। রোকেয়া কিন্তু কখনই নিজেকে কারোর ‘বেগম’ বা স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে চাননি। তিনি চাইতেন কারোর স্ত্রী বা মা হিসেবে নয়, মহিলারা স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠুক। নিজেকে সেই বিশ্বাসের উদাহরণস্বরূপ গড়েছিলেন। সাখাওয়াত হোসেন তাঁর স্বামীর নাম। তাই রোকেয়ার ইচ্ছানুসারে, ‘রোকেয়া [সাখাওয়াত] হোসেন’ নামটাও সঠিক নয়। উনি নিজের নাম লিখতেন ‘রোকেয়া খাতুন’ – বিবাহপূর্ব নাম। এই একই যুক্তিতে পাশ্চাত্যের নারীবাদীরা বিয়ের পরে স্বামীর পদবী গ্রহণ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন প্রায় আরও সত্তর বছর পরে। সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার সম্বন্ধে সচেতন রোকেয়া এই বিরল এবং উল্লেখযোগ্য নারীবাদী সিদ্ধান্তের পথিকৃৎ। শোনা যায় রোকেয়ার ইচ্ছে ছিল সম্পর্কের নিগড় সরিয়ে রেখে সবাই তাঁকে সোজাসুজি নাম ধরে ডাকবে। তাঁর সেই ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে এই লেখায় তাঁকে ‘রোকেয়া’ নামেই উল্লেখ করেছি।

রোকেয়ার খ্যাতি নারীশিক্ষার প্রবক্তা হিসেবে। কিন্তু সে শুধু তাঁর প্রতিভার একটি দিক। আমার মতে উনি প্রথমে এবং সর্বাগ্রে সমাজ পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ এক নারীবাদী কর্মী – নারীর সমানাধিকার অর্জনের পথে শিক্ষাকে সাঁকো হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ওঁর লেখা, কাজকর্ম, এই সঙ্কল্পেরই সাক্ষ্য বহন করছে।

“আমার জীবনই আমার বাণী”

এখনকার বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর তারিখে।[ii] তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে – ভারত অবিভক্ত। রোকেয়ার আব্বা, জাহিরুদ্দিন মোহম্মদ আবু আলি সাবের ছিলেন শিক্ষিত, জমিদার, উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষ। আলি সাবেরের চার স্ত্রীর মধ্যে রোকেয়ার মা একজন – নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়াকে নিয়ে রাহাতুন্নেসা চৌধুরানীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। রোকেয়ার পরিবারে মেয়েরা ছিল পর্দানশীন। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে বহির্জগতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত। নিজের পরিবার ও মুসলমান সমাজের কট্টর পর্দাপ্রথার গল্প রোকেয়া নিজের লেখায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে পর্দার চল যে তাদের পায়ে বেড়িরই সমতুল তা বলতে গিয়ে এতটুকু রাখঢাক করেননি। পর্দাপ্রথার জন্যে সমাজে মহিলাদের যে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে, তা জোরগলায় বলেছেন, কঠিন সমালোচনা করেছেন। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘অবরোধ বাসিনী’তে নারীর জীবনে পর্দাপ্রথার বিধ্বংসী প্রভাব সম্বন্ধে রোকেয়া লিখেছেনঃ

“আমরা বহুকাল হইতে অবরোধ থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি; সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের – বিশেষত আমার কিছুই নাই। মেছোনীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, ‘পচা মাছের দুর্গন্ধ ভালো না মন্দ?’ সে কী উত্তর দিবে? …

“এ-স্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যিক যে, গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষদের বিরুদ্ধে নহে, মেয়েমানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ির চাকরানি ব্যতীত অপর কোনো স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না।

“বিবাহিতা নারীগণও বাজিকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাশাওলি স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেঁচকের মতও লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনি তত বেশি শরিফ। …

কষ্ট সহ্য করিতে না পারিলে আর অবরোধবাসিনীর বাহাদুরি কী?” (ভূমিকা)

দৈনন্দিন জীবন থেকে বেছে, সাতচল্লিশটি গল্প গেঁথে পর্দাপ্রথা ও মেয়েদের গৃহে অন্তরীণ রাখার বিরুদ্ধে রোকেয়া লিখেছিলেন ‘অবরোধ বাসিনী।’ নিজের মায়ের জীবনসত্য মনে রেখে এই একটি বই রোকেয়া মা’কে উৎসর্গ করে গেছেন। এই বিশেষ মহিলার উদ্দেশ্যে ‘অবরোধ বাসিনী’ উৎসর্গের অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধে হয় না।

আলি সাবেরের পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার পরিধি ছিল কোরান পড়া আর সভ্যসমাজের ‘এটিকেট’ শেখা অবধি। রোকেয়ার ভাইয়েরা উচ্চশিক্ষার যে পর্যাপ্ত সুযোগ পেয়েছিল তাতে মেয়েদেরও যে অধিকার আছে, তা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। অবশ্য এর মধ্যে তদানীন্তন ঔপনিবেশিক সরকারের সিদ্ধান্তও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সেই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু মুষ্টিমেয় শিক্ষিত বাঙালি তৈরি করা যারা ইংরেজের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের গুণগান গাইবে। ইংরেজি ভাষা এবং আদবকায়দা গ্রহণ করে এরা দেশের জনগণকে শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল প্রধানত হিন্দু পুরুষকে। মেয়েদের বা সংখ্যালঘুদের জন্যে কোনো নির্দিষ্ট স্থান এই ছকে ছিল না বললেই চলে। ফলে অবহেলিত, স্বল্পশিক্ষিত মুসলমান সমাজ ডুবে গিয়েছিল কুসংস্কারের অন্ধকারে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মুসলমান মহিলা সমাজ। অর্থাৎ রোকেয়া জন্মেছিলেন তিনটি প্রতিবন্ধকতা নিয়ে – ধর্ম, লিঙ্গ, ও পরাধীনতা।

সেই সময়ে অভিজাত পরিবারের সংস্কৃতি অনুযায়ী উর্দু ও আরবি ছাড়া রোকেয়া অন্য কোনো ভাষা শেখেননি। বাড়িতেও নিয়ম ছিল উর্দুতে কথা বলা। বাংলা ভাষায় তাঁর হাতেখড়ি বড়দি কারিমুন্নেসার কাছে। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কারিমুন্নেসা বাংলা শিখেছিলেন। সেই সাহসিকতার পুরষ্কার হিসেবে তাঁকে কিশোরী বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এর পর খোলাখুলি বাংলা পড়তে শিশু রোকেয়া আর সাহস করেননি ঠিকই, কিন্তু অযৌক্তিক প্রাচীন নিয়ম অনুসরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে আরও সচেতন হয়েছিলেন। লুকিয়ে বাংলা পড়া তিনি বন্ধ করেননি। তবে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন আর এক সহোদর – বড় ভাই ইব্রাহিম। এঁর কাছেই রোকেয়া গোপনে ইংরেজি শেখেন।

কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার স্কুলের ছাত্র, ইব্রাহিম, ছোটো বোন রোকেয়াকে ইংরেজি শিক্ষায় উৎসাহ দিতে বলেছিলেন ‘এই ভাষা শিখলে গোটা পৃথিবীর সব ধনরত্ন তোমার কাছে খুলে যাবে। কিন্তু সে শিক্ষা ছিল মেয়েদের জন্যে নিষিদ্ধ। তাই রাতে, বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর, আরম্ভ হত ভাইয়ের কাছে বোনের ইংরেজি শিক্ষা। যতদূর জানা যায়, বাড়ির অন্য কেউ রোকেয়ার বাংলা এবং ইংরেজি শেখার খবর জানতে পারেনি।

এই ভাইয়েরই মধ্যস্থতায়, মাত্র ষোল বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে দেওয়া হয় বয়সে অনেক বড়, বিপত্নীক, খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। ছোটোবোনকে আলোকপ্রাপ্ত করতে উৎসাহী ইব্রাহিম কেন এত কম বয়সে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। আমার ধারণা ইব্রাহিম আশা করেছিলেন রোকেয়ার শিক্ষার পথে প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন সৈয়দ হোসেন কাঁটা হবেন না। অন্য কোনো সংসারে বোনের বিয়ে হলে সেই সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর সেই আশা পূর্ণ হয়েছিল।

বিয়ের পরে স্বামীর ঘর করতে রোকেয়াকে চলে যেতে হয় বিহারের ভাগলপুরে। স্ত্রীর পড়াশোনায় উৎসাহ দেখে সাখাওয়াত হোসেন তাঁর জন্যে বাড়িতে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার বইপত্র এনে দেন। সেই সঙ্গে পর্দার কড়া নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে একই শ্রেণীর হিন্দু ও ক্রিশ্চান মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেও স্ত্রীকে অনুপ্রাণিত করেন। রোকেয়াকে কোনো বিশেষ সুবিধে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না – দরকার ছিল শুধু পথের বাধা সরিয়ে দেওয়ার। তা অবশ্যই সাখাওয়াত হোসেন করেছিলেন। শুধু পড়াশোনা নয়, পত্র-পত্রিকায় লিখতেও তিনি রোকেয়াকে প্রেরণা দিয়েছিলেন। শিক্ষার জোরে রোকেয়া কেবলমাত্র নিজেকেই এগিয়ে নিয়ে গেলেন না, এই সময় থেকে নিজের কলমের জোরে পুরুষপ্রধান সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা আনার কাজে আগুয়ান হলেন।

সজাগ মন, সচল কলম

সাহিত্যের জগতে রোকেয়ার প্রথম পদক্ষেপ নবপ্রভা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পিপাসা’ (১৯০২) প্রবন্ধের মাধ্যমে। এর পর থেকে জীবনের বহু শোক, ঘাতপ্রতিঘাতেও তাঁর লেখনি আর বন্ধ হয়নি। রোকেয়ার প্রতিটি রচনার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা, নারীস্বাধীনতা, ও নারীমুক্তির সপক্ষে যুক্তিতর্ক। যুক্তিতর্ক বলছি কারণ ওঁর লেখায় কোনো আর্তি বা অনুনয় নেই, আছে নারীবাদের দাবি। রোকেয়ার বক্তব্য, নারীকে তার ন্যায্য মানবাধিকার দিতে সমাজ দায়বদ্ধ।

১৯০৪ এবং ১৯২২ সালে রোকেয়ার নারীবাদী চিন্তাভাবনার বাহক হয়ে প্রকাশ পেল দুটি প্রবন্ধ সংকলন – ‘মতিচূর’ ১ ও ২। মতিচূর ১-এ রয়েছে ‘স্ত্রীজাতির অবনতি,’ ‘অর্ধাঙ্গিনী,’ এবং ‘গৃহ,’ ইত্যাদি প্রবন্ধ, আর মতিচূর ২-এ স্থান পেয়েছে ‘সৌরজগত,’ ‘জ্ঞানফল,’ ‘নারীসৃষ্টি,’ ‘মুক্তিফল,’ ‘ডেলিসিয়া হত্যা,’ ইত্যাদি রচনা। অনেক সময় শ্লেষ, রূপক, এবং রূপকথার আঙ্গিকে নারীর সামাজিক অবস্থান ও সমানাধিকার নিয়ে প্রবন্ধগুলি তিনি লিখেছেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী-অবদমন যে প্রতারণারই নামান্তর, এই দুই সংকলনের রচনায় রোকেয়া তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।

দেশের রক্ষণশীল সমাজকে নারীমুক্তির স্বপক্ষে আনতে রোকেয়া যুক্তি দিয়েছেন, শিক্ষা শুধু মহিলাদের ব্যক্তিগত উন্নতি ঘটাবে না, সন্তান এবং সংসারকেও সমৃদ্ধ করবে। পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ নারীর স্বাধীনতা ও সামগ্রিক বিকাশ কী ভয়ঙ্করভাবে খর্ব করছে নিজের লেখায় রোকেয়া সেই আলোচনা বারবার করেছেন। মুসলমান সমাজকে জাগিয়ে তুলতে এই সময়েই তিনি কোরানে সমর্থিত নারীর অধিকার ও নারীবাদী ব্যাখ্যা নিয়ে জনসমক্ষে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেন।[iii] কোরানের নির্দেশ অনুধাবন করতে আলোচনা ও বিশ্লেষণকে (ইজতিহাদ) রোকেয়া বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।[iv]

পরনির্ভরতা ভাঙতে হলে নারীকে যে আর্থিক স্বাধীনতা পেতে হবে সে সম্বন্ধে রোকেয়া নিশ্চিত ছিলেন। ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৬) রচনায় তিনি মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ওপর জোর দিয়েছেন। এছাড়া ‘পদ্মরাগে’ রয়েছে দুনিয়াব্যাপী নারীবাদী আন্দোলন সৃষ্টির সম্ভাবনা। যদিও ‘অবরোধ বাসিনী’ ও ‘পদ্মরাগ,’ দুটি বইই মেয়েদের জীবন নিয়ে লেখা, প্রথমটি তথ্যভিত্তিক আর দ্বিতীয়টি কল্পকাহিনী। ‘পদ্মরাগে’ রোকেয়া সৃষ্টি করেছেন সংসারচ্যুত বিধবা এবং নির্যাতিত মহিলাদের জন্যে একটি আবাসন – ‘তারিণী ভবন।’ সেখানে রয়েছে মেয়েদের স্কুল ও বিধবাদের আবাস, আর স্থাপিত হয়েছে ‘নারী ক্লেশ নিবারণী সমিতি।’ তারিণী ভবনে বাস করে বিভিন্ন শ্রেণী, সংস্কৃতি, ও পটভূমির মহিলারা। একই সঙ্গে পাশাপাশি থাকে বিভিন্ন ধর্মের নারী। এমনকি ইংরেজ নারীও এই ভবনে বাস করে। আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন হলেও সে স্বাবলম্বী নয়, কারণ তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে পুরুষ-গঠিত আইনি ব্যবস্থা।

পরিবারে অত্যাচারিত মহিলাদের জন্যে নিরাপদ আশ্রয় স্থাপনের অনন্য ভাবনা বোধহয় প্রথম রোকেয়ারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ‘পদ্মরাগ’ প্রকাশের প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে, ১৯৭১ সালে, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্যে প্রথম ‘শেল্টার’ পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশে এখনও এই ব্যবস্থা তেমন ছড়িয়ে পড়েনি। এমন প্রগতিশীল চিন্তা রোকেয়া আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়।

শুধু পুরুষপ্রাধান্য নয়, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধেও রোকেয়া প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন তাঁর রচনায়। নারীর জীবনে শিক্ষার আলোককে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, দুইয়েরই প্রয়োজন আশু। ‘পদ্মরাগে’ জাতির স্বাধীনতা এবং নারীমুক্তিকে তিনি একই আসনে বসিয়েছেন; বলেছেন জাতি-শ্রেণী-ধর্ম নির্বিশেষে ভারতে সঙ্গবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব। ব্রিটিশ প্রভাবের গণ্ডী থেকে শিক্ষাব্যবস্থা সরিয়ে না আনলে ভারতবাসী যে নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস ফিরে পাবে না তা তিনি উপলব্ধি করছিলেন। তাঁর মতানুসারে, ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ শিক্ষা ঠিক প্রযোজ্য নয়; ভারতকে নিজের সংস্কৃতি অনুসারে পাঠ্যক্রম গড়তে হবে। রোকেয়ার লেখা ‘জ্ঞানফল,’ ও ‘মুক্তিফল,’ দুটি গল্পই ইংরেজ রাজত্বের বিধ্বংসী ফল এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের উন্মেষ নিয়ে লেখা। তবে তিনি ছিলেন কট্টর যুদ্ধবিরোধী।

এত বিশিষ্ট লেখার মধ্যেও রোকেয়ার একটি লেখা জগতে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত, ইংরেজিতে লেখা বড় গল্প, ‘সুলতানা’স ড্রিম’ রোকেয়ার শ্রেষ্ঠ কীর্তি।[v] ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ান নভেলা হিসেবে বইটি এখন পৃথিবীজুড়ে স্বীকৃত। বইটি শুধু আধুনিক নারীবাদী চিন্তার নিদর্শন নয়, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যেও যুগান্তকারী। ‘সুলতানা’স ড্রিম’ প্রকাশের আরও দশ বছর পরে, কল্পনাবিজ্ঞানে নারীবাদী ইউটোপিয়া রচনা করেছেন আমেরিকার সাহিত্যিক শার্লট পর্কিন্স গিলম্যান তাঁর ‘হারল্যান্ড’ উপন্যাসে। গিলম্যানের ‘হারল্যান্ড’ জগতে পুরুষ জাতি নেই। প্রজনন হয় ডিম্বাণুর মাধ্যমে।[vi] বিপরীতে রোকেয়া পৃথিবী থেকে পুরুষকে একেবারে সরিয়ে দেননি, কিন্তু মানবজাতির জীবনে তার ভূমিকা নগণ্য করে দিয়েছেন। তাদের কাজ সন্তান দেখভাল করা, সংসার সামলানো।

‘সুলতানা’স ড্রিম’-এর কেন্দ্রে রয়েছে কাল্পনিক রাজ্য ‘লেডিল্যান্ড।’ সেখানে পুরুষ শক্তিহীন, ক্লীব, অকর্মণ্য। সে পর্দানশীন, ‘মর্দানা’তে আবদ্ধ – নারী সমাজের অধিকর্তা। পুরুষ গৃহে বন্ধ থাকার ফলে সমাজে পুরুষতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, নারী পৃথিবীকে লালন করছে সযত্নে। নারী বুদ্ধিমতী, কর্মক্ষম, উদ্ভাবক। লেডিল্যান্ডে নারীকে পর্দার আড়ালে রাখার প্রস্তাব অবাস্তব এবং হাস্যকর। লেডিল্যান্ড চলে আইন-শৃঙ্খলার সুষ্ঠু নিয়মে, মানুষের মধ্যে হিংসা-দ্বেষ, অপরাধ-প্রবণতা, বিকৃত দুর্নীতি নেই। শিশুবিবাহ বন্ধ হয়েছে,[vii] নারীশিক্ষার প্রসার ঘটেছে। লেডিল্যান্ডের অধিবাসীরা অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করে না। অপরাধহীন রাজ্যে মানুষের ধর্ম প্রেম, ও সত্য। তাদের লক্ষ্য জীবের মঙ্গল, মানব-উন্নতি। সবচেয়ে সম্মানীত বৈশিষ্ট্য হল টাকা নয়, মানুষের মনের শুদ্ধতা ও পবিত্রতা।

লেডিল্যান্ডে নারী অবাধে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে উদ্ভাবন করে, সেই আবিষ্কার জনগণের কাজে লাগায়। সৌরশক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে প্রযুক্তির সাহায্যে লেডিল্যান্ডে চাষ হয়, ঘরে ঘরে রান্নার উনুন জ্বলে। যে সময়ে রোকেয়া বাস্তবে শুধুমাত্র ঘোড়া ও গরুর গাড়ি দেখেছেন, সে সময়েই কল্পনা করেছেন হাইড্রোজেন গোলকে ভর করে চলা উড়ন্ত গাড়ি। লেডিল্যান্ডের অধিবাসীরা মেঘের গহ্বর থেকে নিষ্কাশিত বৃষ্টির জলে ক্ষেত সেচ করে; দেশ থেকে খরা বা বন্যার সম্ভাবনা চিরদিনের মত মিলিয়ে গেছে। সমাজে অপরাধ নেই, তাই বন্দিও নেই। প্রকৃতি-দূষণের জায়গায় নারী নিয়ে এসেছে প্রকৃতি-পালন। ধনতান্ত্রিক প্রথা উঠে যাবার পর থেকে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা এসেছে। লেডিল্যান্ডের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা শিশুমৃত্যু, মহামারী, এবং অন্যান্য ছোটোখাটো অসুখবিসুখও রোধ করতে পেরেছেন। এমনকী মশার কামড়ও আর মানুষকে উত্যক্ত করে না।

লেডিল্যান্ডে দৈনিক মাত্র দু’ঘণ্টা কাজ করলেই মানুষের জীবন ভালোমত কেটে যায়। মহিলারা তাই করে। লেখিকার মতে এই দু’ঘণ্টা কাজ পুরুষের আট ঘণ্টা কাজেরই সমান। ‘পুরুষ সত্যিকারের কাজ করত দু’ঘণ্টা, বাকি ছ’ঘণ্টা করত অকাজ।’ পুরুষের মত যুদ্ধ, লোভ, পরশ্রীকাতরতায় সময় নষ্ট হয় না বলে মহিলারা পৃথিবীর জন্যে মঙ্গলময় কাজ করার সময় পায়।

বস্তুত, লেডিল্যান্ডে রোকেয়া নারী পুরুষের সামাজিক ভূমিকার প্রতিবর্তন ঘটিয়েছেন। পুরুষের চরিত্র বর্ণনা করে লেখিকা লিখেছেনঃ

পুরুষের নৈতিক জীবন অনেকটা হীন বলিয়া আমরা তাহাদের সহিত কোনোপ্রকার কারবার করিতে ইচ্ছুক নহি। আমরা অপরের জমিজমার প্রতি লোভ করিয়া দুই-দশ বিঘা ভূমির জন্য রক্তপাত করি না, অথবা একখণ্ড হীরকের জন্যও যুদ্ধ করি না – যদ্যপি তাহা কোহেনুর অপেক্ষা শতগুণ শ্রেষ্ঠ হয়, কিংবা কাহারও ময়ূরসিংহাসন দর্শনেও হিংসা করি না। আমরা অতল জ্ঞানসাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি। প্রকৃতি মানবের জন্য তাহার অক্ষয় ভাণ্ডারে যে অমূল্য রত্নরাজি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে আমরা তাহাই ভোগ করি। তাহাতেই আমরা সন্তুষ্টচিত্তে জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ দিই। (রোকেয়া, “সুলতানার স্বপ্ন”)” [viii]

নারীর সামাজিক পরিস্থিতির জন্যে রোকেয়া পুরুষকে সম্পূর্ণ দায়ী করেননি। পুরুষের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে অসহিষ্ণু ভাষা ব্যবহার করেননি। মনে করেছেন নারীকে অবরুদ্ধ করে পুরুষ নিজের হঠকারিতারই পরিচয় দিয়েছে। তবে প্রতিরোধ না করে নারী নিজেদের শোষকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। নারী আত্মবিস্মৃত। শিক্ষা ও নিজের মানসিক উন্নতির জন্যে চেষ্টা না করে মহিলারা সাজগোজ আর খেলো বিনোদনে ব্যস্ত হয়ে থাকে। ফলে নিজের বন্দিত্বে নিজেই শামিল হয়। মহিলাদের অলঙ্কারপ্রিয়তার কঠিন সমালোচনা করে রোকেয়া লিখেছেনঃ

“…আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি – এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ! এখন ইহা সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন (originally badges of slavery) ছিল। তাই দেখা যায় কারগারে বন্দীগণ পায় লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা [পরি] আদরের জিনিষ হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্ম্মিত চুড়ি! বলা বাহুল্য, লোহার বালাও বাদ দেওয়া হয় না! কুকুরের গলে যে গলাবন্ধ (dogcollar) দেখি, উহারই অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক নির্ম্মিত হইযাছে!… এই অলঙ্কারের জন্য ললনাকুলের কত আগ্রহ! যেন জীবনের সুখ সমৃদ্ধি উহারই উপর নির্ভর করে! তাই দরিদ্রা! (বানান অপরিবর্তিত।)” [ix]

১৯৩২ সালের ন’ই ডিসেম্বর, জন্মদিনের দিন, মাত্র ৫২ বছর বয়সে রোকেয়া মারা যান। মৃত্যুর সময় উনি রেখে যান ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ।

“বিদ্যার সাগর তুমি…”

নারীমুক্তি সংগ্রামে রোকেয়ার হাতিয়ার ছিল বিদ্যাশিক্ষা। তিনি বুঝেছিলেন স্বাধীন হতে চাইলে ভারতীয় নারীকে প্রথমে তৈরি হতে হবে। সেজন্যে চাই শিক্ষা। স্বামীর মৃত্যুর পর, ১৯০৯ সালে রোকেয়া মেয়েদের জন্যে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করেন ভাগলপুরে। স্বামী, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন, মৃত্যুর সময়ে, রোকেয়ার বিদ্যোৎসাহের পাথেয় রেখে গিয়েছিলেন ১০,০০০ টাকা। প্রধানত মুসলমান মেয়েদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের নাম রোকেয়া রেখেছিলেন মৃত স্বামীর স্মরণে – তাই স্কুলের নাম সাখাওয়াত মেমোরিয়াল।

পারিবারিক গোলমালের জন্যে এক বছরের মধ্যে ভাগলপুরের স্কুলটি বন্ধ করে দিয়ে ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ, রোকেয়া কলকাতায় নতুন করে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল খুললেন। প্রায় ঘরে ঘরে ভিক্ষে করে আটজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি আরম্ভ হয়। ১৯১১ সালের আট, ১৯১৫য় বেড়ে হয় ৮৪। ১৯১৬ সালের মধ্যে রোকেয়ার স্কুল সরকার ও সমাজের স্বীকৃতি পেয়ে পুষ্ট হতে আরম্ভ করল। ১৯৩০ সালে সাখাওয়াত স্কুল পরিণত হল উচ্চ বিদ্যালয়ে। তাই মনে হয়, সাখাওয়াত স্কুল পরিবারের জন্যে ১৬ই মার্চই হল সরস্বতী পুজোর দিন।

সে সময়ে প্রগতিশীল হিন্দু মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ ছিল শুধু সুগৃহিণী হবার শিক্ষা।[x] রোকেয়া বিজ্ঞান ও সামাজিক ক্ষমতার মধ্যে সম্পর্ক উপলব্ধি করে বলেছিলেন ছেলে এবং মেয়েদের পাঠক্রমে কোনো পার্থক্য থাকা উচিত নয়। সেই ভাবনা থেকে সাখাওয়াত স্কুলে সাহিত্য ও গৃহবিজ্ঞানের পাশাপাশি রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, স্বাস্থ্য, ব্যায়াম, অঙ্ক, পুষ্টি, আঁকা, এবং জিমন্যাস্টিকস শেখানো হত। মেয়েদের পাঠ্যক্রম ছেলেদের থেকে অভিন্ন রেখেছেন বলে নারীশিক্ষার উৎসাহী সমর্থকেরাও তখন সাখাওয়াত স্কুলের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন। সেই সময়ের কৃতী বাঙালিদের মধ্যেও রোকেয়ার কর্মকাণ্ড বিশেষ স্বীকৃতি পায়নি। এর একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিজীবনের মধ্যাহ্নে রোকেয়া নিজের কাজ আরম্ভ করলেও এই বাঙালি সূর্যের লেখায় তাঁর অস্তিত্ব বা ক্রিয়াকর্মের কোনো উল্লেখ আমরা পাই না। ঠিক তেমনি, রোকেয়ার রচনায় সমাজসংস্কারে তাঁর পূর্বসূরী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছায়াও পড়েনি।[xi]

মেয়েদের জন্যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই রোকেয়ার একমাত্র অবদান নয়। তাঁর আশা ছিল মুসলমান পরিবারের মেয়েরা গৃহস্থালির গণ্ডি আর পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে সমাজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থলে আসবে। তিনি জানতেন সেই জন্যে শুধু বিদ্যা নয়, চাই বৃহত্তর সমাজের ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করার ক্ষমতা। তাই ১৯১৬ সালে রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করলেন অঞ্জুমান-ই-খোয়াতিন-ই-ইসলাম নামে একটি মুসলমান নারী সংগঠন। গৃহবন্দি মেয়েরা একসঙ্গে গল্পগুজব করবে ভেবে ইসলামের সমাজপতিরা এতে খুব একটা বিচলিত হননি। আসলে এখানেই দেওয়া হত নারী-ক্ষমতায়নের প্রথম পাঠ। সমাজের সব শ্রেণীর মুসলমান মহিলারা এই প্রতিষ্ঠানে এক সঙ্গে মেলামেশা করতেন।

রোকেয়াকে নিয়ে এখন দেশবিদেশে চর্চা বাড়ছে। তাঁর লেখা, নারীশিক্ষা প্রসার, আর সাংগঠনিক কাজ খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে অনেক গবেষকই স্বীকার করেছেন, রোকেয়া তাঁর সমসাময়িক বুদ্ধিজীবী ও সমাজসংস্কারকদের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। অথচ বহু বছর রোকেয়া সম্পর্কে আমাদের সমাজ ও সাহিত্য নিশ্চুপ ছিল। এর একটি কারণ, হিন্দুপ্রধান দেশে পুরুষ সমাজসংস্কারকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নারীর অবস্থা নিয়েই চিন্তাকুল ছিলেন, মুসলমান নারীর সামাজিক অবস্থানের দিকে দৃষ্টি দেননি। বাংলার সাহিত্যজগতেও প্রাধান্য পেয়েছে পুরুষ এবং হিন্দু উচ্চবর্ণের লেখক। ভারতে নারীবাদী আন্দোলন মুসলমান সমাজ, বিশেষত মুসলমান মহিলাদের অবদানকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোকেয়ার অসাধারণ কীর্তি অবহেলার ধুলো মেখে প্রায় অদৃশ্য হয়েই ছিল। আমাদের স্কুলের নাম ছাড়া তাঁর অস্তিত্বই প্রায় অজ্ঞাত রয়ে গেছিল।

রোকেয়াকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছে তাঁর উত্তরসূরী, দেশবিদেশের নারীবাদীরা। এই অনন্যা নারীর জীবনী ও রচনা আমেরিকার বহু কলেজে এখন পাঠ্য। আমাদের দেশের পরবর্তী প্রজন্মের পাঠ্যক্রমে রোকেয়ার রচনা বাধ্যতামূলক করে আমরা অবশ্যই তাঁর অবদানের কিছুটা স্বীকৃতি দিতে পারি। পারি তাঁর অনুপ্রেরণায় লিঙ্গ-প্রভেদ মুছে ছেলে-মেয়েদের জীবন গড়তে।

পাদটীকা

[i]  ইদানীং রোকেয়ার সম্বন্ধে বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তারই কয়েকটির উল্লেখ এখানে করছিঃ Hasan, Md. M. (2013). Commemorating Rokeya Sakhawat Hossain and contextualising her work in the South Asian Muslim feminism. Asiatic, 7(2): 39; Hasan, Md. M. (2012). Marginalisation of Muslim writers in South Asian literature: Rokeya Sakhawat Hossain’s English works. South Asia Research, 32(3): 179-197; Quayum, Md. A., and Hasan, Md. M. (Eds.) (2017). A feminist foremother: Critical essays on Rokeya Sakhawat Hossain. Intellectual Discourse, 25 (2); Mahmud, R. (2016). Rokeya Sakhawat Hossain: Tireless fighter of female education and their independence – a textual analysis. International Journal on Studies in English Language and Literature, 4(9), 40-48; Zeena, Y. F. (2020, May 12). Rokeya Sakhawat Hossain’s 115-year-old feminist utopia. Critical Essays. Ploughshares at Emerson College. Available at:  http://blog.pshares.org/index.php/rokeya-sakhawat-hossains-115-year-old-feminist-utopia/#:~:text=%E2%80%9CSultana’s%20Dream%E2%80%9D%20was%20written%20in,English%20by%20an%20Indian%20woman; এবং “রোকেয়া-আলোকের দ্যুতি” (তথ্যচিত্র), (২০২০)।

পরিচালনাঃ মুজিবর রহমান। https://www.youtube.com/watch?v=oa7XlxjV-A4&feature=youtu.be&fbclid=IwAR2LoR_23XAjh4-VsW4T1ZY9h3Uacp_jEXfEz_cg6P6GSZcZURQrCqX8uMc

[ii] যদিও জন্মতারিখ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, ৯ই ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্মদিন হিসেবে স্বীকৃত। রোকেয়ার মৃত্যুদিনও ৯ই ডিসেম্বর।

[iii] নারীর দশটি অধিকার কোরানে স্বীকৃতঃ

(১) জীবনের অধিকার; (২) শিক্ষার অধিকার; (৩) বৃত্তি নির্বাচন করা এবং নিজের সম্পত্তি সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার; (৪) স্বামী নির্বাচনের অধিকার; (৫) বিবাহের সময় মেহের বা স্বামীর কাছ থেকে অর্থ/সম্পত্তি দাবী করার অধিকার। বিয়ের আগে আলোচনার মাধ্যমে নারী মেহেরের অঙ্ক স্থির করে নিতে পারে এবং তা নিকাহ্‌নামাতে নথিভুক্ত থাকে। মেহরের অর্ধেক বিয়ের সময় দেয়, ও বাকি অর্ধেক স্ত্রী নিজের ইচ্ছেমত দাবী করতে পারে; (৬) বিয়ের পরে নিজের বিবাহপূর্ব/কুমারী নাম বহাল রাখার অধিকার; (৭) বিয়ের পর বাপের বাড়ির সমতুল্য জীবনযাত্রার মান দাবী করার অধিকার; (৮) স্বামী ও পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার দাবি করার অধিকার; (৯) কিছু কিছু পরিস্থিতিতে বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার অধিকার; এবং (১০) ইচ্ছেপত্রে নিজের খুশিমত সম্পত্তি বিতরণের অধিকার। এছাড়াও রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী জগতে নারীকে পূর্ণ অধিকার দেওয়ার অঙ্গীকার কোরানে রয়েছে।

[iv] কোরান চর্চায় আলোচনা ও বিশ্লেষণকে বলা হয় ‘ইজতিহাদ।’ ইসলাম ধর্মচর্চায় গবেষণালব্ধ জ্ঞানের (ইজতিহাদ) ভূমিকা প্রমাণহীন বিশ্বাসের চেয়ে উচ্চতর।

[v]  ইংরেজি পড়তে অনভ্যস্ত পাঠকদের জন্যে রোকেয়া ‘সুলতানা’স ড্রিম’-এর বাংলা অনুবাদ, “সুলতানার স্বপ্ন,” ‘মতিচূর ২’-এর পাতায় রেখে গেছেন।

[vi] শুক্রাণু বিহীন শুধুমাত্র ডিম্বাণুর সাহায্যে প্রজননকে বলা হয় ‘পার্থেনোজেনেসিস।’ এতে শুধু কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়াই সম্ভব। অর্থাৎ কিছু সময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে পুরুষজাতি লোপ পাবে।

[vii] রোকেয়ার মতে নারীর বিবাহের নুন্যতম বয়স হওয়া উচিত একুশ।

[viii] একই পংক্তিগুলি ইংরেজিতে “Sultana’s Dream” থেকেঃ “Men, we find, are rather of lower morals and so we do not like dealing with them. We do not covet other people’s land, we do not fight for a piece of diamond though it may be a thousandfold brighter than the Kohinoor, nor do we grudge a ruler his Peacock Throne. We dive deep into the ocean of knowledge and try to find out the precious gems [that] Nature has kept in store for us. We enjoy Nature’s gifts as much as we can” (Rokeya Hossain).

[ix]  বেগম রোকেয়া। (মূল প্রকাশ ১৯০৪)। “স্ত্রীজাতির অবনতি।” মতিচূর। উইকিসংকলন। https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0_%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%BF

[x] সেই সময়ে বাংলা নবজাগরণের অন্যতম নায়ক কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ প্রগতিশীল শিক্ষাবিদেরা, ইংরেজি ফিনিশিং স্কুলের পাঠ্যক্রম অনুসারে নারীশিক্ষার গণ্ডী বেঁধে দিয়েছিলেন গৃহবিজ্ঞান, সেলাই, আঁকা, সঙ্গীত ইত্যাদি কমনীয় বিষয়ে। কেশবচন্দ্র সেনের মতে, ‘বি-এ এম-এ পাশের চেয়ে মেয়েদের প্রয়োজন ভালো গৃহিণী এবং মা হওয়ার শিক্ষা।’ কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরিয়া কলেজে এই বিষয়গুলিই ছাত্রীদের শেখানো হত।

[xi] এই উপেক্ষার কয়েকটি কারণ হয়তো ছিলঃ (১) রোকেয়ার কট্টর নারীবাদ তখনকার দিনের পুরুষপ্রধান বুদ্ধিজীবী সমাজ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি; (২) সংখ্যালঘু মুসলমান নারীসমাজের সমস্যা ও সংস্কার বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি; (৩) নিঃসন্দেহে রোকেয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল সমাজের ভিতে পরিবর্তন আনা, নিজের রচনাকে উনি সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেছেন। তাঁর লেখায় শিল্পের খাতিরে শিল্পচর্চা আমরা পাই না। ফলে বাঙালি লেখক মহল তাঁকে এক আসনে বসতে দেয়নি; এবং (৪) তখন হিন্দু এবং মুসলমান সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ কম ছিল।

শিক্ষক, গবেষক ও সমাজকর্মী। বিগত পাঁচ দশকের অধিককাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয় সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশিয় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অপরদিকে গোয়েন্দা গল্প রচনাতেও সুপটু। প্রথম উপন্যাস ‘দ্বন্দ্ব’ সানন্দা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। নিয়মিত লেখালেখি করে চলেছেন ‘সাপ্তাহিক বর্তমান,’ ‘সুখী গৃহকোণ,’ ও বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায়।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Pallab Kumar Chatterjee , January 24, 2021 @ 6:55 am

    এই রচনাটির খুব প্রয়োজন ছিল। মরাঠি চলচ্চিত্র আর বাংলা টেলিভিশনের দৌলতে স্ত্রী-শিক্ষা আন্দোলনে ডাঃ আনন্দীবাঈ যোশী ও ডাঃ কাদম্বিনী- দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা সম্বন্ধে এতদিনে আমরা জানতে পারছি। শমিতাদি ‘অচলায়তন’এর উত্তরের জানলা খুলে দিয়েছেন। এর ফলস্বরূপ যদি ‘মহাতামস’ নামে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় এই সমাজকে, তাও স্বীকার্য। রোকেয়ার অবদান আর জীবনদর্শন নিয়ে আরো চর্চা হোক এ দেশে, উন্মুক্ত হোক এক বিস্মৃতপ্রায় দিগন্ত।

    • Shamita Das Dasgupta , January 24, 2021 @ 12:57 pm

      অনেক ধন্যবাদ! রোকেয়ার চিন্তাধারা এত ভিন্ন, সময়ের এত আগে যে ওঁর মূল্যায়ন হয়নি। সেই কাজ এখন আরম্ভ হয়ছে। কিন্তু অনেক আরও হওয়া প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *