সৃষ্টিতত্ত্ব, বিবর্তন ও আল জাহিজ
“যে জাতি তার মেধা ও বুদ্ধিকে কুসংস্কার আর মিথ্যার কাছে সমর্পণ করে, তার উত্তরসূরি না হয়ে বরং আমি ওইসব নিরীহ প্রাণীদের বংশধর হতে চাইব যারা গাছে বাস করে ও লাফিয়ে বেড়ায়।”
(আলডুস হাক্সলি- বিশপ স্যামুয়েল দ্বারা ডারউইনকে ঈশ্বরবিরোধী আখ্যা দেওয়ার প্রতিবাদে)
ইদানীং বিশ্বে জ্ঞানের পথে কোন কোন ক্ষেত্রে উল্টো হাঁটা শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মানে আর কিছু নয়, বিজ্ঞান-চর্চা নিজের মহলে অব্যাহত আছে ঠিকই, তবে তার সমান্তরাল পথে অপবিজ্ঞান, অযুক্তি আর মৌলবাদ প্রায় সর্বত্রই জোরকদমে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতি, ধর্মব্যবসা আর ঘৃণ্য ক্ষমতাদখলের লড়াই এমন সুপরিকল্পিতভাবে জাল বিস্তার করছে যে সাধারণ মানুষের দিশেহারা অবস্থা। উচ্চবর্গীয়, সুশিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একাংশকে এরা যেভাবে হাত করেছে যে তাঁদেরকে আমরা অবিশ্বাসও করতে পারছি না, তার সঙ্গে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে প্রচারযন্ত্রও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। ফলে দশচক্রে রাতারাতি ভগবানকে ভূত বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, আর তা এমন সন্তর্পণে সারা হচ্ছে যে আমরা টেরও পাচ্ছিনা কখন এই অযৌক্তিক ক্রিয়াকাণ্ডের জালে জ্ঞাতসারে বা অজান্তেই নিজেরা জড়িয়ে পড়ছি। আজ এমনই একটা সমস্যা নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই, যা শুনলে আজকের যুগে হাস্যকর মনে হবে, অথচ গলাবাজি দিয়ে আবার প্রাচীন অন্ধকার যুগের দিনগুলোকে টেনে আনা হচ্ছে।
একদিন ফেসবুকেরই এক গ্রুপে চোখে পড়ল কোন এক বাংলাদেশী মুসলমান বন্ধু নিজের দেশের সরকারের শিক্ষানীতির সমালোচনা করছেন এই মর্মে যে ইসলাম-বিরোধী ডারউইন-তত্ত্ব এখনও কেন বাংলাদেশী শিশুদের পড়ানো হচ্ছে! তিনি নিজে একজন শিক্ষাবিদ, নামী লোক। তাই আমার একটু অবাক লাগল, তাঁর সঙ্গে কিঞ্চিৎ চ্যাট বা লিখিত বার্তালাপ হল। পণ্ডিত মানুষ, এরকম অযৌক্তিক কথা কেন বলছেন? একটু গোলমেলে উত্তর পেলাম। বিশ্ব আর প্রাণীজগতের উৎপত্তির নাকি দু’রকম তত্ত্বের কথা জানা যায়- এক সৃষ্টিতত্ত্ব, মানে সব কিছু কোন এক অদৃশ্য ঈশ্বরের ইচ্ছেয় তৈরি হয়েছে আর দুই বিবর্তনবাদ, মানে বিশ্বসংসার, জীবজগৎ সব কিছু ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে উঠেছে। কোরান-মতে মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব, তাঁকে আল্লাহ নিজের আদলে সৃষ্টি করেছেন, মনুষ্যেতর জীব বা এককোষী প্রাণী অ্যামিবা থেকে ধাপে-ধাপে মানুষে রূপান্তরণের কাহিনী- সে তো মনুষ্যজাতির অপমান, ঈশ্বর বা আল্লাহর অপমান! আমি ভেবে দেখলাম, ইসলাম কেন, খ্রিস্টান, হিন্দু সব ধর্মের বইয়েই তো প্রকারান্তরে তাই লেখা আছে। তবে সত্য তো আর ঈশ্বরের অপেক্ষায় থাকে না, এ জিনিষ অস্বীকার করলে জেনেটিক বিজ্ঞান ভুল প্রমাণিত হয়। যদি ধরেও নিই যে ঈশ্বর আমাদিগকে তাঁর নিজের আদলে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে এটাও মেনে নিতে হচ্ছে যে ঈশ্বর নিরাকার নন আর অদৃশ্যও নন- মানে তাঁর রূপটা যখন সবার জানা! তবে তিনি থাকেন কোথায়? চর্মচক্ষুতে তাঁকে কেউ দেখে রূপবর্ণনা করেছেন বলে তো শুনিনি, জানিনি, তাহলে?
হিন্দুধর্ম মনে হয় এযাবৎ টিকে থাকা পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম, তাই হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে এ সম্বন্ধে কী বলা হয়েছে তাই খুঁজতে বসলাম। কিন্তু সে কি এতই সহজ কাজ! সনাতন ধর্মের রকমারি মতভেদ। ঈশ্বর হয়ত তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে নিজের আদলে গড়েছেন- কিন্তু তাহলে ‘নিরাকারবাদ’-এর প্রসঙ্গ বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রে আছে কেন? বাইবেল বা কোরানও শুনি নিরাকার ঈশ্বরবাদের দলে। তাহলে মানুষ ঈশ্বরের আকৃতিসম্পন্ন এই যুক্তি কি আদৌ ধোপে টেকে? আবার সাকার ঈশ্বরেরও তো লক্ষ রূপ! এমনকি মৎস্য-কুর্ম-বরাহ-নৃসিংহ জাতীয় জীব বা অর্ধমানবও তো ঈশ্বরের অবতার। ইদানীং এমন দাবীও অনেকে করছেন যে দশাবতারবাদের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানসম্মত বিবর্তনবাদ (Evolution)-এর তত্ত্ব হিন্দুশাস্ত্রেই প্রথম জানানো হয়, যা নাকি ডারউইন তত্ত্বের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। অ্যামিবা, অ্যালগি, ফাংগি জাতীয় প্রারম্ভিক জীবজগৎ ছেড়ে দিলে বিবর্তন আসে এইভাবেই- জলচর (মৎস্য), উভচর (কুর্ম), স্থলচর (বরাহ), অদ্ভুত-দর্শন প্রাগৈতিহাসিক জীব (নৃসিংহ), খর্বকায় আদিম মানুষ (বামন)। তারপরের বিবর্তন সভ্যতার ক্রমোন্নতির ধাপ বেয়ে, মানে শিকারজীবি (কুঠার হাতে পরশুরাম), ক্ষেপণাস্ত্র ধনুর্বাণধারী রাম। পরে শিকার দুর্লভ হওয়ায় চাষের উন্নতিকল্পে এলেন হলধারী বলরাম (মতান্তরে কৃষ্ণ)। আর দু’টো ‘পলিটিক্যাল পোস্টিং’-এ অবতীর্ণ হলেন বুদ্ধ আর কল্কি, সে এক অন্য কাহিনী। এছাড়া হিন্দুশাস্ত্রে তো সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকারী বিষ্ণু আর প্রলয়ংকর শিব ছাড়া বিবর্তনবাদের আর কিছু পেলাম না। এটা অনস্বীকার্য যে ভারতীয় বিজ্ঞান, বিশেষতঃ চিকিৎসাশাস্ত্র, খগোলবিদ্যা আর গণিতচর্চা এককালে প্রচুর উন্নতি করেছিল, তবে সৃষ্টিরহস্য, বিশেষতঃ প্রাণ আর প্রাণীসৃষ্টি নিয়ে মাথা অপেক্ষাকৃত কম ঘেমেছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল, ঐতরেয় আর ছান্দোগ্য উপনিষদে যা আছে মানে স্বর্ণডিম্বের কাহিনী, তা নেহাৎই কল্পনা, অবশ্য অন্ধকার জগতে অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডপতির পরমাত্মা আর বিশাল অণ্ড থেকে বিশ্বসৃষ্টির গল্প কোন রূপকও হতে পারে। অবতারের মধ্যে বিবর্তন খোঁজা- এই ধারণাটা একেবারে আধুনিক, কোন শাস্ত্রে বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদ বা পুরাণে এরকম তত্ত্ব পেলাম না, পাঠকরা পেয়ে থাকলে জানাবেন দয়া করে।
ইসলাম বা ক্রিশ্চিয়ানিটিও যতদূর জানি অন্য কিছু বলে না। হিন্দু অদ্বৈতদর্শন ঠিক বিবর্তনবাদ নিয়ে কিছু না বললেও একটা সংশয়ের ধোঁয়াশা তৈরি করে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছে হল, তিনি পৃথিবী তৈরি করলেন, ইচ্ছে হল জীবজন্তু তৈরি করলেন, ইচ্ছে হল নিজের আদলে প্রথম মানুষ আদম, তারপর তারই একটা পাঁজর দিয়ে প্রথম নারী ইভ(হবা)-কে গড়ে তুললেন- এগুলো বিশ্বাসের বস্তু, যুক্তিতে তার ব্যাখ্যা মেলে না। এই ধারণা বা বিশ্বাসেরই নাম ‘ক্রিয়েশনিজম’ বা সৃষ্টিতত্ত্ব যেখানে মনে করা হয় ‘ঐশ্বরিক কোন ঘটনা থেকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও প্রাণের সৃষ্টি’ হয়েছিল যা প্রকৃতির বিবর্তনবাদের ধারণার বিরোধী। সবচেয়ে বড় কথা, যে ঈশ্বরকে শুরুতেই নিরাবয়ব বলে বর্ণনা করা হচ্ছে তিনি নিজের মত দেখতে এক প্রাণী সৃষ্টি করলেন কিভাবে? প্রশ্ন কি জাগে না? ধর্মগুরুদের চোখ রাঙানিতে এর সদুত্তর খোঁজার কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না, তবে গোপনে গবেষণা চলছিল। ব্রুনো, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাসদের মত সাহস আর ক’জনের হয়!
আধুনিক বিজ্ঞানে যত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়েছে তার অন্যতম হল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব। তাঁর এই তত্ত্বে দেখানো হয়েছে প্রাণীরা সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নিয়মে ধীরে ধীরে কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অথচ অল্প বয়সে এই চার্লসকে দেখে তেমন বিপ্লবী বলে মনে হত না। বাবার শখ মেটাতে তিনি এডিনবরার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, তবে রক্ত দেখে অসুস্থ হয়ে পড়া চার্লসকে সে আশায় জলাঞ্জলি দিতে হল অচিরেই। উপরন্তু তিনি ছিলেন অলস প্রকৃতির মানুষ, তবে সেকালের সম্পন্ন-ঘরের ব্রিটিশ যুবকদের মতো তাঁরও প্রকৃতি সম্বন্ধে একটা স্বাভাবিক ঔৎসুক্য ছিল। সেই কৌতূহল মেটাতেই কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করার সময় তিনি ভূ-তথ্য অনুসন্ধানী ‘এইচএমএস বিগল’ নামের জাহাজে প্রকৃতিবিদের কাজ নিয়ে সমুদ্রপথে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন।
‘বিগল’-এ থাকাকালীন পাঁচ বছর ধরে বিশ্ব-পরিক্রমা আর অনুসন্ধান শেষ করে ডারউইন ইংল্যান্ড ফেরেন ১৮৩৬ সালে। দীর্ঘ ভ্রমণকালে দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার উপকূল আর প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রচুর জীবাশ্ম বা ফসিল সংগ্রহ করেন, বিভিন্ন প্রাণী আর গাছপালার, স্থানীয় ভূ-তত্ত্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর তাদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তারপর ফিরে এসে শুরু করেন সেসব নিয়ে বিশ্লেষণ। বছর দুই গবেষণার পর জীবজগতের আবির্ভাব আর বিবর্তন নিয়ে একটা পরিষ্কার রূপরেখা তিনি গড়ে ফেলেন, কিন্তু ১৮৫৮ সালের আগে কিছু প্রকাশ করেন না। সেই সময় আলফ্রেড ওয়ালেস নামে অন্য একজন বিজ্ঞানী ডারউইনের কাজের কিছুটা আভাস পেয়ে নিজের কাজের সম্বন্ধে তাঁকে একটি চিঠি লেখেন। ডারউইন অবাক হয়ে দেখেন যে জীবের উৎস আর প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে তাঁদের দু’জনের মতের বেশ মিল আছে। তখন দু’জনেই আলাদাভাবে তাঁদের গবেষণার বিবরণ প্রকাশ করলেন যা ১লা জুলাই ১৮৫৮তে পঠিত হয় ব্রিটেনের লিনিয়েন সোসাইটিতে। এই কাজের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডারউইন ও ওয়ালেসের প্রাকৃতিক নির্বাচন-তত্ত্ব’, কিন্তু পরে ওয়ালেস এ ব্যাপারে ডারউইনের গবেষণার মৌলিকত্ব স্বীকার করায় তিনি পুরো গবেষণা-পত্রটি নিজের নামেই প্রকাশ করেন।
১৮৫৯ সালে ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পেশিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ নামে চার্লস ডারউইন একটি বই প্রকাশ করেন যা আলোড়িত করে তোলে গোটা বিশ্বকে, ভেঙে চুরমার করে দেয় সব প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসকে। তাঁর এই গ্রন্থে তিনি বিবর্তনবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনো প্রাণী বিবর্তন বা ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে আপন পরিবেশের জন্যে বিশেষায়িত হতে হতে এক সময় নতুন একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত হয় আর এভাবেই পরিবেশ আর প্রয়োজনানুসারে, বস্তুতঃ টিকে থাকার তাগিদেই নতুন নতুন প্রাণীর সৃষ্টি হতে থাকে।’ বিবর্তনবাদের এই তত্ত্বটি আমাদের পৃথিবীর পশুপাখি ও উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে বুঝতে বড়ো ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এই প্রক্রিয়াকে ইংরেজিতে বলা হয় ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন যার মাধ্যমে একটি প্রাণীর জনগোষ্ঠী থেকে নতুন প্রজাতির উদয় ঘটে।
ডারউইন ১৮৩৬-এ ইংল্যান্ড ফেরেন, গবেষণা শেষ করেন ১৮৩৮-এ। তাহলে ১৮৩৮-’৫৮ এই দীর্ঘ কুড়ি বছর বিলম্বের কারণ কী? মনে হয় কোপারনিকাস, ব্রুনো, কেপলার আর গ্যালিলিওদের দুর্দশার উদাহরণ দেখার পর গোঁড়া খ্রিষ্টান সমাজকে এই প্রবল আঘাতখানা দিতে তাঁর সাহসে কুলোচ্ছিল না। যাঁদের কথা বললাম তাঁদের কাজ ছিল মূলতঃ জ্যোতির্বিদ্যা বা খগোলশাস্ত্র নিয়ে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিছুটা আপোষের পথে চলায় আর গবেষণার কাজ অনেকটা লুকিয়ে বা অপ্রকাশিত রাখায় তাঁরা মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পান, কিন্তু অনমনীয়তার ফলে ১৬০০ সালে মরতে হয় জিওর্দানো ব্রুনোকে। আমাদের দেশেও কি আর্যভট্ট-ব্রহ্মগুপ্ত-ভাস্করাচার্যদের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়নি? হয়ত সেজন্যেই বেদোত্তর দর্শনের একটা বড় অংশ যেমন বৈশেষিক, সাংখ্য বা পিঙ্গলের ছন্দশাস্ত্রকে তাঁরা বিজ্ঞান বলে বর্ণনা করতে সে যুগে সাহস পাননি, ষড়-দর্শন আর তন্ত্র-মন্ত্রের ছদ্ম-আবরণের আড়ালে হয়ত ছদ্মবেশে লুকিয়ে রয়েছে অনেক জাগতিক সত্য যার কিছু কিছু অংশ আজ উন্মোচিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু ব্রুনো-যুগের পর আড়াইশো বছর কেটে গেছে, আর ১৮৫৮তে ওয়ালেসের সমর্থন পাবার পর আর ফিরে তাকাননি ডারউইন। ধর্মীয় শাসনকে উপেক্ষা করে তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর বিবর্তন-তত্ত্ব।
আগেই বলেছি, প্রাচীন ভারতে এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তার কোনও ইতিহাস বা তথ্য নেই, কিন্তু মুসলিম আরব দুনিয়ার শত গোঁড়ামির মাঝেও অন্ততঃ একজন এই ‘ঈশ্বরের একদিন হঠাৎ সৃষ্টির ইচ্ছে হল আর তিনি সৃষ্টি করলেন’- এমন অযৌক্তিক কাণ্ড মেনে নিতে পারছিলেন না। চার্লস ডারউইনের প্রায় হাজার বছর আগে ইসলামিক বিশ্বে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের একজন প্রবক্তা ছিলেন। নবম শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইরাকের একজন মুসলিম দার্শনিক প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণীকুলের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে তার উপর একটি বই লিখেছিলেন। যে পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন ঘটে তিনি তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’। এই দার্শনিকের আসল নাম ছিল আবু উসমান আমর বাহার আলকানানি আল-বাসরি, তবে ইতিহাসে তিনি ‘আল জাহিজ’ নামেই বেশি পরিচিত। এই নামটি বিখ্যাত হয়ে আছে তাঁর লেখা প্রাণীবিজ্ঞান সংক্রান্ত একটি বই-এর কারণে। গ্রন্থটির নাম ‘কিতাব আল-হায়ওয়ান’ অর্থাৎ প্রাণীদের বিষয়ে বই।
এই ফাঁকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্মের প্রেক্ষাপটে কোথায় কিভাবে কিছুটা খোলা হাওয়া এসেছিল আর কখন কিভাবে আর কেনই বা তাতে ছন্দপতন ঘটল এ নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করা যাক। এযাবৎ টিকে থাকা ধর্ম-সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে হিন্দুধর্মই বোধহয় প্রাচীনতম। তবে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত আর চিকিৎসাশাস্ত্রের চর্চা প্রায় কাছাকাছি সময়ে শুরু হয়েছিল প্রাচীন ভারত, চীন, সুমের (ইরান-ইরাক), গ্রীস আর উত্তর আফ্রিকার মরক্কো-তিউনিসিয়া-মিশরে। পরে খ্রিস্টধর্মের আদিযুগে ধর্মীয় গোঁড়ামি রোম-গ্রীস সহ ইউরোপে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চাকে নিরুৎসাহিত আর হতোদ্যম করলেও, আরব দেশগুলিতে ইসলামের আসার পরেও প্রায় সাত-আট শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানচর্চা অব্যাহত ছিল। তার আগে ভারতে শূন্যের ব্যবহার, পাই-এর মান জানা হয়ে গেছে, গ্রহতারকার গতিবিধি নিয়ে গবেষণা হয়েছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে চরক-জীবক চিকিৎসা-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেছেন, আলেকজান্দ্রিয়া-গ্রীসে ইউক্লিড আর পিথাগোরাস জ্যামিতি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করে ফেলেছেন। তখনই সেই ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরব-দুনিয়ায় চিকিৎসা-খগোলশাস্ত্র আর গণিতচর্চা এগিয়ে চলে। তারপর এল মহানবী হজরতের কুরানশরীফ যার প্রতি শব্দ আল্লাহের নিজের রচনা বলে জানানো হল ইসলাম-অনুগামীদের, তবে তার সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চার কোন আপাত-বিরোধ ছিল না, বিশেষতঃ উত্তর আফ্রিকা আর এশিয়ার বাগদাদ-দামাস্কাসে। সমস্যা খ্রিস্টান-সমাজে হয়েছিল আরও বেশি করে আর পোপের গোঁড়ামির ফলে প্রায় চৌদ্দ-শতাব্দী ধরে এর জের চলেছিল। কুরানের আগমনে মুসলিম বিশ্বেও নতুনধারার জ্ঞানের চর্চা ব্যাহত হয়েছিল, তবে সেটা মূলতঃ সৌদি আরব আর সংলগ্ন উপসাগরীয় দেশগুলিতে। হ্যাঁ, আব্বাসিদ খলিফা হারুন-অল-রশিদের রাজত্বে (৭৮৬-৮০৯ খ্রীঃ) তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আবার এই ধারা জোরকদমে শুরু হল, আর সবকিছুর পতন শুরু হল ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে আল-মামুনের মৃত্যুতে, চলল পরবর্তীকালে মঙ্গোল আধিপত্যের আর তেরোর শতকের ইউরোপীয় ক্রুসেডের সময় পর্যন্ত। এরপরে ভারতে এল তুর্কী-মোগলরা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্থান নিল ভক্তি, সংগীত, সাহিত্য আর ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামি। ইসলাম দেশগুলি পেল যুদ্ধজয়ের আর সম্পদের স্বাদ, ধর্মগুরুদের ধর্মপ্রচারে উস্কানির ফলে কমে এল জ্ঞানচর্চা। এই অবসরে ইউরোপের কিছু সাহসী আর নির্ভীক জ্ঞানতপস্বী প্রাণভয় তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছিল বলেই হয়ত ইউরোপ শেষে শুরু করেই সর্বাগ্রে এগিয়ে গেল সর্বাঙ্গীণ নবজাগরণের পথে, তবে সে অন্য প্রসঙ্গ। বলতে গেলে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ, সেই ষষ্ঠ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী ছিল ইসলামীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এই সময়ের ইসলামিক কিছু সেরা জ্ঞানতাপসের নাম করছি- অল খোয়ারিজমি (আল-জেব্রা, আল-গরিদম্), অল-বত্তানি (জ্যোতিষ-গণিত), জাবির-ইবন-হাইয়ান (আলকেমি বা রসায়ন), আল-জাহারাওয়ি (শল্যচিকিৎসা), ইবন-বতুতা (ভূপর্যটন ও ভ্রমণকাহিনী), ইবন-খালদুন (সমাজতত্ত্ব), আল-জাজারি (যন্ত্রবিজ্ঞান)– ইত্যাদি। আজ আমরা ডারউইনের পূর্বসূরি তেমনই এক ইসলামি তাত্ত্বিক-পণ্ডিতের কথা বলব, যিনি বহুদিন ধরে হারিয়ে ছিলেন বিস্মৃতির আড়ালে।
আল-জাহিজের জন্ম হয়েছিল ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ইরাকের বসরা শহরে, মুতাজিলাহ্ আন্দোলনের সময়। এসময় ধর্মতাত্ত্বিক কিছু মতবাদ জনপ্রিয় হচ্ছিল যেখানে মানুষের যুক্তির চর্চার উপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। তখন ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের চরম সময়। ইরাকের প্রাচীন শহর বাগদাদ আর বসরাকে কেন্দ্র করে তখন হত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। গণিত, খগোলবিদ্যা আর দর্শনের বিখ্যাত বইগুলির গ্রিক থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হত, জোরালো তর্ক-বিতর্ক হত ধর্ম, বিজ্ঞান আর দর্শন বিষয়ে। এসব আলোচনা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল আল জাহিজের চিন্তাধারা। চীনা বনিকেরা ততদিনে ইরাকে কাগজের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে যার ফলে বিভিন্ন তত্ত্ব লিখিত আকারে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
তরুণ আল-জাহিজ তখন বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন, আরবি ব্যাকরণ এবং সাহিত্য- এসব নানা বিষয়ে লেখালেখি করতে শুরু করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি নাকি দু’শোর মতো বই প্রকাশ করেছিলেন যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ এখনও টিকে আছে। এই বইগুলোর মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে ‘কিতাব আল-হায়ওয়ান’ (The Book of Animals) বইটি। এতে বিশ্বকোষের ধাঁচে প্রায় সাড়ে তিনশো প্রাণীর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটিতে এমন কিছু ধারণা তুলে ধরা হয়েছে যার সঙ্গে পরবর্তী কালের বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ-তত্ত্বের চমকপ্রদ মিল পাওয়া যায়।
আল জাহিজ তাঁর বইতে লিখেছেন, “বেঁচে থাকার জন্যে প্রাণীদেরকে লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় তাদের খাবারের জন্যেও, এবং তারা নিজেরাই যাতে অপরের খাদ্য না হয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। এমনকি, প্রজননের জন্যেও তাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়। যোগ্যতর প্রাণীই এভাবে লড়াই করে টিকে থাকে (Struggle for existence and survival of the fittest)। এসব কারণে তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে রূপান্তর ঘটাতে বাধ্য হয়।” আল-জাহিজ এ কথা পরিষ্কার বলে গেছেন যে প্রাণীকুলের সংগ্রামের মূল লক্ষ্য হল টিকে থাকা আর তার জন্যে ক্রমিক উন্নতির মাধ্যমে আর শক্তিশালী প্রজাতিতে বিবর্তিত হওয়া। “নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয় (Evolution by Natural Selection)।”
তিনি আরো লিখেছেন, “যেসব প্রাণী প্রজনন ঘটাতে টিকে থাকতে পারে তারা তাদের সফল বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে (Heredity, যা থেকে পরে Genetic Inheritance-এর ধারণা আসে) ।”
আল-জাহিজের এসব ধারণা পরবর্তী মুসলিম চিন্তাবিদদেরকেও প্রভাবিত করেছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন আল-ফারাবি, আল-আরাবি, আল বিরুনী এবং ইবনে খালদুন। পাকিস্তানের ‘আধ্যাত্মিক পিতা’ মোহাম্মদ ‘আল্লামা’ ইকবালও আল জাহিজের এসব তত্ত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত তাঁর বক্তব্যের একটি সঙ্কলনে তিনি বলেছিলেন, “আল-জাহিজ দেখিয়ে দিয়েছেন অভিবাসন (immigration) এবং পরিবেশে পরিবর্তনের কারণে প্রাণীদের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে।”
কথিত আছে জ্ঞানতপস্বী আল জাহিজ যখন একটি আলমারি থেকে বই নামাতে গিয়েছিলেন তখন আলমারিটি তাঁর গায়ে পড়ে গেলে তিনি মারা যান। তখন তিনি ৯২ বৎসর বয়সী বৃদ্ধ।
বিবর্তনবাদের ধারণায় মুসলিম বিশ্বের অবদান বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে গোপনীয় কোন বিষয় নয়। এমনকি, চার্লস ডারউইনের একজন সমসাময়িক বিজ্ঞানী উইলিয়াম ড্রেপার ১৮৭৮ সালে ‘বিবর্তনবাদের মোহাম্মদীয় তত্ত্ব’ নিয়ে কথা বলেছিলেন।
অবশ্যই চার্লস ডারউইন মুসলিম বিজ্ঞানী আল-জাহিজের চিন্তাধারা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিনা কিম্বা তিনি আরবি বুঝতেন কিনা তার পক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ নেই। ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানী প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন যেখানে প্রাণীর টিকে থাকার সংগ্রামের কথা বিশদ এবং পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিবিসি রেডিওর জন্যে ইসলাম ও বিজ্ঞান নামের একটি ধারাবাহিক তথ্যচিত্রের নির্মাতা বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিক এহসান মাসুদ বলেছেন, বিবর্তনবাদের ধারণা তৈরিতে আরো যারা অবদান রেখেছেন তাঁদেরকে স্মরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, দশম শতাব্দীর ইরাকে, যখন বাসরা ও বাগদাদ ইসলামিক সভ্যতা ও শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তখনও ক্রিয়েশনিজমের ধারণা খুব একটা জোরালো ছিল না। ইসলামিক গোঁড়ামির অভ্যুত্থান হয় তার অনেক পরে, হয়ত কোন আর্থ-সামাজিক কারণের ভিত্তিতে।
বাস্তবে আমরা দেখি ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে গোঁড়ামি শুরু থেকেই ছিল, ঊনবিংশ শতাব্দী নাগাদ তারা যুক্তিসম্মত আধুনিক বিজ্ঞানকে মেনে নিতে শুরু করে। কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইসলাম প্রায় দশম বা একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি উদারপন্থী ছিল, পরে এদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি কিভাবে বিস্তার লাভ করতে শুরু করে, তা বোধহয় সমাজ-বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে, জানিনা তাঁদের কাছে এর সদুত্তর আছে কিনা। ডারউইন-তত্ত্ব যদিও বিবর্তন-সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি, জেনেটিক বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি তাও হয়ত দেবে, আর তাতে আল-জাহিজ বা ডারউইন কোন একদিন ভুল প্রমাণিত হলেও তাঁরা প্রাণীর উৎপত্তি আর বিকাশ সম্বন্ধে যে যুক্তিসিদ্ধ মতামত দিয়ে গেছেন তা কখনই অর্থহীন হয়ে যাবে না। এর বিপরীতে সৃষ্টিতত্ত্বের স্বপক্ষে আছে শুধু বিশ্বাস, যুক্তি নেই। তাহলে আজ এতদিন পরে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন, যেখানে এই প্রশ্নের পেছনে ধর্মীয় সংস্কার ছাড়া কোন যুক্তি বা তথ্যপ্রমাণ নেই? তবে কি আমাদের মানবসমাজের ‘অবনতি’র পথে বিবর্তন শুরু হয়েছে, সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল-এর সেই বুড়োর বয়স ঘুরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিতে? এ নিয়ে প্রশ্ন প্রবন্ধের গোড়াতেই করেছি, পাঠকের অনুসন্ধিৎসা ন্যূনতম জাগাতে পারলেই বুঝব আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ।
সহায়তা-পঞ্জী-
- Theory of Evolution- Wikipedia
- Charles Darwin সম্বন্ধে পাঠ্যপুস্তক – Contemporary Thoughts.
- Sapiens- Yuval Noah Harari
- Brave New World- Aldous Huxley
- Golden Ages of Islamic Civilization- A presentation by Shamjit KM.
- Islamic Golden Age- Wikipedia page.
- Al-Jahiz : various web-sites on.
- Website- https://www.brown.edu
- Website- https://www.muslimphilosophy.com/
- ওয়েব-পেজ- ডারউইনের ১০০০ বছর আগে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব।
- https://blog.muktomona.com/2015/07/28/46960 ইত্যাদি।
চিত্র ঋণ – অন্তর্জাল
3 Comments