অটোবান ও কেবল-কার

অটোবান ও কেবল-কার

০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২। জার্মানির অটোবানে ঘন্টায় চারশো সতেরো কিমি বেগে গাড়ি চালিয়ে ভিডিও পোস্ট করলেন এক কোটিপতি: রাদিম পাসার। পাবলিকের রাস্তায় রবিবার ভোর সকালে গাড়ি চালিয়ে এই গতিসীমা তোলেন তিনি। তবে এর পরেও তাঁর এই ৪১৭কিমি বেগ পূর্বের রেকর্ড ভাঙতে পারল না। 

জার্মানির ‘অটোবান’হল সেরকম হাইওয়ে -যেখানে সর্বনিম্ন গতিসীমা বেঁধে দেওয়া: ঘন্টায় ষাট কিমি। এর নিচে কেউ সে রাস্তায় যানবাহন চালাতে পারবে না।

আর সেখানে সর্বোচ্চ গতিসীমা?

অসীম।

‘অটোবান’এ তাত্ত্বিকভাবে যে যতখুশি গতিতে চলতে পারে। কিছু কিছু যানবাহনের ক্ষেত্রে আংশিক সীমা থাকলেও “গতির স্বাধীনতা” – এটাই অটোবানএর মূল পরিচয়। এখানে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। কোথাও গাড়ি থামাতে হবে না।

এই বৈশিষ্ট্যর জন্য অটোবান হয়ে উঠেছে জার্মানির অর্থনীতির ধমনী -দেশের যেকোনো প্রান্তে দ্রুত পরিবহনের এক অনন্য ব্যবস্থা।

তবে ধনীদের কেউ খেয়ালিপনা দেখাতে গিয়ে অটোবানে অন্য চালক-যাত্রীদের জন্য বিপদ ডেকে আনলে আইন বসে থাকবে না।

জার্মান পুলিশ এখন সেই কোটিপটি রাদিম পাসার-কে খুঁজছে। সেই ব্যক্তি চেক প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। গাড়ি চালিয়ে সোজা নিজের দেশে ঢুকে চুপচাপ আছেন। 

অটোবান মানে উন্নয়ন -এমন জিগির তুলেছিলেন হিটলার। জার্মান যুবশক্তিকে ব্যস্ত রাখার জন্য দেশ জুড়ে অটোবান তৈরির মহাযজ্ঞ শুরু করেছিলেন তিনি। 

সুইৎজারল্যান্ডের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন ‘তড়িঘড়ি উন্নয়ন’ নিয়ে বিতর্ক প্রবল। সরকারি দলের অনেকেই দেশ জুড়ে পর্বতের তল খুঁড়ে নতুন টানেল আর অটোবান তৈরির পক্ষে। এরকম উন্নয়ন জনগণের চোখে ধরে – বিজ্ঞাপনের মতন। নির্বাচনে কাজে লাগে এসব।

বিরোধী শিবিরের দাবি: মানুষের চলাচলের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। সম্প্রতি A৯ অটোবান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এমনি বিতর্ক সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। বিরোধী পক্ষের নেতার সাথে আলাপও হল। সেনেক্কেন (Zeneggen) হল পর্বতের কোলে সাড়ে চার হাজার ফুট উচ্চতায় একটি জনবসতি। তাঁদের নেতার দাবি: নতুন রাস্তা লাগবে না, তাঁদের চাই কাছের বড় শহর ফিষ্প এর রেলস্টেশন থেকে সরাসরি কেবল-কারের ব্যবস্থা।

তাঁর মতে: পর্বতের উপরে তাঁদের এলাকায় মানুষ বাড়ছে -চলাচলের চাহিদাও বাড়ছে। সেই পর্যন্ত নতুন রাস্তা বানাতে গেলে পর্বতের গায়ে কাটাকুটি করতে হবে, শত সহস্র গাছ কাটা পড়বে। রাস্তা বানালে মানুষ আরও গাড়ি নিয়ে আসবে সেখানে থাকতে। এতে বেশি বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হবে।

সেই গাড়ি রাখার জন্য দরকার নতুন পার্কিং। মানে আরও গাছ কাটো -পরিবেশ আরও ধ্বংস করো।

কেবল-কারের ব্যবস্থা থাকলে নতুন রাস্তা লাগবে না, এত গাছ কাটতে হবে না। পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না।

২০১২ সাল থেকে লন্ডনে টেমস নদীর উপরে চলছে এখন ১কিমি লম্বা কেবল-কার পরিবহন ব্যবস্থা। কলম্বিয়ার মেডেলিন ও মেক্সিকো সিটি-তে ইতিমধ্যেই গণপরিবহনের কাজে কেবল-কারের ব্যবস্থা সুফল দিচ্ছে।

মেডেলিনের মেট্রো-কেবল কার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে। এর সাফল্যে সেই ব্যবস্থা একটি লাইন থেকে শুরু করে ২০২০ সালে এসে ছয়টি লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে। 

এই কেবল-কারের জন্য অপরাধপ্রবণ মেডেলিন শহরের ছিঁচকে চুরি-ছিনতাই অপরাধও কমে গিয়েছে। অপরাধীদের মাথার উপর দিয়ে কেবলকারে চড়ে পাবলিক পার হয়ে যাচ্ছে যে! 

বিরোধী নেতার যুক্তিগুলো ধারালো মনে হল।

অফিস থেকে ফেরার পথে বয়োজ্যেষ্ঠ এক সুইস দম্পতির সাথে এই নিয়ে আলাপ করলাম।

“আমরা চাইনা লয়কেরবাদ এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হক। সেনেক্কেন এলাকার হাজারেরও কম অধিবাসীর জন্য কেবল-কার -একেবারেই যৌক্তিক নয়। খুবই ব্যয় বহুল প্রজেক্ট। এই টাকা কে ফেরত দিবে?” -তাঁদের মতামত। “ওখানের অধিকাংশেরই বয়স ষাট এর ওপরে। এই বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য এই কেবল-কার বসালে দশ বছর পরেই ঋণ-শোধ দূরের কথা, কেবলকার চালানোর খরচ দেবার কোনো লোক পাওয়া যাবে না।”

এই দম্পতি নিজেরাও অবসরপ্রাপ্ত -কিন্তু সুইসরা আবেগ ও বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য করে চলে।  

১৯৮১ সালে লয়কেরবাদ এর তৎকালীন গেমাইন্ডে-প্রেসিডেন্ট (এলাকার চেয়ারম্যান) লোরেটান (Otto G. Loretan) ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়েছিলেন। এলাকাবাসীকে স্বপ্ন দেখালেন: সেখানে উষ্ণ প্রস্রবণ এবং অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ট্যুরিস্টের ঢল নামবে, যদি রাস্তা-ঘাট, কেবল-কার ও টানেল খুঁড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন করা হয়। টুরিস্টদের ঢলে কাঁড়িকাঁড়ি অর্থ উপার্জন হবে এলাকার সবার।

তাঁর এতসব উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে খরচ হয়েছিল বর্তমান সময়ের হিসেবে প্রায় দশ বিলিয়ন টাকার সমপরিমাণ। এত ঋণ শোধ করার সামর্থ্য ছিল না এলাকার দেড় হাজার অধিবাসীর।  

এরই ঘটনাক্রমে লয়কেরবাদ হল সুইটজারল্যান্ডের প্রথম জনপদ -যাকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে আদালত সেই চেয়ারম্যানকে অস্বচ্ছ টেন্ডার-প্রক্রিয়া ও দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছরের সাজা দেয়।

এরপর থেকে অটোবান কিংবা কেবল-কার -যেকোনো উন্নয়ন-প্রজেক্টের ব্যাপারে সুইসরা একটু বেশি সন্দিহান। 

কেবলকার ব্যবস্থা তৈরি ও পরিচালনায় সুইসরা দক্ষ ও বিষয়ে সুপরিচিত। ২০২০ সালের এক হিসেবে সুইৎজারল্যান্ডে ২৫১টি কেবলকার ও ১২৯টি গন্ডোলা আছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ কেবল-কার ব্যবস্থা: ভেনেজুয়েলার মেরিডা কেবল-কার ১৫,৬৩৩ফুট ওপরে যাত্রীকে উঠিয়ে দেয়। এই আশ্চর্য জিনিস তৈরি করতে ব্যবহার হয়েছে সুইস টেকনোলজি। সুইটজারল্যান্ডের থুন থেকে তিন হাজার টন কাঁচামাল ও আড়াইশো টন যন্ত্রাংশ বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভেনেজুয়েলাতে।

বিশ্বের ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নের জন্য কেবল-কার ব্যবস্থা সুইৎজারল্যান্ডেই কিছু স্থানে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আল্পসের অনেক স্থানেই আছে পারমাফরেস্ট। সেগুলো ক্রমাগত উষ্ণ জলবায়ু পেয়ে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। আল্পসের সুপ্রাচীন গ্লেসিয়ারগুলোর বরফ দ্রুত গলে যাওয়াতে পর্বতের পাথুরে গঠনেও পরিবর্তন আসছে হঠাৎ করে। এমনি এক আচমকা পরিবর্তনের জন্য ২০১৯ সালে ফিশেরআল্প্ ও এগিসহর্ন এর মধ্যে কেবলকার বন্ধ ঘোষণা করে নতুন করে আবারো কাঠামো বসাতে হয়েছিল।

কেবলকার নিয়ে অনেক কথা হল, এবার অটোবানের ইতিহাসে ফিরে যাই।

এই লেখার শুরুতেই বলেছি: চেক কোটিপতি রাদিম পাসার অটোবান বা গণব্যবহার্য রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিসীমার রেকর্ডটি ভাঙতে পারেননি। এই রেকর্ডটি আজও অমলিন: ঘন্টায় ৪৩২.৭ কিমি ! 

রেকর্ডটি হয়েছিল গত শতকে: ১৯৩৮ সালে। 

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট ও ডার্মস্টাডের মাঝের অটোবান অংশে এই রেকর্ড করেন রুডলফ কারাচ্চিওলা -মার্সিডিজ বেঞ্জ এর W১২৫ মডেলের গাড়ি চালিয়ে। সেটা ছিল একটি প্রতিযোগিতার অংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রসিদ্ধ চালক রোজমায়ার তাঁর গাড়ি স্টার্ট করলেন। দ্রুত তাঁর গাড়ির গতি ছাড়িয়ে গেল ঘন্টায় চারশো কিমির সীমা। কারাচ্চিওলা নিজেও ভাবছেন, রেকর্ড আর ভাঙতে দেরি নেই।

হঠাৎ কোথা থেকে পাশ দিয়ে এল এক দমকা ঝোড়ো বাতাস। রোজমায়ার-এর গাড়ি ভারসাম্য ধরে রাখতে পারল না। প্রচন্ড গতিতে রাস্তা ছেড়ে উড়ে গিয়ে উল্টে পাল্টে সব শেষ।

প্রতিদ্বন্দ্বীর সেই মৃত্যু কারাচ্চিওলার মনে গভীর দাগ কেটে গেল। 

তাঁর ভাষায়: “কী অর্থ এইসব প্রতিযোগিতার? কয়েক সেকেন্ডের বেশি গতির জন্য জীবনকে তুচ্ছ করার? এমন প্রতিযোগিতায় কি প্রভূত অগ্রগতি হল? মানব সভ্যতা অনেক কিছু পেল? এসব মুখরোচক শব্দ কি একটি প্রাণের বিনিময়মূল্য হতে পারে?”

আমি অনেক ভাবলাম।

ই প্রথম মনে হল: প্রতিটি জীবন চলে যার যার নিজের ঠিক করা জীবনদর্শনে।

আর একজন যোদ্ধার দর্শন হল: নিজেকে জ্বালিয়ে ফেল শেষ আঁশটুকু পর্যন্ত।

“সে জানতেও চায় না তার ছাই-এর কী হবে!” -রুডলফ কারাচ্চিওলা।

তথ্যঋণঃ Caracciola, Rudolf (translated by Rock, Sigrid) (1961) [1958]. A Racing Car Driver’s World. New York: Farrar, Straus, and Cudahy.

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল 

 
কর্মূসূত্রে সুইৎজারল্যান্ডের বাসিন্দা। বেড়াতে ভালোবাসেন, লিখতেও। জীবনসঙ্গী শর্মিষ্ঠার গান লেখালেখির সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *