বেঁচে থাকবেন লেখক
কিছু কিছু ঘটনা এতই আকস্মিক যে, কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। নিজের চোখ-কানকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় যা দেখেছি বা শুনেছি তা ঠিক নয়। বিশিষ্ট লেখক সুজন দাশগুপ্তের মৃত্যু আমার কাছে এমনই একটা ঘটনা। মানুষটি যে শুধুই বড় লেখক ছিলেন তা নয়, এমন আদ্যোপান্ত ভালোমানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একই সঙ্গে একজন সুলেখক ও সুজনকে হারালাম। সাহিত্যের ক্ষতি হল; ক্ষতি হল তাঁদেরও যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে তাঁর কাছাকাছি এসেছিলেন।
সুজনবাবু ও তাঁর লেখিকা স্ত্রী শমীতা দাশ দাশগুপ্ত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকাবাসী। কিন্তু বাঙালিয়ানাকে এই পশ্চিমবঙ্গের অনেক উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বাঙালির চাইতে ঢের বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন ওঁরা। তার ছাপ পড়েছে বিদেশে জন্মানো মেয়ে এবং নাতি-নাতনির ওপর। মেয়ে সায়ন্তনী পেশায় চিকিৎসক, কিন্তু ইংরেজি ভাষার একজন বেস্টসেলার লেখক। তাঁর লেখায় বাংলার চিরন্তন লালকমল, নীলকমল, রাক্ষস-খোক্কসরা অনায়াসে ঢুকে পড়েছে। এমন একটি নিটোল পরিবার থেকে হঠাৎ একজনের চলে যাওয়াটা মস্ত বড় পারিবারিক ক্ষতি।
গত ছ’বছর ধরে লেখক হিসেবে সুজন দাশগুপ্তের জনপ্রিয়তা লাফিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। জনপ্রিয়তার মূলে আছে তাঁর ‘একেনবাবু সমগ্র’ সিরিজ। বাংলা রহস্য ও গোয়েন্দা সিরিজে একেনবাবু অনন্য। আর পাঁচজন গোয়েন্দার মতো লম্বা, স্বাস্থ্যবান, ধারালো চেহারার নন একেনবাবু। বরং তাঁকে দেখলে অনেকেই একটু নাক কোঁচকাবেন। একেনবাবুর বিশাল মাথা উসকোখুসকো চুলে ভর্তি। গায়ে নোংরা সাদা শার্ট, গায়ের কোটও দলামোচা করা। গলার স্বর ঘ্যানঘ্যানে। আর একটা মুদ্রাদোষ আছে, যে-কোনো কথার পিঠে ‘স্যার’ জোড়া। এই একেনবাবু আবার প্রায়ই বিরক্তিকর উলটোপালটা ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। কিন্তু পরে জানা যায়, এই লোকটি অসম্ভব বুদ্ধিমান, এবং খুন, রাহাজানি, অপরাধের কিনারা করতে এক নম্বরের ওস্তাদ। ওটিটি সিরিজ এবং চলচ্চিত্রে এসেই বাজার মাত করে দিয়েছেন একেনবাবু. ওদিকে তাল মিলিয়ে লেখক হয়ে উঠেছেন অসম্ভব জনপ্রিয়। অথচ এই একেনবাবু গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিলেন ন’য়ের দশকের গোড়ায়। একেনবাবুকে নিয়ে বইও বেরিয়েছিল তখন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে বই তখন তেমন কাটেনি। তিন দশক বাদে একেনবাবুর ‘পুনরাবিষ্কার’ করে কলেজ স্ট্রিটের এক নবীন প্রকাশনা সংস্থা ‘দ্য কাফে টেবল।’ এই সংস্থাটি খণ্ডাকারে ‘একেনবাবু সমগ্র’ বার করতে শুরু করে। এবং শুরুতেই বাজিমাত। নতুন ও পুরনো পাঠকদের ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছিল একেনবাবু। ‘একেনবাবু সমগ্র’র ষষ্ঠ খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছে এবারের কলকাতা বইমেলায়। মেলা শুরুর আগেই বইটি দেখে গেছেন সুজনবাবু। তবে শুধু গোয়েন্দা ও রহস্যকাহিনি নয়, নানা ধরনের গদ্য রচনাতেও পটু ছিলেন লেখক, লিখেছেনও দীর্ঘদিন ধরে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তাঁর বেশ কিছু ‘ব্যক্তিগত রচনা’র কথা। রসস্নিগ্ধ ওই লেখাগুলি পাঠককে আপ্লুত করে।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সুজনবাবু আমেরিকাবাসী আর এক লেখক সুমিত রায়ের সঙ্গে মিলিত ভাবে বাংলা ফন্ট আবিষ্কার করে অত্যন্ত উঁচু মানের একটি বাংলা ওয়েবজিন, ‘অবসর,’ বার করেন বহুদিন আগে। আনন্দের কথা, সেটি আজও চলছে ভাস্কর বসুর সম্পাদনায়।
আমরা আশা করব, সুজনবাবুর ছড়িয়ে থাকা লেখাগুলি খুব তাড়াতাড়ি গ্রন্থবদ্ধ হবে। এবং পাঠক ও সমালোচকরা তাঁর মূল্যায়ন করবেন নতুন ভাবে।
এই মার্চে কলকাতার ‘সুখী গৃহকোণ’ পত্রিকায় সুজন দাশগুপ্তের শেষ লেখা ‘হারানো ছবির রহস্য’ প্রকাশিত হয়েছে। পড়ব বলে সংগ্রহ করেছি। এই কাহিনিটি অবশ্য সুজনবাবুর একার লেখা নয়, সহলেখক হিসেবে সঙ্গে আছেন শমীতা দাশ দাশগুপ্ত। এটি একেনবাবুর গোয়েন্দাগিরির গল্প নয়, একেনবাবুর বদলে এখানে গোয়েন্দা হিসেবে এসেছে একটি নারী চরিত্র। শমীতা নিশ্চয়ই এই চরিত্রটিকে ভবিষ্যতে আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দেবেন। কিন্তু সে তো পরের কথা। সুজন দাশগুপ্তকে আমরা আর পাচ্ছি না।
‘পাচ্ছি না’—এই কথাটি মেনে নিতে এখনও কষ্ট হচ্ছে। এবারের কলকাতা-সফরে ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, হল না। উনি বরাবরের জন্য বিদায় নেওয়ার দিন দুয়েক আগে টেলিফোনে আধ ঘণ্টাটাক কথা হয়েছিল আমার সঙ্গে।সেটিই আমার শেষ স্মৃতি হয়ে রইল।
ভাস্কর একদিন আমাকে টেলিফোনে সুজনবাবুর অসুস্থতার কথা জানিয়েছিল। বলেছিল, অসুস্থ হয়ে কয়েকটা দিন নার্সিং হোমে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। খবরটা শুনে চমকে উঠেছিলাম। সে কি! ভাস্করের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পরেই ফোন করেছিলাম সুজনবাবুকে। ওঁর কণ্ঠস্বরে ছিল অতিপরিচিত সেই স্বাভাবিক উত্তাপ। বললেন, না-না তেমন কিছু নয়, কয়েকটা দিন নার্সিংহোমে কাটিয়ে এলাম—এই যা। এখন দিব্যি আছি। তারপর অসুখবিসুখ ছাড়া নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ। সেই সব কথার মধ্যে সাহিত্য ছিল অনেকখানি। ছিল নতুন বইয়ের প্রকাশ, আসন্ন বইমেলা, মেলায় দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার কথা ইত্যাদি ইত্যাদি।
দিন দুয়েক বাদে হঠাৎ এক ধাক্কা খেয়ে আঁতকে উঠেছিলাম আমি। দুপুরে স্নান করতে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণের জন্যে টিভি খুলে থাকি। সেদিনও খুলেছিলাম। খুলেই দেখি সুজন দাশগুপ্তের ছবি। সঙ্গে ক্যাপশন—একেনবাবুর স্রষ্টা সুজন দাশগুপ্ত প্রয়াত। আমার চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে আমার স্ত্রী শ্যামলী ছুটে এসেছিল। “কী ব্যাপার?” প্রশ্নের উত্তরে আমি টিভি স্ক্রিনের দিকে আঙুল তুলেছিলাম। সংবাদপাঠক তখনও সুজনবাবুর ছবিসমেত সুজনবাবুর আকস্মিক মৃত্যুর কথা বলে যাচ্ছিল।
আমেরিকা থেকে ওঁর মেয়ে সায়ন্তনীর আসার অপেক্ষায় সুজনবাবুর দেহ রেখে দেওয়া হয়েছিল পিস হাভেনে। শেষকৃত্যের দিন সকালেই সুজনবাবুদের কলকাতার ফ্ল্যাটে পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি। সায়ন্তনী এসেছিল ভোরবেলায়। ঘরের মেঝেয় শায়িত ছিল আমাদের অতিপ্রিয় মানুষটির মরদেহ। সেই শান্ত সুরসিক মানুষটি শুয়ে আছেন, ঠোঁটের কোনায় বুঝি একটুকরো হাসি লেগে আছে। মনে হচ্ছিল, হঠাৎই বুঝি মজাদার একটি মন্তব্য করে উঠে বসবেন।
ঘণ্টা দু-তিনেক বাদে ওখান থেকে আমরা শ্মশানে গেলাম। তারপর একসময় চুল্লির মধ্যে মরদেহ ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। দাহ শেষ হলে একটি মাটির সরাতে একটু ছাই তুলে দেওয়া হয়েছিল ওঁর এক আত্মীয়ের হাতে। ওই ছাই গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার জন্য। সুঠাম,সুন্দর মানুষটি এখন একমুঠো ছাইতে পরিণত হয়েছেন। আমাদের সবার পরিণতিই একদিন না একদিন এমন হবে। জানি, তবু প্রিয়জনের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি মানতে মন চায় না। একটি মানুষ কী ব্যাপক ভাবে ছিলেন, কিন্তু আর তাঁকে পাওয়া যাবে না। এই শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়।
ভাস্কর আমাদের আড্ডার জন্যে একটি দিন ঠিক করেছিল কলকাতা বইমেলায়। অনেক আগেই ঠিক করা হয়েছিল। সেই আড্ডায় মধ্যমণি হওয়ার কথা ছিল যাঁর, সেই সুজন দাশগুপ্তকে সেদিন মেলায় এসে আমরা নানা ভাবে স্মরণ করেছিলাম। অশ্রুসজল শমীতাও এসেছিল। তাঁর নিজের বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে একেনবাবু সমগ্রর ষষ্ঠ খণ্ডে, যেটি এবারের বইমেলায় প্রকাশিত, সই দিতে হয়েছিল।
লেখক চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি রয়ে যাবে। নতুন পাঠকরা পড়বেন, পুরনো পাঠকরা স্মৃতিচারণ করবেন। এটি একটি প্রবাহ। এবং এই প্রবাহে বেঁচে থাকবেন সুজন দাশগুপ্ত।
1 Comment