প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬

 

দিলীপকুমার -- অশান্তি যে আঘাত করে

সুমিত রায়


[এর আগের রচনা "দৈলীপী", সেখানে দিলীপকুমার রায়ের গান নিয়ে কিছু বলা হয়েছিল। দিলীপকুমার ছিলেন দীর্ঘজীবী তাঁর জীবনকথাও বেশ চিত্তাকর্ষক, এই রচনায় তা সংক্ষেপে ছুঁয়ে যাওয়া হলো।]

আঠারোশো সাতানব্বই থেকে উনিশশো আশি -- তিরাশি বছর। দিলীপকুমার রায় তিরাশি বছর বেঁচে ছিলেন। দীর্ঘ জীবন।

এই দীর্ঘ জীবনে তিনি থেকেছেন, ঘুরেছেন, গেয়েছেন, গাইয়েছেন, পড়েছেন, লিখেছেন, বলেছেন, বলিয়েছেন, খুঁজেছেন, পেয়েছেন।

আর দুলেছেন জীবন-দোলায়। অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। কস্তুরী মৃগ যেমন গন্ধের খোঁজে লক্ষ্যহীন হয়ে চতুর্দিকে দৌড়ে বেড়ায়, তাঁর বহুমুখী প্রতিভার তাগিদ তাঁকেও যে কতোদিকে দৌড় করিয়েছে। জীবনের শেষ দুই দশক বোধহয় আস্তে আস্তে শান্তির লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন।

তাঁর এই দোলন-চলনের কথা বিশদ করে খোলাখুলিভাবে লিখে গেছেন তাঁর অনেক জীবনীমূলক কাহিনী বা ভ্রমণকাহিনীতে। পড়ে মনে হয় আশ্চর্য খোলা মনের মানুষ ছিলেন তিনি, নিজের সম্বন্ধে কোনো কথা রেখে ঢেকে বলেননি, যা জেনেছেন, যা ভেবেছেন তাই বলেছেন, তা সে ভালোই হোক আর মন্দই হোক। তাঁর হাস্যময়,, শিশুসুলভ সারল্যের কথা আমরা তাঁর সম্বন্ধে অন্য লোকের লেখা থেকেও জেনেছি। ১৮৯৭ সালে যখন তিনি জন্মালেন, বাংলাদেশে সে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনার কাল, বাঙালী রেনেসাঁস যাকে বলা হয় তা তখনও তুঙ্গে। যেখানে জন্মালেন --পিতামহ কার্তিকেয়চন্দ্র রায় আর পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছত্রছায়ায় -- সেখানে সাহিত্য-সঙ্গীত-সংস্কৃতির এক অবারিত মিলনক্ষেত্র। মাকে হারালেন তখন মাত্র ছবছর বয়েস। দ্বিজেন্দ্রলাল তখন দিলীপকুমারকে সবদিকে ঘিরে রইলেন -- "শুধু স্নেহময় পিতা বলে নয়, বন্ধু, সাথী, উপদেষ্টা, দিশারি"। দ্বিজেন্দ্রলাল নিজে ছিলেন "তার্কিক, কবি, রসিক, গায়ক. সুরকার" -- তাঁর চোখের মণি পুত্র মণ্টুর চরিত্রে এর প্রতিটি প্রতিভার দান তিনি উদারহস্তে রেখে গেছেন। এ ছাড়া দ্বিজেন্দ্রলালকে ঘিরে কবি-সাহিত্যিক-সঙ্গীতেবেত্তাদের এক জমাট মজলিশ ছিলো, দিলীপকুমার সেখান থেকে বাল্য আর কৈশোরে পেয়েছেন গুণীজনদের সান্নিধ্য।

পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, প্রখর স্মৃতিশক্তি, যাকে প্রডিজি বলে তাই। হেসে, গান গেয়ে, লাফঝাঁপ করে, বাবার প্রশ্রয়ে দশবারো বছরের ছেলেদের যেমন হওয়া উচিত তেমন বড়ো হচ্ছিলেন। লিখছেন, "অত্যধিক প্রশ্রয়েই আমি হয়ে উঠেছি এমন স্পর্শকাতর, দুরভিমানী। কিন্তু আজ বুঝছি যে আমার স্পর্শকাতরতার আরো গভীর কারণ ছিল। সেটা এই যে, আমার অনুভবশক্তি ছিল গড়পড়তা শিশুর চেয়ে অনেক বেশি। ... ক্রমাগত বই-মুখ করে থেকে অজ্ঞাতেই একটু ভাববিলাসী হয়ে পড়েছিলাম।" আরো বলছেন, "সত্যই আমি ভগবান আছেন কি না এ প্রশ্ন নিয়ে বার-তের বছর বয়সেই বিপর্যয় মাথা ঘামাতাম।" দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন ঘোর নাস্তিক, তাঁকে দেখে নাস্তিক হওয়াটাই দিলীপকুমার বেছে নিলেন, অন্তত তখনকার মতো। এই প্রশ্ন আর তার থেকে উত্থিত দ্বন্দ্ব তাঁর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে অনেকদিন, অনেকভাবে, তাঁর সঙ্গীতসৃষ্টি, তাঁর লেখা, তাঁর জীবনযাত্রা -- সব কিছুর মধ্যেই এই দ্বন্দ্ব আর তার থেকে যে কোনো ভাবে উত্তরণের চেষ্টা গভীর ছাপ রেখে গেছে। 

এই দ্বন্দ্ব উত্তরণে প্রথম সাহায্য পেলেন তাঁর পিসতুতো দাদা, প্রখ্যাত নট নির্মলেন্দু লাহিড়ীর কাছ থেকে। কাছাকাছি বয়সের যুবক নির্মলেন্দু কিছুদিন দিলীপকুমারের সঙ্গে এক বাড়ীতেই থাকতেন, এতো নিকট সংস্পর্শে তাঁর ব্যক্তিত্ব দিলীপকুমারকে অভিভূত করেছিলো। তিনিই দিলীপকুমারের "মনকে আর্টের আসক্তি থেকে ছিনিয়ে" এনে সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ আর ভগবানের আসন পেতে দেন। দিলীপকুমার নিয়তি, কর্মফল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করতেন, তাঁর মতে নির্মলেন্দুর সঙ্গ পাওয়াটা তাঁর ভাগ্যের লিখন। পরে অবশ্য গানের জগতেই দিলীপকুমার ফিরে এসে পাকাপাকিভাবে ডেরা বাঁধেন, কিন্তু তাঁর মতে তখন নির্মলেন্দুর দেওয়া বীজমন্ত্র তাঁর জীবনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত, কাজেই অসুবিধে হয়নি কোনো। কথাটা পুরোপুরি ঠিক নাও হতে পারে, সেখানেও অনেক সংশয়ের দোলাচলে দিলীপকুমার দুলেছেন অনেকবার।

স্কুল পাশ করলেন দশ টাকার স্কলারশিপ নিয়ে, জানকী বাঈয়ের গান শুনতে গিযে কুড়ি টাকার স্কলারশিপটা ফসকে গেলো। পড়তে গেলেন ফিজিক্সে বিএসসি, দিলীপকুমারের মতো লোক কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল করছেন, এটা ভাবা কঠিন, তাই যা আশা করা যায় তাই হলো, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ফেল করলেন। এই লাঞ্ছনার শোধ তুললেন পরের বছর, অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে। গান শেখা, গাওয়া চলছে জোর কদমে, আর্টের আসক্তি কিছু কমেছে বলে মনে হয়না। এদিকে আবার শ্রীরামকৃষ্ণকে সাক্ষী মেনে চিরকৌমার্যের ব্রত নিয়েছেন। তিনি আজীবন অকৃতদার ছিলেন। 

দিলীপ কুমার রায়

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে বিরাট লাভ হয়েছে, সুভাষচন্দ্র বোস তাঁর সহপাঠী, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। এ ঘনিষ্ঠতা অনেক বছর ধরে কায়েম ছিলো। , দিলীপকুমারের জীবনে এর প্রভাব গভীর, তিনি অনেক কথা লিখেছেনও এই সৌহার্দ্য নিয়ে। সুভাষচন্দ্র আর দিলীপকুমার, দুজনের জীবনেই ধর্মপ্রবণতা বেশ জটিল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিলো। সুভাষচন্দ্রের ক্ষেত্রে সে দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ দেশপ্রেম আর দিলীপকুমারের ক্ষেত্রে সঙ্গীতসাধনা। সুভাষচন্দ্রের বেলায় জয়ী দেশপ্রেম। সুভাষচন্দ্র ছিলেন স্থির লক্ষ্যের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পুরুষ, তাঁর মনস্থির করতে দেরী হতো না আর একবার লক্ষ্যস্থির করলে তার থেকে বিচ্যুত হতেন না। শত বিপদবাধার সঙ্গে লড়াই করে তাঁর তীর্থযাত্রার কথা তো আজ প্রবাদপ্রতিম। দিলীপকুমারের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার রূপ ধরে সে দ্বন্দ্বের অবসান এসেছে অনেক শারীরিক ক্লেশ আর মানসিক তোলন-নামনের পরে, যদিও শেষ পর্যন্ত দিলীপকুমার তাঁর জীবনের দুই চালিকাশক্তিকে -- গান আর ভক্তি -- মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন। দুই অতি অন্তরঙ্গ বন্ধুর চিন্তা আর ব্যবহার পাশাপাশি রেখে দেখলে এমন বৈষম্য দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই পারে না। দিলীপকুমার তাঁর স্মৃতিচারণে এর ভূরি ভূরি নজির লিখে গেছেন। 

১৯২০ সালে ইংল্যান্ডে বন্ধুদের সঙ্গে দিলীপ কুমার রায়।
(বাঁদিক থেকে) চেয়ারে বসে দিলীপ কুমার রায় এবং সি সি দেশাই;
দাঁড়িয়ে কে পি চ্যাটার্জি এবং সুভাষ চন্দ্র বসু (নেতাজী)।

গণিতে স্নাতক হয়ে বিলেত গেলেন কেমব্রিজে ট্রাইপস করে আইসিএস হতে। সুভাষচন্দ্রও এলেন ওই আইসিএস হতেই। গভীর অন্তরঙ্গতায় কিছু দিন কাটলো, তারপর সুভাষচন্দ্র মাত্র নমাসে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, সরকারী চাকরীও পেলেন কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে কিছুদিন পরে দেশে ফিরে গেলেন। দিলীপকুমার পড়ে গেলেন আতান্তরে, সুভাষচন্দ্র ছিলেন তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা। সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টান্ত মতো আইসিএসের পথ ছেড়ে দিলেন, কিন্তু তারপর করেন কী? লোকের কথা শুনে কতোদিকেই না ছুটোছুটি করেছেন, ক্রমান্বয়ে : ট্রাইপস করে প্রফেসরি; ব্যারিস্টারি; সুভাষচন্দ্রের আদর্শে দেশসেবা; চাটার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট; গান্ধীজীর দক্ষিণ আফ্রিকা কৃতির আদর্শে দরিদ্র শ্রমিকদের সেবা; এমন কী চাষবাস। সঙ্গীতের কথা যে ভাবছেন না তা নয়, কিন্তু সঙ্গীত তো বিলাসের ব্যাপার, মন খুঁৎখুঁৎ করছে। স্মৃতিচারণে তার বিশদ বিবরণ দিয়ে লিখছেন, "আমার মতো অস্থিরমতির পক্ষে কোনো কিছুতেই লেগে থাকা সম্ভব হবে না -- সুতরাং আমার সিদ্ধি নৈব নৈব চ।" সেই সময় দেখা পেলেন রোমাঁ রোলাঁর, তিনি দিলীপকুমারকে সঙ্গীতের দিকে ফিরিয়ে আনলেন। লণ্ডনে রবীন্দ্রনাথও এমনই উপদেশ দিয়েছিলেন। তারপর বছর তিন তিনি সারা ইউরোপ ঘুরলেন, ফরাসী শিখলেন, ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে বক্তৃতা দিলেন, জলসায় গান গেয়ে শোনালেন। আর বহু জ্ঞানীগুণীদের সঙ্গে পরিচিত হলেন, ইউরোপীয় সঙ্গীত শিখলেন। এবার দিলীপকুমার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ (একবার এম এন রায়ের কথায় একটু নেচেছিলেন) আর গান ব্যাপারটা তাঁর মজ্জায়, তাঁকে আর থামায় কে? ১৯২২ সালে দেশে ফিরলেন, লিখছেন "শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আমি দেখতে দেখতে জনপ্রিয় গায়ক হয়ে উঠলাম।"

দিলীপকুমার কিছু বাড়িয়ে বলেননি, ফিরে এসে সুরকার আর গায়ক হিসেবে দিলীপকুমার উঠলেন খ্যাতির চূড়ায়। বার হলেন ভারতপরিক্রমায়, উদ্দেশ্য ভারতীয় সঙ্গীতগুণীদের সঙ্গপ্রাপ্তি, মূল্যায়ন, শিক্ষা, আর গান গাওয়া তো বটেই। এই ব্যাপ্ত ভ্রমণের কালেই সঙ্গীত নিয়ে তাঁর চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করলো, বিশেষত সঙ্গীত, আর্ট, তানকর্তব আদি ঘিরে, সেই চিন্তা তাঁর সারা জীবনের গানের ভিতরে প্রকাশ পেয়েছে। একটা নিশ্চিত পথের সন্ধান পেয়ে দিলীপকুমারের নিশ্চিন্ত হবার কথা, কিন্তু সংশয়ের ভূত অতো তাড়াতাড়ি তাঁকে নিষ্কৃতি দেবার পাত্র নয়। কৈশোর থেকে তাঁর সঙ্গী আধ্যাত্মিক চিন্তা আর প্রশ্ন কিছুদিন চুপ থাকার পর তাঁকে উত্যক্ত করতে শুরু করেছে আবার, তিনি মনের মতো গুরু চান । বহু ধর্মপ্রাণ লোকদের সঙ্গে দেখা করছেন, তাঁদের কথামতো গুরুদের বাজিয়ে দেখছেন, মনের মতো হচ্ছে না। শেষে পছন্দ হোলো শ্রীঅরবিন্দকে, কিন্তু তিনি দিলীপকুমারকে তখনই শিষ্যত্ব দিতে রাজী হলেন না, অতএব দিলীপকুমারের অন্তর্দ্বন্দ্বের উপশম মুলতুবী রইলো তখনকার মতো। অল ইণ্ডিয়া রেডিও আর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঙ্গীত উপদেষ্টা হবার ডাক এলো, উপেক্ষা করলেন। আমেরিকা থেকে ডাক এলো সেখানে গিয়ে নতুন প্রযুক্তির রেকর্ড করবার, পা বাড়ালেন ১৯২৭ সালে, কিন্তু ইউরোপে কিছুদিন ঘুরে বৈরাগ্যচিন্তা তাঁকে অভিভূত করে ফেললো, তিনি দেশে ফিরে এলেন। সঙ্গীতচর্চা কিন্তু চলছে পুরোদমে। কিন্নরকণ্ঠ, কন্দর্পকান্তি যুবক, বিদ্বান, চারুভাষী -- তখনকার বাংলায় দিলীপকুমার নিঃসন্দেহে এক সাড়াজাগানো ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা" উপন্যাসের নায়ক অমিত রায়ের চরিত্র দিলীপকুমারের ছাঁচে গড়া, এমন কথা এককালে প্রচলিত ছিলো।

শেষ পর্যন্ত ১৯২৮ সালে তিনি শ্রীঅরবিন্দের শিষ্যত্ব পেলেন, পণ্ডিচেরীতে তাঁর জীবনের অজ্ঞাতবাস পর্ব শুরু হোলো। দিলীপকুমারের প্রতি যাঁরা প্রীতিময়, সে সুভাষচন্দ্র থেকে সত্যেন বসু, এমন কি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। আশ্রমের নিয়মকানুন কঠোর, সাধকদের বহির্জগতের সঙ্গে সংস্পর্শ রাখা বারণ, বোধহয় নাচগানও। প্রথমটির থেকে দিলীপকুমার রেহাই পেলেন না কিন্তু সঙ্গীতচর্চায় ছাড় পেলেন, যদিও তা ভক্তিমূলক হতেই হবে। দ্বন্দ্ব কিন্তু তাঁর জীবন ছাড়লো না, কতোটা সঙ্গীত আর কতোটা যোগাভ্যাস, তা নিয়ে আশ্রমিকদের, পরিচালকদের আর দিলীপকুমারের মধ্যে মতানৈক্য তাতে ইন্ধন জোগালো। এখন থেকে দিলীপকুমার আমাদের সাধারণ মানুষদের নাগালের বাইরে চলে গেলেন, যদিও রবীন্দ্রনাথ, রোলাঁ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ পরিচিত গুণীজনদের সঙ্গে চিঠির আদানপ্রদান বন্ধ হয়নি। লেখালেখিও চলেছে। পরে তাঁর পত্রাবলী থেকে জানি (শ্রীঅরবিন্দের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে দিলীপকুমারের প্রায় চারহাজার পত্রবিনিময় হয়) থেকে থেকেই তাঁর মন হয়ে উঠতো অত্যন্ত অশান্ত , শ্রীঅরবিন্দ অহরহ যুক্তি, বাণী, উপদেশের প্রলেপ দিয়ে তাঁকে শান্ত করতেন। দিলীপকুমার ছিলেন প্রাণোচ্ছল পুরুষ, তাঁর মন সৃজনশীল শিল্পীর মন, তাঁর পক্ষে যোগসাধনার কৃচ্ছ্রতা বরণ করা ছিলো অতি কষ্টকর। শ্রীঅরবিন্দও দিলীপকুমারকে উপদেশ দিয়েছেন যোগাভ্যাস ছেড়ে সঙ্গীতেই আত্মনিয়োগ করতে। দিলীপকুমার শোনেননি। 

১৯৩৭ সাল থেকে দিলীপকুমার আবার কলকাতায় আসতে শুরু করলেন, প্রথমে মাঝে মাঝে কয়েক সপ্তাহের জন্য, পরে থাকতেন আরো বেশী সময়। গানের কলকাতা তাঁকে তো লুফে নিলো, তিনিও খুলে দিলেন তাঁর এতোদিনের চাপা পড়া গানের ঝরণা। বরাতক্রমে খোঁজ পেলেন আর এক অনন্য প্রতিভাধর শিল্পীর, নাম উমা বসু, ডাকনাম হাসি, যিনি দিলীপকুমারের সৃষ্ট অসাধারণ সব সুর কণ্ঠে নিয়ে রূপ দিতে পারলেন। সঙ্গীতের তত্ত্ব নিয়ে তিনি এতোদিন যে থিওরি খাড়া করেছিলেন, তিনি হাতেনাতে উদাহরণ দেখিয়ে অবাধ প্রয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে লাগলেন। তখন বেশীর ভাগ গানই ভক্তিমূলক কিন্তু "বুলবুল মন"-এর মতো গজলও আছে। সারা ভারত ঘুরে উমার গান শুনিয়ে এলেন, নিজের, উমার আর দ্বৈত কণ্ঠের অগুণতি রেকর্ড বার হলো। অরবিন্দ-আশ্রমের হিতার্থে জলসা করে হাজার হাজার টাকা তুললেন, নিজে ছেঁড়া কাপড় রিপু করে পরে। ভক্তি আর সঙ্গীত মিশিয়ে উমা মারফৎ তাঁর মধ্যের স্রষ্টাকে মুক্তি দিতে পেরে তাঁর মনের উত্তাল দ্বন্দ্ব কিছুটা প্রশমিত হয়েছে মনে হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বানে সঙ্গীতশাস্ত্র নিয়ে দুটো বইও লিখে ফেললেন।

১৯৪২ সালে উমা অকালে মারা গেলেন। দিলীপকুমারের অধ্যাত্মচিন্তার ক্ষেত্র আবার উত্তাল হয়ে উঠলো। এটা বোধহয় সমাপতন -- বা নাও হতে পারে। দিলীপকুমার আবাল্য কৃষ্ণভক্ত ছিলেন, এবার তিনি অরবিন্দ-আশ্রমেও কৃষ্ণপূজায় মেতে উঠলেন। শ্রীঅরবিন্দ তাতে আপত্তি করেননি, -- অনেকে বলেন দিলীপকুমারের প্রতি তাঁর সন্তানবৎ পক্ষপাতিত্ব ছিলো --কিন্তু এই পূজাটা গুরু শ্রীঅরবিন্দকে তাঁরই আশ্রমে ছাড়িয়ে যাবে, এটাতে দিলীপকুমারের সহসাধকদের বিশেষ আপত্তি দেখা গেলো। বহুদিন একসঙ্গে কাটিয়েছেন যাঁদের সঙ্গে তাঁদের এমন ব্যবহারে দিলীপকুমার বিশেষ ব্যথিত হলেন, অরবিন্দ-আশ্রমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরলো। তিনি পণ্ডিচেরী যাওয়া কমিয়ে দিলেন, শ্রীঅরবিন্দ না থাকলে হয়তো যাওয়া বন্ধই করে দিতেন একেবারে। এদিকে ১৯৪৭ সালে কলকাতায় তাঁর পঞ্চাশতম জন্মতিথির সংবর্ধনা-উৎসব হলো। সেখানে পেলেন পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্মানদক্ষিণা, নির্দ্বিধায় তার সবটাই আশ্রমকে দান করে দিলেন।

দিলীপ কুমার রায় ও ইন্দিরা দেবী

কিছুদিন পরে জনককুমারী নামের এক মহিলার সঙ্গে পরিচিত হবার পর তাঁরই আগ্রহে দিলীপকুমার তাঁকে অরবিন্দ-আশ্রমের বিশেষ যোগপ্রণালীতে দীক্ষা দেন, দীক্ষান্তে তাঁর নাম হয় ইন্দিরা দেবী। ইন্দিরা দেবীর কিছু বিভূতি ছিলো বলে শোনা যায়, যার একটি হলো তিনি সমাধিস্থ অবস্থায় ভজন রচনা করতে পারতেন যেগুলো রূপে আর ভাষায় হুবহু মীরা ভজনের অনুসারী, এবং তাঁর মতে মীরাবাঈয়ের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ পাওয়া। বলাই বাহুল্য যে এই সব গীত তখন দিলীপকুমারের যা প্রয়োজন -- তাঁর সঙ্গীতের উচ্ছ্বসিত উৎসের উপযুক্ত কৃষ্ণকেন্দ্রিক আধার -- তার সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলে গেল। দিলীপকুমারের বাকী জীবন কাটে কন্যাস্থানীয়া শিষ্যা এই ইন্দিরা দেবীর নিকট সংস্পর্শে তাঁর শ্রদ্ধা ও সেবা ভিত্তি করে। 

শ্রীঅরবিন্দ দেহ রক্ষা করলেন ১৯৫০ সালের শেষদিকে, ভরকেন্দ্র হারিয়ে দিলীপকুমারের পৃথিবী কক্ষচ্যুতির পথে, দিলীপকুমার আত্মঘাতী হবার চেষ্টা করলেন। পণ্ডিচেরী আশ্রমের মাদার তাঁর শোকে সান্ত্বনা আর দুঃখে মনোবল দিলেন, তার সঙ্গে তাঁর নিজের ঈশ্বরচিন্তা যোগ হলো, দিলীপকুমার আবার গানের জগতে ফিরতে লাগলেন। ১৯৫২ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণের ভিত্তিতে তিনি আর ইন্দিরা বিশ্ব পরিক্রমা করে এলেন ভারত সরকারের আনুকূল্যে, জাপান থেকে শুরু করে আমেরিকা, ইউরোপ হয়ে মিশর পর্যন্ত। দিলীপকুমারের গানের সঙ্গে ইন্দিরা নাচলেন, দিলীপকুমার প্রচার করলেন শ্রীঅরবিন্দের বাণী। তাঁর আগের সব ভ্রমণের মতো এবারেও বহু মনীষীসঙ্গ করলেন -- বার্ট্রান্ড রাসেল, অল্ডাস হাক্সলি আদি আরো অনেক। যেমনটি আশা করা যায়, প্রশংসা পেলেন প্রভূত, মনীষীদের সঙ্গে অনেক তত্ত্ববিনিময় হলো, তা লিপিবদ্ধ করলেন। পণ্ডিচেরীতে ফিরে গেলেন, কিন্তু শ্রীঅরবিন্দের অনুপস্থিতিতে তিনি সেখানে আর থাকতে পারলেন না, ১৯৫৩ সালে পণ্ডিচেরী ছাড়লেন, মোটামুটি অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে। ঠিক কেন তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই, সে সব আর প্রাসঙ্গিকও নয় তবে এটা লক্ষ্যণীয় যে পণ্ডিচেরীতে দিলীপকুমারের কুটির ১৯৭০ সাল অবধি খালি রাখা হয়েছিলো তিনি যদি ফিরে আসেন, সেই আশায়।

সাধক দিলীপ কুমার রায়

চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও দিলীপকুমারের সাধনা রইলো অব্যাহত। তাঁর গান হলো আরো ভক্তিমূলক, তার অনেকই ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে পাওয়া "মীরাভজন"। হাতের কাছে ঠিক তথ্য পাচ্ছি না কিন্তু এটা জানি যে তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে আসছে, ষাটের দশক থেকে একবারেই বন্ধ হয়ে যায় বোধহয়। শিষ্য আর ভক্তদের সহায়তায় ১৯৫৯ সাল পুণেতে হরিকৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করলেন। মন্দির তো শুধু স্থাপন করলেই হবে না, সেটি চালাতে হবে, অতএব তার পরের কয়েক বছর তাতেই গেলো। ষাট আর সত্তরের দশকে দিলীপকুমার গান ছাড়েননি, তাঁর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে অন্যভাবে মনোহর কিন্তু তিনি গাইলেন প্রার্থনা সভায় বা ঘরোয়া ভজন-সংকীর্তন পরিবেশে, সাধারণের জন্য আর গান লিখলেন না, সুর দিলেন না, গাইলেন না। আমাদের গানের জগত থেকে দিলীপকুমার হারিয়ে গেলেন। আমার মনে হয় এই সময় থেকে তাঁর গান অন্তর্মুখী, তিনি আর বাইরের শ্রোতাদের জন্য গান করেন না, তিনি গান করেন তাঁর অন্তরের দেবতাটির জন্য। সভায় গান গেয়ে শ্রোতাদের বাহবা কুড়োবার প্রয়োজন তাঁর মিটে গেছে। লেখালেখির কাজ কিন্তু চলেছে পুরোদমে।, বক্তৃতা দিচ্ছেন, তীর্থে যাচ্ছেন, হরিকৃষ্ণ মন্দিরে দর্শনার্থী বহু গুণীজনের সৎসঙ্গ পাচ্ছেন। সরকারী আর বেসরকারী বহু প্রতিষ্ঠান দিলীপকুমারের প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সম্মান দিচ্ছে উপাধি আর পুরস্কার মারফৎ। সফলকাম বৈষ্ণব সাধকদের যে সব দিব্যপ্রাপ্তির কথা শোনা যায়, যথা শ্যামের বাঁশি শ্রবণ, রাধারানীর দর্শন ইত্যাদি, দিলীপকুমারের জীবনেও তেমন সব ঘটনা ঘটছে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে যখন পৌঁছলেন তখন তাঁর প্রিয় বন্ধুরা -- কৃষ্ণপ্রেম, ক্ষিতীশপ্রসাদ, ধূর্জটিপ্রসাদ, নিশিকান্ত, মায়া দেবী, সত্যেন বসু -- প্রায় সবাই দেহত্যাগ করেছেন। দিলীপকুমারের শরীরও আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। ১৯৭৬ সালে কলকাতায় তাঁর (এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের) আশি বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সভা হলো, সুভাষচন্দ্রের স্মৃতিসভায় তিনি সভাপতিত্ব করলেন। অবশেষে দীর্ঘ পথযাত্রার শেষে ১৯৮০ সালের ছয়ই জানুয়ারী "পূজা তাঁর [আমার] সাঙ্গ হলো।" 

মাকে হারিয়েছেন ছবছর বয়সে, পিতার অফুরান স্নেহের প্রশ্রয়ে বড়ো হয়েছেন, কিন্তু মাত্র ষোলো বছর বয়সে অনাথ। ষোলো বছর হলো সেই বয়ঃসন্ধিকাল যখন কিশোর পা রাখছে তারুণ্যের চৌকাঠে, বাইরের অজানা অচেনা বিশ্ব তার কাছে অতি ভয়াবহ, হাত ধরে তাকে অচেনা সঙ্কট ত্রাণ করাবার নির্ভর বড়ো দরকার। দিলীপকুমার তা পেলেন না। ঠিক সেই কারণেই কিনা বলতে পারি না, কিন্তু বাকি প্রায় সারাজীবনই সঙ্কটের কালে তিনি দিশাহারা হয়ে কারুর না কারুর কাছে পরামর্শ, উপদেশ, আশ্রয় খুঁজেছেন। তার অভাবও হয়নি। দিলীপকুমারের পরিচিতের বৃত্ত বিশাল, তার মধ্যে তখনকার দিনের খ্যাতনামা মানুষদের ছড়াছড়ি, তিনি সবাকার আদরের, সবাকার স্নেহের পাত্র। তাঁর এই ক্ষমতা ছিলো, প্রাণোচ্ছলতা, শিশুসুলভ সারল্য, বুদ্ধির দীপ্তি আর অবশ্যই কিন্নরকণ্ঠ দিয়ে তিনি মানুষের মন জয় করতে পারতেন। তাঁরা দিলীপকুমারকে সাহায্য করতে এগিয়েও এসেছেন। মানুষজন নিয়ে লেখা তাঁর প্রায় সব রচনাতে দিলীপকুমার অকপটভাবে তাঁর সর্বদার সঙ্গী সঙ্কট আর তার থেকে উদ্ধারের কথা লিখে গেছেন। তাঁদের কয়েকজন হলেন: কৈশোরে তাঁর পিসতুতো ভাই নট নির্মলেন্দু লাহিড়ী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র, ফরাসী সাহিত্যিক রোমাঁ রোলাঁ, এবং তাঁর জীবনের উজ্জ্বলতম উপস্থিতি শ্রীঅরবিন্দ। এছাড়া আলাপীরা অসংখ্য এবং তাঁদের থেকে দিলীপকুমার যে অনেকভাবে অনেক কিছু পেয়েছেন তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। 

কিন্তু তাঁর এই মানসিক দ্বন্দ্ব আর সঙ্কট থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি পেলেও তারা যে মিটে গেছে তা কখনোই বলা যায় না। যে সমস্যাগুলো ঘুরে ঘুরে এসেছে তা হলো সংসারের কাজের আহ্বান, ভগবৎপ্রেম আর সাধনা আর অবশ্যই সঙ্গীত -- এই তিন আপাতবিরোধী কোন বৃত্তিটির দাবীতে তিনি সাড়া দেবেন? লক্ষ্যণীয় যে তাঁর কাছের লোকেরা, যথা সুভাষচন্দ্র ও সমবয়সী বন্ধুরা, রবীন্দ্রনাথ এমনকি শ্রীঅরবিন্দ পর্যন্ত সবাই বারবার দিলীপকুমারকে ওই সঙ্গীতের পথেই নিয়োজিতপ্রাণ হবার উপদেশ দিয়েছেন। দিলীপকুমার শুনেছেন আবার শোনেননি, ঘুরে ফিরে আবার সেই গোলকধাঁধায় ঢুকে পথ হারিয়েছেন।

দিলীপকুমার ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাধর লোক, বিজ্ঞান আর গণিতের মতো সুশৃঙ্খল বিষয়ে তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, সফল হবেন এই বিশ্বাসে স্থির হয়ে তিনি বিলেতে ব্যারিস্টারী আর অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে গিয়েছেন, বিনা আয়াসে ফরাসী ভাষা শিখেছেন, দেশেবিদেশে ধর্ম-দর্শন-সঙ্গীতের ওপর বক্তৃতায় প্রকাশ পেয়েছে লক্ষ্যণীয় বাগ্মিতা, আবার সঙ্গীত, সাহিত্য আদি শিল্পসৃষ্টির কাজেও তিনি আছেন প্রথম শ্রেণীতে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তিনি ছিলেন সেইসময়ের বাঙালী সমাজের একটা বিশেষ অংশের প্রতিচ্ছবি -- সাহিত্যে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে উদ্ভাবন আর অফুরান প্রাণশক্তিতে যে বাঙালীরা সারা ভারতকে অনুপ্রাণিত করছে তাদের ছবি। তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভা চাইতো স্বতঃস্ফূর্ত উৎসরণের সুযোগ, তিনি আসলে ছিলেন নরম মনের সৃজনশীল মানুষ। তাঁর জটিল অধ্যাত্মচিন্তা বারবার তাঁর প্রতিভাকে সহজভাবে উৎসারিত হবার পথে বাধা দিয়েছে। তাঁর মতো মানুষকে শ্রীঅরবিন্দ কর্মযোগী করতে চেয়েছেন। তাঁর যৌবন যখন পূর্ণ আর সৃষ্টিশীলতা তুঙ্গে, তখন প্রায় দুদশক ধরে বাঁধা পড়েছেন নানান ধর্মীয় আচার আর অনুশাসনের গণ্ডীতে। পাথরচাপা অঙ্কুরের মতো তাঁর প্রকাশ হয়েছে খর্ব। যতোদিনে সে বন্ধন থেকে মুক্তি পেলেন ততোদিনে তাঁর সতেজ আর তীক্ষ্ণ সৃজনশীলতার ধার গেছে পড়ে, তিনি আধ্যাত্মিক আর ভক্তিযোগের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছেন, বাঙালী সঙ্গীতপ্রেমী আর বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের তিনি আর আকর্ষণ করছেন না। তিনি যে একটা ফাঁক রেখে যাচ্ছেন, সে অনুভূতিটাও আমাদের আস্তে আস্তে একদিন ক্ষীণ হয়ে গেলো।

না হলেই ভালো হতো কিন্তু। তিনি যা দিয়েছেন তার থেকে তিনি আরো কী দিতে পারতেন সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়, এবং তা আপসোস করার মতো। একদিক থেকে বলা যায়  মৃগকে তাড়িয়ে বেড়ায় কস্তুরী,  সেটা যেমন অভিশাপ, মানুষের বন্ধনহীন প্রতিভা, সেটাও তেমনি অভিশাপ। অবশ্য এও বলা যায় যে "অশান্তি যে আঘাত করে, তাই তো বীণা বাজে", কাজেই যা আমরা পেলাম তা দিলীপকুমার এই অশান্তির আঘাত পেয়েছিলেন বলেই পেলাম।

আর মিষ্টান্নে কম পড়লে আমার মতো ইতরজন কিছু কাঁদুনি গাইবেই, সেটাও প্রবাদ কথা! 

দিলীপ কুমার রায় ও ইন্দিরা দেবী

সংযোজন: এ লেখাটা শেষ করার পর একদিন লীলা মজুমদারের আত্মজীবনী "পাকদণ্ডী"-র [আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৬] পাতা ওল্‌টাতে ওল্‌টাতে আবার হঠাৎ দিলীপকুমারের দেখা পেয়ে গেলাম। দিলীপকুমার ছিলেন লীলার স্বামীর আত্মীয়, সম্পর্কে দূর হলেও পরিচয়ে নিবিড় --- অন্তত কৈশোরে আর যৌবনে। দিলীপকুমারকে লীলা খুব ভালো চিনতেন, লীলার কথায়, "আমি দিলীপকে মহাপুরুষ বলি।" কেন বলেছেন তার যুক্তিও দিয়েছেন। সেই লেখার মধ্যে দিলীপকুমারের চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্যের কথা নজরে পড়লো। লিখছেন, "মনের মধ্যে দিলীপের কেমন একটা ঔদাসীন্য ছিল। ব্যক্তিগত বন্ধন তিনি স্বীকার করতেন না।" তার একটা প্রকাশ ছিল আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শালীন ব্যবহার করলেও ব্যক্তিগত টান দেখাতেন না, তাতে মানুষে মনে কষ্ট পেতেন। আর একটি হলো, "ভারী গুণগ্রাহী ছিলেন দিলীপ। গুণ দেখলেই ... মাথায় তুলে নাচতেন। তারপর আরো গুণ না পেলে দুম করে মাথা থেকে ফেলে দিতেন।" দিলীপকুমারের জীবনী খুঁটিয়ে পড়লে এসবের নজির আবিষ্কার করা যায়। আমার মনে হয় তাঁর জীবনে অন্য অনেক কিছুর মতো সম্পর্কের ব্যাপারেও দায়বদ্ধতা গ্রহণ করতে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন, অপারগতা তর্কসাপেক্ষ।   তবে জীবনের শেষার্ধে ইন্দিরা দেবী তাঁর এই ঔদাসীন্য কিছুটা ভাঙতে পেরেছিলেন, এ নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। 

ছবিগুলির জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার - হরিকৃষ্ণ মন্দিরের কর্তৃপক্ষ


লেখক পরিচিতি - পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।