গণজীবনের একটি আদর্শ সংবিধান

গণজীবনের একটি আদর্শ সংবিধান

বইয়ের নামঃ ছোট্ট একটি ইসকুল
লেখকঃ দিলীপকুমার মিস্ত্রী
প্রকাশকঃ চারুপাঠ প্রকাশনী, কলকাতা

গল্প সংগ্রহ

সাহিত্য হল জনশিক্ষার অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। একটি আদর্শ জীবনদর্শনকে সমাজের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরাই একজন সাহিত‍্যিকের প্রধান কাজ। সত্যিকথা বলতে কী, একজন মানুষের জীবনে যা কিছু প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি থাকে, তাকে মানসচক্ষে দেখে, ক‍্যানভাসে তুলে ধরতেই লেখক কলম ধরেন। সেদিক থেকে বিচার করলে, লেখক একজন মরমীশিল্পীও। তাই এই সংকলনের প্রতিটি গল্পে লেখক চরিত্র, ঘটনা, এবং বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। প্রকৃত মানুষ গড়ার উদ্দেশ্যে একজন আদর্শ কারিগর হিসাবে গল্পকার দিলীপকুমার মিস্ত্রী অত্যন্ত যত্ন সহকারে ঔচিত‍্যবোধ, সহানুভূতি, মমতা, এবং সুগভীর আদর্শের দর্শনটি আমাদের উপহার দিয়েছেন তাঁর অনবদ্য শিশু-কিশোর গল্প সংকলন, ‘ছোট্ট একটি ইসকুল’ গ্রন্থে।

দিলীপকুমার মিস্ত্রী একজন শিক্ষক। দীর্ঘসময় ছাত্রছাত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গভাবে মিশে তিনি যে অমূল্য-দূর্লভ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তারই পূর্ণ রূপায়ণ ঘটেছে তাঁর ‘ছোট্ট একটি ইসকুল’ গল্পগ্রন্থে। শব্দচয়ন এবং তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন কৃত্রিমতার ছাপ কখনও চোখে পড়েনি। সবটাই তাঁর খুব কাছে থেকে দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা, যা তিনি প্রকাশ করেছেন গল্পের মাধ্যমে।

একজন বয়স্ক মানুষের পক্ষে  শিশু মনস্তত্ত্বকে অনুভব করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথা কঠিন কাজ। নিজেকে ছোটদের মাঝে বিলিয়ে এবং মিলিয়ে দিতে না পারলে, সেটি কখনও সম্ভব নয় এবং এমন সাহিত্য রচনা অসম্ভব বলেই আমি মনে করি। এক্ষেত্রে লেখক সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছেন নিশ্চিতরূপে বলা যায়। সেজন‍্যই পাঠকদের কাছে গল্পগুলো কোথাও কষ্টকল্পিত মনে হয়নি। প্রাণবন্ত গল্পগুলো, মাটির কাছাকাছি ঘোরাফেরা করতে করতে খুব সহজেই সব বয়েসের পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছে। প্রত‍্যেকটি গল্পের চরিত্রগুলো শিশু কিশোরদের গণ্ডি পেরিয়ে, গোধূলিবেলায় পূর্ণ ব‍্যক্তিত্বে গিয়ে মিশেছে।

লেখক কঠিন বাস্তববোধের কষ্টিপাথরে ঘষে-মেজে একটি আদর্শ ইসকুলের পরিবেশ গড়ে তুলেছেন এই গ্রন্থে। তাই গল্প সংকলনটির নামকরণ একটু অভিনব মনে হলেও যথার্থ।

‘A school is a society in miniature’ এই সমাজবোধ সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এই সংকলনটিতে। সে কারণেই, প্রতিটি কাহিনীর মধ‍্যেই অবধারিতভাবে এসেছে প্রকৃতি, জীবজন্তু, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষের প্রতি নিবিড়, প্রাণবন্ত ভালোবাসা ও তাকে রক্ষা করার অভিনব কৌশল, এবং সুন্দর বার্তা। সংকলনে মোট তেরোটি ছোটগল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পে লেখক নান্দনিক পাঠের নিবিড় আমন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে শিশু কিশোরদের কাছে নীতিশিক্ষার বিষয়টিকে সযতনে মেলে ধরেছেন।

প্রথম গল্প ‘কল্ল আর তার মোরগ বন্ধু।’ গল্পের নায়ক কল্লর ভেতর দিয়ে লেখক প্রাঞ্জল ভাষায় যেভাবে একটি বন্ধু-মোরগের প্রাণ বাঁচাতে এক বালকের গভীর ভালোবাসা ও মমতাকে উজাড় করে তুলে ধরেছেন, তা সত্যিই অনবদ্য। এক অসাধারণ মুন্সিয়ানায় বন্ধুত্বের যে চিত্রনাট্য গল্পকার এই গল্পে এঁকেছেন, তাতে তাঁর শৈল্পিক দক্ষতাটি সহজেই পাঠকের কাছে ধরা দিয়েছে।

কথায় বলে, যে মানুষ ফুল ও শিশুকে ভালোবাসে না, সে হৃদয়হীন মানুষ। তাকে মানুষ বলাও ঠিক হবে না। ফুলবাগানের সামনে কিছু সময় দাঁড়ালে যে কোনো মানুষেরই মনটা খুব হালকা হয়ে যায়, শান্ত হয়ে যায়। অপরাধবোধ যেন পালিয়ে বাঁচে। এই সত‍্যটিকে গল্পকার বাস্তব রূপে তুলে ধরেছেন তাঁর সংকলনের ‘বসন্তপুরের পণ্ডিত স‍্যার’ গল্পে। পণ্ডিত স‍্যার অনাথবন্ধু বিদ‍্যারত্নের ভেতর দিয়ে গল্পকার দেখিয়েছেন, কীভাবে গাছকে ভালবাসতে হয়। কীভাবে ছাত্রজীবন থেকেই বাগান করার সহজ পাঠ নিতে হয়। সেই সঙ্গে তিনি খুব সহজভাবে ছাত্রদলের কাছে এই বার্তাটিও দিয়েছেন- প্রকৃতির সম্পদ মাটি, গাছ, ফুল-ফল, পশু-পাখি, জীবজন্তু – এই সবকিছুকেই বাঁচিয়ে রাখতে ছাত্রজীবন থেকে সবাইকে সচেতন ও যত্নবান হতে হবে।

 ‘বন্ধুর মতো বন্ধু’ গল্পে লেখক দুটি টিয়া পাখির সঙ্গে দুই বোন দিয়া ও প্রিয়ার যে বন্ধুত্বের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন, তা সত্যিই বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজের এক দুর্লভ ও বিরলতম চিত্র। শুধুমাত্র ভালোবাসা রক্ষায় দুই বোন তাদের খাঁচায় পোষা বন্ধু টিয়াদের যেভাবে মুক্তি দিল, তা সত্যিই সহজে মন ছুঁয়ে যায়। এক অনবদ্য মিষ্টি মধুর আবেদন। পাশাপাশি, আকাশে উড়ে যাওয়ার আগে টিয়াদের দিয়ে যাওয়া প্রতিশ্রুতি, মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে তাদের ফিরে আসা – এও এক অকল্পনীয় চিত্রকল্প উপস্থাপনা। গল্পের শেষে, দুই বন্ধুর জন্য টিয়াদের ভালোবাসার উপহার হিসেবে দিয়ে যাওয়া পেয়ারা দুটি যেন হয়ে উঠেছিল স্বর্গীয় দুটি দান।

সংকলনের আর একটি অনবদ্য গল্প ‘হরিপুরের জেদি ছেলে।’ একটি ছেলে কেবলমাত্র পড়াশোনা ভালো না লাগার কারণে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হল। কিন্তু ছাপাখানায় সামান্য মাইনের চাকরি করেও সে তার প্রিয়, ভালোবাসার বিষয়টিকে লালন করে যেতে লাগল সযত্নে। একদিন এই ছেলেটিই বিখ্যাত লেখক হয়ে শুধুমাত্র তার পরিবারের নয়, সমগ্র গ্রামের প্রধান হয়ে উঠেছিল। তাঁর আদর্শবাদী শিক্ষক-পিতাও একদিন প্রকাশ‍্য সভায় ঘোষণা করতে বাধ্য হল – দুর্জয় মল্লর মতো জেদ এবং সততা ছাত্রজীবনে প্রত‍্যেকের মধ্যে জেগে উঠলে তাদের ভালোই হবে। এতে সমাজেরও মঙ্গল হবে। গল্পটি পড়তে পড়তে আমার বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিমল মিত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আর মনে পড়ছিল, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ক‍্যাপটিভ লেডি’ জনপ্রিয় হওয়া রাজনারায়ণের চরিত্রটি। তা যেন আবার নতুন করে এই গল্পের মাঝে তুলে ধরেছেন লেখক।

গ্রামীণ প্রতিভাকে এক অনন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে লেখক তাঁর ‘ছোট্ট একটি ইসকুল’ গল্পে বিষয়টিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, গ্রামের বৃদ্ধ যাত্রামোদি সনাতন মাঝিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দিয়ে। সেইসঙ্গে অত‍্যন্ত পিছিয়ে পড়া একটি গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখি করতে এই গল্পের ক‍্যানভাসটি একটি আন্তর্জাতিক দর্পণ হওয়ার দাবি রাখে বৈকি! এই গল্পের নামটি সংকলনের প্রচ্ছদে হাজির হয়ে গ্রন্থটির আকর্ষণ ও গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।

এই সংকলনের প্রতিটি গল্পই সমাজ শিক্ষার এক একটি দর্পণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি গল্পের পরতে পরতে রয়েছে লোকহিত সাহিত্যের অনন্য উপাদানগুলি। এমনই একটি গল্প ‘ডাক্তারবাবু।’ সমাজের অন‍্যতম সেবক এবং সম্মানীয় মুখ ডাক্তারবাবুও যে অনেকক্ষেত্রে তাঁর মহান দায়িত্ব এবং কর্তব্যকে ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র অর্থের পিছনে ছুটে বেড়ান, সেটা এই গল্পে লেখক সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি, সাধারণ মানুষ যে সেই ডাক্তারবাবুকে আজও দেবতার মতো শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে; সে ছবিও লেখক অতি সহজভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর এই গল্পে।

আমার মনে হয়, এই গ্রন্থের দু’টি মহামূল্যবান গল্প হচ্ছে- ‘গল্প শুধু গল্প নয়’ এবং ‘সোহমের কাণ্ড।’ গল্প দু’টি বর্তমান আন্তর্জাতিক সমস‍্যাকে তুলে ধরার এক শক্তিশালী হাতিয়ার বটে। পরিবেশ রক্ষা নিয়ে ইদানিং রাষ্ট্রসংঘ যে দুশ্চিন্তা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সেকথাই উচ্চারিত হয়েছে ‘গল্প শুধু গল্প নয়’ গল্পটিতে। এই সুন্দর প্রকৃতি,পরিবেশ ধ্বংসের জন্য মানুষই যে প্রধানত দায়ি, সে কথা গল্পকার কোনো রাখঢাক না করেই তুলে ধরেছেন। অথচ কাউকে কোনোভাবে আঘাত করেননি তিনি। ‘সোহমের কাণ্ড’ গল্পটিতেও রাষ্ট্রসংঘ, ইউনিসেফ, হু-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্বেগকে কতো সহজভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই গল্প দুটি ছোটোদের সঙ্গে সঙ্গে বড়োদের চোখে আঙুল দিয়েও বুঝিয়ে দিতে সক্ষম এক অখণ্ড লোকশিক্ষার উপাদান –  ‘নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনো না’।

সংকলনের অন‍্যান‍্য গল্পগুলি – ‘ভালোবাসার পুরস্কার,’ ‘অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক,’ ‘হাতে খড়ি’ – কোনো গল্পকেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। প্রত‍্যেকটি গল্পই আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও  আলোচনা করলে ভালো হত, কিন্তু স্থানাভাবের জন্যে তা সম্ভব হলনা।

‘একটি অদ্ভুত ভূতের গল্প,’ ‘ন‍্যাসটি সিরিয়াসনেস’- গল্প দুটি অতি সাধারণচালে লেখা হলেও, এর ভেতরেও রয়েছে লোকশিক্ষার এক তীক্ষ্ম, তীব্র পথনির্দেশ। গল্পের ছলে, এতো সহজে ছোটদের মধ্যে বোধশিক্ষাকে যে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা গল্পকার দিলীপকুমার মিস্ত্রী’র শিশু কিশোর গল্প সংকলন ‘ছোট্ট একটি ইসকুল’ একটিবার না পড়লে, অনুভব করতে কষ্ট হবে!

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ‘ছোট্ট একটি ইসকুল’ শিশু-কিশোর গল্প সংকলন হয়েও তা শুধুমাত্র শিশু-কিশোরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ‘ছোট্ট একটি ইসকুল,’ ধীরে ধীরে যেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে। গল্পগুলির বিষয়বস্তু দক্ষতার সঙ্গে লেখক উপস্থাপনা করেছেন সঠিক শিল্পায়নে। তাই স্বীকার করতেই হয়, সংকলনটি ‘গণজীবনের একটি আদর্শ সংবিধান’ হয়ে উঠেছে। তাই ‘ছোট্ট একটি ইসকুল’ পাঠকের হৃদয়ে যে সহজেই জায়গা করে নেবে, এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট আশাবাদী।

অধ্যাপক-বিনোদ বিহারী মাহাতো কলেজ, ইংরেজি বিভাগ। বেলিয়াপুর,, ধানবাদ, ঝাড়খন্ড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *