এক অসামান্যা নারী ও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জীবনীগ্রন্থ
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ২রা মে, ১৯২১। গত বছর শুরু হয়েছে তাঁর শতবর্ষ উদযাপন। অত্যন্ত বেদনার কথা যে অতিমারীর কারণে তাঁর শতবর্ষ উদযাপন সেভাবে হয়ে ওঠেনি। তথাকথিত ভার্চুয়াল মাধ্যমে বেশ কিছু আলাপ আলোচনা হলেও অনেক প্রদর্শনীর যে সমস্ত পরিকল্পনা তাঁর অনুরাগীবৃন্দ ও গবেষকেরা করেছিলেন, তার কিছুই সাধারণ দর্শকদের কাছে পৌঁছতে পারল না। সম্ভবতঃ দেরিতে হলেও এই বছর তার কিছু আয়োজন করা সম্ভব হবে।
তবে তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশের সমারোহ চোখে পড়ার মত। সেটি খুবই স্বাভাবিক। তাঁর প্রতিভার বৈচিত্র্য, বিস্তার এবং গভীরতা সত্যিই অতুলনীয়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ একবার মন্তব্য করেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথকে দেখলে যেমন মনে হয় তাঁর মধ্যে অন্ততঃ পাঁচটি প্রতিভাশালী মানুষের সমন্বয় ঘটেছে, সত্যজিৎ রায়কে দেখলে মনে হয় এমন অন্ততঃ তিনটি মানুষের সমন্বয় তাঁর জীবনে।
গ্রন্থ ও পত্রিকাগুলির অধিকাংশ জুড়েই আছে সত্যজিৎ প্রতিভার নানা দিকের কথা। এছাড়া তাঁর জীবনে তাঁর উপর বিভিন্ন প্রভাবের ওপরও আলো ফেলা হয়েছে কয়েকটি লেখাতে। তাঁর প্রতিভার স্পর্শে আলোকিত মানুষেরাও শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান করেছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্ভবতঃ অনালোচিতই থেকে গেছে। তাঁর ‘মানিক’ থেকে ‘সত্যজিৎ রায়’ হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে একজন মানুষের সুদীর্ঘ অবদান। তিনি তাঁর মা সুপ্রভা রায়। সত্যজিতের ওপর তাঁর বংশের প্রভাব নিশ্চয়ই রয়ে গেছে। সত্যজিৎ নিজেই লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে বারংবার। গড়পার রোডের বাড়িতে সন্দেশ পত্রিকা হাতে ধরে দেখার বা প্রিন্টিং প্রেসের ঘরে ঘোরাঘুরি করার বা তাঁর ধনদাদুর (কুলদা রঞ্জন রায়) বা অন্যান্য কাকুদের সম্পর্কের কথা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু তাঁর মা’কে নিয়ে খুব বিস্তারিত ভাবে তাঁর কোন লেখা চোখে পড়েনি। বিভিন্ন লেখার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ আছে। বিজয়া রায় ও তাঁর ‘আমাদের কথা’ গ্রন্থে কিছু লিখেছেন তাঁর মামনির কথা। পার্থ বসুর ‘সত্যজিৎ রায়’ জীবনী গ্রন্থেও কিছু খুবই জরুরী তথ্য রয়েছে তাঁর সম্পর্কে। তা সত্ত্বেও বলব প্রয়োজন ছিল একটি সম্পূর্ণ বইয়ের।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে টুম্পা মুখোপাধ্যায়ের লেখা সুপ্রভা রায়ের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ বই। বলতে দ্বিধা নেই এই বইটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই। তাই আমাদের ধারণা এই বইটি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করলে সত্যজিৎ ও সুপ্রভার সম্পর্কের বেশ অজানা দিক সম্পর্কে জানা যাবে। একই সঙ্গে এই মহীয়সী রমণী কীভাবে সত্যজিৎকে আজীবন প্রভাবিত করেছেন তা জানতে পারব।

লেখিকা ও গ্রন্থ পরিচয় –
আলোচনার শুরুতেই লেখিকা সম্পর্কে একটু বলা প্রয়োজন। টুম্পা মহিলাদের ওপর বেশ কিছু কাজ করেছেন, গ্রন্থ রচনাও করেছেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – Community policing in India: A Sociological perspective।
লেখিকার সুপ্রভা সম্পর্কে আগ্রহের শুরু খুব ছোট বয়সেই, তাঁর মার কল্যাণে। তাঁর মা তাঁকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথে টুলু মাসি(সুপ্রভা রায়) সম্পর্কে অনেক কথা জানাতেন। বিশদভাবে জানাতেন বিধবা টুলু মাসি তাঁর একমাত্র পুত্র স্বনামধন্য শ্রী সত্যজিৎ রায় কে কীভাবে কষ্ট করে মানুষ করেছেন। এমনকি যখন স্কুলে ক্রাফট, সেলাই ইত্যাদি শেখানো হত, লেখিকার ম্যা আপশোস করতেন যে তাঁর টুলুমাসি বেঁচে থাকলে তিনি অনেক সুন্দর করে শেখাতে পারতেন। সপ্তাহান্তে তাঁরা যখন দূরদর্শনে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র দেখতেন, তখনও লেখিকার সুপ্রভার কথা মনে হত। এভাবেই নিজের অজান্তেই তাঁর মনে সুপ্রভা সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘The school of Women’s studies’ থেকে ডক্টরেট করার সময় তাঁর এই আগ্রহ একটি বড় কাজ করার প্রকল্পতে পরিণত হয়। এই প্রকল্পর ফসলই এই বইটি।
বইটি অত্যন্ত সুবিন্যস্ত। ভবিষ্যতে যাঁরা এই বিষয় নিয়ে কাজ করবেন তাঁরা যেন পথ হারিয়ে না ফেলেন বা বিভ্রান্ত না হয়ে যান তার জন্য এই সুবিন্যাস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । প্রথমে বিভাগগুলির কথা বলা যাক।
এই জীবনী গ্রন্থটি লেখার সময় লেখিকা মোট সাত ভাগে ভাগ করেছেন –
- গার্হস্থ্য জীবন, বিবাহ ও দাম্পত্য
- দাম্পত্যের সমাপ্তি
- বৈধব্য
- দ্বৈত যুদ্ধ – অন্তরে ও বাহিরে
- মাতৃতান্ত্রিক সুপ্রভা রায়
- লিঙ্গবৈষম্য, পিতৃতন্ত্র ও সুপ্রভা রায়
- টুলু মাসি – ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ
প্রত্যেক পর্বেই অত্যন্ত যত্নশীলভাবে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তব্য। এমনকি প্রত্যেক মতামতের স্বপক্ষে সটীক তথ্যও পেশ করেছেন। তার ক্রম নির্ধারণ করে দিয়েছেন যাতে পাঠক নিজের ধারণার সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখতে পারেন। কোন সন্দেহ থাকলে তারও নিরশন হতে পারে।
গ্রন্থের একটি সুখপাঠ্য ভূমিকা লিখেছেন শ্রী প্রসাদরঞ্জন রায় যিনি একাধারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন মুখ্যসচিব এবং সুপ্রভা রায়ের নিকটাত্মীয়। সেখান থেকে জানা যায় সুপ্রভার রায়ের জীবন সম্পর্কিত তথ্যের আকালের ফলে কাজটি কতখানি দুরূহ ছিল।
গার্হস্থ্য জীবন ও বিবাহ – দাম্পত্য জীবন – মাতৃত্ব
সুপ্রভার জন্ম ১৮৯২ সালের ৩রা অক্টোবর। এই সময়কার বাংলার জীবনের একখণ্ড ছবি তুলে ধরা হয়েছে এই অধ্যায়ে। কোন কোন পাঠকের কাছে এটি একটু ক্লান্তিকর লাগতে পারে, তাঁরা অত গভীরে না যেতেই পারেন। কিন্তু যে পাঠকেরা অনুসন্ধিৎসু তাঁদের কাছে এটি প্রয়োজনীয়। এই সময়কার বাংলার পারিপার্শ্ব না জানলে সুপ্রভার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, শিল্পের প্রতি আকর্ষণ এবং সর্বোপরি বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা মুশকিল। উনবিংশ শতকের শেষভাগ ও বিংশ শতকের প্রথম দুই দশক এই ঘটনাগুলির সময়কাল। সুপ্রভার জীবনের ঘটনার পরম্পরার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলিও আলোচিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে বাংলার মহিলাদের তৎকালীন অবস্থা, ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব, প্রেমজ বিবাহ সম্পর্কিত ধারণা, তাঁদের ওপর পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার প্রভাব ইত্যাদি। এই বিষয়গুলির আলোচনা আমাদের সুপ্রভা এবং তৎকালীন নারীসমাজ সম্পর্কে অনেক কিছু ধারণা দেয়।
এই সময়, অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই ব্রাহ্ম এবং হিন্দু মহিলাদের মধ্যে বিভেদ বেশ দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। হিন্দুদের তুলনায় ব্রাহ্ম মহিলারা অনেক বেশি শিক্ষিতা বা আধুনিক মনোভাবাপন্না বলে জ্ঞাত হতেন। সম্ভবত ঠাকুর পরিবারের প্রভাব এর একটা বড় কারণ ছিল। এইরকম সময়েই সুকুমারের সঙ্গে সুপ্রভার বিয়ের প্রস্তাব আসে।
ততদিনে ১৯১২ সালে সুপ্রভা বেথুন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন। তাঁর গানের গলাও ছিল ভালো। সুকুমার যখন বিলেতে পড়তে গিয়েছিলেন তখনই তাঁদের বিয়ের সম্বন্ধ হয়। এখানে লেখিকা ওই সময়ের বিবাহের নিরিখে সুকুমারের ‘সৎপাত্র’ কবিতার উদ্ধৃতি দিতে ভোলেননি। বিলেতফেরত ‘সৎপাত্র’ রূপে সুকুমার রীতিমতো আকর্ষণীয় ছিলেন।
এই অধ্যায়ে সুকুমার-সুপ্রভার বিবাহের বেশ বিস্তারিত বিবরণ আছে। এর সঙ্গে উল্লিখিত আছে হিন্দু বিবাহের সঙ্গে ব্রাহ্ম বিবাহের তফাৎ। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে এটি খুব মূল্যবান কারণ যদিও লেখিকা এই বিবাহের খুব বেশি তথ্য পাননি তাও বিভিন্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের কাছে বেশ পরিপাটি একটি বর্ণনা হাজির করতে পেরেছেন। সুকুমার – সুপ্রভার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তাঁর একটি মন্তব্য বেশ চিত্তাকর্ষক। যদিও সুকুমারের ছড়াতে নারী চরিত্রের বেশ অভাব, তাও ‘প্যাঁচা আর প্যাঁচানী’ কবিতাটিতে তাঁর দাম্পত্য জীবনের প্রভাব লক্ষ করেছেন লেখিকা। আমার কাছে তো এই আবিষ্কারটি ভারি মনোগ্রাহী লেগেছে। বিশেষ করে শেষ পংক্তি – “তোর গানে পেঁচি রে / সব ভুলে গেছি রে, চাঁদমুখে মিঠে গান / শুনে ঝরে দু‘নয়ান।” এই পংক্তিগুলি সুকুমারের মাধুর্যপূর্ণ বৈবাহিক জীবনেরই কাব্যিক প্রকাশ।
বিলেত থেকে ফিরে সুকুমার আবার তাঁদের ‘মণ্ডা সম্মেলন’ ক্লাবকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। এই ক্লাবের সম্মেলনেও সুগৃহিনী সুপ্রভা স্বামীকে সাহায্য করেছেন। আবার সুকুমারের ওজন বেড়ে যাওয়াতে চিন্তিত সুপ্রভা তাঁর দুপুরের ঘুম কাটানোর জন্য তাস খেলার ব্যবস্থা করেন। তবে সুপ্রভা নিজের গান বা বিদ্যা চর্চাকে আর তেমনভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। রায় পরিবারে গৃহবধূ জীবনেই তিনি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর এবং সুকুমারের দাম্পত্য জীবনের এক সুমধুর ছবি পাওয়া যায় এই অধ্যায়ে। তাঁদের দাম্পত্য জীবনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহের পরশের কথাও বর্ণিত আছে।
দাম্পত্যের সমাপ্তি –
১৯১৫ সালে পিতা উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর বড় ছেলে সুকুমারের ওপরেই সংসারের ভার আসে। সঙ্গে ছিল সন্দেশ পত্রিকা প্রকাশনার ভারও। এই কর্তব্য খুবই সক্রিয়, সনিষ্ঠভাবে পালন করেছিলেন। এই কাজে তাঁর সুযোগ্য সহকারী ছিলেন সুপ্রভা। ‘সন্দেশ’ পত্রিকাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেন সুকুমার। তখনকার যুগোপযোগী করে তুলতে সাধু ভাষার জায়গায় চলিত ভাষার প্রয়োগ হয়েছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। কিন্তু লেখিকা একটা জায়গাতে আলোকপাত করেছেন, সুকুমারের বোনেরা পত্রিকায় লিখলেও সুপ্রভা কোনদিন সেখানে কিছু লেখেননি। এটা কি তাঁর নিজের অনিচ্ছা না সেভাবে সুকুমার তাঁকে উৎসাহিত করেননি সেটা ঠিক জানা যায় না।
তাঁর মৃত্যুর প্রথম আভাস সুকুমার পান ১৯২০ সালের আগস্ট মাসে। একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তিনি সুপ্রভাকে বলেন যে তিনি সম্ভবতঃ আর বেশি দিন বাঁচবেন না। তিনি একটি বক্তৃতার সময় বুঝতে পারেন তাঁর আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাঁদের পারিবারিক প্রিন্টিং প্রেস ও মুদ্রণের ব্যবসাও ঠিক মতো চলছিল না। এই সময় ময়মনসিংহে তাঁদের জমিদারির তদারক করতে গিয়ে তিনি প্রাণঘাতী কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ফিরলেন।
এর মধ্যেই ১৯২১ সালের ২রা মে তাঁদের একমাত্র সন্তান সত্যজিতের জন্ম। বাবার সংস্পর্শ তাঁর পাওয়া হয়নি, ১৯২৩ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর সুকুমারের অকালপ্রয়াণ হয়। অকাল বৈধব্য এবং ব্যবসায়িক মন্দা – এই দুই পরম দুর্যোগকে মাথায় রেখে তাঁর পরের জীবনে পা দিলেন সুপ্রভা। সঙ্গে শিশুপুত্র।
বৈধব্য এবং দ্বৈত যুদ্ধ – অন্তরে ও বাহিরে
এই দুই অধ্যায়ে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে তাঁর সংগ্রামের প্রথম দিনগুলি। প্রথম কয়েক বছর তিনি ১০০ গড়পার রোডে তাঁর শ্বশুর বাড়িতে থাকলেও তারপরে ব্যবসা বিপর্যয় ও আইনি সমস্যায় সেই বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। শিশুপুত্রের হাত ধরে তিনি উঠে আসেন তাঁর ভাইয়ের বকুলবাগানের বাড়িতে। এই পর্বে আমাদের আপাত অনালোচিত একটি দিকে আলো ফেলেছেন লেখিকা। তিনি দেখিয়েছেন সেসময় ব্রাহ্মদের মধ্যে বিধবা বিবাহ খুবই প্রচলিত ছিল। সুপ্রভার পরিচিত উচ্চশিক্ষিতা ব্রাহ্মদের অনেকেই তা করেছিলেনও। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুপ্রভা সেই পথে পা বাড়াননি। সম্ভবত তাঁর শিশুপুত্রের জীবনে তিনি কোনরকম জটিলতা চাননি। পুত্রের জন্য তাঁর ত্যাগ স্বীকারের এই শুরু।
এই বকুলবাগানেই শুরু হয় সত্যজিতের শিক্ষাপর্ব। সেই পর্বে এক বড় ভূমিকা সুপ্রভার। তিনিই নিজে হাতে সত্যজিতের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ভাইয়ের বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও নিজের ব্যক্তিত্ব ও কর্মক্ষমতার জোরে আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। ছেলে সত্যজিতের ওপরে এই পরগৃহে আশ্রয়ের জন্য কোন কুণ্ঠাবোধ না থাকে তার জন্য তাঁর সচেতন দৃষ্টি ছিল। নিজে কাজও খুঁজে নিয়েছিলেন। তাঁর কাজের ধারা ছিল একেবারে আদর্শ – পরিবারে প্রচলিত ছিল যে সুপ্রভার কাজ একেবারে ত্রুটিহীন। সম্ভবত তাঁর এই নিয়মানুবর্তিতা এবং পরিকল্পিত ও যথাসম্ভব ত্রুটিহীন কাজের জন্য ক্লান্তিবিহীন পরিশ্রমের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। সে কথা তিনি স্বীকারও করেছেন নিজমুখে। সুপ্রভা নিজের অর্জিত টাকায় সত্যজিতের জন্য বইও কিনে দিয়েছিলেন। তাঁর যে খুব স্বাচ্ছল্য ছিল তা নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও পুত্রের পড়াশোনার কোন ত্রুটি তিনি রাখতে চাননি। এই সময় ঘরে বাইরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন সুপ্রভা। আমরা সবিস্ময়ে জানতে পারি তিনি একজন দক্ষ ভাস্কর ও ছিলেন। সত্যজিৎ পরে মনে করতে পারেন তাঁদের বেশ কিছু আত্মীয়র কাছে তাঁর মার হাতে গড়া বুদ্ধ ও প্রজ্ঞাপারমিতার মূর্তি ছিল। এত গুণ ছিল, তবুও সুপ্রভার পৃথিবীর কেন্দ্রে ছিলেন তাঁর পুত্র সত্যজিৎ। তাঁর বাড়িতে শিক্ষার সম্পূর্ণ ভার ছিল সুপ্রভার ওপরেই।
সুপ্রভার জোরাজুরিতেই সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। তাঁর নিজের ইচ্ছে ছিল তিনি চাকরি করে মায়ের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু সুপ্রভা তাঁর মধ্যে প্রতিভার ঝলক দেখেছিলেন। তিনি এও জানতেন সত্যজিৎ পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও শিল্পচর্চার অনুরাগী হলেও ভারতীয় শিল্পের প্রতি সেভাবে আকৃষ্ট হননি। শান্তিনিকেতন তাঁর জীবনে এই প্রভাব আনতে পারে। ঠিক তাই হয়েওছিল। আমরা জানি তাঁর প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’তে কীভাবে এই শান্তিনেকেতনের শিক্ষা কাজ করেছিল। নন্দলাল ও বিনোদবিহারীর কাছে শিক্ষা এবং শান্তিনিকেতনের গ্রামীণ পরিবেশের প্রভাব না থাকলে আদ্যন্ত নাগরিক সত্যজিতের পক্ষে নিশ্চিন্তিপুরকে সিনেমাতে সফলভাবে নিয়ে আসা সম্ভব হত না।


মানিক থেকে সত্যজিৎ – বিবাহ, পথের পাঁচালী, সন্দেশ
এর পরের দুই অধ্যায়ে মোটামুটিভাবে সুপ্রভার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়ের বর্ণনা। এই সময় তাঁর পুত্র মানিক থেকে সত্যজিৎ হয়ে ওঠেন এবং তার প্রতি ধাপেই ছিল তাঁর মায়ের পরশ। এর কিছু ঘটনা হয়তো আমাদের জানা ছিল – যেমন ‘পথের পাঁচালী’ চলাকালীন সুপ্রভার কল্যাণেই বিধান রায়ের হস্তক্ষেপেই ছবির সুরাহা হয়। লেখিকা জানিয়েছেন সুপ্রভা কখনোই চাননি তাঁর ছেলে চিত্রপরিচালক হন। এমনকি তিনি নিজে কোনদিন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমাও দেখেননি। আর সিনেমাতে প্রচুর টাকার ব্যাপার, ভবিষ্যৎ ও অনিশ্চিত। কিন্তু ছেলের আকর্ষণ দেখে তিনি রাজি হন। এমনকি এও জানা যায়, ফিল্ম সোসাইটির সভ্যরা অনেক সময় সত্যজিতের বাড়িতেই আড্ডা দিতেন। পরম উত্তেজনায় সত্যজিৎ পথের পাঁচালী শুরু করলেও অর্থাভাবে যখন আটকে গেল তখন সুপ্রভা তাঁর বান্ধবী বেলা সেনকে সঙ্গে করে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করেন। তার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা।
যদিও এই পর্যায়ের অনেক ঘটনা আমরা বিজয়া রায়ের ‘আমাদের কথা’ বই থেকে জেনেছি, এই বইটিতে সেইসব ঘটনার অনুপুঙ্ক্ষ বিশ্লেষণ আছে এবং সেটি বেশ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে। এমনকি জেনে আশ্চর্য হতে হয় যে ১৯৬১ সালে আবার যে সত্যজিতের হাতে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পুনর্জন্ম হয় তা তাঁর মার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করার তাগিদেই। আমরা ভুলতে পারিনা এই সন্দেশ পত্রিকাই সত্যজিৎকে একজন সম্পূর্ণরূপে কিশোর সাহিত্যিক রূপে জন্ম দেয়। তাঁর রচিত কাহিনিগুলির অসাধারণ জনপ্রিয়তা তাঁকে আর্থিকভাবেও স্থিরতা দেয়। বাদল বসুর লেখা থেকে আমরা জানতে পেরেছি প্রথম রয়্যালটির টাকা পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ। তারপর কিশোর সাহিত্যিক রূপে তাঁর জনপ্রিয়তার গ্রাফ সর্বদাই উর্ধমুখী থেকেছে। জানতাম না, সেই খ্যাতির পিছনেও তাঁর মা’র অদৃশ্য হাত ছিল তাঁর মাথায়। দুঃখের ব্যাপার সুপ্রভা ছেলের এই খ্যাতিটি দেখে যেতে পারেননি। তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন জেনে যে তাঁর পুত্র রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্য চিত্র এবং রবীন্দ্র কাহিনি অবলম্বনে কাহিনি চিত্র করবেন। তাও তাঁর দেখা হল না। ১৯৬০ সালের ২৮শে নভেম্বর অল্প কিছুদিন রোগভোগের পর তিনি লোকান্তরিত হন।
গ্রন্থের সার্বিক মূল্যায়ন
সত্যজিৎ শতবর্ষে আমার কাছে এই গ্রন্থটির মূল্য অপরিসীম। আমি এবং আমার মত বহু সত্যজিৎ অনুরাগীর কাছে এটি একটি অত্যাবশ্যক গ্রন্থ। আমি সত্যি মুগ্ধ যে কী অসম্ভব মমতায় লেখিকা সুপ্রভার জীবনচরিতকে বিধৃত করেছেন। সেই সঙ্গে তালিকা বদ্ধ করেছেন অতি প্রয়োজনীয় তথ্যসূচী। পরবর্তী প্রজন্মের কেউ যদি সত্যজিৎ বা সুপ্রভাকে বা ঐ বংশের কোন মানুষকে নিয়ে কাজ করতে চান তার পথ সুগম হবে। এমনকি উনবিংশ শতক বা বিংশ শতকের মহিলাদের সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনাও বইটিকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করেছে।
সত্যজিৎ অনুরাগীদের জন্য বলি তাঁর জীবনের প্রত্যেক সন্ধিক্ষণেই যেন অদৃশ্য দেবতার মত তাঁর মা’র হাত সত্যজিতের মাথায় ছিল। তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু সুপ্রভা। রাতে বিভিন্ন গল্প শুনিয়ে তাঁকে শিশু সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করাও তাঁর কাজ। ছবি আঁকাতে তাঁর অনুরাগ দেখে সত্যজিৎকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে শান্তিনিকেতনে পাঠানোতেও দেখি সুপ্রভার সক্রিয় ভূমিকা। নিজে ভাল গান করতেন, সত্যজিতের গানের আকর্ষণও তাঁর মায়ের সংস্পর্শেই। সুপ্রভা তাঁকে নিয়ে যেতেন অতুলপ্রসাদের বাড়ি। লখনৌতে অতুলমামার বাড়ি গিয়েই গান শুনে তাঁর ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
তাঁর বিবাহে প্রথমে অমত থাকলেও পরবর্তী কালে তিনি মেনে নেন। লেখিকা প্রাথমিক তথসূত্র থেকেই দেখিয়েছেন যে ধীরে ধীরে কেমনভাবে তিনি ‘পিসিমা’ থেকে ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন বিজয়া রায়ের কাছে। প্রথম বিদেশযাত্রাতে তরুণ সত্যজিৎকে তিনি প্রায় বাধ্য করেন অফিসে কথা বলে বিজয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি জানতেন একলা বিদেশ সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে ছেড়ে তাঁর পুত্রের মন ভালো থাকবে না। পরবর্তী কালে ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পুনর্জন্মেও তাঁর অবদানের কথা জানা গেছে।
আমার কাছে এই বইটি নিঃসন্দেহে এক অনন্য আবিষ্কার। শিল্পী সত্যজিৎ বা মানুষ সত্যজিৎ – দুই সত্ত্বার যে গুণগুলিতে আমি বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছি জেনে আশ্চর্য হলাম যে তার অধিকাংশই তাঁর ম’র দ্বারা প্রভাবিত। সত্যজিৎকে ভালো করে জানতে গেলে সুপ্রভা রায়কে জানা যে এত জরুরী তা এই বইটি পাঠের আগে আমার অন্ততঃ জানা ছিল না। তাছাড়াও এক মহীয়সী নারীর সারা জীবনের সংগ্রাম এবং সাফল্যের কথা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই অনুপ্রাণিত করতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। সঠিক অর্থেই লেখিকা বইটির নামকরণ করেছেন –Suprabha Ray : The Unvanquished
বইটির একটি বাংলা অনুবাদের খুব প্রয়োজন। এছাড়া ও প্রয়োজন প্রচারের। এমনকি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে (কিন্ডল ইত্যাদি)র মাধ্যমেও এই বইয়ের কাটতি বাড়তে পারে। দুই বাংলাতে এবং সারা পৃথিবী জুড়ে অজস্র সত্যজিৎ অনুরাগীর কাছে এই গ্রন্থটি বিশেষভাবে আদৃত হবে বলেই আমার ধারণা।
Suprabha Ray : The Unvanquished – Paperback Edition
Written by – Tumpa Mukherjee
Publishd by – Avenel Press
1st Edition, 15th October, 2020
ISBN – 978-81-947992-3-8
Printed Price – INR 500
11 Comments