রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় সঙ্গীত
পৃথিবীর দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ – ভারত আর বাংলাদেশ। দুটো দেশের মধ্যে সম্পর্ক যেখানেই গিয়ে দাঁড়াক, দেশ দুটো রবীন্দ্রবন্ধনে অন্তত বাঁধা থাকবে – বাঙালি হিসেবে এ নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করতে পারি। কেউ কেউ আবার শ্রীলঙ্কাকেও এর সঙ্গে যোগ করতে চান। তাঁদের দাবি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও রবীন্দ্রনাথের লেখা! সেটা কি সত্যি? সম্ভবত নয়, তবে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কিছু কম হয়নি – তার রেশ এখনও চলছে। তিন হলে চমৎকার হত, কিন্তু দুই-ই বা কম কি! আর কোন কবির ভাগ্যে এরকম সম্মান জুটেছে একবার শুনি? মুশকিল হল, এ নিয়ে যে নির্ভেজাল আনন্দ করব – তার উপায় নেই। অনেকেই বোধহয় ব্যাপারটা জানেন, তাই সংক্ষেপে বলি –
ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমনঅধিনায়ক’। ২৮শে অক্টোবর, ১৯৩৭, কোলকাতার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গানটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি পাবার পর ১৯৫০ সালের ২৪শে জানুয়ারি, গানের প্রথম স্তবকটি সরকারি ভাবে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হল। অত্যন্ত আনন্দের খবর, কিন্তু সেটা কি নিশ্চিন্তে উপভোগ করার জো আছে! গানের জন্মলগ্ন থেকেই নাকি একটা প্রশ্ন উঠেছিল প্রথম লাইনটি নিয়ে। ১৯১১ সালে যখন এটি লেখা হয়, সম্পূর্ণ কাকতালীয় সেসময় ইংল্যান্ডের সম্রাট পঞ্চম জর্জ কোলকাতায় ছিলেন। তাহলে কি গানটি রচিত হয়েছিল রাজপ্রশস্তি হিসেবে – নইলে ‘জনগণমনঅধিনায়ক’-এর অর্থ কি? ভারত-মাতাকে উদ্দেশ্য করেও তো গান লিখতে পারতেন! বিতর্কটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে পরে রবীন্দ্রনাথকেও জবাবদিহি করতে হয়েছিল। পুলিনবিহারী সেনকে ২০শে নভেম্বর ১৯৩৬ তারিখে রবীন্দ্রনাথের একটা চিঠি উদ্ধৃত করছি –
জনগণমনঅধিনায়ক গানটি কোনো উপলক্ষ্য-নিরপেক্ষ ভাবে আমি লিখেছি কিনা তুমি জিজ্ঞাসা করেছ। বুঝতে পারছি এই গানটি নিয়ে দেশের কোনো কোনো মহলে যে দুর্বাক্যের উদ্ভব হয়েছে তারই প্রসঙ্গে প্রশ্নটি তোমার মনে জেগে উঠল। তোমার চিঠির জবাব দিচ্ছি কলহের উষ্মা বাড়াবার জন্য নয়, ঐ গান রচনা সম্বন্ধে তোমার কৌতূহল মেটাবার জন্যে।…
সে বৎসর ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমনঅধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থায় যুগযুগধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক– সেই যুগ যুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না, সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। কেননা তাঁর ভক্তি যতই প্রবল থাক্, বুদ্ধির অভাব ছিল না। আজ মতভেদবশত আমার প্রতি ক্রুদ্ধ ভাবটা দুশ্চিন্তার বিষয় নয়, কিন্তু বুদ্ধিভ্রংশটা দুর্লক্ষণ। [1]
[সূত্রঃ গীতবিতান.নেট]
এ ধুয়ো মিলিয়ে যায় নি। ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ ঠিক কে – সে নিয়ে এখনও কফি টেবিলে আলোচনা চলে।
এবার আসি বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমার সোনার বাঙলা’ গানটি রচিত হয়েছিল। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে এ গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয়সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হল। ঠিক হল, আনুষ্ঠানিকভাবে কেবল প্রথম চার লাইন বাদন করা হবে। ‘আমার সোনার বাঙলা’-র কথা বা বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক নেই। কিন্তু দুয়েকজন প্রশ্ন তুলেছিলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ আসছেন কেন? সেটাকে যখন ঠেকানো গেল না, তখন প্রশ্ন উঠল – এটাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত কেন বলা হবে, এটা তো অন্য একজনের দেওয়া সুর!
একদিক থেকে কথাটা ভুল নয়। রবীন্দ্রনাথের বহুগানেই নানান প্রচলিত সুরের প্রয়োগ রয়েছে। কথা আর ভাবকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্যে ঠিক যে সুরটা লাগবে ওঁর মনে হয়েছে – সেটাকেই রবীন্দ্রনাথ লাগিয়েছেন। সুরের কপিরাইট নিয়ে তখন বোধহয় কেউ অত মাথা ঘামাতেন না। অধ্যাপক মনসুরুদ্দিনের “হারামণি” গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
“শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাত-সারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন্ -এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল—
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে”
মনসুরুদ্দিনের ‘হারামণি’ বইটি আমি পড়ি নি। এই উদ্ধৃতিটা পেয়েছি ইণ্টারনেটে। গীতবিতানের একটি প্রামাণ্য সাইটে সাইট হল গীতবিতান.নেট। সেখানে আছে —
“কুষ্টিয়া অঞ্চলের কোনো ডাকঘরের গগন হরকরা রচিত ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানের সুর ‘আমার সোনার বাংলা’-তে আরোপ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “[‘উচ্চারি আলোর বন্দনা’ -সন্জিদা খাতুন, ১৩৮০ বৈশাখ]।
এই ডাকঘরটি হল শিলাইদহ, আর গগন হরকরা হলেন গগন চন্দ্র দাস, যিনি ছিলেন বিশিষ্ট বাউল গীতিকার। জন্ম অধুনা বাংলাদেশের শিলাইদহের নিকটস্থ আড়পাড়া গ্রামে। পেশা ছিল শিলাইদহ ডাকঘরে চিঠি বিলি করা। নীচে দুটি গানই দেওয়া হল।
প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গান ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’-এর সুরের ভিত্তি ছিল গগন হরকরার ‘ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে’ গানটি। দুটো ক্ষেত্রেই কথার সঙ্গে সুর অপূর্ব মানিয়েছে।
এবার আসা যাক শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের আলোচনায়। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন এটিও রবীন্দ্রনাথ রচনা। ইন্টারনেট ঘাঁটলে বেশ কিছু ব্লগ,এমন কি অনলাইন সংবাদপত্রেও এ নিয়ে লেখালেখি চোখে পড়ে। মূল বক্তব্য – শ্রীলঙ্কা থেকে আনন্দ সামারাকুন নামে একটি ছাত্র বিশ্বভারতীতে এসেছিলেন পড়াশুনো করতে এবং অল্পদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। আনন্দের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ নাকি বাংলায় “নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা’ গানটি লিখে সুর করে আনন্দকে দেন। আনন্দ দেশে ফিরে গিয়ে এটিকে সিংহলীতে অনুবাদ করে রেকর্ড করেন। পরে ১৯৫১ সালে গানটি শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। বহুপঠিত উইকিপিডিয়া-তে বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দ্য হিন্দু’-র ‘মতামত’ বিভাগে প্রকাশিত বাংলাদেশী সাংবাদিক হারুন হাবীবের লেখাকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে এই বিশ্বাসকে সমর্থন করা হয়েছে।
উইকিপিডিয়া বহুপঠিত হলেও সেটাকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরা হয় না, অনেক ভুল তথ্যও সেখানে থাকে! হারুণ হাবীব নিজে এই মূল্যবান তথ্যটি কোত্থেকে পেয়েছেন – সেটার কোনও উল্লেখ ওঁর মতামতের মধ্যে নেই। রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, কোথাও কিন্তু এই মতের সমর্থনে কিছু চোখে পড়ে নি। আরও অবাক লাগে, এত বড় একটা ঘটনা সদা-সতর্ক বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির নজর এড়িয়ে গেল কি করে!
উইকিপিডিয়াতে বলা হয়েছে এই গানের সুরের সঙ্গে ‘জয় জগদীশ্বর হরে’ গানটির মিল আছে। আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রভাবের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
যাঁরা ‘জয় জগদীশ্বর হরে’ গানটা শোনেন নি তাঁদের জন্যে সেই লিঙ্কটাও দিয়ে দিলাম।
পাঠকরা বিচার করবেন দুটোতে মিল আছে কিনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রভাবও পাঠকরাই বিচার করুন। যদি থেকে থাকে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। ইন্টারনেটে নানান সূত্র ঘেঁটে এটুকু বুঝলাম শ্রীলঙ্কার খ্যাতিমান সংগীত ব্যক্তিত্ব আনন্দ সামারাকুন ১৯৩০-এ বিশ্বভারতীতে চারুকলা ও সংগীত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছিলেন। যদিও বিশ্বভারতীতে অল্প সময় – সম্ভবত মাস ছয়েক ছিলেন। অনুমান করা যেতে পারে সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পান ও তাঁর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। “নমো নমো মাতা, আপা শ্রী লঙ্কা’ এই দেশাত্মবোধক গানটিতে সেই প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়। গানটি আনন্দ রচনা করেন ও সুর দেন ১৯৪০ সালে এবং এটি রেকর্ড করা হয় ১৯৪৬ সালে। ১৯৫১ সালে এটি শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। কিন্তু গানের প্রথম লাইনে ‘নমো নমো মাতা’ ব্যবহার করা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। পুরো বিতর্কটাই কুসংস্কারের ওপর ভিত্তি করে। এর জন্যেই আনন্দের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৬২ সালে প্রথম লাইনটি বদলে ‘শ্রীলঙ্কা মাতা, আপা শ্রীলঙ্কা নমো নমো নমো নমো মাতা’ করা হয়। সেই জন্যেই নাকি, ১৯৬২ সালে আনন্দ অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেন! জাতীয় সঙ্গীতে ওঁর লাইনটি বদলানোর জন্যে আনন্দ অপমানিত ও বিষাদগ্রস্ত হয়েছিলেন – এটা বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু শুধু কি সেই জন্যেই তিনি আত্মহত্যার করেছিলেন?
যাক সে কথা, এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রশ্ন ছিল, ভারত, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা – এই তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের রচনা কিনা। উত্তরে বলা যায়, তিনটি জাতীয় সঙ্গীতেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন। একটিতে কথা ও সুরে, দ্বিতীয়টিতে কথায়, আর তৃতীয়টিতে প্রভাবে। পৃথিবীর সব বাঙালি ও অবাঙালি রবীন্দ্র-অনুরাগীদের কাছে এটা আনন্দের খবর।