নিঃশঙ্ক পৃথিবী

নিঃশঙ্ক পৃথিবী

যে দেশের পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষা প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলা জাতি জন্ম গ্রহণ না করে।

–ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (বিধবা বিবাহ, দ্বিতীয় পুস্তক)

মেয়েদের নিরাপত্তা সমাজ তুচ্ছ করেছে

সারা দেশ, তথা সারা পৃথিবী নারী-নির্যাতন আর নারীর অধিকার নিয়ে আজ সোচ্চার হয়েছে। যদিও অভাবনীয় আর সাঙ্ঘাতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, তবু ক্ষীণ আশা হয় এই ঘটনার পর হয়তো অবস্থার কিছু উন্নতি হবে, হয়তো অবশেষে মেয়েরা তাদের প্রাপ্য অধিকার আর সম্মান পাবে।

কিন্তু সত্যিই কি তাই হবে? যুগ যুগ ধরে মেয়েদের ওপর অত্যাচারকে, মেয়েদের নিরাপত্তার  অভাবকে আমরা তুচ্ছ করে এসেছি, সাহায্যের ব্যাকুল ডাককে অগ্রাহ্য করেছি। আর এটা কেবল পৃথিবীর একটা দুটো দেশের কথা নয়, অভিযোগটি মোটামুটি সমানভাবে সব জায়গায় প্রযোজ্য। (২০১৪ সালে রাষ্ট্রসংঘের ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন-এর রিসার্চ অনুযায়ী পৃথিবীর যে কোনো দেশে তিনজনের মধ্যে একজন মেয়ে নির্যাতনের শিকার হন।) সেই পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে বহমান অত্যাচার বন্ধ করার চেষ্টার অভাব নিয়ে ভাবা দরকার। শুধুমাত্র ভারত বা দক্ষিণ এশিয়া নয়, সারা পৃথিবীতে মেয়েদের আর অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীকে, তাদের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করার প্রবণতার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশে নয়, যে সব দেশে আইন ও তার প্রয়োগ সম্বন্ধে সচেতনতা উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়, সেখানেও এই উদাসীনতা দেখা যায়। অনেক সময়েই দেখা যায়, যে আইন যে ভাবে পুরুষ তথা “উচ্চস্তরের” মানুষকে সাহায্য করছে, মহিলাদের বা প্রান্তিক দলের মানুষের প্রতি তা ততোটা দয়ালু নয়।

এই দ্বিচারিতা, এই অবজ্ঞা কেন? কবে থেকে আর কেন সারা পৃথিবীতে মেয়েরা লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়াল, নিজেদের অধিকারের স্থান তাদের ছেড়ে দিতে হল? এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে এই উত্তর দেওয়া যায় না। আধুনিক পৃথিবীতে তাই যতটুকু চোখ-কানের আওতায় পড়ে তাই নিয়ে ভাবার চেষ্টা করি।

আগেই বলেছি, কেবল আমাদের দেশ বা সংস্কৃতি নয়, নারী নির্যাতন আর অবহেলার সমস্যা সারা প্রৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ভারতীয় বা দক্ষিণ এশিয় সমাজে এই সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই খানিকটা ধারণা আছে। জন্মের পর থেকেই ছেলে ও মেয়েদের নিজ নিজ অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা করে দেওয়া – ব্রেনওয়াশিংই বলা যায়, কেমন করে মেয়েদের নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেবল তাদের নিজেরই (আর জি করের ডাক্তার মেয়েটি মরণোত্তরেও কেন সে একলা সেমিনার রুমে গেছিল এই তিরস্কার থেকে মুক্তি পায়নি), তাদের চলাফেরা, পোষাক পরা, ব্যবহার, স্বামী বা অন্যান্যদের আদেশ মেনে চলা, বলতে গেলে দাসত্ব করা, ইত্যাদি সব নীতিই এমনভাবে স্থির করা যাতে তাদের সমাজে অবস্থান সবসময় পুরুষের নীচে থাকে। সবসময়ে তাদের তৈরি থাকতে হবে কীভাবে নিজের শরীর সামলে রাখতে হবে শিকারীদের হাত থেকে। ঘরে, বাইরে, বাসে, ট্রামে, স্কুলে, কলেজে, কর্মক্ষেত্রে – সব জায়গায় সব সময়ে। যদি কেউ তার ওপর হামলা করে, দোষটা বর্তাবে মেয়েটির ওপর। অকুস্থল থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়া ছাড়া পুরুষদের তেমন কিছু দায়িত্ব থাকে না। তার কোনো শাস্তি হবে কিনা বা হলেও কী হবে সেগুলো পুরুষটির সামাজিক অবস্থানের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। কোথায় তার কোন চেনাশোনা আছে, বা তার কত পয়সাকড়ি আছে, তাই দিয়ে ব্যাপারটা নির্ধারণ হয়। তাই তাদের ওপর বিশেষ কোনো ‘চাপ’ থাকে না। সাধারণতঃ  এ ব্যাপারে মেয়েদের অভিজ্ঞতা হল, যখন তখন যে কোনো পুরুষ এসে যে কোনো ভাবে সুযোগ নিতে পারে। অতএব তার কাজ হল যদি সম্ভব, যে ভাবে পারে, পালানো – তারপর ঘরে গিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকা। যা ঘটেছে সেটা তার লজ্জা। সেই ঘটনা জানাজানি হলে তাকেই সেই লজ্জা বহন করে চলতে হবে বাকি জীবন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীর কোনরকম শাস্তির ব্যবস্থা হয়না – সামাজিক লজ্জার ভয়ে মেয়েটি বা তার বাড়ির লোকে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়াই ঠিক মনে করেন। শুধু অবিবাহিত মেয়েদের নয়, এমনকী ডিভোর্সি মেয়েদেরও অনেক রকম লজ্জার মুখোমুখি হতে হয়, যা পুরুষদের বেলায় কখনওই হয় না।

নারীবাদ সমাজে পরিবর্তন এনেছে

এই সামাজিক লজ্জার বিষয়টি খুব মজার। কেউ কিছু জানতে পারলে লজ্জা পুরপুরি মেয়েটির, অত্যাচারীর বা আর কারো নয়। এই লজ্জার ব্যাপারটা নানাভাবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। ভারতীয় মেয়েরা সাধারণতঃ লজ্জা পায় তার ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তাই নিয়ে। এ’ছাড়াও প্রায় সব জায়গাতেই লজ্জা অন্যরকমভাবেও আসে। “ডোমেস্টিক ভায়লেন্সের শিকার” কথাটা একটা মস্ত বড় লজ্জার, যদিও অত্যাচারিতা এই নির্যাতনের জন্য দায়ী  নয় (এই সত্যি কথাটা বেশির ভাগ মানুষই যদিও মানেন না বরং মনে করেন সে নিশ্চয় এমন কিছু করেছে যার জন্য তার স্বামী, ভালোমানুষটি রাগ সামলাতে পারেননি।)। এই কথা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন জানলে তাদের চোখে নীচু হয়ে যাবে মেয়েটি। অনেক সময় মেয়েরা লজ্জা বা ‘শেম’ অনুভব করেন, হয়ত নিজের জন্য নয়, স্বামীর মুখ বাঁচাতে। এই লজ্জা মেয়েদের সোচ্চার হতে বাধা দেয়, বছরের পর বছর সহ্য করে যেতে বলে, আর কখনো কখনো মৃত্যু পর্য্যন্ত ঠেলে দেয়। এই লজ্জা সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিষম বোঝা – মা, বাবা, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পুলিশ, চার্চ আর অন্যান্য ধর্মীয় অনুশাসন, আর যে যে জায়গার থেকে মেয়েটি সহায়তা আশা করে – তাদের দিক থেকেই আসে। এঁরাই অনেক সময় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান – অত্যাচারিতাকে তার কথা বলা থেকে নিরত করেন। ফলে নিগৃহীতা আর তার পরিবার চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করেন। নিগৃহীত মা্নুষের যে সহায়তা বা সাপোর্ট সিস্টেম দরকার হয়, তা সামাজিক আর পারিপার্শ্বিক থেকে পাওয়া সহজ নয়।  এঁরা উপদেশ দেন, হয়ত ভালো ভেবেই দেন, কিন্তু বুঝতে পারেন না এই সময়ে এই মানুষটির শুকনো উপদেশের চেয়ে সহানুভূতি, সঙ্গে থাকা, আর বন্ধুত্বের হাত অনেক বেশি প্রয়োজন।

এই সামাজিক লজ্জার আর উল্টো পিঠ সামাজিক অনুশাসন, যা অনেক সময়েই নির্মম অত্যাচারের রূপ নেয়। যা অত্যাচারিতার মানসিক আঘাত আরো বাড়িয়ে দেয়। আদ্যিকাল থেকে প্রত্যেক সমাজ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেয়েদের (অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের কথাও আমরা ভুলব না) দমন করে রাখার বিভিন্ন উপায় বের করে চলেছে। সেই অনুশাসন চালিয়ে আমরা এক দিক থেকে সমাজের একদলকে দমন আরেক দিক থেকে হিংসাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের ইতিহাস, সাহিত্য, আর ধর্মের অনুশাসন থেকে পুরুষ আর মেয়েদের মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট বোঝা যায়, আর তা এখনও চলছে। যুগ যুগ ধরে এই বৈষম্যমূলক চিন্তা এক গোষ্ঠীর ওপর অন্য আরেক গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার প্রবল ইচ্ছের পৃষ্ঠপোষকতা করে – নারী ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর ওপর লাগাতার নির্যাতন ধামাচাপা দিয়ে রাখে যাতে নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে, আর এই প্রথা চালু থাকে। সব দেশেই এই প্রথাগুলি সমাজের স্তরে স্তরে গেঁথে রয়েছে, যার ফলে যেখানে মানুষ বিচার চাইতে যায়, সেখানেও নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়। 

ছেলেদের থেকে শেখানো হয়, তারা বাড়ির সবার বাছাই করা পছন্দের মানুষ। তারা যাই করুক না, সাহায্য পাওয়া, শেল্টার পাওয়া, তাদের জন্মগত অধিকার। তারা যদি এমন কোনও কাজ করে যা শাস্তিযোগ্য, তখনও সাহায্য পাবে, সবাই তাদের বাঁচাবার জন্য যা প্রয়োজন করবেন – তাদের সব অপরাধ ক্ষমা হয়ে যাবে। ছেলেদের অনেক অপরাধই উড়িয়ে দেওয়া হয়, “ছেলেরা তো অমনই হয়” বলে। পশ্চিমি দুনিয়ায় পুরুষমানুষ হওয়ার আরো অনেক সংজ্ঞা আছে যা এখন পৃথিবীর অন্য জায়গাতেও সঞ্চারিত হচ্ছে। প্রকৃত পুরুষমানুষ কাঁদে না, ভয় পায় না, কঠিন মনের হয়, মেয়েদের তুচ্ছ করে – এমন আরো অনেক সংজ্ঞাসহ পৌরুষের এক ভয়াবহ ছবি তৈরি করা হয়েছে। 

এই্ বৈষম্য সমাজের কাঠামোর মধ্যেও যেমন দেখা যায় কোর্ট হাউসে বা বিচার বিভাগেও দেখা যায়। পাশ্চাত্য সমাজের দুটো উদাহরণ দিই।

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের মামলা চলছে। মেয়েটি বাচ্চাদের ভরণপোষণের জন্য আবেদন করছে – অনেক খেটেখুটে নিজে কেস তৈরি করে এনেছে। পয়সার অভাবে উকিল রাখতে পারেনি। কোর্টে এসেই ছেলেটি হাসিখুশিভাবে গল্প শুরু করল জাজের সঙ্গে – তিনিও নির্বিবাদে যোগ দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা চললো। তারপর মেয়েটির আবেদন নিয়ে তেমন কিছু সময় খরচ করা গেল না। শুকনো মুখে সে ফিরে এল। আবার কবে পরের ডে্ট পড়বে, আর তার নিজের পক্ষে কথা বলার সুযোগ হবে কিনা সে জানেনা।

দ্বিতীয় গল্প একটি ঘুমন্ত মেয়ের ওপর যৌন অত্যাচার নিয়ে। অত্যাচারীর শাস্তি হল মাত্র ছ’মাস – সে বড় কলেজের নামকরা খেলোয়াড়। একটা চমৎকার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে তো লাভ নেই! ছেলেটির বাবার মতে মোটে কুড়ি বছর তার বয়স, তাই তাকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত। মেয়েটির ভালমন্দ, তার প্রতি সুবিচার হওয়া, এসব অতি তুচ্ছ ব্যাপার। এই ধরণের কেসে এমন দ্বিচারিতা আখছার চলে – নির্যাতক ব্যাপারটা ভালোভাবে জানে, তাই তার কাছে এমন জ্ঞান হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়।  

এই সব দেশ নিজেদের আইন আর তার প্রয়োগ নিয়ে গর্ব করতে পারে – কিছু বড় কেসে হয়ত সেটা যোগ্য গর্ব। কিন্তু ছোটো ছোটো কেসে বা পারিবারিক (ফ্যামিলি) কোর্টে অনেক সময়েই বিচারে ঘাটতি পড়ে যায়। পাশ্চাত্যের সমাজেও সামাজিক অনুশাসন আর লজ্জা বা ‘শেম’ও বিশেষ কাজ করে – কাছের মানুষদের কাছ থেকে সহায়তার অভাবও ঘটে।

ইদানীং নানারকম রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ধর্মীয় মতামত চেষ্টা করে চলেছে মেয়েদের জন্য তৈরী আইন উঠিয়ে দিতে (আমেরিকায় মেয়েদের প্রজননের খোলা অধিকার, Roe V Wade, খর্ব করা এর জ্বলন্ত উদাহরণ)। আমাদের দেশে মেয়েদের পক্ষে যদি কোনও আইন লেখা হয়, তাকে “খারাপ” মেয়েদের হাতের অস্ত্র, গোল্ডডিগারদের পোয়া বারো, ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে কাটছাঁট করে দেওয়ার নজির রয়েছে।

এই আলোচনা ছোট্টো করে শেষ করা খুবই কঠিন। যদিও কিছুটা পথ আমরা এগিয়েছি, এখনও অনেক পথ চলা বাকি। গুহামানবের সময় মেয়েরা পেরিয়ে এসেছেন সত্যি। অনেকে নিজ নিজ দেশে, সমাজে, সর্বোচ্চ পদ অধিকার করছেন। মহিলা ও পুরুষেরা যাঁরা এই আন্দোলন সমর্থন করেন, তাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আর সফলও হচ্ছেন। তবুও এখনো আসল কাজটাই বাকি রয়ে গেছে। এখনও পথ খুঁজে বার করতে হবে কেমন করে ‘অভয়া’দের আস্বস্ত করতে পারব এই পৃথিবী তাদের জন্য নিঃশঙ্ক। এই পৃথিবী নিঃশঙ্ক, নিরাপদ করার প্রথম পদক্ষেপ হল মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের পরস্পরকে সমান ভাবে শ্রদ্ধা করা, সবাইকে সমান ভাবে অনুধাবন করা।

———-

ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

১৯৯২ সাল থেকে মহিলাদের অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত কাজে ব্রতী। নির্যাতিতাদের সাহায্যার্থে টেক্সাসে সংগঠিত দুটি দক্ষিণ এশিয়/এশিয় সংস্থার রূপায়নের অংশীদার তিনি। ২০০০ সাল থেকে ক্যালিফর্নিয়ায় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত –লক্ষ্য নারী সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পূরণ করা।। বর্তমানে একটি ননপ্রফিট সংস্থায় সাপোর্ট গ্রুপ পরিচালনা করেন এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ‘মৈত্রী’ সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *