বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের আঁধার পেরিয়ে অলোকবৃত্তে পৌঁছানোর উপাখ্যান

বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের আঁধার পেরিয়ে অলোকবৃত্তে পৌঁছানোর উপাখ্যান

বাঙালি জাতির সূচনার অনেক রকমের ব্যাখ্যার মধ্যে বাংলাভাষার সৃষ্টিকাল থেকেই বাংলা সংস্কৃতির শুরু, সেই ব্যাখ্যাতেই আপাতত থাকা যাক। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রাচীনতম বাঙলা বলা হয় চর্যাপদকে। সেই চর্যাপদের বৌদ্ধ চর্যাগীতিতে এক জায়গায় একটি পদ পাওয়া যাচ্ছে –

নাচন্তি বাজিল, গান্তি দেবী
বুদ্ধনাটক বিসমা হোই।।

অর্থাৎ অভিনেতা নাচছে, অভিনেত্রী গান গাইছে। বুদ্ধনাটকের এর চেয়ে বেশি বিবরণ আর কিছু পাওয়া যায়নি। দশম শতাব্দীতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নাট্যগীতি করার একটি রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখানে পুরুষ নাচছে এবং নারী গাইছে এরকম একটা উল্টো রীতির কারণ ঠিক জানা না গেলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই সময় অভিনেত্রীরা মঞ্চে জনসমক্ষে উপস্থিত হতেন।

এর দুশো বছর পরে, দ্বাদশ শতাব্দীতে জয়দেবের গীতগোবিন্দ লেখা হয়েছে। চৈতন্য যুগে রূপ গোস্বামী সেই গীতগোবিন্দ নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করলেন এবং সেই সময় থেকে তা লৌকিক নাট্যরূপে প্রচারিত হতে শুরু করে। এই লৌকিক নাট্যে সম্ভবত নারীরাও অংশগ্রহণ করতেন। জানা যাচ্ছে জয়দেবের পত্নী পদ্মাবতী স্বয়ং গান এবং নাচ, দুটোতেই পারদর্শিনী ছিলেন। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে তখন মহিলারা ততটা পর্দানশিন ছিল না। চৈতন্যদেব নিজেও অভিনয় করতেন। অনেক সময় নিজে নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে জানা যায়।

কিন্তু অনেকের মতে চৈতন্যযুগ বাংলার প্রথম নব জাগরণের যুগ হলেও সেই জাগরণ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। চৈতন্যদেবের অকালপ্রয়াণের পর, বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতিতে তাঁর প্রভাব একটু কমে আসতেই বাংলা আবার এক ধরণের কুসংস্কার, গোঁড়ামি, সংকীর্ণতার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল।

এর পরে নবাবি আমলে নাট্য অভিনয়ে মেয়েদের আসার প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় নবাব জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু ভ্রাম্যমাণ নাট্যদলের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তারা এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে নাটক করত, তাই তাদের দলে কমবয়সি মেয়েদের অংশগ্রহণ হয়তো সুরক্ষার কারণেই সম্ভব ছিল না। হয়তো সামাজিক বাধাও ছিল। তাই সে সময় মেয়েদের চরিত্রে ছেলেরাই অভিনয় করত।

পলাশির যুদ্ধে সিরাজদৌলার পতনের পর ইংরেজরা কলকাতা শহরে জাঁকিয়ে বসতে আরম্ভ করল এবং কলকাতা শহরের প্রাধান্য আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। ইংরেজরা এ শহরকে তাদের মনের মত করে গড়ে তোলবার চেষ্টা চালাল। নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্যে যে সব ব্যবস্থা তারা নিয়েছিল তার মধ্যে নাট্যালয়ও ছিল। কিন্তু সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজি নাটকেরই অভিনয় হত। বাঙালি নেটিভদের কোনো নাট্যশালা ছিল না।

গেরাসিম লেবেডফ

অষ্টাদশ শতকের শেষে দিকে গেরেসিম স্তেপেনোভিচ লেবেডফ নামের এক রুশ যুবক ঘুরতে ঘুরতে কলকাতায় এসে উপস্থিত হলেন। এর আগে তিনি মাদ্রাজে গিয়ে কিছুটা তামিল ভাষা শিখেছিলেন। লেবেডফ ভাল বেহালা বাজাতে পারতেন। কলকাতায় এসে বেহালা বাজানোর শো করতে লাগলেন এবং সেই সঙ্গে বাংলা ভাষাটাও জনৈক গোলকনাথ দাসের কাছে শিখতে লাগলেন। কিছুটা বাংলা শিখে তিনি রুশ ভাষায় অনুবাদ করলেন রায়গুণাকর ভরতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালা। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল এই কলকাতায় ইংরেজি ভাষার থিয়েটার থাকলেও বাংলা ভাষার কোনো নাট্যশালা নেই। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে নাটকের খিদে ছিল। তাঁর বাংলা শিক্ষক গোলকনাথ দাসের সহায়তায় জড্রেলের ‘দি ডিসগাইস,’ এবং মলিয়ের ‘লভ ইজ দা বেস্ট ডক্টর’ নামে দুটি ইংরেজি প্রহসনের বঙ্গানুবাদ লেবেডফ করে ফেললেন ও কিছু বাঙালি পণ্ডিত ও বন্ধুবান্ধবদের ডেকে পড়ে শোনালেন। তারা তো পড়া শুনেই হেসে লুটোপুটি। লেবেডফ এতে উৎসাহ পেলেন। গোলকনাথ দাস জানালেন এ নাটক যদি লেবেডফ মঞ্চস্থ করতে চান, তিনি বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী জোগাড় করে দেবেন। লেবেডফ প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। এটাই তো তাঁর স্বপ্ন! কিন্তু কলকাতায় তখন বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করার কোনো জায়গা নেই। নিজের প্রায় সব সঞ্চয় খরচা করে ১৭৯৫ খৃষ্টাব্দের ২৭ শে নভেম্বর তারিখে, ২৫ নম্বর ডোমতলা লেনের (এখনকার এজরা স্ট্রিটে) ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ নামে একটি থিয়েটার হল তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন।

সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বেরল। চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। প্রথম শো হাউস ফুল। দ্বিতীয় শো হবার আগে চরিত্রদের নাম, যা আগে মূল নাটক অনুযায়ী বিদেশিই ছিল, তাদের নাম পালটে বাংলা নাম দেওয়া হল। তাতে দর্শকদের কাছ থেকে আরো ভাল সাড়া পাওয়া গেল। ঠিক হল, তৃতীয় বারে ইংরেজি এবং বাংলা, দুই ভাষাতেই অভিনয় হবে। সেই মর্মে অনুমতিও পাওয়া গেল ইংরেজ সরকারের কাছে। কিন্তু কিছু বাঙালি এবং কিছু ইংরেজের ষড়যন্ত্রে লেবেডফের বিরূদ্ধে মামলা রুজু করা হল। সম্ভবত লেবেডফের ‘কোথাকার কে এক রাশিয়ান’ এই পরিচয়টি বাঙালি এবং ইংরেজ দুই পক্ষের কাছে স্বস্তিদায়ক ছিলনা। তিনি গ্রেফতার হলেন। মামলা চলতে লাগল দু’বছর ধরে। লেবেডফ সর্বস্বান্ত হলেন এবং প্রথম বাংলা নাট্যশালার ঝাঁপ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।

লেবেডফের নাটকে তিনটি নারী চরিত্র ছিল। গোলকনাথ দাসের সহায়তায় এই নারী চরিত্রের জন্যে তিনজন বারাঙ্গনাকে যোগাড় করা হয়েছিল। মাত্র দুই রজনী নাটক অভিনয় হয়েছিল। তাই বাংলা থিয়েটারের প্রথম অভিনেত্রীদের ঐতিহাসিক নাম অজানাই রয়ে গেছে। লেবেডফ যে পথ দেখালেন, বঙ্গসমাজ তার জন্যে তখনো ঠিক প্রস্তুত ছিল না। টুলো পণ্ডিতদের বিধান শাসিত হয়ে সমাজ আটকে ছিল এক বদ্ধ আবহাওয়ার মধ্যে। নতুন কিছু গ্রহণ করার জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়নি।

এই ঘটনার প্রায় ৩৬ বছর পর, ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁর নারকেলডাঙ্গার বাগানবাড়িতে হিন্দু থিয়েটার নামের একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করলেন। এখানে শেক্সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ আর ‘উত্তররামচরিত’ অভিনীত হয়েছিল বলে জানা যায়। তাতে কোনো মহিলা অভিনেত্রী নেওয়া হয়নি। এই নাট্যশালাও অবশ্য বেশিদিন চলেনি।

এর পর নবীনচন্দ্র বসু একটি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩৫ সালের ৬ই অক্টোবর, সেখানে যখন ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালা অভিনীত হল, তাতে লেবেডফের পর আবার নারী চরিত্রে মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করানো হল। তার মানে মাঝের চল্লিশ বছর এখানে ওখানে যা নাটক হয়েছে তাতে নারী চরিত্রে ছেলেদের দিয়েই অভিনয় করানো হয়েছে, অথবা নাটকে স্ত্রী-চরিত্র আদৌ ছিল না।

বিদ্যাসুন্দর নাটকে একাধিক নারী চরিত্র ছিল। যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজনের নাম জানা যায় –রাধামণি আর জয়দুর্গা। এর মধ্যে রাধামণি বিদ্যার ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং সেই সময়ের খবরের কাগজে এবং সাময়িক পত্রিকায় রাধামণির অভিনয়ের যথেষ্ট প্রশংসা করা হয়েছিল। কিন্তু রাধামণির দৃষ্টান্ত থাকা সত্বেও এর পরেও আবার নারীরা রঙ্গমঞ্চে ব্রাত্যই থেকে গেলেন।

১৮৫০ সাল থেকে কিছু কিছু বাংলা নাটক লেখা এবং অভিনীত হতে আরম্ভ হল। ‘কুলীনকুলসর্বস্ব,’ ‘বিধবাবিবাহ,’ ‘বিক্রমোবর্শী’র মতন নাটক অভিনীত হলেও, স্ত্রী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করতে থাকলেন। এমন কি ইয়োরোপের আদর্শে দীক্ষিত মাইকেল মধুসূদনের লেখা নাটকেও স্ত্রী চরিত্রে মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করানো যায়নি।

১৮৭৩ সালে বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা হবার পর আবার উদ্যোগ নেওয়া হল মেয়েদের রঙ্গমঞ্চে ফিরিয়ে আনার। তখন সমাজ সংস্কারের নানা প্রয়াস শুরু হয়েছে। বিদ্যাসাগর মশাই, শিবনাথ শাস্ত্রী, কেশব সেন, এঁরা নারী প্রগতির জন্যে নানান কাজ করেছেন। কিন্তু মেয়েদের মঞ্চে অভিনয় করার ব্যাপারে সমাজ তখন অবধি মুক্তমনের পরিচয় দেয়নি।

বেঙ্গল থিয়েটাররের কর্তৃপক্ষকে অভিনেত্রী জোগাড় করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হত, এবং অবশেষে সেই নিষিদ্ধপল্লী থেকেই তাদের নিয়ে আসতে হত। প্রথমের দিকে যাদের পাওয়া গিয়েছিল তাদের নাম ছিল – জগত্তারিণী, এলোকেশী, শ্যামা, এবং গোলাপসুন্দরী। এঁরা অভিনয় তো জানতেনই না, লেখাপড়াও জানতেন না। তবে পেশার কারণে সবাই নাচ গান একটু আধটু শিখতেন। তাই তাঁদের মেজেঘষে তৈরি করে নেওয়া গেল বটে, কিন্তু এঁদের বারাঙ্গনা পরিচয় লুকানো সম্ভব হল না, সমাজ আবার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠল।

কিন্তু বেঙ্গল থিয়েটার আসার পর কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন নারী চরিত্রে মেয়েরা অভিনয় না করলে থিয়েটারে উন্নতি সম্ভব নয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মৃত্যুর কিছুদিন আগে, বেঙ্গল থিয়েটারের জন্যে ডিকটেশন দিয়ে ‘মায়াকানন’ নামে একটি ফরমায়েশি নাটক লিখে দিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের শরৎ চন্দ্র ঘোষ মশাইকে বলেছিলেন অভিনেত্রী ছাড়া বাংলা নাটকের উন্নতি হতে পারে না। ১৮৭৩ সালেই মাইকেল মধুসূদন মারা যান। শরৎ চন্দ্র মাইকেল মধুসূদনের উপদেশ মাথায় রেখে অভিনেত্রীদের রঙ্গমঞ্চে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।

জগত্তারিণী, এলোকেশী, শ্যামাদের এর পর কী হয়েছিল জানা না গেলেও গোলাপসুন্দরী কিন্তু রয়ে গেলেন অভিনয়ের জগতে। সেকালের বিখ্যাত নট অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি গোলাপসুন্দরীকে অভিনয় শিখিয়ে এতই পটু করলেন যে পরের নাটক ‘শরৎ-সরোজিনী’তে অভিনয় করে তিনি দর্শকের মন কাড়লেন। এর পরে আর একটি নাটকে তাঁর অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল সুকুমারী। সুকুমারীর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় এতটাই জনপ্রিয় হয় যে গোলাপসুন্দরীকে সকলে সুকুমারী বলেই ডাকতে লাগলেন। পুরোনো নাম থেকে মুক্তি ঘটলেও তাঁর অন্ধকার অতীত তাঁর পিছু ছাড়েনি। থিয়েটারের এক অভিনেতার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু সেই সমাজের রক্তচক্ষু তাঁদের সংসার করতে দেয়নি। গোলাপসুন্দরীর সেই অভিনেতা স্বামী, গোষ্ঠবিহারী, শেষ পর্যন্ত অভিনয় ছেড়ে, দেশ ছেড়ে জাহাজের খালাসি হয়ে বিলেতে চলে যান।

কিন্তু সুকুমারী থেমে থাকেননি। তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন। বেঙ্গল এবং মিনার্ভা থিয়েটারের মঞ্চে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘পুরুবিক্রম,’ ‘সরোজিনী,’ ও ‘অশ্রুমতী’ নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি সুখ্যাতি পান। এছাড়া তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ,’ ‘দুর্গেশনন্দিনী,’ ‘মৃণালিনী’তে নায়িকার অভিনয় করেন। শুধু অভিনয়ই নয়, নিজের জীবনের গল্প নিয়ে আশুতোষ দাসের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটকও রচনা করেন। এই নাটকটিও খুব জনপ্রিয় হয়। এ ছাড়া আরো সুকুমারী একটি বৈপ্লবিক কাজ করেন। ‘হিন্দু ফিমেল থিয়েটার’ নামে শুধু মহিলা অভিনেত্রীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনকে দিয়ে তিনি ‘শুম্ভসংহার’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করান। ১৮৯৮ সাল অবধি নানা নাটকে সুকুমারী চুটিয়ে অভিনয় করেন।

শ্রী রামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্যা অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী

সেকালের বাংলা নাটকের সবচেয়ে বিখ্যাত নায়িকা অবশ্য সুকুমারী নন। সেই পদ অধিকার করে আছেন বিনোদিনী দাসী। তার কারণ অবশ্য শুধু অভিনয়ের পারদর্শিতা নয়। নানা কারণে বিনোদিনী দাসী ওই সময়ের উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠেছেন। গোলাপসুন্দরী মঞ্চে আসার বছর দেড়েক পরে বিনোদিনী মাসিক দশ টাকা বেতনে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগ দেন। তখন তাঁর বয়স এগারো কি বারো। তিনিও অভিনয় কিছুই জানতেন না। তিনিও জন্মসূত্রে বারাঙ্গনা ছিলেন।

বিনোদিনী ছোটোবেলায় এক বাইজির কছে কিছু গানবাজনা শিখেছিলেন। এর পরে থিয়েটারে এসেও অনেকের কাছে গানের তালিম পেয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে সত্যিকারের সঙ্গীতপ্রতিভা ছিল। ১৮৭৪ সালে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারে ‘বেণীসংহার’ নাটকে বিনোদিনী দ্রৌপদীর পরিচারিকার একটি ছোটো ভূমিকায় অভিনয় করে শুরু করেন তাঁর অভিনয় জীবন। সেই ছোট্টো ভূমিকাতে অভিনয় করেই তিনি দর্শকদের ‘ক্ল্যাপ’ পেয়েছিলেন। এর কয়েকমাস পরে তিনি ‘হেমলতা’ নাটকে একেবারে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। তারপরেই গ্রেট ন্যাশানালের হয়ে তিনি উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফিরে এসে আবার পুরোদমে কাজ শুরু করেন ন্যাশানাল থিয়েটারে। দু’বছর কাজ করার পর বিনোদিনী যোগ দেন বেঙ্গল থিয়েটারে। কিন্তু মাত্র ন’মাস সেখানে থাকার পর একরকম গিরিশ ঘোষ মশাইয়ের চেষ্টায় বিনোদিনী আবার ন্যাশনালে ফিরে আসেন। গিরিশ ঘোষ তাঁর প্রতিভাকে সঠিক ভাবে পরিমাপ করতে পেরেছিলেন। সেই প্রতিভাকে তিনি প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর নিজের মত করে।

তাঁর লেখা আত্মজীবনীতে গিরিশ ঘোষকে ‘গুরু ও দেবতা’ বলে বিনোদিনী উল্লেখ করেছেন। গিরিশ ঘোষ এবং বিনোদিনীর এই কম্বিনেশন সেই সময় কলকাতা শহরকে উদ্বেল করে তুলেছিল। একাধারে মাইকেল মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী,’ ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ,’ বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাস ‘মৃণালিনী,’ ‘বিষবৃক্ষ,’ ‘দুর্গেশনন্দিনী,’ উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎ-সরোজিনী নাটক’ অভিনীত হয়ে চলল। বলতে গেলে বঙ্গ সংস্কৃতি গিরিশ ঘোষের হাত ধরেই একটা ভাঁড়ামি, খেউড়, অশ্লীলতার জগত থেকে সাহিত্য নির্ভর হওয়ার রাস্তা চিনতে শিখল।

দুঃখের বিষয়, সম্ভবত আর্থিক সঙ্কটের কারণে ন্যাশনাল থিয়েটার এই সময় বন্ধ হয়ে যায়। দু’বছর পর প্রতাপ চন্দ্র জহুরি নামক এক ব্যবসায়ীর অর্থ সহায়তায় ন্যাশনাল থিয়েটার আবার শুরু হল। কিন্তু এর চূড়ান্ত ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে শিল্পী গিরিশ ঘোষের পদে পদে সংঘাত লাগল। গিরিশ ঘোষ চাইলেন এখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেই একটি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু তাঁর কাছে অত টাকা ছিল না। এর পরের কাহিনি বিনোদিনীর ব্যাক্তিগত প্রেম, সঙ্গে থিয়েটারের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষনের টানা পোড়েন, এবং শেষ পর্যন্ত বাংলা থিয়েটারের এক সঙ্কটকালে বিনোদিনীর আত্মত্যাগ কীভাবে বাংলা থিয়েটারকে অক্সিজেন যুগিয়েছিল তা আমরা নাটক এবং সিনেমার কল্যাণে অনেকটাই জানি। তাই এখানে তা আর বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করছি না।

গিরিশ ঘোষের থিয়েটার গড়ে তোলার জন্যে বিনোদিনী শুধু যে অর্থ দিয়েই সাহায্য করেছিলেন তাই নয়। তিনি রীতিমত মিস্ত্রীদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে পরিশ্রম করে এই থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন। আঠারোশো বিরাশি সালের মাঝামাঝি নাগাদ এই থিয়েটার সম্পূর্ণ হয়। বিনোদিনীর আশা ছিল তিনি তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পাবেন। তাঁর নাম এই থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত থাকবে। কথা হয়েছিল বিনোদিনী না হোক অন্তত এই থিয়েটারে নাম হবে বি থিয়েটার। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সমাজ ভুলে যায়নি বিনোদিনী যত বড়ই নটীই হোক, তার আত্মত্যাগ যত বড়ই হোক, আসলে সে এক বারাঙ্গনা। তাই থিয়েটারের নাম হল – স্টার থিয়েটার। বিনোদিনী মর্মাহত হলেন। অভিমান হল তাঁর দেবতা, তাঁর গুরু গিরিশচন্দ্রের প্রতি। কিন্তু হয়ত গিরিশবাবুর কোনো উপায় ছিল না। সমাজের রক্তচক্ষুর কথা ভাবতে হয়েছিল।

স্টার থিয়েটার শুরু হবার গিরিশ ঘোষ নতুন উৎসাহে নাটক লিখতে আরম্ভ করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটকগুলি এই সময়েই রচিত হয়। বিনোদিনী নানা ভাবে বঞ্চিত হলেও এই স্টার থিয়েটারে গিরিশ ঘোষের পরিচালনায় অভিনয়ের সময়েই তাঁর এক আশ্চর্য উত্তরণ ঘটে। ১৮৮৫ সালের ৭ই অক্টোবর স্টার থিয়েটারে ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক দেখতে আসেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ। চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ অভিভূত হয়ে বারাঙ্গনা বিনোদিনীকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে যান।

শ্রীরামকৃষ্ণের এই স্টার থিয়েটারে আসা আসলে সেই সময়ের নাট্যসমাজকে অনেকটা উত্তরিত করে দিয়েছিল। থিয়েটারে যাওয়া নিয়ে সে সময়ের বিদ্বজনের মধ্যে যে কিছুটা শুচিবাই ছিল এতে তা অনেকটাই চলে যায়। এর পরে স্টার থিয়েটারে নাটক দেখতে আসতেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্রের মত বিখ্যাত ব্যাক্তিরাও।

বিনোদিনী স্টার থিয়েটারে অভিনয় করেছিলেন মাত্র দু’বছর। ১৮৮৭ সালের ১লা জানুয়ারী, সহকর্মীদের ষড়যন্ত্রে তাঁকে স্টার থিয়েটার থেকে সরে যেতে হয়। তখন তাঁর বয়স মাত্র পঁচিশ। এই বয়সে তিনি প্রায় ৮০টি নাটকে শতাধিক চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেছেন। তার মধ্যে অনেকগুলিই ছিল যাকে বলে সুপারহিট। একজন অসামান্য অভিনেত্রী এবং সুনিপুণ গায়িকা হওয়া সত্বেও, আরো পঞ্চাশ বছর অবধি জীবিত থাকলেও, আর কোনোদিন তিনি স্টেজে ফিরে আসেননি। খুব সম্ভবত তাঁর অভিমান ছিল গিরিশ ঘোষের প্রতি। তিনি জানতে পেরেছিলেন তাঁকে স্টার থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পিছনে গিরিশ ঘোষ মশাইয়ের সমর্থন ছিল।

বিনোদিনীর পাঁচ বছর বয়সে সম্ভবত একটি বিবাহ হয়ছিল। কিন্তু তার পরে তাঁর গোটা জীবন কাটে কোনো না কোনো ধনী বাবুর রক্ষিতা হয়ে। ১৯৪১ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরে তাঁকে নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। নাটক উপন্যাস লেখা হয়েছে। মঞ্চের চড়া আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে তিনি অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বসা দর্শকদের মুহুর্মুহু হাততালি পেয়েছেন। চৈতন্য সেজে স্বয়ং রামকৃষ্ণের কাছ থেকে ‘তোমার চৈতন্য হোক’ আশীর্বাদ পেয়েছেন। কিন্তু জীবিত অবস্থায় আমাদের সমাজ তাকে রক্ষিতার বেশি মর্যাদা দেয়নি।

পঁচিশ বছর বয়সে বিনোদিনী স্টার থিয়েটার থেকে সরে যাবার পর সেই শূন্যস্থানে জায়গা পান কিরণবালা। প্রথমদিকে বিনোদিনীর ‘কপি’ হলেও ‘স্বর্ণলতা’য় সরলার ভূমিকায় অভিনয় করে নিজের পরিচয় তিনি গড়ে তোলেন। কিরণবালাও নিষিদ্ধপল্লী থেকেই এসেছিলেন। বিনোদিনী যখন নায়িকা হতেন তখন তিনি সহনায়িকা বা ছোটোখাটো ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেতেন। কিন্তু বিনোদিনীর পর তিনি নায়িকা হবার সুযোগ পান এবং নিজের অভিনয় ক্ষমতার প্রমাণ দেখান। কিন্তু মাত্র বাইশ বছর বয়সে বসন্ত রোগে তাঁর মৃত্যু হয়।

বিখ্যাত অভিনেতা অমরেন্দ্রনাথ বসু ও অভিনেত্রী কুসুমকুমারী

বিনোদিনীর পর যে অভিনেত্রী বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে তারকা হয়ে উঠেছিলেন তাঁর নাম তিনকড়ি দাসী। ১৮৮৬ সালে গিরিশ ঘোষের ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটকে একটি ছোটো ভূমিকায় তাঁর মঞ্চে অবতরণ। ইনিও সেই নিষিদ্ধপল্লি থেকেই এসেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গিরিশ ঘোষের প্রিয়তম অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। অনেকে তাঁকে গিরিশপ্রিয়া বলে ডাকতে লাগেন। ‘মীরাবাই’ থেকে ‘লেডি ম্যাকবেথ’ নাটকে অভিনয় করে তিনকড়ি দাসী দর্শকের বাহবা কুড়োন। গিরিশ ঘোষ তাঁকে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বলে উল্লেখ করেছিলেন। এমনকী কিছু ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালি তাঁকে তৎকালীন বৃটিশ অভিনেত্রী মিসেস সিডনস এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তবে তিনকড়ি দাসীর ব্যাক্তিগত জীবনের গল্পটাও এঁর পূর্বসুরিদের মতই। তবে থিয়েটারকে তিনি কতটা ভালবাসতেন সেটা একটা ঘটনায় বোঝা যায়। থিয়েটারে যখন ইনি চল্লিশ টাকা মাস মাইনেতে কাজ করেন, সে সময় এক বাবু তাঁকে দু’শো টাকা মাস মাইনেতে রক্ষিতা করে রাখতে চান। এই প্রস্তাবে রাজী হওয়ার জন্যে তিনকড়ি দাসীর মা, যিনি নিজেও বাইজি ছিলেন, তাঁকে রীতিমত অত্যাচার করেন। কিন্তু তিনকড়ি থিয়েটারকেই আঁকড়ে ধরে থাকেন। অবশ্য পরে সেই রক্ষিতা হয়েই তাঁকে দিন কাটাতে হয়েছে। ১৯১৭ সালে মারা যাবার আগে তাঁর বাবুর কাছ থেকে পাওয়া দুটি বাড়ি ইনি হাসপাতালের জন্যে দান করে দিয়ে যান।

এর পর কুসুমকুমারী, নরীসুন্দরী, তারাসুন্দরী, নীরদাসুন্দরী, নীহারবালা, প্রভাদেবী, রমা, এঁদের জীবনের গল্প মোটামুটি একই রকম। অন্ধকার জগত থেকে এসে থিয়েটারকে আশ্রয় করে একটু ভদ্রস্ত জীবন পাবার জন্যে প্রাণপাত করা। নানান থিয়েটারে ঘুরে কখনো গিরিশ ঘোষ, কখনো অর্ধেন্দু শেখর মুস্থাফি, কখনো অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, কখনো অমৃতলাল মিত্রের মত বিখ্যাত নটদের ‘গুরু ও দেবতা’ বলে মেনে নিয়ে অভিনয় শেখা। এঁরা ‘আলিবাবা,’ ‘চন্দ্রশেখর,’ ‘মীরাবাই’ বা ‘চৈতন্যলীলা’র মত নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন। সম্ভবত এসব নাটকের সাহিত্যগুণের মর্মে প্রবেশ করেননি, শুধু গুরুদের দেখানো শিক্ষায় অভিনয় করে দর্শকদের হাততালি এবং সেই সঙ্গে কিছু অর্থ উপার্জন করা, এইটুকুই ছিল তাঁদের প্রাপ্তি।

দুই বিখ্যাত অভিনেত্রী – তারাসুন্দরী এবং কুসুমকুমারী

উনিশ শতকের শেষ অবধি এ ভাবেই কেটেছে অভিনেত্রীদের জীবন। ‘আলিবাবা’ নাটকে কুসুমকুমারী নাকি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে মধ্যবিত্ত বাঙালি ধার করেও মর্জিনার নাচ দেখতে থিয়েটারে ভিড় করত। সেই কুসুমকুমারীর করুণ কাহিনি আমরা জানতে পারি পরবর্তী কালের এক অভিনেত্রী অপর্ণাদেবীর স্মৃতিকথা থেকে-

আমি মঞ্চের পিছনে গ্রিনরুমের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এমন সময় নাট্যনিকেতনের ভিতরে একজন মহিলা প্রবেশ করলেন। শীর্ণ শরীর। পরনে অত্যন্ত ময়লা একটা ছেঁড়া থান, অনাহারে অনিদ্রায় মহিলাটি রীতিমতো ধুঁকছিলেন। আমি সামনেই ছিলাম। মহিলা ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘আমাকে চার আনা পয়সা দেবেন?’ আমি বিনা বাক্যব্যয়ে মহিলার হাতে চার আনা পয়সা তুলে দিলাম। পাশেই ছিলেন নীহারবালা। বললেন, ‘…আমাদের শেষজীবন যে কত ভয়ংকর হয় তার প্রমাণ ওই মহিলা। উনি কে জানো? উনি প্রখ্যাত অভিনেত্রী কুসুমকুমারী।’

এঁদের মধ্যে বিনোদিনী এবং তারাসুন্দরী কিছুটা আলোকপ্রাপ্তা হয়ে নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছিলেন। বিনোদিনী আত্মজীবনী লিখেছিলেন, তারাসুন্দরী গল্প কবিতা লিখেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একজন শিল্পীর জীবন তাঁদের পাওয়া হয়ে ওঠেনি। রক্ষিতার তকমা গা থেকে মুছে ফেলতে দেয়নি তৎকালীন সমাজ। গোলাপসুন্দরী-বিনোদিনী-তিনকড়ির মতোই কৃষ্ণগহ্বর থেকে উঠে আসার বিফল চেষ্টা করেছেন বসন্তকুমারী-সুশীলবালা-হরিসুন্দরী (ব্ল্যাকি), নরীসুন্দরী, চারুশীলার মত বহু অভিনেত্রী। অনেকের নাম আমরা জানতেই পারিনি।

মঞ্চে ভদ্রঘরের মেয়েদের আসা শুরু হয় সেই ঠাকুরবাড়ির উদ্যোগেই। ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ নাটক অভিনীত হয় ১৮৮১ সালে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সে নাটকে বাল্মিকীর অভিনয় করেন এবং তাঁর ভাইঝি, ভাগ্নিরা তাতে অভিনয় করেন। এরপর আরো বেশ কিছু নাটক বা গীতিনাট্যের অভিনয় হয় সেখানে। তাতে ঠাকুর বাড়ির মেয়েরাই অভিনয় করেন। কিন্তু এই সব নাটক জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত ছিল না। তাই এর প্রভাব বাইরের সমাজে তেমন পড়েনি।

১৯২৫ সালে শিশির ভাদুড়ি কঙ্কাবতী এবং চন্দ্রাবতী দুই বোনকে মঞ্চে নিয়ে আসেন। এঁদের পিতা ব্রাহ্ম এবং মুজঃফরপুরে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কঙ্কাবতী বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন, দিনু ঠাকুরের কাছে গান শিখেছিলেন। পরে ইনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন। পরবর্তী কালে সিনেমায় অভিনয় করেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।

অভিজাত পরিবার থেকে পেশাদারী মঞ্চে আসা প্রথম অভিনেত্রী – সাধনা বসু

মধু বসুর স্ত্রী সাধনা বসু ছিলেন কেশব সেনের পুত্র সরল সেনের কন্যা। অর্থাৎ সে সময়ের সত্যিকারের অভিজাত পরিবারের মেয়ে। ষোল বছর বয়সে তিনি নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের ‘দালিয়া’ নাটকে অভিনয় করেন। তবে যে নাটকে অভিনয় করে তিনি বঙ্গদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তার নাম ‘আলিবাবা।’ নাচে এবং গানে তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন।

এর পরে এ দেশে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা প্রবাহ দেশের সমাজচিত্রের উপর নানা রকম ভাবে প্রভাব ফেলল। বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ এসব তো বটেই, সেই সঙ্গে টকি সিনেমা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হল। এ সবের প্রভাবে পেশাদারি থিয়েটার তার গরিমা হারাতে থাকল। চল্লিশের দশকে অর্ধেন্দুশেখর-গিরিশ-অমরেন্দ্র যুগের শেষ প্রতিনিধি শিশিরকুমার ভাদুড়ি পেশাদারি মঞ্চের ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ হয়েই রইলেন।

গণনাট্য সংঘের হাত ধরে বাঙলা

থিয়েটারে চলে এলো অন্য আঙ্গিক, অন্য বিষয়। ১৯৪৪ এর ২৪শে সেপ্টেম্বর শ্রীরঙ্গম মঞ্চে বিজন ভট্টাচার্য আর শম্ভু মিত্রের হাত ধরে নবান্ন নিয়ে বাংলা থিয়েটারের নতুন যুগের ভোর এল। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে বাংলা নাটকে শিক্ষিতা অভিনেত্রীরা আসতে লাগলেন। এলেন প্রখ্যাত ডাক্তারের কন্যা শোভা সেনগুপ্ত, এলেন প্রখ্যাত উকিলের কন্যা তৃপ্তি ভাদুড়ি। এলেন আরো অনেকেই। শুধু অভিনয় নয়, তাঁরা এলেন পরিচালনায়, এলেন নাট্যকারের ভুমিকায়। গ্রুপ থিয়েটার বাঙালির নিজস্ব আইডেন্টিটির জায়গা হয়ে উঠল। থিয়েটার হয়ে উঠল বাঙালি নারীর প্রতিবাদের ভাষা, প্রত্যয়ের ভাষা, প্রকাশের ভাষা।

বিখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র

এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙলা নাটকের অভিনেত্রীদের সেই অন্ধকারচ্ছন্ন দিনগুলির যন্ত্রণার কথা হয়তো আমাদের পক্ষে সঠিক ভাবে বোঝা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র ‘নটী বিনোদিনী’ নাটক মাঝে মাঝে মঞ্চস্থ করে আমরা যদি আমাদের আত্মবিস্মৃত জাতির বদনামটা ঘুচাবার চেষ্টা করি সেটা বোধহয় ঠিক হবে না। রাধামণি, গোলাপসুন্দরী, তারাসুন্দরী, তিনকড়ি দাসী, কিরণবালা, কুসুমকুমারী, নরীসুন্দরী, তারাসুন্দরী, নীরদাসুন্দরী, নীহারবালা, প্রভাদেবী, রমা, এবং আরো অনেক অভিনেত্রীর ধারাবাহিক অবজ্ঞা আর অপমানের দীর্ঘ অধ্যায় পেরিয়ে বাংলা থিয়েটার আজকের মর্যাদার আসনে পৌঁছাতে পেরেছে, এটাও মনে রাখতে হবে।

*********
তথ্যঋণ

দত্ত, ড: অজিত কুমার। (১৯৪৬, পুণর্মুদ্রনঃ ২০০৫)। বাংলা নাটকের ইতিহাস কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং।

পত্রী, পূর্ণেন্দু (১৯৮৬)। কলকাতার প্রথম। কলকাতাঃ দে’জ পাবলিশিং।

বিদ্যাভূষণ, উপেন্দ্রনাথ। (১৯৮৫)। তিনকড়ি, বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী কলকাতাঃ অক্ষর প্রকাশনী।

মিত্র, শম্ভু। (জানুয়ারি-মার্চ ২০০৫)। ‘বাংলা মঞ্চ ও অভিনয়ের বিবর্তন রেখা।’ থিয়েটারওয়ালা। http://www.theatrewala.net/shankha/29-2014-12-13-09-00-17/188-2015-01-17-16-26-19

মুরশিদ, গোলাম। (২০১৩)। নারী প্রগতির একশো বছর – রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া। ঢাকাঃ অবসর প্রকাশনা সংস্থা।

ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *