শিলং-চেরাপুঞ্জির রূপকথা

শিলং-চেরাপুঞ্জির রূপকথা

পাহাড়ি রূপকথার স্বপ্নে বিভোর থাকে মন। এই রূপকথার টানেই শারদীয়ার উচ্ছ্বাসকে পিছনে ফেলে পাড়ি দিয়েছিলাম রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’-র আপন দেশ, শিলং-এ। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতকন্যার মধ্যে মেঘালয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। হিমালয় সাম্রাজ্যের এক লুকায়িত রত্ন, গারো-খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়ের অবগুণ্ঠনে বাঁধা এক চিরায়ত রহস্যময়ী নারী মেঘালয়। এখানে নিরন্তর মেঘের খেলা চলতে থাকে, হিমেল হাওয়া পাহাড়ী পথের গা বেয়ে নেমে যায়। জঙ্গল-পাহাড়-নদী-ঝর্ণা সম্বলিত রূপের মহিমায় আকৃষ্ট হয়ে সাহেবরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘পূর্বের স্কটল্যান্ড।’ এক-এক ঋতুতে সে এক-একভাবে নিজেকে মেলে ধরে। তাইতো আমাদের কাছে সে মায়াবিনী, কুহকিনী।
মেঘালয় ভ্রমণপ্রেমীদের ভ্রমণের সূচীতে অগ্রাধিকারের ছাড়পত্র পেয়েছে, কারণ তার কাছে আছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর শিলং আর চেরাপুঞ্জি। এখানে মেঘ সবসময়ই নাছোড়বান্দা শিশুদের মতো দাপিয়ে বেড়ায়, কখনো কখনো সে পাহাড়ের কোলে বা পথের আঁকেবাঁকে প্রেমিকের জন্য সেজেগুজে বসে থাকে অন্তহীন অপেক্ষায়। শিলং মানে রবীন্দ্রনাথ, শিলং মানে অমিত-লাবণ্য। অনেকেরই মতো ‘শেষের কবিতা’-র রোমান্টিসিজমে আকৃষ্ট হয়ে আমিও এই স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ২০১৯-এর অক্টোবরে ওখানে গিয়ে জানতে পারি রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার এখানে এসেছিলেন ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে, প্রায় ১০০ বছর আগে। শরীরে শিহরণ তোলার জন্য তথ্যটা যথেষ্ট ছিল।
প্রথমে গৌহাটি পৌঁছে যেখানে দু’দিন থেকে শিলং-এর উদ্দেশে রওনা দিই। গৌহাটি থেকে শিলং-এর প্রায় তিনঘণ্টার পথ অত্যন্ত মায়াবী। প্রথম প্রথম চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত, গাছগাছালিপূর্ণ দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে থাকি। সমতল ছেড়ে পাহাড়ী রাস্তা ধরতেই দৃশ্যের পট-পরিবর্তন। পাহাড়ের অজানা, অচেনা বাঁক তাদের রহস্যময়তার আবরণ উন্মোচন করতে লাগল। পাহাড়ী রাস্তার চারপাশে রকমারি গাছ আর তাদের নানারঙের পাতা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। গাছের পাতার রং যে এতপ্রকার হতে পারে তা এখানে না আসলে জানতে পারতাম না। কোথাও ঘন সবুজ, কোথাও বা হালকা, আবার কোথাও হলদে, কালচে কিংবা লালচে। এরই ফাঁকে ফাঁকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে রঙ-বেরঙের নাম-না-জানা ফুল। হঠাৎ দেখতে পেলাম বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে লাল আর হলুদ ফুলের মিশ্রণ। মনে হল কোন পাহাড়ি কন্যা যেন হলুদ ফুল পরে লাল শাড়িতে বিবাহসজ্জায় সজ্জিত। একপাশে অন্তহীন খাদ, আরেকপাশে পাহাড়ি সবুজ গা। গাড়ির জানালা দিয়েই দেখতে পাই নীলাকাশ জুড়ে মেঘের পালের বিস্তার। চড়াই-উৎরাই পাকদণ্ডি পথ, পাহাড়ি সবুজের মাঝে উতলা ঝর্ণা, গারোদের বস্তি পিছনে ফেলে একসময় পৌঁছে যাই উমিয়ম লেক-এ। স্থানীয়দের কাছে বড়াপানি নামে পরিচিত। পাহাড়ি নদীর প্রবাহ মানুষের হাতে গড়া পাঁচিলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এই নয়নাভিরাম কৃত্রিম সরোবরের সৃষ্টি হয়েছে। নীলাভ, স্বচ্ছ, টলটলে জল। আশেপাশে ছোট ছোট টিলা থাকায় লেকের শোভা আরও বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। বোটিং ও নানারকমের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের ব্যবস্থা আছে। শিলং শহরে পৌঁছানোর তাড়া থাকায় নৌ-যাত্রার ইচ্ছা দমন করলাম। শেষ বিকেলের রক্তিম আলোয় থমকে যাওয়া সময়কে উপভোগ করি কিছুক্ষণ। লেকের ওধারে রয়েছে মেঘালয় উন্নয়ন পর্যটন নিগমের একটি সুন্দর, বিলাসবহুল রিসোর্ট। দেখে মনে হল যেন রূপকথার রাজ্যের রাজবাড়ি। মনে মনে আশা রাখি হয়তো কোন একদিন থাকব এই রিসোর্টে আর বিকেলে প্রিয়জনের সাথে কফিপানের আমেজ নিতে নিতে উমিয়ম লেকের ওপর নীল আকাশের শামিয়ানায় সূর্যদেবের পাটে যাওয়ার অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করব।

শিলং-এর পথে
শিলং-এর পথে
শিলং-এর ভোর

ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরে পেতেই আবার পথচলা শুরু। সন্ধ্যের ঠিক মুখে মুখে শিলং শহরে প্রবেশ। এখানকার সবচেয়ে জনবহুল এলাকা পুলিশ বাজারের এক মনোরম জায়গায় আমাদের হোটেলের অবস্থান। হোটেলের কর্মীরা প্রায় সবাই বাঙালি। ব্যালকনি থেকেই দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেগে আছে আলোর ফুলকি। তার সাথে রাতের আকাশের তারারা মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে। হোটেলের জানালা থেকে আলোয় ঝলমল করা পুলিশ বাজারের একাংশ দেখা যাচ্ছে। সান্ধ্যকালীন জলযোগ সেরে পুলিশ বাজার এলাকাটি ঘুরে নেওয়ার জন্য হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকাটি জমজমাট। প্রচুর লোকজনে পূর্ণ এলাকাটি সরগরম হয়ে আছে বিভিন্ন দোকানপাটে। চারিদিকে আলোয় আলোকিত। বড় বড় শপিং মলের পাশাপাশি খাসিয়া নারী, পুরুষ রাস্তার দু’পাশেই রকমারি জিনিসের পসরা নিয়ে বসে আছে। কাছে যেতেই তারা হাসিমুখে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরছে বাঁশের তৈরি নানারকমের ঘর সাজাবার শৌখিন জিনিস, বন থেকে সংগ্রহ করে আনা টাটকা মধু, উলের তৈরি রকমারি পোশাক। বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
পরদিন আমাদের সারাদিনের প্রোগ্রাম। প্রথমেই গেলাম ওয়াংখোর প্রজাপতি সংগ্রহশালায়। ওয়াহিংদো এলাকায় এই মিউজিয়াম। ১৯৭৩ সালে এম কে সরকার নামে এক বাঙালি প্রাণীবিদ ও কীটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞর উদ্যোগে এই মিউজিয়ামটি স্থাপিত হয়। প্রচারের আলো সেভাবে পায় নি এখনো। পরের গন্তব্য ইস্টার্ন এয়ার কম্যান্ড মিউজিয়াম। ভারতীয় বিমানবাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে আপার শিলঙয়ের এই অসাধারণ সংগ্রহশালায় আসতেই হবে। এখানে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইস্টার্ন এয়ার কম্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখানো হয়েছে আলোকচিত্রের মাধ্যমে। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে ব্যবহৃত বিমান ও হেলিকপ্টারের ছোট ছোট মডেল এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। মিউজিয়ামের বাইরের মাঠেও বেশ কয়েকটি বিমান ও একটি হেলিকপ্টার রাখা আছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ক্যারিবিউ ডি এইচ সি-৮ বিমানটিও আছে।

এরপর গেলাম ডন বসকো মিউজিয়াম। প্রায় সাত-আটতলা বিল্ডিং। টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করেই মনে হল এক অন্যজগতে এসে পড়েছি। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জনজাতির বিচিত্র ধরণের জীবনযাত্রা, পোশাক, চাষবাস, চাষের কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, বাড়িঘর, তাদের নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস মডেলের আকারে বর্ণনা করা আছে। অপূর্বশৈলীতে তৈরি মূর্তিগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় ভূমিপুত্রদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জগতের আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে। খুব ভালোভাবে দেখতে হলে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হবে। মিউজিয়ামের একদম মাথায় রয়েছে একটি স্কাইওয়াক। এখান থেকে পাখির চোখে দেখে নেওয়া যায় গোটা শিলং শহরকে।

এরপরের গন্তব্য ওয়ার্ডস লেক,  যাকে দেখতে অনেকটা কলকাতার রবীন্দ্র সরোবরের মতোই। এটি খনন করেছিলেন আসামের একসময়ের চিফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড। তাই লেকের নামকরণও তাঁর নামেই। জলের ওপর দিয়ে চলে গেছে একটি সেতু। জলে রয়েছে রকমারি রঙিন মাছ। বোটিং-এর ব্যবস্থাও আছে। আর বোটিং করতে না চাইলে সরোবরের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেঞ্চে অথবা সবুজ ঘাসের গালিচায় শুয়ে বসে দিব্যি অলস সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। এরপর ফুলের বাগিচা লেডি হায়দারি পার্ক ও মেরী হেল্প অফ ক্রিশ্চিয়ান নামের একটি গির্জায় মাদার মেরীর কমনীয় মূর্তি দেখে সোজা চলে গেলাম শিলং গলফকোর্স। সাহেবদের খুব প্রিয় জায়গা ছিল শিলং। তাঁদের সেইসব অতীত স্মৃতি যারা এখনও বহন করে চলেছে তাদের মধ্যে ১৮ হোলের এই গলফকোর্সটি অন্যতম সেরা। মখমলের মতো সবুজ ঘাসে ঢাকা গলফকোর্সকে ঘিরে পাইনের সারি আর চারদিকের অপূর্ব মোহময়ী প্রাকৃতিক শোভা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। এরপর গেলাম শিলং-এর অন্যতম আকর্ষণ শিলং পাহাড়ের শিখর শিলং পিক-এ। এখান থেকে শিলং শহরের একটি অংশকে পাখির চোখের চোখে দেখে নেওয়া যায়। একটা সুন্দর ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা যায় বাংলাদেশ। শিলং পিকের দিনের আর রাতের রূপ সম্পূর্ণ আলাদা। পুরো চত্বর জুড়ে নানারঙা পোশাক আর মানুষজনের কোলাহলে পূর্ণ। একঝলক দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড়ি বনানীর মাঝে উজ্জ্বল একঝাঁক রঙিন প্রজাপতির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আরও ছোটখাটো দু’একটা জায়গা দেখে চললাম শিলং-এর অন্যতম প্রধান গন্তব্য রবীন্দ্রনাথের শিলং আবাসস্থলের দিকে যার টানে বাঙালি আজও ছুটে যেতে চায় বার বার। জনবহুল ও ঘিঞ্জি পুলিশবাজার ছাড়িয়ে পাহাড়ের আরেকদিকে আকাশ-ছোঁয়া পাইন-ফার সম্বলিত রিলবং এলাকার আঁকাবাঁকা রাস্তার নির্জন স্থানে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ব্রুকসাইড বাংলো। এখানেই রবীন্দ্রনাথ উনিশ দিনের ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। সম্মুখেই রয়েছে স্ট্যাচু। ঠিক তার পিছনে ছবির মতো সুন্দর বাংলো। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে কোথায় বসে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন সেই জায়গা দেখলাম। এক অপার্থিব পরিবেশের মধ্যে এসে মন আবেগপূর্ণ হয়ে ওঠে। জানালা দিয়েও দূরে শিলঙের পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছিল। কবিগুরুর অত্যন্ত প্রিয় শহর শিলং তাঁর শেষ বয়সের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’-র পটভূমি। যদিও এখানে বসবাসের সময় তিনি এই উপন্যাসের প্লটটাই শুধু ভেবেছিলেন, পুরো উপন্যাস লিখেছিলেন আরও আট বছর বাদে বেঙ্গালুরু থাকাকালীন সময়ে। শিলঙয়ের নির্জনতা তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে তিনি এখানে আরও দু’বার গিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে দ্বিতীয়বার ‘জিৎভুমি’ নামে একটি বাড়িতে বসে ‘যক্ষপুর’ নামে একটি প্রাথমিক খসড়া করেছিলেন যা পরবর্তীতে ‘রক্তকরবী’ হিসেবে প্রকাশ পায়। ১৯২৭ সালে তৃতীয়বারের জন্য গিয়েছিলেন এবং উঠেছিলেন ‘সলোমন ভিলা’-য়। এখানে থাকাকালীনই ‘তিন পুরুষ’ উপন্যাসের খসড়া করেছিলেন যা পরবর্তীকালে ‘যোগাযোগ’ নামে প্রকাশিত হয়। শিলঙে নির্জন আবাসকালে উপন্যাস ছাড়াও বেশ কিছু কবিতা ও ‘শিলঙের চিঠি’-ও রচনা করেন যা আজও বাংলা সাহিত্যের গৌরব বহন করে চলেছে। নতজানু হয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

শিলং-এর তৃতীয়দিন আমাদের গন্তব্য চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জির নাম শুনলেই ছোটবেলার ভূগোল ক্লাসের সেই প্রশ্নটির কথা মনে পড়ে যায়-“পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত কোথায় হয় বল তো?” ক্লাসের সবাই মিলে সমস্বরে বলে উঠতাম ‘চেরাপুঞ্জি।’ বর্তমানে কিছুটা ভৌগোলিক আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের জায়গা চেরাপুঞ্জি থেকে সরে গিয়ে ছয় কিলোমিটার দূরে মৌসিনরাম হয়েছে। চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথটি ভারী চমৎকার। দু-এক টুকরো নয়, মাইলের পর মাইল জুড়ে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ চেরাপুঞ্জির নাম মাহাত্ম্য তুলে ধরার প্রচেষ্টায় সামিল হয়েছে। পাহাড়ি পথের প্রতি বাঁকেই নতুন নতুন রহস্য। রাস্তার পাশে মাঝে-মাঝেই দেখা যায় পাহাড়ি রাজকন্যাদের। শিলং থেকে রওনা দেওয়ার প্রায় ৪০-৫০ মিনিট পর একটি ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়েই পড়ে মাওকডক ভিউ পয়েন্ট। দুই পাহাড়ের গর্জের মধ্য থেকে উঠে আসে রাশি রাশি মেঘ। পায়ে হেঁটে চলে যাই দুয়াংসিং ভিউ পয়েন্টে। এখানে খাসি পরিবারের সদস্যরা বেশ কয়েকটি জলখাবারের দোকান চালাচ্ছেন। আমাদের যাত্রাপথের সাময়িক বিরতি নিয়ে এখানেই প্রাতরাশ করে নেওয়া হল। আবার পথচলা শুরু। যেতে যেতেই ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ঝর্ণা চোখে পড়ল। এরকমই একটি মনকাড়া ঝর্ণা এলিফ্যান্ট ফলস। শিলং থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। প্রপাতটি দেখার উপযুক্ত সময় অবশ্য জুলাই-আগস্ট মাস। প্রথম ধাপটির নাম ফার্স্ট ফলস আর দ্বিতীয় ধাপটির নাম মেইন ফলস। জলপ্রপাতটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখতে হলে একেবারে নিচে নামতে হবে। ঝর্ণার আশেপাশে অবস্থিত রডোড্রেনড্রনের বন এপ্রিল-মে মাসে লালফুলে ঢেকে যায়।

পথে আরও কয়েকটি ঝর্ণার রূপ তারিফ করার পর ছোট্ট এক জনপদের সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম ‘সোহরা।’ ‘সোহরা’ শব্দটির অর্থ কয়লা। আশেপাশেই কয়লা আর পাথরের খাদান রয়েছে। ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে এই সোহরাই হয়ে যায় ‘চেরা’ আর ‘চেরা’ থেকেই চেরাপুঞ্জি। চড়াই-উৎরাই পথ ধরে গাড়ি যত এগোয় ততই বদলে যেতে থাকে প্রকৃতি। পথেই দেখা হয়ে গেল কিনরেন আর বাহ-কাবা ফলস। চেরাপুঞ্জির প্রায় পাঁচ কিলোমিটার আগে ডাইনথলেন জলপ্রপাত। পাশেই সা-ই-মিকা পার্ক ভিউপয়েন্ট। ভিউপয়েন্টের কাছেই এশিয়ার দ্বিতীয় আর বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম প্লাঞ্জ জলপ্রপাত নোহকালিকাই। ভিউপয়েন্টে দাঁড়িয়ে দেখা যায় অনেক উঁচু থেকে গভীর খাদে ঝরে পড়ছে গোটা ঝর্ণা। দূর থেকে দেখা যায় সূর্যের আলো এসে পড়ছে ঝর্ণার গায়ে আর তার থেকে সৃষ্টি করছে রামধনু। এত সুন্দর ঝর্ণার পিছনে যে একটা করুণ কাহিনী আছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। জনশ্রুতি যে, এই ঝর্ণার কাছে এক পরিবার বাস করত। স্বামী-স্ত্রী আর তাদের ছোট্ট একটি মেয়ে। পেশায় কুলি ছিল তারা। কিন্তু হঠাৎ স্বামী মারা যাওয়ায় স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই দ্বিতীয় স্বামী বাচ্চা মেয়েটিকে একেবারেই পছন্দ করত না। মহিলার নাম ছিল লিকাই। লিকাই সারাদিন কাজেই ব্যস্ত থাকত। একদিন সে কাজে থাকাকালীন তার দ্বিতীয় স্বামী লিকাইয়ের মেয়েকে খুন করে এবং তার মাংস রান্না করে লিকাই কাজ থেকে ফিরে আসলে তাকে খেতে দেয়। লিকাই সেই মাংস খেতে খেতে দেখে যে তার মেয়ের একটা আঙুল ওর মধ্যে রয়েছে। সে তখন উন্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে এই ঝর্ণার ওপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। খাসিয়া ভাষায় ‘নোহ’ মানে লাফ দেওয়া আর ‘লিকাই’ মানে চোখের জল। কাহিনী শুনে এত সৌন্দর্যের মধ্যেও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় আজও লিকাইয়ের চোখের জলের ধারা হিসেবে পতিত হচ্ছে নোহকালিকাইয়ের প্রবল ধারা। এখানে মিশনারিদের বেশ কয়েকটি সমাধি ও স্মৃতিসৌধ আছে। গাড়ি একসময় পৌঁছে যায় সোহরা বাজার। এখানেই মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেওয়া হল। বেশ বড় জনপদ। কিনে নেওয়া হল কমলালেবুর মধু, দারুচিনি আর চেরির আচার। রাস্তা এই বাজার ছাড়িয়েই পৌঁছেছে চেরাপুঞ্জি।

নোহকালিকাই ফলস
উমিয়ম লেক

শহরে ঢোকার মুখেই রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলভবন। রামকৃষ্ণ মন্দির, স্কুল, দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র দেখে এখানকার নৃতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাটিও ঘুরে ঘুরে দেখে নিই। এখানে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন উপজাতির মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও তাঁদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। চেরাপুঞ্জির অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট এই রামকৃষ্ণ মিশন। চারিদিকে ক্যানিয়নের অপূর্ব বৈচিত্র্যময় রূপরেখার মধ্যে পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদোপম রামকৃষ্ণ মিশনের বিশাল চত্বর। দূর থেকে দেখে খাসিয়া পাহাড়ের শিখর-মুকুট বলে মনে হবে। মিশনের চত্বর থেকে দূরে পাহাড়সারিগুলোকে দেখতে দুর্দান্ত লাগে। বিস্তৃত পাহাড়রাজির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় সারাজীবন যদি এখানেই থাকতে পারতাম!
এখানকারই এক আবাসিকের মুখে শুনলাম আজ এতবড় প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলেও একসময় এখানে কিছুই ছিল না। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের জায়গা হলেও খাবার জলের অভাব ছিল খুব। সন্ন্যাসীরা যাঁরা থাকতেন জলের চাহিদা মেটাতে পাহাড়ের নিচে ঝর্ণার জল বয়ে নিয়ে আসতে হত। রাতে বন্যপ্রাণীদের আনাগোনাও বৃদ্ধি পেত। এখন সেই দিন পাল্টে গেলেও রাতে মিশনচত্বর ছেড়ে একটু দূরে যেতে বেশ গা ছমছম করে।
চেরাপুঞ্জিকে একটু একটু করে দেখি আর মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এগিয়ে চলি সবুজের সাম্রাজ্য সোহরা গ্রামে। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সোহরাকে আসামের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করলেও আবহাওয়ার জন্য ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয়। প্রকৃতিদেবী গোটা চেরাপুঞ্জিতেই তাঁর অপূর্ব সৌন্দর্যের ডালি উজাড় করে সাজিয়ে দিয়েছেন। সোহরা গ্রাম ছেড়ে এগিয়ে যাই ইকো-পার্কের দিকে। শান্ত প্রকৃতির মাঝে এই পার্কে রয়েছে বিনোদনের নানা উপকরণ। ছোটদের জন্য একদম আদর্শ জায়গা। মাঝে-মাঝেই মেঘের দল হানা দেয়। আবার মেঘ সরে গেলেই পাহাড়ের নিচে বাংলাদেশের সিলেট বা শ্রীহট্ট জেলার সমতল প্রান্তর চোখে পড়ে।
এবার গন্তব্য মওসমাই গুহা। গুহায় প্রবেশ করার আগে ও বেরোনোর পর রয়েছে চমৎকার সিঁড়ি-বাঁধানো রাস্তা। কিন্তু ভিতরের পথ বেশ দুর্গম। রোমহর্ষক গুহার ভিতরে সর্বত্র চুনাপাথরের বিভিন্ন আকৃতির স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট। গুহার মধ্যে প্রচুর জল আছে। কিছু কিছু জায়গায় প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। তবে পুরো পথই আলোকিত। কিছু জায়গায় অবশ্য আলো-আঁধারিতে পূর্ণ। গুহা দেখে সোজা চলে যাই এক বিস্তৃত ক্যানিয়নের গা থেকে অবিরাম ঝরে পড়া ‘সেভেন সিস্টার্স’-নামী সপ্তকন্যার নির্ঝরিণীদের দেখতে। ফেরার পথে বৃষ্টি। চেরাপুঞ্জিতে এসে বৃষ্টি না পেলে সারাজীবন বোধহয় আক্ষেপই থেকে যেত।

চেরাপুঞ্জিতে একদিন কাটিয়ে পরদিন ফেরার পথে অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছি এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মাওলিননং গ্রামের দিকে। চেরাপুঞ্জি থেকে দূরত্ব প্রায় ৮১ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সীমানার কাছে অবস্থিত এই গ্রাম আজ সারা বিশ্বের আলোচনার বিষয়। বাইরে গাড়ি রেখে এখানে প্রবেশ করতে হয়। প্লাস্টিক পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ। ভ্রমণপ্রেমী হওয়ার সুবাদে সিকিমের বিভিন্ন গ্রামে গিয়েও এমন পরিচ্ছন্নতা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এই গ্রামটি এতটাই পরিচ্ছন্ন যে একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে থাকতে দেখলাম না। পথেই দেখা হয়ে গেল টুকরি পিঠে নিয়ে ফেরা একদল নারী-পুরুষের সাথে। এদের মূল জীবিকা সুপুরি বিক্রি। গ্রাম জুড়ে বেতের তৈরি ডাস্টবিনের ছড়াছড়ি। গ্রামের প্রায় সব বাড়ির সামনেই ফুলের বাগান রয়েছে আর সেই বাগান আলো করে আছে রকমারি মরশুমি ফুল আর বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড। গ্রামের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি চার্চ আর কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে থাইলন নদী। পুরো গ্রামই সবুজে মোড়া। চারিদিকে ছোট ছোট বাড়ি। গ্রামের প্রায় শেষের দিকে পুরোপুরি বাঁশের তৈরি ৮০ফুট উচ্চতার ওয়াচটাওয়ার। টিকিট কেটে এখান থেকে দেখে নেওয়া হল বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। ওয়াচটাওয়ার থেকে চারপাশ দেখলে মনে হবে সারা পৃথিবীর একটাই রঙ- আর সেটা হল সবুজ। গ্রামের একপাশে মহিলা পরিচালিত পরিচ্ছন্ন ধাবা। আজকের লাঞ্চটা এখানেই সেরে নেওয়া হল।

মাওলিননং গ্রামের মূল আকর্ষণ গাছের মূল দিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক রুটব্রিজ যা এখানে প্রবেশ করার প্রায় ২ কিলোমিটার আগে রিওয়াই গ্রামে অবস্থিত। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই রুটব্রিজে। এই ব্রিজ অবশ্য একতলা। চেরাপুঞ্জিতে আছে ‘ডাবল ডেকার ব্রিজ।’ প্রাচীন খাসিয়া উপজাতির মানুষের চোখে প্রথম ধরা পড়ে এক বিশেষ প্রজাতির রবারগাছ। বৈজ্ঞানিক নাম ফাইকাস ইলাসটিকা। এই গাছের মূল শিকড়টি অন্যান্য গাছের মতোই মাটির নিচে থাকে। কিন্তু গাছের বয়স যত বৃদ্ধি পায় শিকড়গুলি উপরের দিকে বেড়ে উঠতে থাকে। এই শিকড়ের সাথে সুপারিগাছ, পাথর, কাঁকড় ইত্যাদি নানা জিনিস দিয়ে জীবন্ত সেতু তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি শেষ করতে প্রায় ২৫-৩০ বছর সময় লাগে। শোনা যায় এই ব্রিজের বয়স প্রায় ৩০০ বছর। একটি ঝোরার ওপরে দু’দিকের গাছের শিকড় জুড়ে জুড়ে তার ওপর তৈরি করা হয়েছে হাঁটার উপযুক্ত সাঁকো। একেকবারে মাত্র একজন করেই যেতে পারবে। বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেশ শক্তপোক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে সেতুটি। স্থানীয় মানুষই এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ করেন।

ব্যালান্সিং রক
লিভিং রুট ব্রিজ

মাওলিনলং গ্রামের আরেক অন্যতম দ্রষ্টব্য ব্যালান্সিং রক। একটি চৌকো মতো জায়গায় একটি বড় আকারের প্রস্তরখণ্ড তার ঠিক নিচে থাকা একটি ছোট পাথরের টুকরোর ওপর ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের তলদেশ গ্রিল দিয়ে আটকানো। স্থানীয় মানুষজন এই রককে দেবতা হিসেবে পুজো করেন। এগিয়ে যাই গাড়ির দিকে। এবার গন্তব্য ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ডাওকি। ডাওকি যাওয়ার পথে পড়ে একের পর এক পাগলপারা জলপ্রপাত। বর্ষার ঠিক পরপর হওয়ায় প্রপাতগুলো সবচেয়ে দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ডাওকির নদীর নাম উমঙ্গত। বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে করা যায় নৌকাবিহার। এই নদীতে নৌকাবিহার জীবনের এক অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। জলের নিচে পাথরের খাঁজে খাঁজে সাঁতাররত রঙিন মাছ, নুড়ি, পাথর, অ্যালগি, ফাঙ্গি সুস্পষ্ট দৃশ্যমান। নৌকার মাঝি চমন চামলিঙের সাথে গল্পে গল্পে চিনে নিতে থাকলাম জলের নিচের পাহাড়ি জগতকে। চমন জানালেন বৃষ্টি না থাকলে নৌকা থেকেই স্ফটিকস্বচ্ছ জলতলের একেবারে নিম্নভাগ অবধি পরিষ্কার দেখা যায়। নৌকা বেয়ে নিয়ে তিনি এমন একটি জায়গায় গেলেন যেখানে দুগ্ধসাদা ফেনিল জল অবিরাম গতিতে ঝরে পড়ছে উমঙ্গতের বুকে। সেই জলের ঘূর্ণনে নৃত্যরত মাছের দল যেন আনন্দের উৎসবে মাতোয়ারা। এখানে প্রচুর স্থানীয় আসেন মাছ ধরতে। সামান্য কিছু মূল্যের বিনিময়ে দিব্যি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছিপ নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। চমনই জানালেন সামান্য ময়দার টোপ দিয়ে নানাধরনের মাছ ধরা যায়। উমঙ্গত নদী এখানে কাউকেই নিরাশ করে না- তা সে পেশাদার বা অপেশাদার যে ধরনের মাছশিকারিই হন না কেন। জলের মধ্যে মাথা উঁচু করে আছে বেশ কিছু অমসৃণ পাথর। ইচ্ছে হল কিছুক্ষণ জলে পা ডুবিয়ে রেখে থাই স্পায়ের মতো মাছেদের দিয়ে স্পা করিয়ে নিই। রাতে থাকার জন্য দেখলাম নদীর তীরে রয়েছে তাঁবুর ব্যবস্থা। মনে মনে ইচ্ছেপোষণ করলাম কোন এক চাঁদনিরাতে এই তাঁবুতে থেকে উমঙ্গত নদীর মনমোহিনী রূপকে প্রত্যক্ষ করব। উমঙ্গতের একদিকে খাসিয়া পাহাড়, আরেকদিকে জয়ন্তিয়া পাহাড়। একটি ঝুলন্ত ব্রিজ এই দুটি পাহাড়কে জুড়ে রেখেছে।

ডাওকি
মাওকডক ভিউ পয়েন্ট
এলিফ্যাণ্ট ফলস

উমঙ্গত নদী ধরে পশ্চিমদিকে এগোতেই চমন বললেন ‘ওদিকে বাংলাদেশ সীমান্ত।’ সিলেটের দিকে বয়ে চলেছে উমঙ্গতের জল। সীমান্তরেখার একদিকে বিএসএফ, অন্যদিকে বিডিআর-এর চেকপোস্ট। সামনেই দেখতে পাচ্ছি বাপ-ঠাকুরদার নিজভূম। কিন্তু কাঁটাতার পেরিয়ে তো যাওয়ার উপায় নেই। এক অদৃশ্য সীমান্তরেখা দিয়ে জলের ভাগাভাগি সত্ত্বেও ভারতীয়রা বাংলাদেশের চরে চলে যান, আবার কখনও কখনও বাংলাদেশীরাও ভেসে বেড়ান উমঙ্গতের বুকে। অতন্দ্রপ্রহরীদের কড়া নজরদারি পেরিয়েও বাংলাদেশী আচারওয়ালা, ডালমুটওয়ালা চলে আসেন ভারতের সীমানায়। আর এখানকার কুলের আচার আর মুড়িমাখার স্বাদ তো অতুলনীয়। মনভূমের সীমান্তরেখা ভুলে দুই বাংলার মানুষই এই মিলনমেলার যজ্ঞে সামিল হন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। দিনান্তে দুই দেশের প্রহরীদের সতর্কতায় বন্ধ হয়ে যায় এই মিলনমেলা। ভাঙা হাটের মতো পড়ে থাকে শূন্য তীর, সারবাঁধা যাত্রীবিহীন ফাঁকা নৌকো। ডাউকির তীর অপেক্ষায় থাকে এক নতুন সূর্যোদয়ের।

রূপকথার শিলং-এ এসেছিলাম চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সব স্বপ্নই শেষ হয় একদিন। কয়েকদিন মেঘ, বৃষ্টির রাজ্যে থেকে মন কানায় কানায় পূর্ণ। হয়তো এ যাত্রায় অনেককিছু অ-দেখা হয়ে থাকল। কিন্তু এই ক’দিনে যা যা দেখলাম তা মনের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আজকের রাতটা শিলং-এর হোটেলে কাটিয়ে আগামীকাল খুব ভোরের ফ্লাইটেই উড়ে যাব নিয়মবাঁধা তাসের দেশে, মিশে যাব জনারণ্যে। আবার শুরু হবে নাগরিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব।

সেভেন সিস্টার্স ফলস
ওহ-কাবা ফলস
পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বিভিন্ন ধরনের বই পড়া, বেড়ান আর সিনেমা দেখা। পছন্দের ভ্রমণ তালিকায় প্রথম স্থানে আছে পাহাড়িয়া ছোট ছোট গ্রাম। আরও শখ সময় ও সুযোগ পেলেই পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তা গ্রহণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে থেকে নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখা। বেড়িয়ে এসে মনের আনন্দে টুকটাক ভ্রমণকথা লেখার চেষ্টা। লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, বাতিঘর অনলাইন ব্লগজিন, প্রবচন পত্রিকা, ‘পর্যটকের ডায়েরি’ নামক ভ্রমণ সংকলনে। পঙ্কজ উধাস, জগজিৎ সিং আর রশিদ খানের গান সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সফট রোম্যান্টিক গান বিশেষ পছন্দ। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি প্রবল ঝোঁক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *