নারী দিবসে ‘নারী মুক্তি’

নারী দিবসে ‘নারী মুক্তি’

নারী সমাজের মুক্তি? সে তো নারীরাই একমাত্র পারে। সমাজের সমস্ত কুসংস্কার দূর করে, সমস্ত বাধা আতিক্রম করে, কঠোর পরিশ্রম করে, সংসারে দু’মুঠো অন্ন জোগাতে নারীকেই দেখেছি। তবুও কি নারী মুক্তি আছে? নারীদের মুক্তি আমার দৃষ্টিতে আজও আধরা।

অনেকেই মনে করেন নারীরা জড়বুদ্ধি সম্পন্ন, পুরুষের চেয়ে কম ক্ষমতাবান, জীবনের কোন সিদ্ধান্তই একা নিতে পারে না। এর কি বিজ্ঞানসম্মত কোন কারণ আছে? আসলে একই কথা সমাজের চারপাশ থেকে শুনতে শুনতে নারীরা নিজেদের কম ক্ষমতাসম্পন্ন ও বুদ্ধিহীন মনে করতে শুরু করছে। তাই হয়ত কখন তারা সন্তান জন্ম দেবে, দু’টি সন্তানের মধ্যে ব্যবধান কত হবে, ক’জন সন্তানের জন্ম দেবে, অবাঞ্ছিত গর্ভধারন করলে গর্ভপাত করাবে কিনা, ২/৩ টি কন্যাসন্তান হলে পুত্রসন্তানের আশায় আবার গর্ভধারণের প্রচেষ্টা – সব সিদ্ধান্তই ছেড়ে দেওয়া হয় স্বামী তথা পুরুষদের ওপর। নারীরা নিজেরাই জানে না তাদের কী অধিকার। শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থের অধিকারের পাশাপাশি প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্যের অধিকার যে তাদের নিজস্ব, তা নারীরা নিজেরাই হয় বুঝতে চায়না, নয়তো না-বোঝার মত ভান করে থাকতে বাধ্য হয়। আমরা, নারীরা, যদি আমাদের অধিকারগুলো সম্পূর্ণভাবে আদায় করে নিতে পারি তবেই নারীমুক্তি সম্ভব, আর নারী দিবসের স্বার্থকতা।

ক্লারা জেটকিন। কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ অন্তর্জাল

১৯১০ সালে নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ক্লারা জেটকিন (Clara Zetkin) দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সন্মেলনে ৮ই মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণার দাবি করেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পর ১৯৭৮ সালে আন্তর্জাতিক নারীদিবস স্বীকৃতি পায়। এই দিনটি বিশ্বের প্রতিটি নারীর কাছে একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, তা আমাদের সকলেরই জানা।

নারীরা কী না পারে! তারা কী কঠিন পরিশ্রমী, কী অসম্ভব সহনশীল, তা নিজেরাই জানে না। আমি এই রকমই এক নারী সমাজে আলোকপাত করতে চাই।

দীর্ঘদিন হল আমি তরাই ও ডুয়ার্সের বিভিন্ন মহিলা চা শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করে চলেছি। আর দেখেছি তাদের সংগ্রাম, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। কোন অন্ধকার থাকতে তারা ঘুম থেকে উঠে ঘরের যাবতীয় কাজ করে – রান্না করে, জল ভরে, ঠিক সকাল সাতটার আগে চা বাগানে পৌঁছায় চা পাতা তোলার জন্য। তারা আট ঘণ্টা কাজ করে। চা শ্রমিক মহিলাদের পরিধানে কী থাকে তা অবশ্যই লক্ষ্য করা প্রয়োজন। প্রথমে তারা নিজস্ব পোশাক পরে। তার ওপর ফুলশার্ট, কোমরে প্লাস্টিকের এপ্রন, পায়ে গাম্বুট (হাঁটু পর্যন্ত জুতো), পাতি তুলে ভর্তি করবার জন্য পিঠে ঝোলা। বর্ষাকালে রেইনকোট, শীতকালে গরম জামা। এই হল ডুয়ার্সের চা বাগানের মহিলাদের পোশাক। দার্জিলিং-এর মহিলা চা শ্রমিকদেরও একই পোশাক। তবে সারা বছর গরম পোশাক পরে আর মাথায় থাকে টুপি। এই ভাবে সব মহিলা চা শ্রমিকরা সারাদিন চা পাতা তুলছে আর তুলছে। কে কত বেশি চা পাতা তুলতে পারে সারাদিন তারই প্রতিযোগিতা চলছে। তাদের দৈনিক হাজিরা (পারিশ্রমিক) ২০৩ টাকা। এর বিনিময়ে প্রতিদিন তাদের ২০ কেজি চা পাতা তুলতে হয়। কেউ এর অতিরিক্ত তুললে কেজি প্রতি ১ টাকা বেশি পায়। প্রতি সাতদিন অন্তর তাদের রোজগার পেয়ে থাকে।

চা বাগানের শ্রমিক মহিলাদের সঙ্গে লেখিকা। ছবিঃ লেখিকা

এবার বলি এই মহিলাদের স্বাস্থ্যের কথা। স্বাস্থ্য সম্মন্ধে সচেতন হওয়া তাদের পক্ষে খুবই জরুরি। সারাদিন একই পোশাক পরাতে এবং প্রস্রাব করবার কোন নির্দিষ্ট জায়গা না থাকাতে, তাদের পক্ষে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা সম্ভব হয় না। ফলে চা বাগানের মহিলা শ্রমিকদের মধ্যে প্রজননযন্ত্রের সংক্রমণ (Pelvic Inflammatory Disease), প্রস্রাবজনিত সংক্রমণ (Urinary Tract Infection), চুলকানি (Scabies) সহ বিভিন্ন রকম চর্মরোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া উচ্চরক্তচাপ, মধুমেহর সম্ভাবনাও আজকাল প্রবল ভাবে দেখা দিয়েছে। এর একটি কারণ হল তারা নিয়মিত ঔষধ খায় না। চা বাগানের প্রতি ঘরে সদস্যসংখ্যা ছয় থেকে সাতজন। প্রতি ঘরে উপার্জন করে এক বা দু’জন। সংসারে মাসিক আয় হয় সাড়ে দশ হাজার টাকার মত। তাদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, যাতায়াতের খরচ সবই এই সীমিত টাকায় বহন করতে হয়। ফলে ওষুধে টাকা ব্যয় করার বাড়তি টাকা কোথায়? এমনকি শ্রমিক পরিবারের কন্যাসন্তানরা উচ্চশিক্ষার দোরগোরায় খুব কমই পৌঁছোবার সুযোগ পায়। ‘স্কুলছুট’ এর সংখ্যাও বেশি।

চা বাগানে আর একটি বড় সমস্যা হল নারীপাচার। পরিবারের মেয়েদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে, অন্যান্য সদস্যদের ভাঁওতা দিয়ে, মেয়েদের পাচার করা হয় বিভিন্ন রাজ্যে। পাচারের বিরুদ্ধে আমরা নিয়ম করে সচেতনতা শিবির করে চলেছি। নারীপাচারের বিরুদ্ধে মহিলাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে।

এ বছরের নারী দিবসে আমি প্রতি মহিলার উদ্দেশ্যে একটি কথা বলতে চাই, নিজেদের মূল্যায়ন নিজেরা করুন। মহিলাদের মধ্যে প্রচুর প্রতিভা থাকা সত্বেও কেন আমরা মানসিক, শারীরিক, ও যৌন হেনস্থার স্বীকার হবো? কেন আমরা প্রতিবাদের ভাষাটাই হারিয়ে ফেলব? ধৈর্য আছে বলে সহ্যের সীমা অতিক্রম করতে দেব? এভাবে কি নারীরা কোনোদিন সম্মান জয় করতে পারবে? তা যদি না হয়, তবে কেউ নারীকে সম্মান করবে না।

আমাদের দেশে রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে নারীমুক্তির প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন রাজা রামমোহান রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই দুই মহাপুরুষের দেখানো পথ অবলম্বন করে নারীসমাজের মুক্তির জন্য সমাজের সবরকম কুসংস্কার এবং প্রতিবদ্ধকতা জয় করে আমাদের অগ্রণী ভুমিকা নিতে হবে। তখনই হবে নারী দিবসের স্বার্থকতা, যখন প্রতিটি নারী স্বনির্ভর হয়ে তাদের আধিকারগুলি সঠিকভাবে চিনে নিতে পারবে।

ছন্দা দত্ত চক্রবর্তী ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েসান অফ ইন্ডিয়ার (FPAI) কাউন্সেলার। কাজ করেন পশ্চিমবঙ্গের কালচিনি শাখায়। আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিলটনগঞ্জে থাকেন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে অঞ্চলের মানুষদের সুখেদুঃখে পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে চলেছেন। কাজের দক্ষতা ও গভীর দায়বদ্ধতার জন্যে কর্মজীবনে স্বীকৃতি ও পুরস্কার পেয়েছেন।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Tushar Moitra , April 20, 2022 @ 4:02 pm

    একটি তথ্য সমৃদ্ধি লেখা। খুব ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *