শ্রাবণের ধারার মত

শ্রাবণের ধারার মত

"মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি / বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশীষে অমৃতের টীকা পরি।"

সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত - 'আমরা'

কবিরা দূরদর্শী, তাই আগেই জেনে গেছেন! অতিমারীর তো যাওয়ার কোন লক্ষণ নেই। কবিবর তো আবার একধাপ এগিয়ে, তাঁর গানে আছে না, ‘তোমার যাওয়া তো নয় যাওয়া’? কিন্তু আমাদের প্রাণ যে ওষ্ঠাগত!

ভরসা আমাদের চিকিৎসক কুল ও তাঁদের প্রদত্ত ঐ অমৃতের টীকা। ভারতে এখনও অবধি দুশো কোটির মত মানুষের টীকাকরণ হয়েছে। এ সত্যি এক আশ্চর্যজনক সাফল্য!

প্রতি বারের মতই এবারেও ব্যাঙ্গালোরের বর্ষা বেশ জাঁকিয়েই এসে গেছে। বর্ষা যাঁর প্রিয় ঋতু ছিল তাঁর সেই ছিন্নপত্রের চিঠির ভাষা ধার করেই বলতে হয় “বর্ষার নব রাজ্যাভিষেক বেশ রীতিমত আড়ম্বরের সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেছে।”

জানলার বাইরে সেই সমারোহ দেখছি আর বর্ষা সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে বসে দেখছি নয়নয় করে আট – আটটি বছর আমার সম্পূর্ণ হল ‘অবসর’ পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে।

হ্যাঁ, এরকম এক শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝিই প্রকাশিত হয়েছিল এই অধুনা সম্পাদকের অতিথি সম্পাদক রূপে সম্পাদিত ‘অবসর’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। নাম ছিল ‘রবি-স্মরণ – শ্রবণে, শ্রাবণে’! প্রকাশের তারিখ ছিল – ৩০শে জুলাই, ২০১৪। দেখতে দেখতে আটটি সোনার বছর পার হয়ে গেছে।

পুরনো অবসর ২০১৮তে বন্ধ হল। আবার নবরূপে তার যাত্রা শুরু হল ২০২০র সেপ্টেম্বরে।

সেই শ্রাবণ সংখ্যা প্রকাশের ঘটনাটা ছিল একেবারেই আকস্মিক ও কাকতালীয়। তখন ‘অবসর’ পত্রিকায় আমার দুটি কি তিনটি লেখা প্রকাশ পেয়েছে। এই সময় ২০১৪র মে মাস নাগাদ কী খেয়াল চাপল, সম্পাদক সুজন দাশগুপ্ত মশাইকে বলে বসলাম যে আসন্ন ২২শে শ্রাবণ উপলক্ষে কোন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের পরিকল্পনা আছে কিনা। সুজনদা বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, বললেন, “ছিল না, তবে এখন আছে এবং তুমি হবে তার অতিথি সম্পাদক।” সত্যি কথা বলতে আমি বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, আবার বেশ উৎসাহিত বোধ করেছিলাম। এক বছরেরও পরিচয় নেই, কিন্তু এর মধ্যেই প্রধান সম্পাদক আমাকে এতটা নির্ভরযোগ্য ভেবে ফেলেছেন? তবে আরও একজন ছিলেন, তিনি ঘোর টেগোরাইটিসে আক্রান্ত অবসরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রী সুমিত রায়। তিনি আছেন আর রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুমাসে একটা বিশেষ কিছু হবে না?

 

 

তা কাজ তো শুরু হল। সম্পাদনার বড় কাজ লেখক যোগাড়। আমি নিজে, সুজনদা এবং সুমিত বাবু। সর্বসাকুল্যে তো তিনজন! যাইহোক খুঁজে খুঁজে পাওয়া গেল আরও কয়েকজনকে যাঁদের অন্যতম হলেন আমার প্রিয় লেখক শ্রী শেখর বসু। এছাড়া অন্য বন্ধুবান্ধবরা অর্থাৎ, ঈশানী, সৌম্যকান্তি, পল্লবরাও এলেন। ব্যস! মোটামুটি হয়ে গেল হাতে খড়ি। এই লেখকেরা পরবর্তী কালেও বারংবার ‘অবসর’কে ধন্য করেছেন তাঁদের সোনার কলমের দ্বারা। সুজনদা এবং সুমিতবাবুর ও উৎসাহ এবং আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল বেশ কয়েকজন নতুন লেখক পেয়ে। মজার ব্যাপার হল, সুজনদা এবং শেখরবাবু আগেই পরস্পরের পরিচিত ছিলেন কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই সূত্রে আবার তাঁদের মধ্যে যে সেতুবন্ধন হয়েছিল তাতে সেই কাঠবিড়ালির মাপের অবদান ছিল আমার, এটা আমাকে সত্যিই পুলকিত করেছিল।

সংখ্যার সূচীপত্র

তবে এই সংখ্যা প্রকাশের সময় এক বেদনার স্মৃতি মনকে আচ্ছন্ন করছে। সুমিতবাবু এই শ্রাবণে আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। বিগত বছরে তিনি আমাদের ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। সেই বেদনা আজও আমাদের ভারাক্রান্ত করে। তাই এবারের ‘পুরনো অবসর’ বিভাগে রইল তাঁর সেই সেবারের রচনাটি – ‘যত শুনিয়েছিলেম গান’!
এছাড়া রইল অন্যান্য বিভাগের রচনাও। কিছুদিন আগে ‘অবসর’ ফেসবুক গ্রুপে আহ্বান করা হয়েছিল সাহসিনী নারী সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতার মনোনীত রচনাগুলিও প্রকাশিত হয়েছে এই সংখ্যায়।
প্রিয় লেখক নারায়ণ সান্যাল একবার সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে গিয়ে স্মরণ করেছিলেন তাঁর লিখিত ‘অপরূপা অজন্তা’ গ্রন্থটির একটি কপির কথা। সুনীতি কুমার ঐ ‘অপরূপা অজন্তা’ গ্রন্থটিতে স্বহস্তে মার্জিনে প্রচুর মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, দ্বিতীয় সংস্করণ হবেই এই বইয়ের, তখন মন্তব্যগুলি কাজে লাগবে।
তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য শেষ করার সময় নারায়ণ সান্যাল যা লিখেছিলেন যে তিনি চলে গেলেও তাঁর কাছে রয়ে গেছে তাঁর স্বহস্তে, বহু যত্নে কাটাকুটি করা সেই গ্রন্থটি। কোন সময় মন খারাপ করলেই তিনি সেই বইটি উল্টেপাল্টে দেখেন আর একেবারে বলীয়ান হয়ে যান।
সুমিতবাবুর সম্পর্কেও আমরা অবসরকুল এভাবেই ভাবতে পারি। তিনি চলে গেলেও তাঁর সৃষ্ট ঐ বিখ্যাত http://www.gitabitan.net/ ওয়েবসাইটটি আজও রয়ে গেছে আমাদের পথ প্রদর্শক রূপে। তাঁর কথা মনে পড়লেই বা মন খারাপ করলেই আমরা যেতে পারি তাঁর বহু যত্নে নির্মিত ঐ ওয়েবসাইটটিতে। একবার ভ্রমণেই অনেক শক্তি সঞ্চয় হবে। দুই প্রিয় মানুষ রয়ে গেছেন যে সেখানে – রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্য সুমিত রায়।

আমাদের সকলের জন্য আরও একটি দুঃসংবাদ – আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। আমরা শোকার্ত, কিন্তু সময়াভাবে আমরা তাঁকে সেভাবে সম্মান জানাতে পারলাম না। পরবর্তী সংখ্যাতে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে।

জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, অন্যদেশ, পরবাস ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। সম্প্রতি নিজের একটি ব্লগ চালু করেছেন – www.bhaskarbose.com

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • দীপঙ্কর চৌধুরী , July 16, 2022 @ 12:45 pm

    একটি সুলিখিত সম্পাদকীয়, স্বকীয়তায় ভাস্বর!

    • admin , July 16, 2022 @ 6:58 pm

      অনেক ধন্যবাদ!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *