‘থ্যাঙ্কসগিভিং’

‘থ্যাঙ্কসগিভিং’

নভেম্বরের শেষে এদেশে ‘থ্যাঙ্কসগিভিং’ উৎসব পালিত হয় – ব্যাপারটা সঠিক জানা ছিল না মোটেই। শোনা গেল – আমেরিকার আদিযুগে এখানে নবাগত ইউরোপিয়ান, যাঁরা নাকি জাহাজে চড়ে এসেছিলেন ‘পিলগ্রিম’ অর্থাৎ তীর্থযাত্রীর বেশে, সেই তাঁদের প্রচুর আদর-আপ্যায়ন করে অতিথি বলে’ ভুরিভোজ খাইয়েছিলেন এখানকার আদিম অধিবাসী ‘রেড-ইন্ডিয়ানরা। সেই থেকে কৃতজ্ঞতাবশত তাদের সেই বদান্যতার স্মরণে ধন্যবাদ জানাতে, আমেরিকার ঘরে ঘরে প্রতিবছরেই অনুষ্ঠান প্রথা-হিসেবে চলে আসছে। সেই বৃহস্পতিবারটা দেশশুদ্ধ ছুটির দিন।
তখন আমার আস্তানা ছিল বার্কলের ইন্টারন্যাশনাল বা ‘আই-হাউসে’। নভেম্বরের মাঝামাঝি আই-হাউসে একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হল -‘থ্যাঙ্কসগিভিং’ উপলক্ষ্যে প্রতিবছরের মত এবারও স্থানীয় আমেরিকান পরিবারে আই-হাউসের বাসিন্দা বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীরা নিমন্ত্রিত হয়েছে। সেই সুবাদে, প্রত্যেক বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীকে একেকটি পরিবার অর্থাৎ ‘হোস্ট ফ্যামিলি’ সেই সন্ধ্যায় বিশেষ ডিনারে আপ্যায়ন করবে। বিশদ খবরে আরো জানা গেল, আমার আতিথেয়তার দায়িত্ব নিচ্ছেন যে ‘হোস্ট ফ্যামিলি’- তাঁরা নাকি ‘উলফ পরিবার’! চকিতে আমার চোখের সামনে ‘রেড রাইডিং হুড’-এর কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখের ছবিটা ভেসে উঠেছিল সেদিন এক লহমার মধ্যে। আমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই!

যাই হোক্, আমি তো সুবোধ বালকের মত যথাবিধি জামাজুতো পরে’ আই-হাউসের বাহির-দ্বারে এসে, সিঁড়ি পেরিয়ে ধুকপুক-বুকে নেমেছি পথে। দেখি, আমারই মত আরো দু-এক বেচারা দাঁড়িয়ে সেখানে তথৈবচ! হ্যাঁ, নির্ধারিত সময়ে একটা কালো ঢাউস গাড়ি এসে থামল আমার সামনে। জানলার কাঁচটা আধখানা নেমে এল নিজে থেকেই। তখনি, দৃষ্টির বাইরে গাড়ির ওপাশ থেকে – ঠিক যেন গুহার ভেতর থেকে, কানে ভেসে এল গম্ভীর এক আওয়াজ – “এ্যা-মি-ট্যা-ভ্যা”?
তার যে মানেটা কী, সেটা বুঝতে আমার লেগে গেল পাক্কা এক মিনিট। শব্দটা যে প্রশ্নসূচক, অতএব তার যে কীধরণের উত্তর দেওয়া উচিত হবে, সেটা বুঝতে লাগল আরো এক। কানের সঙ্গে মনের আধাআধি সমঝোতা হয়েছে ততক্ষণে – মনে হল যেন ওটা আমারই শুভনামের বিশ্রী অপভ্রংশ তথা ধ্বংসাবশেষ। বুকের ধুকপুকুনি বেড়েই চলেছে এদিকে। ওদিকে অযথা দেরী আর সইতে না পেরেই বোধহয়, নেমে দাঁড়ালেন সেই রথের সারথি। সেইসঙ্গে আবার সেই সশব্দ সম্ভাষণ – “এ্যা-মি-ট্যা-ভ্যা”? প্রশ্নটাও যেন আরো অধৈর্য, তাই দ্বিগুণ সোচ্চার।
কানের মোকাবিলা তো শেষ – এবার চোখের পালা। আমেরিকানদের দশাসই চেহারা ইতিমধ্যে নিজের চোখে দেখা আছে কিছু – আমাদের ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যান ডঃ পিয়ার্সন তার এক সার্থক স্পেসিমেন। কিন্তু এই মার্কিন-পুঙ্গব পিয়ার্সন-সাহেবের দুগুণ না হলেও, হেসেখেলে দেড়গুণ তো বটেই! পুরো একটা থান নিশ্চয়ই লেগেছে ওঁর গায়ের ঐ এঁটে-বসা চকচকে সিল্কের সাদা সুটখানা বানাতে, তার সঙ্গে ওঁর আবলুস-কাঠের মত গায়ের রঙটা যেন মূর্তিমান কন্ট্র্যাস্ট। এতসব লিখতে যতটা সময় লাগল, দেখতে তার দশভাগও লাগেনি। তার সংক্ষিপ্ত আর দুর্বোধ্য প্রশ্নের উত্তরে কখন যে নির্বোধের মতই ওপর-নীচে মাথা নেড়েছি শুধু, জানিনা। ততক্ষণে তিনি আমার দিকে ঘুরে এসে, পেছনের দরজাটা খুলে দিয়ে চোখের ইশারায় আমাকে গাড়িতে ঢুকে পড়তে অনুরোধ, কিংবা বুঝি আদেশ করছেন। বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিয়ে, যা থাকে কপালে ভেবে গাড়িটার ব্যাকসীটে নিজেকে সঁপে দিলাম – আর মুহূর্তে তলিয়ে গেলাম তার নরম-গরম উত্তাপে। কখন যে দরজা বন্ধ হয়ে গাড়িটা নিঃশব্দে চলতে শুরু করছে, খেয়াল করিনি। আমার মুখে কোনো কথা সরছিল না তখনো – ভয়-ভয় ভাবটাও পুরোপুরি কাটেনি। সম্বিত ফিরলে – সীমিত শব্দসম্ভার সম্বল করে, আর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে, সামনের দিকের আধো-অন্ধকারে কোনমতে ছুঁড়ে দিলাম – ‘থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার উলফ।’
আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাতের আওয়াজ ঠিক কেমন আমি জানিনা – তবে জলপ্রপাতের আওয়াজ আগে শুনেছি। ঠিক তেমনি এক অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত আওয়াজ ছুটে এল অন্ধকার ভেদ করে। অনুমান করলাম – সেটা ঐ সামনের সীটের পাহাড়-ফাটানো অট্টহাসি। হাসি থামলে সেই রসিকপ্রবর জলদমন্দ্রে ঘোষণা করলেন – ‘আয়্যাম্ নট্ মিস্টার উলফ।’
আমার তো তখন রক্ত জল হবার উপক্রম। গাড়িতে ওঠার আগে মিস্টার উল্ফকে নিয়ে আশঙ্কার অন্ত ছিল না – এখন আবার ইনি মিস্টার উল্ফ না হওয়ায় এ কী নতুন বিপদে পড়া গেল! দরজাটা খুলে ঝাঁপ দেব ভাবছি, আমার হতবাক অবস্থা অনুমান করেই বোধহয় সামনের সীট থেকে জবাব ভেসে এল – ‘আয়্যাম্ মিস্টার উলফস্ শোফার। আর ইউ ওকে?’
উঃ, যাক্ বাবা – এতক্ষণে পরিষ্কার হোলো ব্যাপারটা। একটা ছোট্ট হাঁফ ছেড়ে আমি তাড়াতাড়ি বললাম -’ই-ইয়েস স্যার।’
জবাব এল -’ইউ ডোন্ট হ্যাভ্ টু কল্ মি স্যার।’
‘স্যার’-টা সত্যি নিজের কানেও কেমন যেন একটু বেজেছিল – তবু ভাবলাম ঠিক আছে, সাধের প্রাণটা যখন আপাতত এঁরই হাতে – এঁকে খুশি রাখা দরকার! ঐ যাকে বলে – সাবধানের মার নেই। হঠাৎ সামনের ছোট আয়নাটায় চোখ পড়তে দেখি – তেনার মস্ত মুখে মিটিমিটি হাসি!

ইতিমধ্যে গাড়ির গতি কমে এসেছে। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে বেশ কিছুটা ওপরে উঠে একটা বড় কালো লোহার গেটের সামনে গাড়ি থামাতে হল। সুইচ টিপে গেট খুলে, তারপরে সবুজ লনের পাশ কাটিয়ে আরো কিছুটা এগোবার পর, একটা লম্বা গাড়ি-বারান্দার নীচে এসে গাড়ি থামল।
সিটের গহ্বর থেকে নিজেকে উদ্ধার করে, গাড়ির দরজা খোলা যায় কী করে তার কলকব্জা খুঁজছি – তার আগেই শোফার-সাহেব বাইরে থেকে সেটা খুলে দাঁড়ালেন। মস্ত বাড়িটার পেছনদিক থেকে যেন বেশ কিছু লোকজনের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল, গোটা দুয়েক কুকুরের ডাকও। শোফার-সাহেবকে অনুসরণ করে আমিও পা বাড়ালাম সেদিকে।
সাদা কাঠের বেড়ার গায়ের দরজাটা খোলার আগেই চোখে পড়ল একটা পার্ক-মত, কিছুটা বাঁধানো আর কিছুটা ঘাসে ঢাকা। বাঁধানো জায়গাটায় বেশ কিছু বেতের চেয়ার-টেবিল ইতস্তত ছড়ানো – সেখানেই লোকজনের জটলা। আলাপরত অনেকের হাতেই ছোট ছোট গেলাস। আমি ঢুকতেই কিছু নারী ও পুরুষ তাকাল আমার দিকে। তাদের মধ্যে বর্ষীয়ান দীর্ঘদেহী এক পুরুষ লম্বা পা ফেলে, স্মিতহেসে এগিয়ে এলেন আমার দিকে।
“হ্যাল্লো! ওয়েলকাম্ টু আওয়ার্ হোম্। এ্যান্ড ওয়েলকাম্ টু অ্যামেরিকা! আই য়্যাম্ ডক্টর উলফ। এ্যান্ড ইউ আর অ্যাম্ …অ্যামি …” এই পর্যন্ত বলে, একটু অপ্রস্তুত আর বেশ কিছুটা বিব্রত-মুখে তিনি থেমে পড়লেন।
কারণটা বুঝে নিতে এবার আমার আর বেশি কষ্ট হল না; এ-ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এদেশে আসা ইস্তক। মানে আবার সেই নাম-বিভ্রাট আর কি! তাড়াতাড়ি ভেবে নিলাম, এই সুযোগ ছাড়া চলবে না – পেরেকটা মারতে হবে এক্ষুনি, তাহলে অন্তত এই ধ্যাস্টামির হাত থেকে আজকের দিনটার মত নিষ্কৃতি। যেই ভাবা অমনি কাজ। সুযোগ-সন্ধানী দক্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ডের মত ক্ষিপ্রগতিতে মুখ চালালাম ওঁর অর্ধসমাপ্ত কথার পিঠে – “আই য়্যাম্ অ-মি-ত।” বলেই করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ওঁর দিকে।

এবার ওঁর মুখ থেকে বিব্রত-ভাব অন্তর্হিত হয়েছে দেখলাম; সেখানে এখন স্বস্তির হাসি – চিরাচরিত অ্যামেরিকান কনফিডেন্স ফিরে এসেছে পুরোমাত্রায়। “গ্ল্যাড টু মিট য়্যু, অমিট।” সোৎসাহে করমর্দনের পর যোগ করলেন তিনি। “কাম্, মিট্ এভ্রিওয়ান্ হিয়ার্। লেট্ মি অফার্ আ ড্রিঙ্ক।”
অ্যামেরিকান উচ্চারণে ‘সফট’ বলে কিছু নেই – কইতে গেলেই হয়ে যায় ‘হার্ড’। ‘ত’-উচ্চারণ ওদের ‘এ্যাকিলিস্ হিল’, মানসাঙ্কের চেয়েও শক্ত! ওদের নামে ‘ত’ গরহাজির। শুনেছি ওদেরই কারো মুখে – “ইউ’ইল্ সি – উই ওয়ার্ক হার্ড, এ্যান্ড উই প্লে হার্ড এ্যাজ ওয়েল।” তা ‘ওয়ার্ক হার্ড’-এর নমুনা তো দেখা হয়েছে এই ক’দিনে, ‘প্লে হার্ড’ বস্তুটি যে কী জানিনা এখনও – তবে ভরসা আছে, জেনে যাবো শিগগিরি। টাইম্ উইল টেল্।

তবে ড্রিংকস বা পানীয়ের ব্যাপারে কিন্তু এখানে দ্বিবিধ ব্যবস্থাই চলতি – হার্ড এবং সফট। এ্যালকোহলিক – যথা হুইস্কি, জিন, ভদকা, প্রভৃতি হল হার্ড, এমন-কী বিয়ারও পড়ে প্রথম দলে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ওয়াইন বা দ্রাক্ষারস (অর্থাৎ মদ) -পানেরও বেশ চল আছে, বিশেষত মহিলা-মহলে পার্টি-ফার্টিতে – সে-ও পড়ে ঐ দলেই। নন্-এ্যালকোহলিক পানীয়রা – যথা কোক, সেভেন-আপ, স্প্রাইট, পেপসি প্রভৃতি পড়ে সফটের দলে। এই দু’দলের অবাধ মিশ্রণে জন্ম নেয় হাজারো ককটেল – তার জাত আলাদা।
অন্যদের সঙ্গে ‘হাই-হুই’ জাতীয় খেজুরে আলাপ-পরিচয়ের পরে ডক্টর উলফ আমাকে নিয়ে এগোলেন অদূরেই একটা লম্বা টেবিল লক্ষ্য করে – যেখানে থরে থরে শোভা পাচ্ছে হরেকরকম পানীয়। টেবিলটার সামনেও ছোটখাটো একটা জটলা – তাদের সবার হাতেও প্লাস্টিকের গেলাসে টলটল্ করছে রঙিন জল। টেবিলের ওপারে একটি মেয়ে – বয়েসে আমার চেয়ে হয়ত একটু ছোটই হবে – লাল ফ্রক-পরা, ব্লন্ড চুল, মুখে হাসি।
“লিন্ডা, দিস্ ইজ্ অ্যামিট্ – ফ্রম বার্কলে। অ্যামিট্, লিন্ডা।” দ্রুতগতিতে আলাপ করালেন ডক্টর উলফ – তারপর ‘এক্সকিউজ্ মি’ বলে চলে গেলেন আর একদিকে কোথায় যেন।
“হা-য়; ওয়েলকাম্ টু আওয়ার হোম্ – এ্যান্ড হ্যাপি থ্যাঙ্কসগিভিং! টেল্ মি – ইফ্ আই মে আস্ক্ – হোয়্যার্ আর ইয়্যু ফ্রম্?”
“আই য়্যাম ফ্রম্ আই-হাউস্, ইন্ বার্কলে।” আমার অকপট স্বীকারোক্তি।
একগাল হেসে লিন্ডা তো প্রায় উল্টে পড়ে আর কী! “নো, সিলি! আই মিন, ফ্রম হুইচ্ কান্ট্রি?”
মেয়েটা আমাকে বেশ বোকা ভেবেছে নিশ্চয়ই। ‘সিলি’ শুনে রাগলেও, মনে এল – ‘ও, তাই বল’। মনের কথাটা দ্রুত অনুবাদ করে বললাম – “ও, সে দ্যাট্।” সাবধানে হিসেব করে বলতে গেলাম – “আই য়্যাম্ ফ্রম্ …”
উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে লিন্ডা ততক্ষণে বলে উঠল, “নো, ডোন্ট টেল মি … লেট মি গেস্ – ইজরায়েল … ইটালি?” কুতূহলী সপ্রশ্ন দৃষ্টি তার চোখে।

মজা পেয়ে আমি এবার মাথা নাড়লাম।। বললাম – “আই গিভ ইয়ু ওয়ান মোর গেস্, এ্যান্ড দেন …”
“ইন্ডিয়া?”
এবার একটু হেসে আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ালাম ওপর-নীচে।
“ই-ই-য়েস! আই থট্ সো! !” এবার ততোধিক উৎসাহে লিন্ডা হাতজোড় করে বলল – “নমস্তে! টেল্ মি, প্লিজ – হোয়াট্ ক্যান্ আই অফার ইয়ু?”
একঝটকায় আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল এয়ার-হোস্টেসদের মুখগুলো, আর তার সঙ্গে তাদের সম্বন্ধে শোনা সত্যি-মিথ্যে চটুল আর মজাদার গল্পগুলো। দেশ ছাড়ার পর থেকে প্লেনে তো কম চড়িনি – মিলেমিশে এক হয়ে গেছে সব এখন। সে যাহোক্ – খোয়াব কাটিয়ে উঠে, তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম – “হো -হোয়াট্ ডু ইয়ু মিন বাই দ্যাট্?”
“হোয়াট ড্রিংকস উড য়্যু লাইক? হার্ড, সফট – ইয়ু আর অ্যালায়োড্ টু ড্রিঙ্ক – আরনট ইউ?”
আবার বোকা বনে যাবার ভয়ে তাড়াহুড়োতে বলে ফেললাম – “সফট, অর হার্ড – আই মিন, এনি …”
আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থাটা এক লহমায় বুঝে নিয়ে লিন্ডা বলল – “হুম্ – সফট, অর্ হার্ড – লেট্ মি মেক্ ইউ আ স্পেশাল ওয়ান্; আফটার অল, ইয়ু আর্ আ স্পেশাল্ গেস্ট – এ্যান্ড টুডে ইজ্ আ স্পেশাল্ ডে।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তবু আমি কিছু না ভেবে পেয়ে জিগ্যেস করে ফেললাম – “হোয়াই ইজ্ ইট্ আ স্পেশাল্ ডে?”
আমার হাতে ড্রিঙ্কের গেলাসটা তুলে দিয়ে লিন্ডা আবার একচোট হেসে নিয়ে বলল – “বিকজ্ ইটস থ্যাঙ্কসগিভিং, সিলি! বি হ্যাপি!” আমার গেলাসটার সঙ্গে নিজেরটা আস্তে ছুঁইয়ে হাসি-হাসি মুখে সে বলে উঠল – ‘চিয়ার্স! ’
অকারণ হাসি যে একটি সাধারণ-দেখতে মেয়েকেও সুন্দর করে তোলে, দাগ রেখে যায় মনে – তার অকাট্য প্রমাণ মিলল আবারও। মনে হল, লিন্ডার সঙ্গে আর একটু গল্প করি, এমনিই – স্পেশাল কিছু বলার নেই যদিও। ততক্ষণে সে দেখি গল্প জমিয়েছে আরেকজনের সঙ্গে – মনে হল তারা অনেকদিনের চেনা। আমার তখন আর নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছে হলনা। পায়ে-পায়ে সেখান থেকে সরে গিয়ে একটু আড়ালে সুইমিং পুলটার পাশে দাঁড়ালাম – যেখানে চার-পাঁচটি ছোটবড় বাচ্চা তখন হৈ-হৈ করছিল বিপুল উৎসাহে। পুলের ওপাশে দূরে চেয়ে দেখি – সীমানার কাছে বড় বড় কয়েকটা প্রায়-পত্ররিক্ত গাছ – মৃদু হাওয়ার দোলালাগা শেষের পাতাগুলো উজাড় করে উড়িয়ে আর পায়ের কাছে রঙবেরঙে সাজিয়ে নিয়ে, পড়ন্ত সূর্যটাকে সাক্ষী রেখে উদ্বাহু হয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের আলো মেখে নিচ্ছে সারা গায়ে। মুগ্ধচোখে অনেকক্ষণ সব ভুলে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। মন বলল – দিস্ ইজ্ সানি ক্যালিফোর্নিয়া! আবার নতুন করে বাঁধা পড়লাম সেই আধো-চেনা সুন্দরের। জানি – এ-আমার পুরনো অভ্যেস!

ইতিমধ্যে বিভিন্ন-বয়সী যারা ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্পগুজব করছিল এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে ফেরার পথে কানে আসছিল তাদের দু’চারটে টুকরো কথা। সবটা যে আমার বোধগম্য হচ্ছিল তা নয়। আমার চেয়ে ছোট যারা, সেইসব ছেলেদের দলে আলোচনা চলছে খেলাধুলো নিয়ে – ফুটবল, নাইনার্স শব্দ-দুটো কানে এল। এদেশের ফুটবল আমাদের দেশের মত নয় – বড়সড় পটলের মত ফোলানো বল হাতে নিয়ে ছোটাছুটি মাঠ জুড়ে – আমি তার মাথামুণ্ডু বুঝি না। রোববারে আই-হাউসে দু-চারজন দেখে বটে টিভিতে, তাই নামটা জানা। একটু দাঁড়িয়ে যা দেখেছি – এ’দলের প্লেয়াররা ও’দলের প্লেয়ারদের জ্যান্তে মেরে কাবাব বানিয়ে ফেলতে চায় – সেই যাকে বলে ‘কিলায়কে কাঁঠাল পাকায় দিয়া’। সত্যি-মিথ্যে জানিনা – গল্পে শুনেছি, খোদ রবিঠাকুর যখন ইলিনয়ে ছেলের কাছে এসেছিলেন, তখন রথীন্দ্রনাথ বাবাকে সখ করে কলেজের ফুটবল খেলা দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন। একটুক্ষণ দেখে রবিঠাকুর নাকি আর নিতে পারেননি, ছেলেকে বলেছিলেন – ‘এতো খেলা নয়, যুদ্ধ! ’ সাক্ষাৎ ঋষিবাক্যই বটে – ছোট হলেও মোক্ষম। ফুটবল নিয়ে এরপর আর কথা চলে না।

আরেকটা ছোট দল বয়স্কদের নিয়ে – হয়ত ডক্টর উলফের ভাই-ভাতিজা বা বন্ধু-বান্ধব, কে জানে। তাঁদের আলোচ্য বিষয় পলিটিক্স থেকে স্টক মার্কেট ইস্তক। দুটোই আমার জ্ঞানের বাইরে – ইন্টারেস্ট বলতে তথৈবচ। নিকসন সাহেব আর ডাউ-জোন্স মাথায় থাক কী নিপাত যাক – কিছুতেই কিছু এসে যায় না আমার আপাতত। হাতের ড্রিঙ্কটা প্রায় শেষ, ঐ যাকে-বলে ‘মস্তি’-ও হয়েছে বেশ – সেটা বহাল তবিয়তে বজায় থাকতে থাকতে বরং আমি সাহস সঞ্চয় করে পা বাড়ালাম সেই লম্বা টেবিলটার দিকে; লিন্ডার দেখা পাওয়ার আশাটাও হয়ত উঁকি মারছিল অবচেতনে।
বেশী এগোতে হলনা – লিন্ডার লাল ড্রেসটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রঙবেরঙের সাজে আরও কয়েকটি মেয়ে ঘিরে আছে তাকে, রয়েছে কয়েকটা আস্তিন-গুটোনো টাইট সার্ট-পরা গুলি-ফোলানো ছেলেও – সে যেন মক্ষীরানি! আশ্চর্য, এই শেষ নভেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে, বাইরে এই খোলা জায়গায় আর কনকনে হাওয়ায় ঠাণ্ডা লাগেনা ওদের? আমার তো একটা জ্যাকেট পরেও শীত মানছে না যেন। ভাবতে ভাবতে ওদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি – ওরা আমারই দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কী-সব বলাবলি করছে। নাকি সেটা আমার চোখের ভুল – ঘোর লেগেছে আমার চোখেই? চশমার কাঁচটা মুছে নিলাম একটু। নাঃ, এইতো চশমার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট দেখছি, লিন্ডা আমায় দূর থেকে হাত নেড়ে ডাকছে!

কিছুটা আচ্ছন্নের মত ওদের দিকে ক-পা এগোতেই লিন্ডার গলা শুনলাম – “ওকে গাইজ্, দিস্ ইজ্ আওয়ার্ স্পেশাল গেস্ট অমিট্ – ফ্রম্ ইন্ডিয়া।”
চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে-পড়া চুল সরিয়ে রিনরিনে গলায় একটি মেয়ে বলে উঠল – “ওয়াও; য়্যু আর সো-ও ফা-র ফ্রম হোম্ – মাস্ট্ বি ফিলিং হোমসিক্।”
আর একটি মেয়ে পাশ থেকে হিহি করে হেসে বলে উঠল – “কাম অন্, হি ডাসনট লুক লাইক্ আ মামাজ বয়, লাইক্ ইয়োর ব্রাদার – আর ইয়ু?”
ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার চোখে চোখ রেখে শেষ প্রশ্নটা সে ছুঁড়ল আমারই উদ্দেশে। কী বলব ঠিক করতে না পেরে আমি শুধু মুচকি হাসলাম।
গুলি-ফোলানো ছেলেদের মধ্যে একজন ঢুলুঢুলু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল – “ইয়ো! হাউ কাম্ ইয়্যু এইন্ট ড্রেসড লাইক্ দোজ্ হ্যারে-কৃষ্ণা পিপল?”

আমি কিছু বলার আগেই আমার হয়ে উত্তর দিয়ে দিল চশমাচোখো রোগামত আর একটা ছেলে – “বিকজ হি ইজনট ডাম্ব লাইক ইয়ু। হি গোজ্ টু বার্কলে – ইয়ু ইডিয়েট্।”
“ও ইয়্যা? ডুড – আই গো টু বার্কলে টূ-উ। আই ডিগ্ টেলিগ্র্যাফ …।
“ইয়া ডুড্। ইউ গো দেয়ার টু হ্যাঙ আউট্ উইথ্ দ্য হিপিজ্। হি গোজ্ টু বার্কলে টু স্টাডি য়্যাট্ দ্য ইউনিভারসিটি -দ্য স্কুল, ইয়ু স্টুপিড ফুল্! ” কথাগুলো বলেই মুহূর্তে দৌড় মারল রোগা ছেলেটা। আস্তিনগুটনো ছেলেটাও ছুটল ওর পেছনে তাড়া করে, উচ্চৈস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে।
এইসব অসংলগ্ন আলাপ আর অসঙ্গত প্রশ্নের হাত থেকে লিন্ডাই আমাকে বাঁচাল শেষটা। দেখলাম বুদ্ধিমতী সে – দল থেকে বেরিয়ে টেবিলটার দিকে পায়ে-পায়ে এগোতে এগোতে, ফাঁকা গেলাসটা দেখিয়ে সে জিজ্ঞেস করল – “সো, হাউ ওয়াজ্ ইয়োর ড্রিঙ্ক?”
“গুড্। বাট অল্ সো হোয়াইট, কালারলেস … হোয়াট্ ওয়াজ্ ইন্ ইট?”
“আই পুট ভদকা, জিন, এ্যান্ড লিটল বিট্ সেভন-আপ ফর্ টেইস্ট। লেট্ মি মেক্ ইয়্যু অ্যানাদার ওয়ান্ – দিস্ টাইম্ আইল্ পুট্ সাম্ কালার, ফিট্ ফর্ দ্য স্পেশাল গেস্ট।” বলে আবার একটা মধুর হাসি আমাকে উপহার দিয়ে, সে গেল টেবিলটার ওপাশে – পছন্দমত রঙিন বোতল খুঁজতে। কী জানি কেন – মনে হল, ওর এবারের হাসিটা যেন আরো অর্থপূর্ণ!
“হি ইজ্ নট্ ইয়োর মামাজ বয়, লিন্ডা – বি কেয়ারফুল্। হোপ্ হি নোজ্ হোয়াট্ ইয়ু আর ডুইং।” একটু দূর থেকে কথাকটি ছুঁড়ে দিল ওর বন্ধুদের একজন। উচ্চকিত হাসির রোল উঠল ওদের দলে তারপরে।
নতুন ড্রিঙ্কটা ঈষৎ সবুজ; সেটা আমার হাতে তুলে দিয়ে লিন্ডা আবার উইশ্ করল – ‘চিয়ার্স’। পেয়ালাটা প্রায় টইটম্বুর – চলকে পড়ার আগে তাড়াতাড়ি এক চুমুক দিয়ে মনে হল আরো যেন মিষ্টি। সে কী কেবল হাতের ছোঁয়ায়? বড় করে আরেক চুমুক দিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল তা-ই।
“লাইক ইট?” যেন দূর থেকে প্রশ্ন ভেসে এল নতুন-চেনা মেয়েলী গলায়। জানাশোনা শব্দসম্ভার থেকে মহার্ঘতম বিশেষণটি বেছে তুলে, উচ্ছ্বসিত হয়ে তার উত্তরে বললাম – “ফ্যান্ট্যা-স্টিক।” কথাটা নিজের কানেই বাজল বেশ – যেন তাতে মাখা আছে না-দেখা কোন্ অলীক স্বপ্নের রেশ।
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ মুখে-মুখে খবর ছড়িয়ে গেল – ‘টার্কি ইজ্ আউট -ইটস অল ডান।’ ধারে-কাছে যারা ছিল, তারা দেখি এগোচ্ছে বাড়ির ভেতরের দিকে – আমিও পায়ে-পায়ে তাদের অনুসরণ করলাম।
থ্যাঙ্কসগিভিং-এ টার্কি খাওয়ার রেওয়াজ যে এদেশে অবিসংবাদিত, সে-খবরটাই শুধু জানতাম। তার উল্লেখ ছিল ইন্টারন্যাশনাল হাউসের সারাদিনের সেই ওরিয়েন্টেশন্ মিটিংয়ে – দেখান হয়েছিল ছবিতে, বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের ‘কালচারাল লিটারেসি’ বাড়াবার জন্যে। নইলে টার্কি-পাখি কখনো চোখে দেখিনি – চিড়িয়াখানাতেও নয়! চেহারা তার মোটামুটি কুচ্ছিত – তাকে সুন্দর বলতে যে ক্ষমা-সুন্দর চোখ বা যতখানি কাব্য-প্রতিভা লাগে, তা আমার নেই। সাইজে সে মোরগ আর ময়ূরের মাঝামাঝি, সে-অনুপাতে ডানার জোর বিশেষ নেই বলে ছুটতে গিয়ে ধরা পড়ে সহজেই। মাথাটা অনেকটা শকুনের মত, দেখে মনে হয় ধারালো চঞ্চু – আর গলা জুড়ে বুক পর্যন্ত অবিন্যস্তভাবে থাকে থাকে ঝুলছে লাল রঙের বিস্তীর্ণ গলকম্বল। গায়ের পালক কিছুটা মোরগেরই মত – লেজের দিকের লম্বাটে পালকগুলো ছোটখাটো জাপানি পাখার মত সাজানো – ফুলিয়ে খুললে পাখিটার রূপও একটু যেন খোলে। সব মিলিয়ে দশে চার।
অবশ্য তার রূপ নিয়ে ‘কি বা যায় আসে’ – আসল কথা হচ্ছে, এই বিশেষ দিনে দলে দলে তাকে ধরে-মেরে ছাড়িয়ে-পুড়িয়ে ফেলার পর, ঘরে ঘরে ডাইনিং টেবিলে তার আবশ্যিক আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি নিয়ে। সকাল থেকে এই এতক্ষণ চলছিল তারই প্রস্তুতি। সাইজের ওপর নির্ভর করে রন্ধনযজ্ঞ সম্পূর্ণ হতে লেগে যায় চার-পাঁচটি ঘন্টা। তারপরে আসে সেই ঈপ্সিত মুহূর্ত। সারাদেশের মনুষ্য-বসতিতে ‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি যায় ক্রমে’ – ‘টার্কি ইজ্ আউট -ইটস অল্ ডান্।’ এ’ক্ষণে ঘোষিত হবে –  ‘এস বস আহারে, খাওয়াবো আজব খাওয়া ভোজ কয় যাহারে।’

তা ‘আজব খাওয়া’-ই বটে। তার একটা কারণ অবশ্য – এদেশে নবাগত বলে ‘আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন’ – কিন্তু না, শুধু তাই-ই নয়। ভেতরে ঢুকে দেখি – সত্যিই যাকে বলে ‘এলাহি বন্দোবস্ত’। একদিকে মস্ত কিচেন – চোখে পড়ে রান্নাবান্নার যাবতীয় যন্ত্রপাতি আর সাজসরঞ্জাম। কোনও গৃহস্থবাড়িতে এতটা জায়গা নিয়ে শুধু রান্নার ব্যবস্থা এর আগে কোথাও দেখিনি – যে রাঁধে, সে তো হারিয়ে যাবে এখানে! আমরা অবশ্য দরজা দিয়ে কিচেনের ভেতরে ঢুকিনি। জনতার পেছন-পেছন শেষমেশ পৌঁছলাম একটা বিশাল হলঘরে – আয়তনে সেটা প্রায় আই-হাউসের গ্রেট হলটারই সমান – তবে চৌকো নয়, লম্বাটে। ঘরটার ঠিক মাঝ-বরাবর প্রকাণ্ড ডাইনিং টেবিল – তার চারধারে সাজান চেয়ারের সংখ্যা গুণে ওঠার অবস্থা তখন আমার ছিল না – তবে আন্দাজে মনে হল সমাগত অতিথিরা সেখানে ধরে যাবে হেসে-খেলে। সারা টেবিলটা চিত্রবিচিত্র টেবলক্লথে ঢাকা – লাল-কমলা-হলুদের প্রাধান্য তার রঙে। বর্ণালীর একধারের আগুনরাঙা এরা এ’উৎসবেরই প্রকৃষ্ট রঙ। টেবিলের ওপরে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত বিভিন্ন পাত্রে শোভা পাচ্ছে আর খোশবু ছড়াচ্ছে রকমারি খাদ্যবস্তু। সেইসঙ্গে তাদের মধ্যমণি-রূপে ‘পরমন্তি-শয়নে শয়ান’ বাদামী-ছালে ঢাকা দগ্ধ-বর্ণ এক নধরকান্তি টার্কি – সেই প্রখ্যাত ‘বিগ বার্ড’ – যিনি নাকি আজকের নিহত নায়ক!
সুদৃশ্য কাঁটাচামচ কাপডিশে সুচারুরূপে সাজানো টেবিল ঘিরে সকলে যখন আসন গ্রহণ করতে প্রস্তুত, তখন হঠাৎ অন্যদের ইতস্তত কথাবার্তার ফাঁকে ডক্টর উলফের জলদগম্ভীর গলা কানে এল আমার – “হোয়্যার ইজ্ এ্যামিট্?”

ইতিমধ্যে আমি ভিড়ের মাঝে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিলাম। আমার দুপাশে দুই জাঁদরেল চেহারার মাঝখান দিয়ে কোনমতে মাথা গলিয়ে, ওঁর দিকে ঝাপসাচোখে তাকিয়ে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ ক্ষীণকণ্ঠে দাখিল করলাম – ‘হিয়ার।’ আধো-শেষ ড্রিঙ্কের পেয়ালাটা তখনও আমার হাতে।
“ওহ্ গুড্; প্লিজ কাম্ হিয়ার্ য়্যাণ্ড সিট বিসাইড্ মি।” অনুরোধের সুর বাজলেও সেটা প্রায় আদেশ বলেই মেনে নিয়ে, সেই মস্ত টেবিলের আধখানা ঘুরে গুটিগুটি ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেয়ালাটা টেবিলে কোথাও রাখা যায় কিনা ভাবছি, এমন সময়ে উনি টেবিল থেকে একটা ওয়াইন-গ্লাস আর কাঁটা তুলে নিয়ে আমার কানের কাছে বাজাতে লাগলেন – আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে, অন্যদেরও সচেতন করার উদ্দেশ্যে। ভাবলাম, এটা বুঝি কোনও রিচুয়াল, আজকের উৎসবের বিশেষ অঙ্গ। চমকের ঘোর কাটেনি তখনো – ঝটিতি মনে পড়ল, কোনো উৎসবের গোড়ায় আমাদের দেশে যেমন শাঁখ বাজায় – কিংবা এদেশেও এককালে রেড ইন্ডিয়ানরা যেমন ওদের সব বাদ্যযন্ত্র বাজাত ধুমধাড়াক্কা – এ-ও বুঝি তেমনি, রিচুয়ালিস্টিক্! যাহক, মন্ত্রের মতই কাজ হল সেই ঝনঝনে আওয়াজে – কোলাহল একেবারে থেমে গিয়ে ঘরজুড়ে নেমে এল অখণ্ড নীরবতা। আমার এক কানে তখন অবশ্য ঝিঁঝি ডাকছে একটানা! তখনো বুঝিনি, চমকাবার বাকি ছিল আরো।
সেই ঝিঁঝি-ডাকা কানের দিক থেকে হঠাৎ ভেসে এল ঘোষণা – “লেডিজ্ য়্যাণ্ড জেন্টল্-মেন, ওয়েলকাম্ টু আওয়ার এ্যানুয়াল থ্যাঙ্কস্গিভিং পার্টি। টুডে উই আর লাকি টু হ্যাভ্ আওয়ার স্পেশাল্ গেস্ট হিয়ার, স্ট্যান্ডিং বিসাইড্ মি – মিস্টার এ্যামিট্। হি ইজ্ এ গ্রেট্ স্কলার – ডুয়িং গ্র্যাজুয়েট্ স্টাডিস এ্যাট বার্কলে। ইট্ ইজ্ আ গ্রেট্ অনার ফর আস্ – হি কেম্ অল্ দ্য ওয়ে ফ্রম্ ইন্ডিয়া, টু কাট্ দ্য স্পেশাল্ টার্কি অন্ দিস্ অকেশন্। লেটস অল গিভ হিম আ বিগ হ্যান্ড।” এই বলে উনি একটু সরে দাঁড়িয়ে, আমার কাঁধে একটা ঠেলা মেরে এগিয়ে দিলেন টেবিলের কাছে – প্রকাণ্ড টার্কিটার এক্কেবারে সামনে। কী ভাগ্যি সে মুণ্ডুহারা, চক্ষুহীন – তাই আর চোখাচোখি হল না দুজনে। অত লোকের উচ্চকিত করতালিতে গমগম করছে তখন হলঘরটা।
ইতিমধ্যে আমার হাত থেকে প্লাস্টিকের সেই ড্রিঙ্কের পেয়ালাটা সযত্নে তুলে নিয়ে, তার পরিবর্তে একটা করাতের মত লম্বাটে ফলাওয়ালা যন্ত্র ধরিয়ে দিলেন ডক্টর উলফ। আমার ধারণা ছিল, আমেরিকানরা যে কোনো ব্যাপারেই যন্ত্রপাতি ভীষণ ভালবাসে – তা’বলে খাবার টেবিলেও যে এহেন এক যন্তর ছাড়া তাদের চলে না, তা কখনো ভাবিনি। মাথাটাও তখন ঠিক কাজ করছিল না – ড্রিঙ্কটাও হাতে নেই যে লম্বা করে শেষ চুমুকটা দিয়ে একটু সাহস সঞ্চয় করব – এ-পরিস্থিতিতে সেটা এখন নিতান্ত দরকারী।
ভারী যন্ত্রটা হঠাৎই বাঘের মত গোঁ-গোঁ করে উঠল রাগে – হয়ত অজান্তে হাত পড়েছিল তার সুইচে। মনে হল, অযথা দেরী সইছে না আর তার – নইলে সে নিজেই করবে যা করার। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কী আর করা! হাতের অস্ত্রটা সাবধানে টেবিলে নামিয়ে হাতজোড় করে বিপদভঞ্জন শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে, অর্জুনের স্টাইলে আস্তিন গুটিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নামলাম। তারপর যা থাকে কপালে – সুইচটা সাবধানে টিপে ধরে অস্ত্র-স্বরূপ যন্তরটা সন্তর্পণে নামিয়ে আনলাম টার্কিটার স্ফীতোদরে।
অমনি কিমাশ্চর্যম্! ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল ‘বিগ বার্ড’। যন্তরটার কেরামতিতে নিজের সেই অপ্রত্যাশিত আর অনায়াস সাফল্যে চমৎকৃত হয়ে গেলাম। ব্যস, তখন আর আমাকে পায় কে! মনে পড়ল, অস্ত্রহাতে বাঙালীর বাচ্চাকে ব্রিটিশ সাহেবরা পর্যন্ত ভয় পেয়ে মূর্ছা যেত – আর এ তো যুদ্ধক্ষেত্রে ধরাশায়ী মৃত সৈনিকের ভূমিকায় তুচ্ছ এক টার্কি মাত্তর। ইতিমধ্যে এখানকার সাহেবদের অবস্থাও দেখি তথৈবচ – সব্বাই চুপ, পলক পড়ছে না কারও চোখে – ম্যাজিক দেখছে যেন। শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্র তো তখন আমার হাতে! দ্বিগুণ উৎসাহে পুনঃপুন আক্রমণে যখন ছিন্নভিন্ন হয়েছে নিহত নায়ক সেই টার্কির নশ্বর দেহ, কিমায় পরিণত হতে অল্পই বাকি – এদিকে মুড্ এসে গেছে আমার, তখন আমি উদ্যত-অস্ত্রে নতুন শত্রুর খোঁজে হুংকার ছাড়লাম – “নেক্সট?”

চারদিক কেমন যেন ফাঁকা হয়ে এল নিমেষে। হাতের অস্ত্রটা গোঁ-গোঁ করছিল তখনো – সেও কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল, কীকরে কি জানি এক লহমায়। আগেই তো জানান দিয়েছিল সে – তার আছে নিজস্ব মন; কাজ শেষ হয়েছে, এখন তার ছুটি। কিংবা হয়ত তাঁর সুদর্শন চক্র ফিরিয়ে নিলেন সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ। আমি তো নিমিত্তমাত্র – ‘মা ফলেষু কদাচন’। এখন কর্ম-অন্তে সন্তুষ্টোহস্মি – ধীরেসুস্থে একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে, তারপরে এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার ভঙ্গীতে আজানুলম্বিত একটা ‘বাও’ করে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লাম। আর সেইসঙ্গে হাতের ইশারায় আর সবাইকেও বসতে বললাম, ঠিক যেভাবে মহারাজা তাঁর রাজকীয় দরবারে সভাসদদের আসন-গ্রহণের অনুমতি দেন – কল্পনায় যেমনটি দেখেছি। টুঁ শব্দটি না করে বসে পড়ল সবাই। ডক্টর উলফ এতক্ষণ কোথায় ছিলেন জানিনা – সন্তর্পণে এসে বসলেন আমার পাশে।
কিছুক্ষণ পরে চারদিক থেকে একটু-আধটু ফিসফিসানি কানে এল – ‘মাই গড্, ইট্ ওয়জ্ কোয়াইট্ এ শো’; ‘মেসমেরাইজিং’; ‘প্রিটি ভায়োলেন্ট’; ‘ইয়া, লাইক্ দ্য নিনজা ওয়ারিয়ার্স’; ‘ডেফিনিটলি নট্ পার্ট অব্ হরেকৃষ্ণজ্’; ‘আই থট্ দে আর ভেজিটেরিয়ানস’; ‘ইউ নেভার নো দোজ্ ইন্ডিয়ানস’; ‘হি ইজ্ নট্ দ্যাট্ কাইন্ড অব্ ইন্ডিয়ান্, ইউ ইডিয়েট্’; ‘নো, দ্যাটস ফর সিওর্’; ‘ডিডনট ইউ হিয়ার, হি ইজ্ আ নার্ড’; ‘ইয়া, বাট্ এ স্কেয়ারি ওয়ান’; ‘স্যুয়োর, লাইক্ দ্য চেন্-স মার্ডারার’; ‘এনিবডি কল্ড্ পোলিস ইয়েট্’; ‘শ্-শ্-শ্ …’; ইত্যাদি। ছেঁড়া-ছেঁড়া মন্তব্যগুলো মজাই লাগছিল শুনতে – বিশেষ যখন আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই তাদের জবাবদিহির।

টেবিলভর্তি নানারকমের খাবার – খাওয়া আরম্ভ করেছে প্রায় সবাই। কারো প্লেটেই তখনও টার্কির ছিটেফোঁটাও নেই! টার্কির সার্ভিং-প্লেটটার ধারে-কাছেও ঘেঁষছে না কেউ। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম – কোথায় তার সেই প্রকাণ্ড বৈভব – ঝড় বয়ে গেছে বেচারীর ওপর দিয়ে। হাড়গোড়-ভাঙা দধীচি সে এখন – তাকিয়েও দেখছে না কেউ আর তার দিকে। তবে তাকে বাদ দিলেও খাবারের তো কোনো অভাব নেই – সবারই মুখ ভর্তি। মন্তব্যের স্রোতও এখনকার মতন থেমেছে তাইজন্যে। আর সবার দেখাদেখি আমিও যাহোক কিছু খাবার তুলেছি নিজের প্লেটে – হাতের কাছে যা পেলাম। আই-হাউসের কল্যাণে তার কিছু চেনা, কিছু মনে হল একেবারে অচেনা। খেতে অবশ্য মন্দ লাগছিল না – এমনিতে তো আমি প্রায় সর্বভুক – তবে তখন আর খিদে ছিল না বিশেষ।
কখন যে ডক্টর উলফ ওঁর প্লেটে খাবার নিয়েছেন লক্ষ করিনি। আড়চোখে দেখি, উনিও ঠিক মন দিয়ে খাচ্ছেন না – নিঃশব্দে কেবল প্লেটে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। হঠাৎ আমার চোখে চোখ পড়তেই তিনি কাঁটাটা নামিয়ে রেখে বললেন – “ওকে অ্যামিট্, আই হ্যাভ আ কনফেশন টু মেক্।” আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম আবার – এ আবার কী নতুন বিপত্তি। আমি তো যদ্দূর জানি – ক্রিশ্চানরা কনফেশন দেয় চার্চে গিয়ে ওদের প্রিস্টের কাছে, পর্দাটানা ঘুপচি একটা ঘরে মাথা নীচু করে বসে। এখন, এখানে, এ-পরিবেশে, সর্বোপরি আমার কাছে – ব্যাপারটা তো হবে নেহাৎই বিসদৃশ! মনের ভাব মনেই চেপে, মুখটা যথাসাধ্য গম্ভীর রেখে আমি অ্যামেরিকান্ কায়দায় বললাম – ‘ও-কে-এ।’
“আই রিয়েলি মেন্ট্ ইট্ য়্যাজ্ আ জোক্ – হোপ্ ইয়ু ডিডনট মাইন্ড।”
অবাক হয়ে আমি বললাম – “ইয়ু মেন্ট্ হোয়াট্ য়্যাজ্ আ জোক্? আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।” অকপটে জানাতে হল আমায়।
“ওয়েল, আই সেড্ দ্যাট্ ইউ কেম্ অল্ দ্য ওয়ে ফ্রম্ ইন্ডিয়া, টু কাট্ দ্য স্পেশাল্ টার্কি। আই মেইড্ ইট্ আ লিটল ড্রামাটিক্ – জাস্ট আ জোক্।”
“এ্যান্ড দেন্ ইয়ু কুডন্ট টেক্ ইট্ ব্যাক, রাইট্? এনিওয়ে, হাফ অব্ হোয়াট ইয়ু সেড্ ওয়াজ্ এবসলিউটলি ট্রু। দ্য ট্রাবল ইজ, নোবডি স দ্য কমা।”
“হোয়াট্ কমা?” এবার ডক্টর উলফের অবাক হবার পালা।
“দেয়ার ওয়জ্ এ কমা – এ পজ্ – আই হার্ড ইট্ ক্লিয়ারলি। সো নো হার্ম ডান। আই – আই ফরগিভ্ ইয়ু।” সেক্ষণে আমি উদার – ক্ষমার প্রতিমূর্তি।

ডক্টর উলফ কে কিছুটা আশ্বস্ত দেখাল। ইতিমধ্যে চোখে পড়ল, ছোটদের দলের কেউ কেউ সাহস করে এগিয়ে ছোটবড় দু-এক টুকরো টার্কি খুঁজে তুলে নিয়েছে প্লেটে। সেদিকে একবার তাকিয়ে বললেন ডক্টর উলফ – “এনিওয়ে, ইয়ু টোট্যালি ডেসিমেটেড দ্য পুয়োর টার্কি – ইভন আই কুডন্ট হ্যাভ্ ডান্ আ বেটার জব্ – আই নো; য়্যাণ্ড আই’ম সাপোজড টু বি দ্য ফেমাস্ সার্জন।”
“য়্যাণ্ড আই’ম সাপোজড টু বি য়্যান্ এঞ্জিনীয়ার – কনস্ট্রাকটিভ, নট্ ডেসট্র্যাকটিভ। এনিওয়ে, আই টেক্ ইজ্ য়্যাজ্ আ কমপ্লিমেন্ট। আই ট্রাই টু নেভার লিভ আ জব্ আনফিনিসড – হোপ্ ইয়ু ডোন্ট আইদার্।” বললাম আমি।
ডক্টর উলফের উচ্চকিত প্রাণখোলা হাসিতে সচকিত হয়ে উঠল আশপাশের লোকজন। মনে হল, উৎসবের মেজাজটা যেন ফিরে এল – হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই।
কথার পিঠে কথায় ডক্টর উলফ বললেন, “আই থট্ আই স ইউ সে আ কুইক্ প্রেয়ার আপ্ ফ্রন্ট। ইয়ু থট্ দ্য জব্ উড্ বি টূ হার্ড ফর্ ইউ?”
সাহেবের কথা শুনে দুষ্টুবুদ্ধি চাপল মাথায়। বললাম – “ওয়েল্, ইয়ু আস্কড এ্যান এঞ্জিনীয়ার টু পারফর্ম আ সার্জারি ফর্ দ্য ফার্স্ট টাইম, আই জাস্ট কমপ্লায়েড – হোয়াট্ এলস কুড আই ডু? সো আই প্রেড্ – টু আস্ক্ ফর্ সাম্ ডিভাইন্ হেল্প টু স্টেডি মাই হ্যান্ড। ডিডনট ইয়ু এভার?”
“ডিডনট আই হোয়াট?”
“আস্ক্ ফর্ সাম্ হেল্প টু স্টেডি ইয়োর হ্যান্ড – দ্য ভেরী ফার্স্ট টাইম্?”
সাহেবের মুখে তক্ষুনি কোন উত্তর যোগাল না – দেখলাম তিনি চিন্তামগ্ন। এই সুযোগে আমি যোগ করলাম, “টেল্ মি ডক্, ডিড্ ইয়ু এভার কিল্ এনি অব্ ইয়োর পেসেন্টস? নট্ ইভন আ সিঙ্গল্ ওয়ান্? পারহ্যাপস ইয়ু ডিড্। সি, দ্যাট্ ইজ্ কনসিডার্ড্ ব্যাড ‘কারমা’। ফর্ দ্যাট্ -”
“ফর দ্যাট্ -হোয়াট?” ডক্টর উলফের কণ্ঠস্বর বেশ সংশয়াপন্ন শোনাল।
“ফর্ দ্যাট্ – ইয়ু মে হ্যাভ্ টু বি রিবর্ন এ্যাজ্ … এ্যাজ আ টার্কি – ফর এগজামপল – সো ইয়ু ক্যান্ বি অপারেটেড্ অন্ বাই আ ডেসট্র্যাকটিভ এঞ্জিনীয়ার, সাম্ ডে ডাউন্ দ্য লাইন্। হি উড্ গেট্ দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব্ আ লাইফটাইম্ – এ্যান্ড ইয়ু …” বলে টার্কির প্লেটটার দিকে তাকিয়ে করুণ-কণ্ঠে বললাম, “উড্ বি রেডি ফর্ ইয়োর নেক্সট লাইফ।” একটু থেমে সাহেবের ভ্যাবাচ্যাকা মুখের দিকে তাকিয়ে যোগ করলাম – “এ্যান্ড দিস্ কুড গো অন্ অ্যাড্ ইনফিনিটেম্ – আনটিল …”
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পাংশুবর্ণ ডক্টর উল্ফ জিজ্ঞেস করলেন – “আনটিল”?
“আনটিল ইয়োর ব্যাড্ কারমা রানস আউট্।”
“হাউ – হাউ ডু ইয়ু নো অল্ দিস্?” সাহেব তখন প্রায় কাঁদোকাঁদো।
“বিকজ আই য়্যাম্ ইন্ডিয়ান – কামিং অল্ দ্য ওয়ে ফ্রম্ ইন্ডিয়া টু কাট্ ইয়োর টার্কি – রিমেমবার?”
হাসবেন কি কাঁদবেন ঠিক করতে না পেরেই যেন কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে উঠলেন ডক্টর উলফ, ”ইয়ু আর জোকিং নাউ, রাইট্?”
“জাস্ট লাইক্ ইয়ু জোকড উইথ্ মি! আই য়্যাম্ রিটার্নিং ইউ দ্য ফেভার।”
সাহেবের মুখে একটা নার্ভাস হাসির আভাস দেখা দিল যেন। আমার মনে হল, এত সহজে ছাড়া হবে না – আর একটু লেজে খেলানো যাক্।
“বাট্ ইট্ কুড স্টিল হ্যাপন -” আমি বলে চললাম আগের কথার খেই ধরে -”ইয়ু বিলিভ ইন রিবার্থ্, রাইট্? আই নো জিসাস্ ওয়জ্ রেজারেক্টেড্ – দ্য সেইম্ থিং য়্যাজ্ বিয়িং রিবর্ন। উই বিলিভ্ ইন্ ইট্ টূ! ইন্ আওয়ার হোলি বুক, ইভন আওয়ার অলমাইটি সেইড্, য়্যাণ্ড আই কোট -’টু সেভ্ দ্য গুড্ পিপল এ্যান্ড ডেস্ট্রয় দ্য ব্যাড্, টু প্রিজার্ভ গুড্ কারমা অর্ ধরমা, আই এ্যাপিয়ার থ্রু দ্য এজেস্।’ সো, দেয়ার ইয়ু গো। হি এ্যাপিয়ার্ড টুডে রাইট্ হিয়ার টু হেল্প মি কিল্ দ্য ইভ্ল্ স্পিরিট, দ্য টার্কি। ইউ বেটার বিলিভ্ ইট্।” ক্লাসে সেমিনার দেওয়ার মত এই পর্যন্ত বলে আমি ক্ষান্ত দিলাম।
ইতিমধ্যে একটু চিন্তা করে ডক্টর উলফ যুক্তির আশ্রয় নিতে চাইলেন। “বাট দ্য টার্কি ওয়জ্ অলরেডি কিল্ড্! ”
“ইফ্ ইয়ু ক্যান বি রিবর্ণ, ইয়ু ক্যান বি রি-কিল্ড্।” বললাম আমি। “সিনস আই ওয়জ্ দ্য ছয়জন ওয়ান টু পারফর্ম দ্য ব্লেসেড্ ডিড্, আই হ্যাভ্ আর্নড সাম্ পয়েন্টস্ টু গো স্ট্রেট্ টু হেভন হোয়েন্ টাইম্ কামস।” এর পর চিন্তিত-মুখে যোগ করলাম, “এ্যাজ্ ফর্ ইয়ু, আয়্যাম্ নট্ সিওর্…”

সাহেবের মুখ তখন অন্ধকার। এই সুযোগে আমি তখনও বলে চলেছি – “আই মাস্ট সে – হোয়েন দ্য নাইফ্ ওয়জ্ মেকিং দ্য হুইর্লিং সাউন্ড – ইট্ ওয়জ্ সো ‘একজিলারেটিং’ – হি হি…” হাসির ছটায় আমার মুখ উজ্জ্বল। আসলে, এই রকম বড় বড় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে আমি খুব ভালবাসি। বিশেষত শব্দটা সাহেবের ওপর প্রয়োগ করে বেশ আত্মপ্রসাদ বোধ করলাম তক্ষুনি। এরকম চান্স তো আর হামেশাই আসে না!
“ইটস দ্য অ্যাড্রেনালিন। ইটস সো স্ট্রেইঞ্জ – অল্ দিস্ টাইম্, আই অলোয়েজ থট্ দ্যাট্ ইন্ডিয়ানস আর পিসফুল, নন-ভায়োলেন্ট পিপল …” সাহেব মৃদু স্বরে বিড়বিড় করলেন – যেন স্বগতোক্তি করছেন।
“ইউ আর পার্টলি রাইট্ এগেন; দে সিওর্ আর্ – আনটিল প্রভোকড।”
বিপন্ন নিরুপায় ডক্টর উলফ এবার কথা ঘোরাতে চাইলেন – বোঝা গেল এ’বিষয়ে আলোচনায় উনি আর বিশেষ উৎসাহী নন। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের মাঝখানে রাখা একটা রেড্ ওয়াইনের বোতল থেকে কিছুটা নিজের গ্লাসে ঢাললেন অভ্যস্ত হাতে। বুঝলাম গলা শুকিয়ে গেছে ওঁর। বোতলটা আমার ফাঁকা গ্লাসটার ওপর বাড়িয়ে একটু কাত করে ধরে উল্ফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন -”আর ইয়ু থার্স্টি? আই নো আই য়্যাম্।”
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। আমার গ্লাসে অনেকটা ঢেলে দেবার পরে বোতলটা নামিয়ে রেখে নিজের গ্লাসটা তুলে উনি বললেন ‘চিয়ার্স’। ওঁর গ্লাসের সঙ্গে আমারটা আস্তে ঠেকিয়ে বড় করে একটা চুমুক লাগিয়ে আদবকায়দা-মাফিক একই ভঙ্গীতে আমিও বলে উঠলাম, ‘চিয়ার্স’। তবে ওয়াইনের স্বাদটা আমার তেমন ভালো লাগল না – একটু যেন তিতকুটে।
মনে হল একটু দূর থেকে ডক্টর উলফকে আরেক সাহেব চোখের ইশারায় ডাকল। আমাকে ‘এক্সকিউজ্ মি’ বলে ডক্টর উলফ পা বাড়ালেন তার দিকে। ওয়াইন-গ্লাসটায় আরো দুয়েকটা ছোটখাটো চুমুক মেরে, আমিও গুটিগুটি পা বাড়ালাম টেবিলের অন্যপ্রান্তে থরেথরে সাজানো সুইট্ ডিশের সন্ধানে। তিতকুটে ওয়াইনে জিভটা একেবারে বিস্বাদ হবার আগে মিষ্টিগুলোর যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করা, বিশেষ অতিথিবেশে আমার বিশেষ কর্তব্য বলে মেনে নিলাম এক্ষণে। মাথাটা তখনো যেন তাজ্ঝিম-মাজ্ঝিম।
কর্তব্য-কর্ম সম্পূর্ণ সমাধা হবার আগেই ডক্টর উল্ফের আসরে প্রত্যাবর্তন ঘটল। শেষ মিষ্টিটায় শেষ কামড় দিতে না দিতে কানে এল তাঁর নাটকীয় ঘোষণা – “আই হ্যাভ সাম্ ব্যাড নিউজ্ ফর্ ইয়ু, অ্যামিট।”
ঠিক যেন মূর্তিমান ছন্দপতন! যথেষ্ট ‘ব্যাড্ নিউজ্’ তো ঘটে গেছে আমার মতে। এই মুহূর্তে মিষ্টিগুলোর দিকে ছলছল-চোখে তাকিয়ে এবার শুধু গেয়ে ওঠার পালা – ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই – প্রহর হল শেষ।’ এত দুঃখেও মনে হল – কী আশ্চর্য, রবিঠাকুর কি এদের এই মধুর আপেল-’পাই’ আর পাম্পকিন-’পাই’য়ের কথাও জানতেন? আমিও যে নিবিষ্টচিত্তে ওদের দিকেই তাক করেছিলাম। সবজান্তা লোক যাহোক্!

ইতিমধ্যে এ’নাটের ভিলেনের পরবর্তী ডায়ালগ ভেসে এল – “ইয়ু নো দ্যাট্ গ্রিন ড্রিঙ্ক ইয়ু ওয়্যার সিপিং বিফোর দ্য ম্যাসাকার – হোয়্যার ডিড ইয়ু গেট্ ইট্?”
মন বলল – সাবধান, ‘ট্রিক-কোয়েশ্চেন’ হতে পারে এটা। সব মিলিয়ে যে মস্তিটা এখনো অব্দি ধরে রেখেছিলুম, সেটা নির্মমভাবে কেটে গেল এক ঝটকায়। মুখে বললাম – “আউটসাইড্, হোয়্যার উই মেট্।”
“হু গেভ্ ইট্ টু ইয়ু?”
আবার সাবধান হবার পালা। এই সওয়াল-জবাবের পরিণতি যে কী হতে চলেছে, কে জানে। অজান্তে নির্দোষীকে শাস্তি দেওয়া হোক্, তা মোটেই চাই না – বিশেষত সেই নির্দোষী-জন যদি … একেই কি বলে ‘হর্নস্ অব্ এ ডিলেমা’ – উভয়-সঙ্কট? ডক্টর উল্ফ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তখনো আমার মুখের দিকে। কী আর করা, কবুল করতেই হল – “লিন্ডা।” সঙ্গে সঙ্গেই সাফাই জুড়ে দিলাম -”শী গেভ্ মি দ্য ড্রিঙ্ক, বাট আই আস্কড্ হার্ টু য়্যাড্ সাম্ কালার …” – এক নিঃশ্বাসে কথা-কটা বলে হাঁফ ছাড়লাম।
ডক্টর উলফের গলা দিয়ে শুধু বেরোল – ‘হুঁঃ’। আর কোনো বাক্যব্যয় না করে, আমাকে চরম সাসপেন্সে রেখে – লম্বা লম্বা পা ফেলে উনি চলে গেলেন ঘরটার অন্যপ্রান্তে – যেখানে ভিড় জমিয়েছে বালখিল্যদল।
অনতিবিলম্বেই ফিরলেন উনি – লিন্ডাকে সঙ্গে নিয়ে।
“দ্যাট্ ড্রিঙ্ক অব্ ইয়োর্স ওয়াজ্ আ ডেঞ্জারাস্ মিক্স – য়্যান্ একজোটিক ককটেল অব ভদকা, সেভেন-আপ্, য়্যাণ্ড আবসাঁথ্। ইয়ু মে নট্ নো হোয়ট্ আবসাঁথ্ ইজ্। এনিওয়ান ড্রিঙ্কিং আবসাঁথ্ ফর্ আ হোয়াইল্ বিকামস ম্যাড ইন্ দ্য লং রান্, বিফোর হি অর্ শী নোজ্ ইট্। দ্যাট গ্রিন কালার ওয়জ্ অলরেডি আ গিভ-অ্যাওয়ে ফর্ মি। দ্যাট্ বটল শুড্ নট্ হ্যাভ্ বিন্ দেয়ার্। মাই অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট মিস্টার স্মিথ্ ওভার হিয়ার চেকড ইয়োর্ ড্রিঙ্ক। বিলিভ্ মি – হি ইজ ক্লিয়ার্লি অ্যান্ এক্সপার্ট, হি নোজ্ হিজ্ স্টাফ্।” চেয়ে দেখি আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে সেই সাহেব ঢুলুঢুলু চোখে হাসি-হাসি মুখে মাথা নেড়েই চলেছেন – সেটা ওঁর সাময়িক মুদ্রাদোষ বা এপিলেপ্সি বা আর কিছু, কে জানে! মানুষ বড় বিচিত্র জীব।
“ওকে। নাউ লিন্ডা শুড্ অ্যাপোলোজাইস্ টু ইয়ু – দো আই য়্যাম্ য়্যাফ্রেড্ দ্য ড্যামেজ্ ইজ্ অলরেডি ডান্। দ্যাট্ হাউএভার এক্সপ্লেইন্স্ আ লট্ …” এই বলে বিড়বিড় করতে করতে ডক্টর উলফ চলে গেলেন সেখান থেকে।
কানটা ঝিমঝিম করছে তখনো, মাথার ভেতরে তাজ্জিমতাজ্জিম। মনে হল, বোধহয় বেশিদিন আর বাঁচবো না। কী কুক্ষণে যে বেঘোরে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে পড়েছিলাম – আর হয়ত ফেরা হল না এযাত্রা। আবছা মনে পড়ল – ‘আবসাঁথ্’-এর কথা পড়েছিলাম বটে মুজতবা আলীর লেখায় – উঃ, সে কতদিন আগে! সেই ‘আবসাঁথ্’-এর স্বাদ পেলাম আমি – আজ এখানে – ভুল করে, না চাইতেই! ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই’ – হে আমেরিকা … সত্য সেলুকাস্, কী বিচিত্র এই দেশ!

লিন্ডা তখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে – সে-বেচারীও বোধহয় খুঁজে বেড়াচ্ছে বলার মত কিছু – মনে-মনেই। এটা যদি সত্যি-সত্যিই নাটক হোত, নায়ক-নায়িকার সাক্ষাৎকারের এহেন দৃশ্য লেখা হত কিনা জানিনা – তবে সুবিধে হত একটাই – তাদের মুখে ডায়ালগের জোগান দিতেন নাট্যকার স্বয়ং। আর আমার নিজস্ব ধারণা – তাহলে নিশ্চয়ই তাদের আলাপ-পরিচয়ের আর একটু পরিসর থাকত, আর একটু সুযোগসুবিধে যুগিয়ে দেওয়া হত দেখাশোনার – এধরণের মর্মান্তিক মুহূর্ত এত তাড়াতাড়ি এসে পড়ত না তাদের মাথায়, এমন করে বিনা নোটিশে হুড়মুড়িয়ে। কী আর করা, এ’নাটক নয় – রূঢ় বাস্তব। দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমিই বললাম প্রথমে – “ইটস অল্ মাই ফল্ট। আই রিমেমবার, আই আস্কড্ ফর্ সাম্ কালার্ ইন্ মাই ড্রিঙ্ক।”
ওর ড্রেসের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে মুহূর্তে রাঙিয়ে উঠল লিন্ডার ফর্সা কপোল। “ও নো; ইটস অল্ মাই ফল্ট। আই শুড্ নো … আয়্যাম্ সো সো স্যরি। প্লিজ এ্যাক্সেপ্ট্ মাই সিনসিয়ার এ্যাপলজি।”
“নো, রিয়েলি – দেয়ার্ ইজ্ নো নিড ফর্ এ্যাপলজি।”
“আই’ল্ সিনসিয়ার্লি ওয়ারি য়্যাবাউট্ হাউ ইউ ফিল – আফটার ইউ গো …।”
“সিরিয়াসলি? ওয়েল্, ইন্ দ্যাট্ কেস্ – উই মাস্ট্ কিপ ইন্ টাচ্।”
“ইয়েস্, আই থিঙ্ক উই রিয়েলি শুড্।”
“দ্যাটস গুড্। দিস্ ওয়ে, সামডে আইল্ হ্যাভ্ আ চান্স টু লেট্ য়্যু নো হাউ আই ফিল য়্যাবাউট্ ইয়ু টু।” বলে এবার আমি একটু হাসলাম।
“আই’ল লাইক্ দ্যাট্।” এর পরে লিন্ডা আর দাঁড়াল না, একছুটে পালাল সেখান থেকে। দূর থেকে দেখলাম, ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ওর বন্ধুরা।
আমার তখন সব মিলিয়ে কেমন একটা ঘোর- ঘোর অবস্থা। অত বড় ঘরটা দেখতে দেখতে খালি হয়ে এসেছে কখন, খেয়াল করিনি। অতিথি অভ্যাগতরা অনেকেই হয়ত দূর-দূর থেকে এসেছেন থ্যাঙ্কসগিভিং-এর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে – তাঁদের এখন ঘরে ফেরার পালা। খাবার টেবিল প্রায় ফাঁকা – সেখানে এখন বিবিধ প্লেটে খাদ্যবস্তুর ভগ্নাবশেষ-মাত্র পড়ে আছে ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। টার্কির প্ল্যাটারেও সেই মহানায়ক দধীচির হাড়গোড়ের ধ্বংসাবশেষই শুধু বিদ্যমান – বাকি সবই প্রায় সাফ – কিছু সর্বভুক মানুষের পেটে, আর কিছু তুলে রাখা হয়েছে ঠাণ্ডা-বাক্সের পেটে – ‘লেফট-ওভার’-স্বরূপ গৃহস্থ-পরিবারের ভবিষ্যৎ ক্ষুন্নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে।

ঘরের অন্যত্রও অনুরূপ অগোছালো অবস্থা। ঝাড়লণ্ঠনগুলো থেকে ঝুলছে ছেঁড়া কাগজের কনফেট্টি, সিলিং থেকে মেঝে অবধি ইতস্তত চুপসানো বেলুন – সব মিলিয়ে দৃশ্যটা এখন যুদ্ধশেষে কুরুক্ষেত্রের মত – উত্তরকাণ্ড বললেই হয়। আর আমি যেন সেই ভাঙাহাটে মহাকালের সাক্ষীস্বরূপ, একমাত্র দর্শকের ভূমিকায় অনিচ্ছুক কোনও মূকাভিনেতা।
চোখের সামনের অবস্থাটা যখন ধাতস্থ করছি ধীরে ধীরে, মনের ভেতরের অবস্থাটা বাগ মানছে না তত সহজে – সেটাকে ঠিক আত্মস্থ করতে কষ্ট হচ্ছে তখনো। হাড়ে হাড়ে বুঝছি – বইপড়া শিক্ষা আর জীবনের শিক্ষা ঠিক এক নয়। প্রথমটায় না-বুঝে মুখস্থ করে লগি ঠেলে তবু পার পাওয়া যায়, অন্যটায় অথৈ সাগরে ভুল করলে একেবারে ভরাডুবি। আপাতত এক-জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে এইসব চিন্তায় যখন ডুবে আছি, তখন পাশ দিয়ে নানাবয়সি লোকজন আমায় পেরিয়ে পা বাড়াচ্ছে বাইরের দরজার দিকে। কেউ আলগা করে হ্যান্ডশেক করছে আমার সঙ্গে, কেউ-বা আলতো করে পিঠে মারছে চাপড়। সবাই প্রায় যান্ত্রিক নিয়মেই কানের কাছে আউড়ে যাচ্ছে – ‘হ্যাপি থ্যাঙ্কসগিভিং।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমিও দেখি প্রত্যুত্তরে নীচু গলায় তারই পুনরাবৃত্তি করে চলেছি সকলের সঙ্গে অজান্তেই – ছোটবেলার সেই নামতা মুখস্থ বলার মত, সুর করে। দরজার দিকে চোখ পড়তে দেখি, সপরিবারে বাইরে দাঁড়িয়ে ডক্টর উল্ফ সবাইকে বিদায়-অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত, মুখে অনর্গল সেই ‘হ্যাপি থ্যাঙ্কস্গিভিং।’
আমিও এগোলাম সে-মুখো। আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন – “ইয়ু ডোন্ট হ্যাভ্ টু গো নাউ। ইটস আপ্ টু ইয়ু। হোয়াট্ ডু ইয়ু থিঙ্ক? আর ইয়ু ফিলিং ওকে?”
ওঁর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শুনে আর প্রশ্নবাণের বহর দেখে মনে হল – পারলে একবার কাছাকাছি টেবিলটায় শুইয়ে ফেলে,, আমার আপাদমস্তক একবার যন্ত্রপাতি চালিয়ে সন্ধানী দৃষ্টিতে সরেজমিনে পরীক্ষা করে নেন।
আমি তৎক্ষণাৎ ওঁকে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম – “আই থিঙ্ক আই শুড্ গো নাউ। আয়্যাম্ ডেফিনিটলি ফিলিং ওকে – ডোন্ট ওয়রি।”

আমার ভাবটা তখন – ‘চাচা আপন বাঁচা’, আর সেইসঙ্গে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। উনি একটুক্ষণ কী যেন ভেবে বললেন, “প্লিজ ওয়েট্ আ মোমেন্ট।” তারপর ধাঁ করে ঢুকে গেলেন বাড়ীর ভেতরে।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই – ন যযৌ, ন তস্থৌ। ফিরে যাবার ব্যাপারে আমি এখন নেহাৎই পরনির্ভর। এবারেও লিন্ডাই উদ্ধার করল। এতক্ষণ সে-ও বাইরেই দাঁড়িয়েছিল বাবার আড়ালে। এবার আমার চোখে চোখ রেখে পার্শ্ববর্তিনীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে সে বলল – “হ্যাভ্ ইয়ু মেট্ মাই মম্ ইয়েট্?” এই প্রথম মিসেস্ উল্ফ আমার দিকে চোখ ফেরালেন। সৌম্যকান্তি ধীরস্থির মহিলা – দেখেই মনে হল বেশী কথার মানুষ নন – নিজের মনেই থাকতে ভালবাসেন। উনি এতক্ষণ এখানেই ছিলেন, মাঝে মাঝে হাত নেড়ে সবাইকে বিদায় জানাচ্ছিলেন স্মিত-হেসে – সেইসঙ্গে বিনিময় করছিলেন সংক্ষেপে দুয়েকটি কথাও। তবু আমার মনে হচ্ছিল উনি আছেন ওঁর নিজের জগতে। মৃদুকণ্ঠে উনি আমায় বললেন – “হোপ্ ইয়ু লাইকড দ্য পার্টি।” তারপর একটু ভেবে যোগ করলেন – “ওয়জ্ এভরিথিং ওকে?”
আমি কেতাদুরস্ত ভঙ্গীতে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম – “মেনি থ্যাঙ্কস্ ফর্ ইনভাইটিং মি। ইয়েস্, ইট্ ওয়াজ্ এ ওয়ান্ডারফুল এক্সপিরিয়েন্স।”
“ইট্ ওয়জ্ আওয়ার প্লেজার্।” মাপা-ওজনের কথা-কটি বলে উনি যেন আবার ফিরে গেলেন ওঁর নিজের জগতে, আর কারো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ইতিমধ্যে ব্যস্তসমস্ত পায়ে ফিরে এলেন ডক্টর উলফ – তাঁর পেছনে প্রকাণ্ড দুটো কুকুর, বোধহয় গ্রেট্ ডেন্ – হাতে একটা বোতল আর ছোট্ট একটা-কী কার্ড। সে-দুটো উনি বাড়িয়ে ধরলেন আমার দিকে। বোতলটার লেবেলে দেখি লেখা আছে – ‘ক্র্যানবেরি জুস্’। ডক্টর উল্ফ ততক্ষণে উৎসাহের সঙ্গে বলে চলেছেন – “এ্যামিট্, দিস্ উড্ বি দ্য রাইট্ ড্রিঙ্ক ফর্ ইউ, ট্রাস্ট মি। হ্যাভ্ আ গ্লাস আফটার ইচ্ মীল্ ফর্ সেভেন ডেজ্ স্ট্রেইট্ – ইউ উইল সি – অল্ ইয়োর ট্রাবলস উড্ বি গন্। ইফ্ ইউ হ্যাভ্ এনি প্রবলেম – গিভ মি আ কল্। নো চার্জ! দেয়ার’জ্ মাই নাম্বার।” কার্ডটার দিকে তর্জনীসঙ্কেত করলেন তিনি। ইতিমধ্যে কুকুরদুটো পায়ে-পায়ে আমার দিকে এগিয়ে শুঁকতে শুরু করেছে আমার আপাদমস্তক। সেদিকে তাকিয়ে ডক্টর উল্ফ এবার ঘোষণা করলেন, “ডোন্ট ওয়রি এ্যামিট্, গুড্ নিউজ্! দে আর জাস্ট সেয়িং ‘থ্যাঙ্কস্’; ওঃ, দে লাভড ইয়োর্ মিন্সড্ মিট – আই মিন দ্য টার্কি – অফকোর্স।” আমার চোখে পড়ল – লিন্ডা আর তার মা দুজনে নীরবে তাকাল দুজনের মুখে।

একনিঃশ্বাসে এতখানি বকে এবং নিজের রসিকতায় উচ্চৈস্বরে হো-হো করে একগাল হেসে, আমাকে আর কিছুমাত্র বলার সুযোগ না দিয়ে দু-পা এগিয়ে শোফারকে ডাক দিলেন তিনি এবার – আই-হাউসে আমাকে ফেরত দিয়ে আসার জন্যে। কার্ডটার দিকে এক-ঝলক তাকিয়ে দেখলাম – ওঁর নামের পেছনে ‘উলফ’ বানানে একটা নয়, দু-দুটো ‘এফ্’ – আর পরের লাইনে ইংরেজি বর্ণমালার অনেকগুলোর মধ্যে প্রথমেই জ্বলজ্বল করছে আরো একটা এফ্, তারপরে আর, সি, এস – সার বেঁধে সাজানো।
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। শোফার-সাহেব নেমে পেছনের দরজাটা খুলে ধরে দাঁড়ালেন অভ্যস্ত কায়দায়। গাড়িতে উঠে বসবার আগে আমি ওঁদের সকলের উদ্দেশে বলে উঠলাম – “বাই। থ্যাঙ্কস্ ফর্ দ্য মেমোরিজ্।” হলিউডের সিনেমা দেখে কথাগুলো মুখস্থ করে রেখেছিলাম কবে।
“ইয়েস্, ইট ওয়জ কোয়াইট্ মেমোরেবল। হ্যাপি থ্যাঙ্কস গিভিং।” বললেন ডক্টর উলফ। চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে দেখলাম, লিন্ডা হাত নাড়ছে – মুখে হাসি, মনে কী – কে জানে! পাশে এখনো দাঁড়িয়ে ওর মা – মনে হল এইদিকেই তাকিয়ে আছেন, কিন্তু দেখছেন কিনা ঠিক বোঝা গেল না।
বোতলটা পাশের সিটে নামিয়ে রাখলাম। মনে পড়ে গেল, আই-হাউসের সেই ওরিয়েন্টেশনে ওরা বলেছিল বটে – বিদেশি-হিসেবে এরকম কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলে অ্যামেরিকান ফ্যামিলিকে কাছ থেকে চেনাজানার সুযোগ মিলবে। হ্যাঁ, আমার সে-সুযোগ হল বটে – কিন্তু সত্যিকারের চেনাজানার অনেকই রয়ে গেল বাকি। তাকানোই হল শুধু – দেখা হল না। তাতে আরো সময় দিতে হয়।

বাইরে অন্ধকার – ভেতরেও তাই। পাহাড়ের ঢালু রাস্তাটা বেয়ে নামতে শুরু করেছে গাড়িটা। যবনিকা নেমে আসছে আজকের এই বিকেল থেকে সন্ধে-রাতের অলীক নাটকেও। কতটা পথ যেতে হবে এখনও ঠিক জানিনা – কতটা এসেছি, সেটুকু শুধু জানি। তবে চলতি-পথের আলো-অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল – জীবনের এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। এখানকার এই-দিনগুলোর হুমড়ি-খাওয়া বিপুল বৈচিত্র্যের ছড়াছড়ির মাঝে কখনো মেঘ, কখনো তারার আলো – আমি শুধু তার এক চলমান দর্শকমাত্র – স্পেশাল গেস্ট।

‘দ্য ওয়ার্লড্ ইজ্ এ স্টেজ’ – এই মহান সত্যটা তো পাঁচশ বছর আগেই বলে গিয়েছেন সারাবিশ্বের অন্যতম মহান নাট্যকার। সেখানে নাটক হয়েই চলেছে – গোচরে অগোচরে। আজকের এ’ স্টেজে নায়ক সাজা আমার আর হল না। আজকের নায়ক রয়ে গেলেন নাহয় সেই নিহত টার্কি – শুধু এ-জন্মে কেন, জন্ম-জন্মান্তর ধরে! আমার কেবল দুঃখ রয়ে গেল, নাটকটা ট্র্যাজেডি না কমেডি সেটা জানা গেল না।

শেষের দিকের সিনটা আরেকবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। হ্যাঁ, ঠিক টিপিকাল ডাক্তারের মতই প্রেসক্রিপশন বাতলালেন ডক্টর উল্ফ – যেন জোলাপ দিচ্ছেন রুগীকে। তখনো কানে বাজছে – “দিস্ উড্ বি দ্য রাইট্ ড্রিঙ্ক ফর্ ইউ, ট্রাস্ট মি।” মনে পড়ে গেল, এদেশি কোনো এক শুভানুধ্যায়ী আমাকে একবার বলেছিল – “কথার শেষে কেউ যদি বলে ‘ট্রাস্ট মি’, কক্ষনো বিশ্বাস কোরো না তাকে – সে যতবড় লোকই হোক্।”
পড়ে-পাওয়া উপদেশটা কাজে লাগল আজ। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, একটু যেন চেনা-চেনা ঠেকছে আশপাশটা। ঐ তো ক্যাম্পানিলের চুড়োটা দেখা যাচ্ছে – আর একটু এগোতেই আই-হাউসের মাথাটাও। পাশ থেকে বোতলটা একটু তুলে ধরতেই রাস্তার আলো পড়ে তার লাল রঙটা উচ্ছল হাসির মত চকচকিয়ে উঠল। চোখে-লাগা সেই লাল রঙ – সেটার দিকে সন্দেহের চোখে একবার তাকিয়ে, শেষবারের মত দেখে নিয়ে, নিজের মনেই বেসুরে গান ধরলাম – ‘পাগল যে তুই কণ্ঠ ভরে জানিয়ে দে তাই, জানিয়ে দে, জানিয়ে দে ওরে পাগল।’
গাড়ি থামল গন্তব্যে। বেসুরো গান শুনে শোফার-সাহেব পেছন ফিরে তাকাতেই বোতলটা বাড়িয়ে ধরলাম বিস্ময়-সচকিত শোফার-সাহেবের দিকে। তারপর গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় নেমে, ভাঙা রেকর্ডের মত ওঁর দিকে ছুঁড়ে দিলাম আজকে-শেখা এই স্পেশাল দিনটার সেই সর্ব-পরিচিত বাঁধা-বুলি – ‘হ্যাপি থ্যাঙ্কসগিভিং।’

জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই দক্ষিণ কলকাতার চক্রবেড়েয়। কর্মসূত্রে দেশত্যাগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন। লেখালেখির শখ বরাবরই। ‘শঙ্খ’-নামে পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিয়েছিলেন। তবে অবসর জীবনে চুটিয়ে লেখালেখি করে সেই শখ পূর্ণ হচ্ছে। বেশকিছু লেখা - ‘মাতৃশক্তি’, ‘উৎসব’, ‘সাংবাদিক’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত। প্রকাশিত গ্রন্থ - ১৫১টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইংরেজী অনুবাদ - "Lyrics to Love"। আরো অনুবাদ নিয়ে আর একটি বই বেরোবে খুব শীঘ্রই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *