ঐশ্বরিক’ ক্রীড়া- প্রাঙ্গণ – আমাদের ইডেন
সঞ্জয় সেনগুপ্ত
মুখবন্ধ:
কনকনে শীতের কুয়াশা-ভরা সকাল। কোনো মন্ত্রবলে ইডেন উদ্যানের গ্যালারি উৎসাহী ক্রিকেটপ্রেমীদের ভিড়ে ঠাসা। টস্ থেকে উত্তেজনা শুরু। ব্লেজার পরা থাকবেই দুই অধিনায়কের গায়ে, এই মুদ্রা উৎক্ষেপণের সময়। গ্যালারি জুড়ে বিজ্ঞাপনের ছটা লাগা রোদ সামলানো কাগজের শেড, টুপি-চুইংগাম সব মিলিয়ে যেন সাজো সাজো রব। কে যে বেশী উত্তেজিত – মাঠের খেলোয়াড় না গ্যালারির দর্শক – বিচার করা দুঃসাধ্য। লাঞ্চ-টি-তে সবাই ব্যস্ত পাঁউরুটি-ডিম-কলা-কমলালেবু-কেকের সদ্ব্যবহারে। খেলা চলছে যখন, নির্দিষ্ট কারণে উল্লাস ও হতাশার দুই বিপরীতমুখী সমবেত ধ্বনি বা হাততালি। এসবই ইডেন গার্ডেনসে টেস্ট-ক্রিকেটের স্মৃতি। যদিও এসব বেশ কিছু বছর আগেকার অভিজ্ঞতা।
অনেকের মতে ইদানীংকালে ইডেন তার মেজাজ-পরিবেশ-খাদ্য উপকরণ-আচার আচরণ ইত্যাদি আরো অনেক কিছুতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে। একে বয়স্করা প্রায়শই বলে থাকেন, ‘ক্রিকেট-ঐতিহ্যে’র বিরোধী । তাই কি? কিন্তু সেটা বুঝতে গেলে আমাদের তো একটু সুলুক সন্ধান করে দেখতে হবে ইডেনের ‘ক্রিকেট-ঐতিহ্য’র।
স্থাপনা:
তখনকার দিনের কাগজ পড়ে জানা যায়, ১৮০৪ সালে ইডেন গার্ডেনসে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব, ওল্ড ইটোনিয়ান্স আর রেস্ট অফ ক্যালকাটার মধ্যে এক খেলার ব্যবস্থা করেছিল। ১৮৬৪ সালে এমিলি ইডেন পরিকল্পনামাফিক ইডেন গার্ডেনসের সংস্কার করেন। তার বেশ কিছু বছর আগে ক্রিকেটের ছোঁয়া কলকাতার বুকে এসে লেগেছিল । ‘ম্যাড্রাস ক্যুরিয়ার’–এর ১৭৯২ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারির রিপোর্টে কলকাতায় হওয়া ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে ব্যারাকপুর-দমদম দলের ম্যাচের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৭৮০ সালের ‘হিকি’-র বেঙ্গল গেজেটে (৪৮ তম সংখ্যা, ১৬-২৩ ডিসেম্বর ) কলকাতায় অবস্থিত বিভিন্ন ক্রিকেট ক্লাবের উল্লেখ আছে। এঁরা নিয়মিত ইডেন উদ্যানে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলতেন।
এমিলি ইডেন |
Wisden Cricketers’ Almanack অনুযায়ী ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের (সি সি সি)র জন্ম হয়েছিল ১৭৯২ সালে। এমিলি ইডেনের চিঠিপত্র সংক্রান্ত নথি থেকে এ তথ্য উদ্ধার হয়েছে যে কলকাতায় প্রথম বড় ক্রিকেট ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় ২৩শে মার্চ ১৮৩৬–এ। ১৮৬৪ সালের এপ্রিলে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব দ্বারা পরিচালিত খেলাগুলি হয় ইডেন উদ্যানে। ইডেনের মালিকানা নিয়ে বিস্তর মতান্তর রয়েছে। শোনা যায় এ জমির মালিক ছিলেন রায়চৌধুরী বংশের জমিদাররা। পরে তা শেঠ ও বসাকদের হাত ঘুরে চলে যায় রাণী রাসমণির বংশধরদের জিম্মায়। কুচবিহারের মহারাজা পরে এটি অধিগ্রহণ করেন। কালের স্রোতে জমির মালিক হন গভর্নর জেনারেল, লর্ড অকল্যান্ডের পরিবার।
ইডেনের জন্মলগ্নেই তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুই মহিলা, তাঁরা অকল্যান্ড সাহেবের দুই বোন - এমিলি ও ফ্যানি ইডেন। ১৮৪০ সালে এর নাম রাখা হয় অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেনস। ইডেন গার্ডেনস নামটি প্রস্তাবিত হয় ১৮৫৪ তে। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিশেষ অনুরোধে মাঠের সীমানাগুলিকে বিস্তৃত আকার দেওয়া হয়েছিল ঐ বছরই। পাকাপাকি ভাবে প্যাভিলিয়ন গড়ে তোলার প্রস্তাবটি সরকারের কাছে পেশ করা হয় ১৮ই এপ্রিল ১৮৬৮ তে। কাজ শুরু হল তিন বছর পর ঐ এপ্রিল মাসেই।
খেলা শুরু:
তখনকার ইডেন |
ইডেনে প্রথম টেস্ট খেলা হয় ১৯৩৪-এর ৫ই জানুয়ারি ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে। এটি ছিল ঐ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ। প্রথম খেলাটি হয়েছিল বোম্বাই জিমখানা মাঠে। কিন্তু তারপর ওখানে একটিও টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়নি বলে ইডেন গার্ডেনসই বর্তমানে এদেশের সব থেকে পুরানো টেস্ট সেন্টার। তখনকার ইডেনের চেহারা এখনকার থেকে একেবারে অন্যরকম ছিল। গোড়ার দিকে মাঠে কোনো স্থায়ী গ্যালারি ছিল না। বাউন্ডারি সীমানার কিছু দূরে মাঠের সব দিকেই বড় বড় গাছ দেখা যেত। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অবশ্য কলকাতার ইডেনই প্রথম ‘ইডেন’ নয়। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড শহরের ক্রিকেট মাঠটির নামও ইডেন পার্ক, আর সেখানে প্রথম টেস্ট খেলা হয় ১৯৩০-এর ফেব্রুয়ারিতে। বোঝাই যাচ্ছে, ‘অকল্যান্ড’ পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ‘ইডেন’ নামটি।
আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে প্রথম এম সি সি দল যখন এদেশে আসে, অল ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে তাদের খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় আমাদের ইডেন গার্ডেনসেই, ১৯২৬-২৭ সালের মরসুমে। এম সি সি দলের অধিনায়ক ছিলেন আর্থার গিলিগান। সরকারী টেস্টগুলি ছাড়া ১৯৩৫ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে ইডেনে কমনওয়েলথ এবং অন্যান্য দলের সঙ্গে ছয়টি বেসরকারি টেস্ট ম্যাচও খেলা হয়েছে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পথে অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দল ভারতে খেলে যায়। কলকাতায় হয় দ্বিতীয় বেসরকারি টেস্ট। মুস্তাক আলিকে ভারতীয় একাদশে না নেওয়ার ফলে কলকাতার ক্রিকেট অনুরাগী যুবকরা প্রতিবাদ করে। তারা ‘নো মুস্তাক, নো টেস্ট’ বলে এমন অভিযান চালায় যে, নির্বাচকেরা মত বদলে মুস্তাককে দলভুক্ত করেন। আসলে মুস্তাক ছিলেন কলকাতার মানুষের খুব প্রিয়, তাঁর টেস্ট খেলার শুরু কলকাতাতেই, ১৯৩৪ সালে। শিল্পপ্রাণ কলকাতার দর্শক ছিলেন তাঁর ব্যাটিং সৌন্দর্যের গভীর অনুরাগী।
ইডেন গার্ডেনস বললেই সকলেরই মনে বাসা বাঁধে ক্রিকেটের কথা এবং অন্যান্য কিছু খেলা সংক্রান্ত বিষয়। কিন্তু, এই উদ্যান আরো কিছু অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী।
১৯৩০-৩১-এ কলকাতায় ভিজিয়ানাগ্রাম একাদশ-এর হয়ে খেলতে এসেছিলেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান স্যার জ্যাক হবস্। খেলা হয়েছিল গভর্নর একাদশ-এর বিরুদ্ধে। সেবারই জানুয়ারি (১৯৩১) মাসের একটি দিনে তৎকালীন ১ নাম্বার গারস্টিন প্লেস-এ অবস্থিত কলকাতা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন হবস্। ধরেই নেওয়া যায়, তা ছিল ক্রিকেট সংক্রান্ত, যার মধ্যে কিছুটা ইডেনও হয়তো থাকতে পারে। ১৯২৯ সালের লাহোর কংগ্রেসে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারি দিনটি স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পরাধীন ভারতে পালিত হতো। ১৯৪৬-এর ২৬ জানুয়ারি ইডেনে খেলা ছিল লিন্ডসে হ্যাসেটের নেতৃত্বে আসা অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দলের সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বেসরকারি টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিন। খেলা শুরুর আগে কংগ্রেস-এর পতাকাসহ কয়েকজন লোক নিয়ে মাঠে বিক্ষোভ দেখাতে ঢুকে পড়েন মোহনবাগানের তৎকালীন ফুটবলার সেন্টার হাফ, অনিল দে। তাঁর দাবী ২৬ জানুয়ারির (তখন স্বাধীনতা দিবস) মতো পবিত্র দিনে বিদেশীদের সঙ্গে খেলা চলবে না। অবশেষে, তাঁকে দলবল সহ মাঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ছোট হলেও ঘটনাটির ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।
তিন দিক ঘেরা ফুটবল মাঠের কাঠের গ্যালারির মালিক ছিল সাহেবি হেডওয়ার্ড কোম্পানি। ইডেনে তখন বসার জায়গা সেভাবে কোথায়? এই কোম্পানি তাই টেস্ট ম্যাচ শুরুর আগে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল–মহামেডান মাঠ থেকে গ্যালারি খুলে নিয়ে গিয়ে বসাতো ইডেনে। ফলে তিন দিক ঘেরা মাঠ হয়ে যেতো খোলামেলা। ফেব্রুয়ারির প্রায় শেষের দিক পর্যন্ত এরকম অবস্থা থাকার কারণে, হকি লীগের অনেকটাই হতো খোলা মাঠে। আবার ইডেন থেকে গ্যালারি চলে আসতো যথাস্থানে। ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এরকম চলছিল। পরে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায়।
বিচিত্র ইডেনের অন্য রূপ:
শুধু খেলা কেন, ইডেন গার্ডেনস-এ সেই ৫০ দশক থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত বার কয়েক হয়েছে যুব উৎসব। বামপন্থী আদর্শে ব্রতী মানুষজন ছিলেন এর উদ্যোক্তা। চলচ্চিত্র-নাটক-গান-নাচ-আবৃত্তি ইত্যাদি আরো নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভরপুর থাকতো ইডেনে যুব উৎসব। গ্যালারির দিকে মুখ করে মাঠের ধারে ধারে মঞ্চ ও পর্দাগুলি থাকতো। গ্যালারিতে বসতেন দর্শক শ্রোতারা। বিভিন্ন প্রখ্যাত ব্যাক্তির নামাঙ্কিত এক একটি মঞ্চে সারা মাঠ জুড়ে হয়ে চলতো নানা বর্ণের অনুষ্ঠান। সেরা শিল্পীদের সমাবেশ ঘটতো এই উৎসবে। এছাড়া চিত্রতারকা ও সঙ্গীতশিল্পীরা কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার ক্রিকেট খেলেছিলেন ইডেন গার্ডেনসে। একবার হয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একাদশ বনাম কানন দেবী একাদশ-এর ক্রিকেট ম্যাচ। শুধু বাংলা নয়, হিন্দি ছবির জগতেরও অনেক তারকা ক্রিকেট খেলে গেছেন এই ইডেনে। বন্যাকবলিত অসহায় বিপন্ন মানুষের সাহায্যের জন্য বম্বে, কলকাতা, মাদ্রাজের চিত্রতারকাদের নিয়ে একটি প্রদর্শনী ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল এই মাঠে। প্রধানত উত্তমকুমারের উদ্যোগেই আয়োজিত হয়েছিল ঐ আকর্ষণীয় খেলা। অসুস্থ শরীর নিয়ে সেসময় বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মহানায়ক।
ইডেনে মহানায়ক |
১৯২৩ সালে ইডেন গার্ডেনসে হয়েছিল এক বিরাট প্রদর্শনী- ‘ক্যালকাটা এক্সজিবিশন’। এই প্রদর্শনীতে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি এক তরুণ সম্প্রদায়কে নিয়ে অভিনয় করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’ নাটক। দলে ছিলেন ললিতমোহন লাহিড়ী, যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, রবি রায়, জীবন গাঙ্গুলি প্রমুখ তরুণ অভিনেতারা। প্রযোজনাটি এত প্রশংসিত হয়েছিল যে, প্রদর্শনীর প্রত্যেক দিন নাটকটিকে মঞ্চস্থ করতে বাধ্য হয়েছিলেন শিশিরকুমার। এর আগে বেশ কয়েকবার শৌখিন থিয়েটারে অভিনয় করেছিলেন নাট্যাচার্য। তখন তিনি মেট্রোপলিটান কলেজের (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) ইংরেজির অধ্যাপক। মাঝে বেশ কিছু দিন থিয়েটার থেকে তিনি সরে গিয়েছিলেন। বহুদিন বাদে ইডেন গার্ডেনসের নাট্যমঞ্চে তাঁর নতুন করে আত্মপ্রকাশ ঘটলো এবং চূড়ান্ত সাফল্য পেলেন তিনি। এই সাফল্যের কারণেই নাট্যাচার্য শিশিরকুমার পাকাপাকি ভাবে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ কথা বলা যায়, নাট্যজগতে ‘শিশির–যুগ’ এর সূচনা হয়েছিল এই ইডেন গার্ডেনসে ‘সীতা’ নাটকের মাধ্যমে।
কান দিয়ে যায় শোনা:
আচ্ছা, ‘সুনন্দ’-র ‘দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই ‘ভজুদা’ কে মনে পড়ে? সেই যিনি উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত ম্যালেরিয়ায় ভুগতেন আর নিয়মিত পাইরেক্স ডি.গুপ্ত সেবন করতেন? এক সময় ক্রিকেটে তাঁর তীব্র অনীহা ছিল। ভজু বউদির সংস্পর্শে এসে ও বেতারে ধারাভাষ্য শ্রবণ করে তিনিও হয়ে ওঠেন এক উৎকৃষ্ট ক্রিকেটপ্রেমী। টেস্ট খেলার ধারাভাষ্য যে একটা শিল্প সেটাও তুলে ধরেছিলেন যুগান্তকারী ধারাভাষ্যকারেরা। সুনন্দ’র ভাষায় – “পর পর মেডেন ওভারের যে জঘন্য খেলা মাথা ধরিয়ে দেয়, বেতারের মাধ্যমে তাতে তাঁরা নরহত্যার শিহরণ জাগাতে পারেন”।
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বাংলা ধারাভাষ্য চালু করার নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন সিনিয়র প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ, সন্তোষবিকাশ বড়ুয়া। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে প্রথম বাংলা ধারাবিবরণী দেবার চেষ্টা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন প্রথম ধারাভাষ্যকার। শুরুতে তিনি গররাজি ছিলেন। পরে সহকর্মী সংগীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়ালের অনুরোধে রাজি হন।
শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর, ম্যাচের বিশ্লেষণ ও ভাষাজ্ঞানের পাশাপাশি খেলার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধারাভাষ্য দিতেন কিংবদন্তি ভাষ্যকার অজয় বসু। ১৯৬১-৬২-এ ভারত বনাম ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিন। দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রুত রান তুলছে ভারতীয় দল। উইকেটে তখন চাঁদু বোরদে ও রমাকান্ত দেশাই। দেশাইয়ের মারমুখী ব্যাটিংয়ের সামনে দিশেহারা ইংল্যান্ডের বোলাররা। একটা বল দেশাই ওভার বাউন্ডারিতে সীমানার বাইরে পাঠালেন। দেশাইয়ের মারের সঙ্গে সঙ্গে বলের গতিপথকে নিখুঁত ভাবে শ্রোতাদের কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন এইভাবে ‘বল চলেছে সীমানার দিকে উঁচু হয়ে, আরও জোরে ওভার বাউন্ডারি’। ধারাভাষ্যে সাহিত্য তাঁর সৃষ্টি। এখানে তাঁর একচেটিয়া আধিপত্য।
তিন বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার |
একটি বর্ণনা বা বিশ্লেষণ শ্রোতাদের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে কত আনন্দ দিতে পারে তার ভুরিভুরি নিদর্শন রেখে গেছেন অজয়বাবু। ১৯৬৪–তে ভারত – ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ দিন। উইকেটে তখন দাপটের সঙ্গে ব্যাট করছেন জয়সীমা। টিটমাস, প্রাইস, লার্টার, উইলসনদের বেধড়ক পেটাচ্ছেন। ৯১ রানের মাথায় উইলসনের বল ওভার বাউন্ডারিতে যখন সীমানার বাইরে পাঠালেন তখন অজয় বললেন, ‘কাল শুনেছিলাম ইডেনের গ্যালারিতে কোথায় যেন আগুন ধরেছিল। আজও ইডেনে আগুন লেগেছে। তবে গ্যালারিতে নয়, আজকের আগুন জয়সীমার ব্যাটে’। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ইডেনে তখন মাথার ওপর চটের ছাউনি দেওয়া হত। সেখানেই তৃতীয় দিন আগুন লেগেছিল। ১৯৭০–এর শিল্ড ফাইনালে ইরানের প্যাজ ক্লাবকে ইস্টবেঙ্গল হারাবার পর যখন গ্যালারিতে হাতেহাতে মশাল জ্বলেছিল তখন সেই দৃশ্যের বিবরণ শ্রোতাদের কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন এইভাবে –
ইডেন উদ্যানের সৌন্দর্যে অভিভূত অজয়বাবু একাধিকবার তাঁর ধারাভাষ্যে বর্ণনা দিয়েছেন। তাই ইডেনে যে কোনো বিশেষ মুহূর্তই তাঁর কন্ঠে বিশেষ মর্যাদা পেত। খেলার বিবরণের মাঝে থাকতো রূপসী ইডেনের আরও অনেক তথ্য। ১৯৬৭-তে যখন লিগে মোহনবাগান বনাম মহমেডান ম্যাচ দিয়ে প্রথম ফুটবল শুরু হল ইডেনে, সেদিনও তিনি শুরু করলেন এই ভাবে – ‘ক্রিকেটের নন্দনকাননে আজ থেকে ফুটবলের পদধ্বনি’।
মনে আছে, ইডেনে কোনো ক্রিকেট টেস্ট হলে আমরা বাংলায় ধারাবিবরণী শুনতে ভুল করতাম না। ধারাভাষ্যের মেজাজটাই অন্যরকম ছিল । বিশেষ করে কমেন্টারি বক্সে যদি কমল ভট্টাচার্য থাকতেন। খ্যাতনামা চিত্রাভিনেতা পাহাড়ী সান্যাল একদিন কমলবাবুকে বলেই ফেললেন – ‘মাঠে যাওয়া হবে না। তুই-ই ভরসা। ভালো করে বলিস’। কমলবাবুর ধারাভাষ্যের কয়েকটি মুহূর্ত কানে বাজে। রেডিওতে শুনে ইডেন উদ্যানে শিল্ড ফাইনালে গোলের সেই মুহূর্ত আজও দেখতে পাই। হাবিব তখন সবে মাঠ ছেড়ে গেছেন, নতুন এসেছেন পরিমল দে। মজার ব্যাপার হল, পরিমলের আদৌ খেলার কথা ছিল না, তিনি গ্যালারীতে বসে খেলা দেখছিলেন। হঠাৎ হাবিব আহত হয়ে মাঠ ছাড়তেই তাঁর ডাক পড়ে। কোনক্রমে তাড়াহুড়ো করে মাঠে নেমেই তিনি হয়ে যান নায়ক। তখন মাইক ছিল কমলদার হাতে। ধারাভাষ্যটা অনেকটা এরকম ছিল – ‘নঈম সামনের দিকে বল বাড়িয়েছে স্বপনকে। স্বপন অসম্ভব জোরে ছুটছে। ডান দিক থেকে সেন্টার করে জংলাকে (পরিমলের ডাক নাম) দিয়েছে। গোল’। তারপর হয়তো মনে হল এত বড় একটি ম্যাচের সঙ্গে গোল বলাটা মানানসই হয়নি। তার পরেই আবার বললেন, “গো-ও-ল। ইস্টবেঙ্গলের পি দে গোল করেছে।”
যত বড় ম্যাচই হোক, তিনি বলতেন অনায়াসভঙ্গিতে। ম্যাচের গতির সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করত তাঁর গলা। তিনি পুষ্পেন সরকার। ইডেনে ম্যাচ হলেই, বলের অবস্থান, কার পায়ে বল, কাছাকাছি কে রয়েছেন – খুব দ্রুত অথচ স্পষ্টভাবে বর্ণনা দিতেন তিনি। ম্যান টু ম্যান, বল টু বল – খেলার গতির সঙ্গে তাল রেখেই ধারাভাষ্য দিতেন। ক্রিকেটে যখন ধারাভাষ্য দিয়েছেন ইডেনে, তখন যে ব্যাটসম্যান ব্যাট করছেন তিনি কিভাবে ব্যাট করলেন বা বোলার কিভাবে বল করলেন, পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করতেন পুষ্পেনদা। সামান্য সানুনাসিক ভঙ্গীতে তিনি বলতেন এইরকম – “এখন হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে বল করতে যাচ্ছেন দেশাই। তিনি দৌড় শুরু করলেন, বল ছুঁড়লেন। অফ ষ্ট্যাম্পের বাইরের বল হানিফ দেখে ছেড়ে দিলেন। এ বলেও কোনো রান হয়নি। রান যা ছিল তাই রয়েছে। দু উইকেটে ১০৪।” বলার ফাঁকে ব্যাটসম্যান এবং বোলারের পরিসংখ্যান জানাতেও ভুল করতেন না পুষ্পেনদা। এতে শ্রোতারা বিরক্ত হতেন না। আবার উত্তেজনার মুহূর্তে সেই কণ্ঠেই থাকত অন্য মেজাজ। ১৯৬২ সাল। ইডেনে চতুর্থ টেস্টের শেষ দিন, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের মুখে ভারতীয় দল। উইকেটে রয়েছেন ডেভিড স্মিথ। অন্যদিকে ব্যারি নাইট। ভারতের হয়ে বল করছিলেন সেলিম দুরানি। সেই মুহূর্তে মাইক তখন পুষ্পেনদার হাতে। অনেকের কানে হয়তো আজও বাজে – ‘সোজা ক্যাচ মঞ্জরেকারের হাতে, ভারতের দ্বিতীয় জয়’। অনেক শ্রোতাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি অন্যদের চেয়ে প্রিয় ছিলেন, কারণ তথ্যানুগত্য ও সুস্পষ্ট বাচনভঙ্গী।
ম্যাচের গতির সাথে তাল রেখে কথা বলার গতিকেও ওঠানামা করাতে পারতেন তিনি। ১৯৭৭ সালে পেলের কসমস ক্লাব খেলতে এসেছিল কলকাতায়। খেলার প্রথম দিকে বেশ কয়েক মিনিট গড়িয়ে যাওয়ার পর প্রথম বল পেয়েছিলেন পেলে। ঠিক তার আগের মুহূর্তে পুষ্পেনদা বলেছিলেন – ‘এখনও পেলে বল ধরেননি’ । তারপরই পেলের পায়ে বল পড়তেই গোটা ইডেন যখন উত্তেজনায় ফেটে পড়ল তখন তিনিও ব্যতিক্রম ছিলেন না।
ইডেনে পেলে |
বলতে দ্বিধা নেই কমলদা, পুষ্পেনদা এবং অজয়বাবুর অবর্তমানে বাংলা ধারাবিবরণীর মজাটা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সেজন্যই মানুষের অন্তরের মণিকোঠা থেকে ওঁরা হারিয়ে যাননি। তাই এখনও পড়ন্ত বেলায় মনে হয় ইডেন থেকে কমলদা বলছেন, ‘মাঠে প্রচুর দর্শক হয়েছে। যেদিকে তাকাই শুধু মাথা আর মাথা’। বা পুষ্পেনদা বলছেন, ‘গোল হল না, দুর্ভাগ্য সুরজিত সেনগুপ্ত’র, দুর্ভাগ্য ইস্টবেঙ্গলের’। ঠিক তখনই ভেসে আসে অজয়বাবুর কণ্ঠস্বর, ‘জার্নেলকে কাটিয়ে নিয়েছেন বলরাম, সামনে অসহায় সনৎ শেঠ, গো...ও...ল । গো...ও...ল।”
ইংরেজিতে ধারাভাষ্য প্রদান করে জনপ্রিয়তা লাভ করেন – বেরী সর্বাধিকারী, বার্টি মায়ার, ডিকি রত্নাগর, পিয়ার্সন সুরিটা, কিশোর ভিমানী, শিবাজী দাশগুপ্ত, অরিজিৎ সেন, রাজন বালা, বিজন বালা প্রমুখ ।
ক্রীড়া সাংবাদিকদের রোমান্স -
ইডেনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন টেস্ট প্রতিযোগিতার প্রতিদিনের খেলা সম্পর্কে মন্তব্য লিখেছেন গুণী বিশেষজ্ঞরা যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বেরি সর্বাধিকারী, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, মতি নন্দী প্রমুখ। এমনই রুদ্ধশ্বাস এঁদের বর্ণনা ও এমনই তথ্যাশ্রয়ী এঁদের বিবরণ যে, শুধু খেলা নয়, খেলার সঙ্গে সঙ্গে মাঠের গোটা পরিবেশটাই যেন আমাদের মনশ্চক্ষে ভেসে উঠত । ভারত-ইংল্যান্ড তৃতীয় টেস্ট, ১৯৬৪–এর প্রতিবেদক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার। চতুর্থ দিনের শেষে তাঁর কলম থেকে ঝরেছিল এক মনোজ্ঞ লেখা । ‘এক বনে দুই বাঘ’ শিরোনামে লেখা প্রতিবেদনে তিনি কাউড্রে ও জয়সীমার শতরানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছিলেন। কি লিখেছিলেন তিনি একবার দেখে নেওয়া যাক –
আবার ঐ টেস্ট ড্র হওয়াতে বিষণ্ণ চিত্তে লিখেছেন –
আবার খেলায় টস নিয়ে বিদ্রূপ করতে পিছপা হননি তিনি। টসকে এক বৈজ্ঞানিক খেলায় অবৈজ্ঞানিক আরম্ভ বলেছেন তিনি। লিখেছিলেন –
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত |
আর এক দিকপাল শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিভিন্ন ক্রিকেটারদের খেলার ধরন অনুধাবন করে যেভাবে তাঁর বিশ্লেষণ করেছেন, জীবন ও প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশের সঙ্গে উপমা দিয়ে তাকে বাঙ্ময় সাকার রূপ দিয়েছেন, তা যে কবিকৃতি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর ইডেনপ্রেম সংশয়াতীত – তাঁর বিরচিত “ইডেনে শীতের দুপুর” বাংলা ক্রীড়াসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ইডেনে ভালো ব্যাটিংয়ের স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে। তাঁর কলম থেকে নিঃসারিত হওয়া পংক্তিসমূহ এরূপ আকার নিয়েছিল –
ঝরঝরে ও প্রাণবন্ত ভাষায় টেস্ট ম্যাচের রিপোর্ট লিখতে ভালবাসতেন ক্রীড়া সাংবাদিক বেরি সর্বাধিকারী। ভারত-অস্ট্রেলিয়া পঞ্চম টেস্ট, ১৯৬০ এর প্রতিবেদন লিখে জনসমক্ষে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। শুরুটা অনেকটা এরকম ছিল –
ভারত-অস্ট্রেলিয়া চতুর্থ টেস্ট, ১৯৬৯-এ আনন্দবাজার – এ প্রতিবেদন লিখেছিলেন ক্রীড়া প্রেমিক ও বিশিষ্ট লেখক, মতি নন্দী। দিনলিপির শিরোনামগুলি চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে পরিবেশন করতেন নন্দী মহাশয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘ধ্বসের মুখে বাঁধ-বিশ্বনাথ’, ‘বেদি-তলে বলি বিল লরি’, ‘ওয়াল্টার্স যাই হোন ব্রাডম্যান কিছুতেই নন’। ১৯৭৪-৭৫-এ ইডেনে বিশ্বনাথের অনবদ্য ১৩৯কে শতাব্দীর সেরা এক ইনিংস বলে আখ্যা দিয়েছিলেন মতি নন্দী। প্রতিবেদনে লিখেছিলেন-
ইডেনে বিশ্বনাথ |
হাসি কান্নার রোমাঞ্চ -
১৯৩৪ সালে প্রথম যেদিন ইডেন গার্ডেনসের বুকের উপরে টেস্ট ক্রিকেটের আসর সাজানো হয়েছিল, তার পরে পুরো ৮৩ বছর অতিক্রান্ত। কলকাতা নাকি ফুটবল পাগল শহর। কিন্তু আসক্তি যে তার ক্রিকেটের প্রতি কিছু কম নয়, ১৯৬৯ সালে ইডেনের দরজায় প্রাণ দিয়ে এই শহরেরই ছয় ক্রিকেটপ্রেমী তরতাজা যুবক তার প্রমাণ রেখেছিলেন। এই টেস্টটি বাংলার মানুষের কাছে এক স্মৃতি, তাঁদের দু’ দুজন ঘরের ছেলে অম্বর রায় ও সুব্রত গুহ, এই টেস্টে অংশ নেন। অন্যদিকে, কলকাতায় খেলেছেন অথচ ইডেনের প্রেমে পাগল হননি, কোনো দেশেরই টেস্ট ক্রিকেটার সমাজে সম্ভবত এমন খেলোয়াড় একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
সানাইয়ের মিঠে সুর, সন্ধ্যায় রঙবেরঙা আলোর মালায় উদ্ভাসিত ক্লাব-ভবন, এই পরিবেশে সাজানো ইতিহাসের ক্রিকেট উদ্যান উৎসবের মেজাজে সেজে উঠেছিল ৮০-র দশকের গোড়ায়। কিসের উৎসব? দেখতে দেখতে ৫০ বছর পার হয়ে গিয়েছিল রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার। ৫০ বছর টিকে থাকা এ সংস্থার পক্ষে এক গৌরবময় অধ্যায়। এই পূর্ণ লগ্নে সিএবি বিশেষ খেলার ব্যবস্থা করেছিলেন ইডেন উদ্যানে। উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান প্রবীণদের প্রীতি সম্মেলন – ওভারসীজ একাদশ বনাম ভারতীয় একাদশ এবং অবশিষ্ট ভারত বনাম ভারতীয় একাদশ। অতীতের একাধিক খ্যাতকীর্তি খেলোয়াড়কে একই আসরে দেখতে পাওয়া নিশ্চয়ই একটা বড় আকর্ষণ ছিল। বিশেষ করে সেখানে যদি গডফ্রে ইভান্স, নীল হার্ভে, ফ্রেডি ট্রুম্যান, হানিফ মহম্মদ, ল্যান্স গিবস, মুস্তাক আলি, বিজয় হাজারের মতো প্রথিতযশা ও প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের উপস্থিতি ঘটে।
ইডেনে প্রবীণদের ৪০ ওভারের খেলায় মূল আকর্ষণ ছিল অতীতের খেলোয়াড়দের একালের দর্শকের কাছে উপস্থিত করা। ব্যাট করতে যাওয়ার পথে মুস্তাক আলির সেই রাজকীয় হাঁটা, অফ ষ্ট্যাম্পের বাইরের বলকে অন সাইডে পুল করা এবং ক্রিকেটের অন্যতম চমকপ্রদ মার লেট কাট, যা এখন ভারতীয় ক্রিকেটে প্রায় লুপ্ত – সব কিছুই মুস্তাক আলি তাঁর ছোট্ট ইনিংসের মধ্যে বেঁধে রেখেছিলেন। বাংলার প্রবীণদের কাছে ৬৫ বছর বয়সে হাজারে, অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী সুব্রত গুহ ও তপনজ্যোতি ব্যানার্জীর বলের বিরুদ্ধে অনায়াস ভঙ্গিতেই খেলেছিলেন। বর্ষীয়ান খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরায় সেকালের তরুণেরাও বিফল হননি। পাঁচ দিনের ক্রিকেটে প্রণব রায় অপরাজিত শতরান করেন। ১৯৮২-৮৩-তে ইডেন উদ্যানে রাজস্থান ক্লাব আয়োজন করেছিল এক ডবল-উইকেট ক্রিকেট প্রতিযোগিতার । দু’দিন ব্যাপী এই খেলায় জুটি বেঁধেছিলেন ভারতসহ সেইসময় বিশ্ব ক্রিকেটের দিকপালদের অনেকেই। প্রবীণ অবস্থায় জুটি হিসেবে খেলেছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স ও ওয়েসলি হল। ডেনিস লিলি ঐ একবারই ইডেনে পদার্পণ করেন। মনে পড়ে, লিলির করা গুডলেংথ থেকে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বলে জাভেদ মিয়াঁদাদের মাথায় আঘাত লাগার কথা। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন হোল্ডিং – গারনার জুটি।
১লা জানুয়ারি, ১৯৬৭ – ভয়াবহ দিন |
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৯৬৬-৬৭এ ইডেন টেস্টের দ্বিতীয় দিন। পয়লা জানুয়ারি, ১৯৬৭। খেলা আরম্ভ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে যে সব দর্শক গ্যালারিতে বসেছিলেন, তাদের মধ্যে জায়গা নিয়ে গণ্ডগোল শুরু হয়। অনেকেই বেড়া ডিঙ্গিয়ে মাঠের ভেতর বসতে চেষ্টা করেন। উত্তেজিত জনতা চতুর্দিকে ছুটে যায়। এই সময়ে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হলে কিছু মারমুখী দর্শক মাঠের ছাদে আগুন লাগিয়ে দেয়। পূর্বদিকের স্ট্যান্ডের উদ্বেল ও মুখর দর্শকদের শান্ত করতে এক ব্যক্তি মাঠে নামতেই, পুলিশ তাঁকে বেধড়ক প্রহার করে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমবেদনা রূপান্তরিত হয় এক প্রচণ্ড ক্রোধের বহ্নিতে। যখন সেই দিনটিতে পুঞ্জীভূত ক্রোধ ফেটে পড়ল, তখন খেলোয়াড়রা দৌড়ে আশ্রয় নিলেন ড্রেসিংরুমের নামমাত্র নিরাপত্তার মধ্যে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়রা নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সকলেই অক্ষত শরীরে হোটেলে ফিরে গিয়েছিল। কনরাড হান্ট তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যেই জাতীয় পতাকা রক্ষার চেষ্টা করেন। বিশালকায় চার্লি গ্রিফিথ ঠিক করেছিলেন মাঠ থেকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পর্যন্ত রাস্তাটুকু হেঁটেই মেরে দেবেন। তাঁর আত্মজীবনীতে সোবার্স জানাচ্ছেন, এক ভদ্রলোক তাঁদের গাড়ীতে লিফট দেন, কিন্তু চার্লি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি, তাই পায়ে হাঁটার সিদ্ধান্ত। পথে এক জায়গায় গোটা দুই স্কুল-পড়ুয়া ছেলে তাঁকে চিনতে পেরে অটোগ্রাফের জন্য দৌড়ে আসে। চার্লির ধারণা হয়েছিল ছেলেদুটো তাঁকে মারতে আসছে। ফলে হাঁটা ছেড়ে তিনি এমন দৌড় লাগালেন যে, হোটেলের লবিতে এসে পৌঁছোবার পর হেদিয়ে তাঁর মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা এই ঘটনায় এতই ঘাবড়ে যায় যে, কয়েক ঘন্টার মধ্যে সফর বাতিল করে দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল তখন কলকাতায়। তিনি অবশ্য এসেছেন অন্য কাজে। কিন্তু তা হলেও, দলে তাঁর ভূমিকা ছিল সংসারের পিতার মতো। ওরেল ধীরে ধীরে যুক্তি দিয়ে বোঝালেন সকলকে –
স্যার ফ্রাংক ওরেল |
স্যার ফ্র্যাঙ্ক দর্শকদের মনস্তত্ত্ব দারুণ বুঝতেন। উনি বুঝেছিলেন, হতাশা এবং ক্রোধটুকু উবে গেছে। এবার থিতু হওয়ার পালা। ওরেলের এসব কথার পর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা এই টেস্টের ভাগ্য সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। পরের দিন খেলা আরম্ভ হয় বেশ শান্তিতে যদিও ভারত এ টেস্ট ইনিংসে হেরে গিয়েছিল। তখন কি আর কেউ জানতো আর মাত্র তিনমাস পরেই এই মানুষটি দুরারোগ্য লিইকোমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছাড়বেন? ইডেন মনে রেখেছে তাঁকে। সিএবি প্রত্যেক ফেব্রুয়ারি মাসের তিন তারিখে, ইডেনে ফ্র্যাংক ওরেল ডে পালন করে, রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে।
১৯৬৯-৭০-এ ভারত সফরে এসেছিল অস্ট্রেলিয় দল, ৩২ বছর বয়সী বিল লরির নেতৃত্বে। ছিলেন কিথ স্ট্যাকপোল, ইয়ান চ্যাপেল, ডগ ওয়াল্টার্স, ইয়ান রেডপাথ, পল শিহানের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যাটসম্যানরা। গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, এরিক ফ্রিম্যান, অ্যাসলে ম্যালেট, অ্যালেন কনোলির মতো বাঘা বোলাররা তখন বিশ্বের ত্রাস। সিরিজের চতুর্থ টেস্ট (ইডেন গার্ডেনস- এ) শুরু হওয়ার আগের মুহূর্ত ছিল নাটকীয় উপাদানে ভরপুর ।
প্রখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক রে রবিনসন তাঁর “দ্য ওয়াইল্ডেস্ট টেস্টস” (The Wildest Tests) বইতে এর ব্যাখ্যা করেছিলেন –
অঘটন ঘটে এই টেস্টেও। ডেইলি টিকিটের লাইনে দাঁড়ানো ক্রিকেটপ্রেমী মানুষদের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয় মাঠে ঢোকাকে কেন্দ্র করে। দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটতে থাকা জনতার পায়ের তলায় বলি হন ছয় ক্রিকেটপ্রেমী যুবক। আহত হন শতাধিক।
এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয় ইডেন, ১৬ই অগস্ট, ১৯৮০তে। খেলা ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মধ্যে। এ খেলায় দু’-দলের খেলোয়াড়রাই চোরাগোপ্তা মারপিটে জড়িয়ে পড়েছিল। গ্যালারি ছিল প্রথম থেকেই উত্তপ্ত । যা কিছু উত্তেজনা বা গোলমালের সূত্রপাত হয় রঞ্জি স্টেডিয়াম থেকে। মোহনবাগানের লেফট-উইং বিদেশ বসু ইস্টবেঙ্গলের রাইট-ব্যাক দিলীপ পালিতকে টপকাতে গিয়ে দু’জনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দিলীপের পরিষ্কার ফাউল ছিল। কিন্তু, বিদেশ মাথা ঠিক রাখতে না পেরে, দিলীপের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। ইডেনে উত্তেজনা বাড়তেই পুলিশ লাঠি চালাতে উদ্যোগী হয়। পরে জানা যায় তরতাজা ষোলোজন তরুণ ‘স্ট্যামপিডে’-এ প্রাণ হারিয়েছে। আরও অনেক তরুণ আহত হয়েছে। শোনা গেল, পুলিশের লাঠির হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই ঐ তরুণের দল প্রাণপণে ছুটোছুটি করছিল। পরিণামে ঐ বিপর্যয়। পরবর্তীকালে সেই ফুটবল প্রেমিকদের স্মরনে এক শহীদবেদী নির্মিত হয়।
শহীদ বেদী |
এছাড়া ইডেনে, ১৯৯৬-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ও ১৯৯৯-এর ইন্দো-পাক টেস্টের বিভীষিকাময় অধ্যায় আমরা চিরতরে স্মৃতির আয়না থেকে মুছে ফেলতে চাই।
আবার আশির দশকের গোড়াতে এক অসাধারণ, মর্মস্পর্শী ঘটনার সাক্ষী থেকেছিল ইডেন। আসিফ ইকবালের নেতৃত্বে পাকিস্তান দল ভারত সফর করছিল, শেষ টেস্ট ইডেনে। সিরিজে পাকিস্তান ০ – ২ পেছিয়ে। আসিফ ইতিমধ্যে এই সিরিজের পর অবসরের কথা ঘোষণা করেছেন। এই টেস্টে খুব স্পোর্টিংভাবে ঝুঁকি নিয়ে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে দেন আসিফ। ইমরানের দুর্দান্ত বোলিং-এ ভারত দ্বিতীয় ইনিংসে তাড়াতাড়ি গুটিয়ে যায়। জয়ের জন্য খুব তাড়াতাড়ি রান তুলছিলেন আসিফ ও জাভেদ, এই সময়ে হঠাৎ রান আউট হন আসিফ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন ইডেনের দর্শক। কিন্তু জীবনের শেষ টেস্ট খেলা আসিফকে যোগ্য মর্যাদা দিতে আশি হাজার দর্শক একযোগে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিবাদন জানান। আসিফ এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে পরবর্তীকালে বিভিন্ন আলাপচারিতায় এই ঘটনার উল্লেখ করেন।
ইডেনে এক রুদ্ধশ্বাস পরিসমাপ্তি ঘটে ইন্দো-অস্ট্রেলিয় টেস্ট ম্যাচের, মার্চ ২০০১এ। ফলো অন করেও ভারত জয়লাভ করে মূলত দ্বিতীয় ইনিংসে লক্ষণ আর দ্রাবিড় এর অকল্পনীয় ব্যাটিং শক্তির প্রয়োগে। ৩৭৬ রানের পার্টনারশিপের সৌজন্যে দলের রান পৌঁছে যায় ৭ উইকেটে ৬৫৭-এ।
৩৮৪ রানের লক্ষকে সামনে রেখে খেলতে নামা অস্ট্রেলিয়রা গুটিয়ে যায় ২১২তে, মূলত হরভজনের ঘূর্ণি বলের যাদুতে। ছয়-ছয়টি মূল্যবান উইকেট নিজের দখলে নেন সিংজি। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন শচীন তেন্ডুলকর। তিনটি উইকেট জমা পড়ে তাঁর ঝুলিতে। এ টেস্ট হেরে মুখ থুবড়ে পড়ে অস্ট্রেলিয় টিমের জয়রথ। এর আগে সিরিজে ০-১ এ পিছিয়ে ছিল ভারতীয় দল। ইডেনের এই জয় তাঁদের মনোবল বাড়িয়ে পরের টেস্টে জিতে সিরিজ জয় করতে সাহায্য করে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
অস্ট্রেলিয়া ৪৪৫ (স্টিভ ওয়া – ১১০, ম্যাথিউ হেডেন – ৯৭, হরভজন সিং – ৭/১২৩) ও ২১২ (হেডেন – ৬৭, হরভজন ৬/৭৩)
ভারত ১৭১ (লক্ষণ – ৫৯, ম্যাকগ্র্যাথ – ৪/১৮) ও ৬৫৭/৭ ডিক্লেয়ার্ড (লক্ষণ-২৮১, দ্রাবিড়-১৮০)
ফলাফল - ভারত ১৭১ রানে জয়ী
জয়ের মূল স্থপতি – দ্রাবিড় ও লক্ষণ |
আমাদের সাধের ক্রীড়াঙ্গন, ইডেন উদ্যান বহু ঐতিহ্যমন্ডিত ঘটনার সাক্ষী। শোনা যায় ইডেনে কিংবদন্তী ক্রিকেটার রঞ্জিত সিংজির (নওয়ানগরের জামসাহেব) পদধূলি পড়েছিল দু’বার। ১৮৯৮-এ খেলতে এসেছিলেন পাতিয়ালা একাদশের হয়ে। তবে ১৯০৫-এ ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে তাঁর চোখ ধাঁধানো ১৩২ তৎকালীন দিনের ক্রীড়াপ্রেমিকদের মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। এ ইনিংসের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বড়লাট লর্ড কার্জন। অভিভূত হয়ে রঞ্জির অকল্পনীয় প্রতিভা নিয়ে এক আস্ত বই লিখে ফেলেন ক্রিকেট বোদ্ধা Major C.H.B. Pridham।
এই মাঠে ১৯৮২ সালে প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয় নেহেরু গোল্ড কাপের মতো আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল প্রতিযোগিতা। র্যামস-ফ্রান্সিস কোলি (উরুগুয়ে), বুরুচাগা (আর্জেন্টিনা), লাজলো কিস্ (হাঙ্গেরি), - এদের শিল্পময় ফুটবল ও ভারতীয় ফুটবলারদের প্রশংসনীয় লড়াইয়ের কথা আমরা ভুলিনি। আমাদের স্মৃতিপটে আঁকা আছে ইডেনে অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ সালের রিল্যায়েন্স ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল, ১৯৮৯-এ বাংলার দ্বিতীয়বার রঞ্জি ট্রফি জয়, ১৯৯৩-এ হিরো কাপ জয়, এশিয়া কাপ ফাইনালে কপিল দেবের হ্যাট্রিক ও শচীন তেন্ডুলকরের অন্তিমপূর্ব টেস্ট ম্যাচ।
পরিসংখ্যান:
ক্রিকেট – এখানে ক্লিক করলে দেখা যাবে
ফুটবল – এখানে ক্লিক করলে দেখা যাবে
লেখক পরিচিত - পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সঞ্জয় সেনগুপ্ত বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক। একইসঙ্গে সাহিত্য ও সঙ্গীত অনুরাগীও। বাংলা তথা হিন্দি আধুনিক ও ছায়াছবির গান নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। বেশ কিছু লেখা বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে প্রকাশিত। ভারতীয় তথা পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীত-এ সমান ভাবে উৎসাহী। ক্রিকেট অন্ত প্রাণ, সঞ্জয় স্কুল/কলেজ লেভেলে ক্রিকেট খেলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ফুটবলও তাঁর অতি প্রিয় খেলা।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.