বাংলায় নারীশিক্ষার ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা
ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসের গতিপথের দিকে তাকালে দেখা যায় ভারতীয় শিক্ষার প্রামাণ্য নিদর্শন বৈদিক সাহিত্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্যে শিক্ষার যে বিবরণ পাওয়া যায় সেখানে নারীর তুলনায় পুরুষদের শিক্ষার প্রসঙ্গটি বেশি সুস্পষ্ট ঠিকই কিন্তু এটাও স্বীকার্য যে পুরুষ এবং নারী উভয়েরই শিক্ষার নিদর্শন রয়েছে সেখানে। অর্থাৎ, সেসময় স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত ছিল। স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন থাকলেও নারীদের জন্য আলাদা কোন শিক্ষালয় ছিল কিনা তার উল্লেখ অবশ্য পাওয়া যায়না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, এবং বৈশ্য সমাজের এই তিন উচ্চ শ্রেণীর নারীদের বেদ অধ্যয়নের পূর্ণ অধিকার ছিল।১ বিশাল বৈদিক সাহিত্যের সংহিতায়, ব্রাহ্মণে, উপনিষদে অনেক বিদূষীর নাম পরিলক্ষিত হয়।
ব্রহ্মবাদিনী এবং ব্রহ্মচারিণী – এই দুই প্রকারের নারীর নাম পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। ব্রহ্মচারিণীগণ গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ করার পূর্বে পুরুষ ব্রহ্মচারীর মতো কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতেন বলে উল্লেখিত হয়েছে অথর্ববেদে (১১/৬)।২ মহাভারতেও শাণ্ডিল্য এবং গর্গের কন্যাগণকে ব্রহ্মচারিণী নামে অভিহিত করা হয়েছে।
ব্রহ্মচারিণীগণ ব্রহ্মচর্য পালন করার পর গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ করতেন কিন্তু ব্রহ্মবাদিনীগণ আজীবন চিরকুমারী থাকতেন। বৈদিক দেবতা বিষয়ক গ্রন্থ ‘বৃহদ্দেবতা’য় বিশ্ববারা, রোমশা, লোপামুদ্রা, অম্ভৃণী বাক, জুহু, পৌলমী, কাক্ষীবতী, ঘোষা, জরিতা প্রমুখ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিনারীগনকে ব্রহ্মচারিণী রূপে অভিহিত করা হয়েছে। এরূপ সাতাশ জন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিনারীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে ‘বৃহদ্দেবতা’য়।
বৈদিক যুগে যে নারী অধ্যাপিকাও ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাণিনির সূত্র-এ। তিনি আচার্যা এবং আচার্যাণী, উপধ্যায়া এবং উপধ্যায়ানী এই দুটি শব্দের ব্যুৎপত্তিমূলক সূত্র নির্ণয় করে শব্দ জোড়ার পার্থক্য দেখিয়েছেন। আচার্যা এবং উপধ্যায়া শব্দের অর্থ হল অধ্যাপিকা এবং আচার্যাণী, উপধ্যায়ানী এই শব্দগুলি গুরুপত্নী অর্থে ব্যবহৃত হয়। পতঞ্জলি তাঁর মহাভাষ্যে পাণিনি কৃত এই সূত্রগুলির ব্যাখা প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় কয়েকজন অধ্যাপিকার নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি আপিশালা এবং ঔদমেধার নাম উল্লেখ করেছেন বিদুষী অধ্যাপিকা হিসেবে। যে নারী বৈয়াকরণ আপিশালিগোষ্ঠীর সৃষ্ট ব্যাকরণের একটি বিশেষ শাখা শিক্ষা করেছেন তিনি পরিচিত হতেন আপিশালা নামে। ঔদমেধী নামক আচার্যের ছাত্রীদের বলা হতো ঔদমেদী।৩
বৈদিক যুগের বিদূষী ব্রহ্মবাদিনী নারীদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্যা ছিলেন জ্ঞানী, বিদুষী, তপস্বিনী গার্গী। বৃহাদারণ্যক উপনিষদে বিবৃত হয়েছে যাজ্ঞবল্ক্য এবং গার্গীর মধ্যে জনক রাজের রাজসভায় অনুষ্ঠিত বিতর্কের বিবরণ। সেই বিচার সভায় বিচার্য বিষয় ছিল – ব্রহ্মজ্ঞান, উপস্থিত ছিলেন বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত ঋষি এবং বিচার সভায় পুরষ্কার হিসেবে ছিল একশত গোধন। সে বিতর্ক শেষ পর্যন্ত চলেছিল যাজ্ঞবল্ক্য এবং গার্গীর মধ্যে। এই বিতর্কে কারো জয় বা পরাজয় নির্ণীত হয়নি। তাঁদের দার্শনিক বিতর্ক থেকে একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে উভয়েই ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ে সমান পারদর্শী ছিলেন।
এই উপনিষদের আরেকটি আধ্যাত্মিক আলোচনা যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যাজ্ঞবল্ক্য এবং তাঁর পত্নী মৈত্রেয়ীর মধ্যে, তা প্রমাণ দেয় বৈদিক যুগের উন্নত নারীশিক্ষা ব্যবস্থার। যাজ্ঞবল্ক্য প্রবজ্যা গ্রহণ করার অভিপ্রায়ে পার্থিব সম্পত্তি, দুই স্ত্রী কাত্যায়নী এবং মৈত্রেয়ীর মধ্যে বন্টন করে দিতে চাইলে মৈত্রেয়ী তা প্রত্যাখ্যান করেন, পার্থিব সম্পদ তাঁকে অমৃতত্ব বা ব্রহ্মপদ দিতে পারবে না বলে। ব্রহ্মবাদিনী মৈত্রেয়ীর এই বাণীর মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবাত্মার চিরন্তন অভীপ্সার কথা।
অগ্নিহোত্রী নামক একটি প্রাত্যহিক হোম সম্পাদনার সময়কে কেন্দ্র করে একবার বিদ্বান ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসা করার জন্য নামগোত্রহীন এবং কেবলমাত্র ‘কুমারী’ নামে উল্লেখিত বিদূষীর কাছে যান এবং তিনি সে সমস্যার সমাধানও করে দেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উল্লেখিত এই প্রসঙ্গ থেকে এই ধারণা করা যেতে পারে যে সেই সময় পাণ্ডিত্যে, বৈদগ্ধ্যে কোন কোন বিদুষী নারী বৈদিক পুরুষ ঋষিকে অতিক্রম করে গেছেন।
বৈদিক যুগে কন্যা সন্তান কাঙ্খিত৪ ছিল অথচ পরিবর্তিত সময়ে সামাজিক অনুশাসনের নাগপাশে নারী একসময় হয়ে উঠলেন কারো না কারো অনুগ্রহীতা। মনু তাঁর স্মৃতিতে বললেন –
পিতা রক্ষতি কৌমরে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
পুত্রশ্চ স্থাবিরে ভাবে ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমইতি।। (মহাভারত অনুশাসন পর্ব ৪৬/১৪)
মহাভারতে নারীশিক্ষার যে বিবরণ পাওয়া যায় সেখানে দেখা যায় কন্যার অভিভাবকগণ স্বগৃহে শিক্ষক রেখে কন্যাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। অধ্যাপকগণ নিজ নিজ কন্যাদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করতেন। এই নিয়ম পরবর্তীকালেও কোন কোন অবিভাবক অনুসরণ করেছিলেন।
মুসলমান শাসনকালে মুসলমান মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকলেও মেয়েরা ঘরেই কোরানের সুরা আবৃত্তি করতে শিখত। সম্ভ্রান্ত এবং রাজপরিবারের মহিলাদের মধ্যে বিদ্যাশিক্ষার সমাদর ছিল বলে মনে করা হয়। নূরজাহান সুশিক্ষিতা ছিলেন। শাহজাহানের কন্যা জাহানারার আত্মজীবনী বিখ্যাত গ্রন্থ। ঔরঙ্গজেবের কন্যা জেব উন্নিসা বিদুষী ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। মুসলিম নারীরা মাদ্রাসা স্থাপন করে শিক্ষার মর্যাদা দিয়েছেন। আকবরের ধাত্রীমা মাহম অনগ একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুসলিম সমাজে অবরোধ প্রথা যদিও কঠোর ছিল তবুও মেয়েরা মক্তবে সাত বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেদের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত।
ষোড়শ শতাব্দীর বাংলার উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল চৈতন্যদেবের আবির্ভাব। চৈতন্যদেবের উদার এবং সাম্যবাদী ধর্মান্দোলনের প্রভাবে বহুমুখী সুপরিবর্তন আসে বঙ্গ সংস্কৃতিতে। মূলত এই ধর্মান্দোলনের প্রভাবে নারীশিক্ষার সচেতনতা প্রথম প্রবেশ করেছিল বৈষ্ণব সমাজে। বৈষ্ণবী মা-গোঁসাইগণের অনেকেই ছিলেন শিক্ষিতা এবং তাঁরা অনেকেই বৈষ্ণব সমাজে ‘আচার্যা’র পদ অধিগ্রহণ করতেন। উদাহরণ হিসেবে শ্রীনিবাস আচার্যের কন্যা হেমলতা দেবী, জাহ্নবী দেবী প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। মুসলমান আমলেও বৈষ্ণব সমাজে পর্দাপ্রথা না থাকায় শিক্ষায় নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণে কোনপ্রকার বাধা ছিলনা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এদেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত করা হতো এই সকল বৈষ্ণবীদের।৫
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের অন্যতম দুই বিদূষী রমণী হলেন হটু বিদ্যালঙ্কার এবং হটী বিদ্যালঙ্কার। রাঢ় দেশের কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের বালবিধবা ছিলেন হটি বিদ্যালঙ্কার যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে বারাণসীতে চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন এবং সেখানে অধ্যাপনাও শুরু করেন। হটি বিদ্যালঙ্কার ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত। সংস্কৃত ব্যাকরণ, স্মৃতি, নব্য-ন্যায় কাব্যে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অপরিসীম।৬
রাঢ় দেশের আর একজন প্রসিদ্ধা পণ্ডিত হলেন হটু বিদ্যালঙ্কার। তাঁর আসল নাম রূপমঞ্জরী। পিতা নারায়ণ দাসের উৎসাহে তিনি চতুষ্পাঠীর শিক্ষালাভ করতে সমর্থ হন এবং ব্যাকরণ, সাহিত্য, আয়ুর্বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। চিরকুমারী, পুরুষবেশধারী, মুণ্ডিত মস্তক, অর্কফলাধারী হটু বিদ্যালঙ্কারের পাণ্ডিত্যের খ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে নানা স্থান থেকে বিদ্যার্থী তাঁর কাছে শিক্ষালাভের জন্য আসতো।৭
যদিও হিন্দু ধর্ম ও শাস্ত্রে স্ত্রী শিক্ষার প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে তবু বাস্তবে দেখা যায় প্রাচীন আর মধ্যযুগীয় বাঙালি সমাজ স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে, জমিদার ও অভিজাত পরিবারের মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়া শেখবার প্রবণতা দেখা যায়। তবে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালি সমাজে স্ত্রীশিক্ষা অনেকখানি অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। এর কারণ হল বাল্যবিবাহ। মেয়েদের এই সময়ে শিক্ষালাভের তুলনায় গৃহকর্মে অনেক বেশী ব্যস্ত থাকতে হত। তাছাড়াও, সমাজে পুরুষপ্রাধান্য বজায় রাখতে সমাজপতিরাও অতিমাত্রায় তৎপর ছিলেন। লেখাপড়া শিখে মেয়েরা যদি তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং পুরুষপ্রাধান্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন – সে আশঙ্কা অনেকের মনেই দানা বেঁধেছিল। কাজেই নারীকে শিক্ষা হতে বঞ্চিত করতে, সমাজপতিরা, স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কিত নানান অলীক ও অবাস্তব ধারণা সমাজের মধ্যে গড়ে তোলেন। এইরকম পরিস্থিতি শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত দেখা যায়।
সমাজের এক অংশ যখন মেয়েদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে উৎসাহী, ঠিক তখনই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কিছু মানুষ মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য রাধাকান্ত দেব, রামমোহন অনুরাগী প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও ডিরোজিওর আদর্শে অনুপ্রাণিত ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী ও খ্রিস্টান মিশনারিরা ।
উনিশ শতকের বাঙালি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রথম মিশনারিরাই এগিয়ে আসেন। এরাই প্রথম এদেশে মেয়েদের স্কুল স্থাপন ও স্ত্রীশিক্ষা কর্মসূচী রূপায়নের জন্য জনসাধারণের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখা যায় যে, মিশনারিদের শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা নিতান্তই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মূলতঃ খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার। এই কারণে ধীরে ধীরে মিশনারিদের তৈরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের সমর্থন কমে আসে। বাঙালি সমাজে পর্দাপ্রথা তখনও উঠে না যাওয়ায় ভদ্র ঘরের মেয়েরা এইসব স্কুলে আসতে চাইত না। সমাজের সর্বহারা, নিম্নশ্রেণীর পরিবারের মেয়েরা পড়তে আসতেন এই বিদ্যালয়গুলিতে।
এদেশে স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে যার অবদান সবথেকে বেশি তিনি হলেন ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। এদেশে এসে নারীকল্যাণে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। নারীশিক্ষা ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে তিনি ‘বেথুন’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে স্কুলের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে ১৮৫৪ সালে উডের ডেসপ্যাচে স্ত্রীশিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে বেথুন স্কুলে অর্থ সাহায্য করায় স্কুলের শোচনীয় অবস্থা দূর হয়।
স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অতুলনীয়। অবহেলিত, অপমানিত নারীর সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের শিক্ষার মাধ্যমে আত্মসচেতন করে তোলা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করতেন। ১৮৪৯ সালে বেথুনের প্রচেষ্টায় সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের জন্য যে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে স্কুলের উন্নতি প্রকল্পে বিদ্যাসাগর তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। শুধু তাই নয়, স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে বাংলা সরকারের মনোভাব বিদ্যাসাগরের কাছে সদর্থক মনে হওয়ায় বালকদের মডেল স্কুলের সঙ্গে তিনি বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপনেও অগ্রসর হন। নভেম্বর ১৮৫৭ থেকে মে ১৮৫৮ – এই অল্প সময়পর্বে তিনি স্থাপন করেন ৩৫টি বালিকা-বিদ্যালয়। সরকার তখন সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে চিন্তিত। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের জন্য অর্থব্যয়ে উৎসাহ ছিল না তাদের। সেকারণে শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর এই বিদ্যালয়গুলির অর্থ সাহায্যের বিরোধিতা করেন। কিন্তু সরকারি অসহযোগিতা, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ ত্যাগ করার কারণে আর্থিক অনিশ্চয়তা – কোনটাই বালিকা বিদ্যালয়গুলির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাঁকে নিরাশ করতে পারেনি। স্কুলগুলি পরিচালনার জন্য তিনি একটি নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খোলেন।
এছাড়াও উনিশ শতকে বিভিন্ন জায়গায় অনেক সহৃদয় ব্যক্তির উদ্যোগে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর উদ্দেশ্যে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সরকারি ঔদাসীন্য, আর্থিক অনটন, ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য এইসব স্কুলের অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লেখাপড়া শেখার অধিকার যে মেয়েদের আছে আর তাতে যে কিছু ক্ষতি হয়না – এই বোধ জনসমাজে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল স্কুলগুলো।
উনিশ শতকের ষাটের দশকে স্ত্রী শিক্ষার পদ্ধতি নিয়েও সমাজের বিভিন্ন স্তরে মতবিরোধ দেখা যায়। সব ধরণের শিক্ষা গ্রহণ করার মানসিক সামর্থ্য মেয়েদের আছে কিনা, তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তবে এমন নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ধীরে ধীরে মেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেও বসবার অধিকার লাভ করে। ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে তাদের শিক্ষার জগৎ। শতাব্দীর প্রথমার্ধে মেয়েদের শিক্ষার বিস্তার মোটামুটি বাঙালি হিন্দু ও ব্রাহ্মণ পরিবারে সীমাবদ্ধ থাকলেও, শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তা মুসলমান সমাজের মেয়েদের মধ্যেও বিস্তার লাভ করে ।
স্ত্রীশিক্ষার অগ্রগতির পথে উনিশ শতকের শেষের দিকেও অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। কুসংস্কারের এই অন্তরায় দূর হতে আরো বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিলো। তবে এর মধ্যেও ১৮৭৮ সালের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্ত্রী ও পুরুষের শিক্ষা ক্ষেত্রে সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে স্থির গতিতে হলেও স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।
—–
পাদটীকা
১) পাণিনি কৃত কঠী, কলাপী, প্রভৃতি শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত সূত্র থেকে ধারণা করা যায় যে নারী শিক্ষার প্রচলন ছিল। বেদের কঠ শাখায় সুপণ্ডিত নারীকে অবিহিত করা হয় কঠী নামে। কলাপ শাখার পাণ্ডিত্য অর্জনকারী নারী হলেন কলাপী এবং তাঁরা অধ্যাপনার কাজও করতে পারতেন।
দেখুনঃ বসু, ডঃ যোগীরাজ (১৪২৩ বৈশাখ ১)। বেদের পরিচয়। কলকাতাঃ সংস্কৃত বুক ডিপো।
২) তদেব।
৩) তদেব।
৪) বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি অংশ থেকে জানা যায় বৈদিক যুগে পিতামাতা বিদ্বান পুত্রের কামনার পাশাপাশি বিদূষী কন্যার জন্মের জন্যও কামনা করতেন। যদি কেউ দীর্ঘায়ুযুক্তা বিদুষী কন্যা লাভ করতে চান তাহলে পিতামাতা কে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদনা করার নির্দেশ দেওয়া আছে।
৫) দত্ত, ডঃ জয়ীতা (২০০০)। সমকালের প্রেক্ষাপটে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য। কলকাতাঃ পুস্তক বিপণী।
৬) বন্দ্যোপাধ্যায়. ব্রজেন্দ্রনাথ (সম্পা) (১৩৫৮)। সাহিত্য সাধক চরিতমালা। কলকাতাঃ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
৭) তদেব।
৮) বন্দ্যোপাধ্যায় (রায়), চিত্রিতা (২০০৪)। সময়ের উপকরণঃ মেয়েদের স্মৃতিকথা। কলকাতাঃ পুস্তক বিপণি।
৯) নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি (সম্পাঃ) (১৪১১)। আচার্য কাহিনী। কলকাতা।
১০) চক্রবর্তী, সুধীর (২০০৩)। লেখাপড়া করে যে। কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং।
ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।