ডু-ইট-ইয়োরসেল্ফ
দু হাজার একুশ সালের শেষে কোভিড ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে বুক ফুলিয়ে ভারতবর্ষে গিয়ে আত্মীয়স্বজনকে ভ্যাকসিনের উপকারিতা, এবং তা না নেবার পরিণতি সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান দেবার পর আমার বউ আর আমি দুজনেই কোভিডে আক্রান্ত হলাম। পাছে বৃদ্ধা মা আক্রান্ত হন সেই ভয়ে দুজনে একটা দশফুট-বাই-দশফুট কামরায় ঘাপটি মেরে রইলুম এবং আত্মীয়-বন্ধুদের নানা সুপরামর্শ যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করতে লাগলুম। কেউ বললেন গরমজল, কেউ গার্গল, কেউ মাল্টিভিটামিন, কেউ প্রোটিন, কেউ ভেপার। আবার যারা শুধু কনসালটেন্সি নয়, ডাইরেক্ট অ্যাকশনে বিশ্বাসী, তাঁরা সবাই পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। যেমন আমার মাসি বাড়তি প্রোটিনের নিদান দেবার পরের দিনই পাঠিয়ে দিলেন একবাটি চিকেন স্ট্যু। ভেপার নিতে ফাঁকি দিচ্ছি সন্দেহ ক’রে জ্যাঠতুতো দিদি সকাল সকাল এসে দরজায় পৌঁছে দিয়ে গেল একখানা ভেপার নেবার যন্ত্র!
কিন্তু এরপর হল মহা মুশকিল। ভেপার নেবার যন্ত্রটার চার পাঁচটা অংশ, সেগুলো জিগ-স পাজলের মত সঠিকভাবে জোড়া দিতে গিয়ে ঘেমে গেলুম। এমনিতেই আমি যাকে বলে ভীষণরকম টেকনিক্যালি চ্যালেঞ্জড। ঘ্যাঁঘাসুরের গল্পের মত নৌকা গড়তে গেলেই গামলা হয়ে যায়।
তা আজকাল এইসব কঠিন পরিস্থিতি থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য আছে ইউটিউবের ডি-আই-ওয়াই অর্থাৎ ডু-ইট-ইওরসেল্ফ ভিডিও। হাতে আছে মুঠোফোন। তাই আমি ইউটিউবে “ভেপার মেশিন অ্যাসেম্বলি” গোছের জিনিসপত্র লিখে সার্চ কত্তে লাগলুম। কিন্তু তাতে কেবলই ভিকস কোম্পানির যন্ত্রের নানারকম ভিডিও উঠে আসে। তার ল্যাজা মুড়ো কোনটাই দিদির দেওয়া ভেপার মেশিনের মত নয়।
কিন্তু আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই, দাঁতে দাঁত চেপে সার্চ করতে লাগলাম। অবশেষে পেয়েও গেলাম একখানা ভিডিও, যাতে দেখানো যন্ত্রটি বিলকুল দিদির দেওয়া মেশিনের মতই। শুধু একটাই সমস্যা। ভিডিওটিতে ধারাভাষ্য দেওয়া হয়েছে তেলুগু ভাষায়। এক ভদ্রমহিলা হাসি হাসি মুখে তেলুগু ভাষায় মেশিন জোড়া দেওয়া শেখাচ্ছেন।
প্রথমে সামান্য ঘাবড়ে গেলেও আমি ভেবে দেখলাম এটা কোন সমস্যাই নয়। ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজ শহরে থাকাকালীন একবার ভুল করে বাবা-মা-বউকে নিয়ে হিন্দি ভেবে একটা তেলুগু সিনেমা দেখতে ঢুকে পড়েছিলাম। সিংহম টু। আড়াই ঘন্টা ধ’রে তেলুগু ভাষায় ধাঁইধপাধপ ঢিস্যুম ঢিস্যুম দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। বাবাও আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, “বাঃ, সবই তো দিব্যি বোঝা যাচ্ছে!” তেলুগু সিনেমা ম্যানেজ হয়ে গেল, আর এ তো তুচ্ছ ভেপার মেশিন।
তা সেই তেলুগু ভাষার ভিডিও দেখে অচিরেই আমি জোড়া লাগিয়ে ফেললাম ভেপার মেশিন। তারপর একটা চোঙা মাইকের মত জিনিসের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে তাতে ভেপার নিতেই সর্দিরা সব হুড়হুড়িয়ে বেরোতে শুরু করল। তার সাথে হাজার হাজার অযুত নিযুত ডেল্টা-ওমিক্রনরাও যেন পালাই পালাই রব তুলল। শরীরটা দিব্যি ঝরঝরে লাগতে লাগল।
তেলুগুভাষার ভিডিওলব্ধ বিদ্যার রোমাঞ্চকর উপাখ্যান এবং তৎসহ ভেপার নেবার ছবি হোয়াটসঅ্যাপ মারফৎ কিছু আত্মীয় ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম। চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। ক্যালিফোর্নিয়াবাসী এক বন্ধু বলল ইংরাজী ডি-ওয়াই-আই ভিডিওগুলো কোন কম্মের নয় – ফালতু বকবক করে। সে নাকি এরপর থেকে তেলুগু ডি-আই-ওয়াই ভিডিওই খুঁজবে। এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত এক বন্ধুর মাথায় আবার ঝটিতি একটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি খেলে গেল – ভেপার নেবার মেশিনে এক একটা কোভিড ভ্যারিয়েন্টের জন্য এক একটা রঙের ভেপোরাইজার ট্যাবলেট দিয়ে মার্কেটিং করলে মারমার কাটকাট করে বিক্রি হবার সম্ভাবনা।
কিন্তু দুদিন পর আমার শিক্ষার গর্ব চুরমার হয়ে গেল। ভেপার নেবার ছবিটা দেখে এক হতচ্ছাড়া স্কুলের বন্ধু জানালে যে ওই চোঙা মাইকের মত অ্যাটাচমেন্টটা নাকি মহিলাদের মুখে স্টিম নিয়ে ফেশিয়াল করতে ব্যবহৃত হয়। ভেপার নেবার জন্য নাকি একটা ছোট অ্যাটাচমেন্ট আছে। ইউটিউব ভিডিওতে ভদ্রমহিলা দুটোই দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তফাৎটা তেলুগু ভাষায় বলেছেন বলে বুঝিনি। যাই হোক, ভেপারও হল, রূপটানও হল। টু ইন ওয়ান। এ জিনিস কোভিড আর তেলুগু ডি-আই-ওয়াই না থাকলে জীবনেও হত না।
আমি অবিশ্যি এই ঘটনার পর থেকে বাংলা ছাড়া আর অন্য কোন ভাষায় ডি-আই-ওয়াই ভিডিও দেখা বন্ধ করে দিয়েছি।