বিবিধ প্রসঙ্গ
মার্চ ৩০, ২০১৭
আপিস কথা
মৃগাঙ্ক মজুমদার
(১)
নকুড় চ্যাটার্জীর নাম নিয়ে যত না মুশকিল তাকে ছোটবেলায় সামলতে হয়েছে, এন সি নস্য শুনে শুনে তার চেয়ে বেশি হয়েছে আর হচ্ছে তার এই আপিস জীবনে। লোকে আপিস যায় কেন? পয়সা কামাতে। অন্তত নকুড় তো তাই জানতো শুরুতে। শুরতে, মানে আপিসে ঢোকার আগে কত্ত কিছু ভেবেছিল। সকালে উঠে ইস্ত্রি করা পাটভাঙা জামা প্যান্ট পরে আপিসে ঢুকবে চেয়ারে বসে নিজের ডেস্কটা হাল্কা গুছিয়ে নেবে। নিজের জলের বোতল বা গ্লাস যেটা কোম্পানী থেকে দেবে, তার ভরা জলে হালকা চুমুক আর তার পরে একটা চা নিয়ে বসা, আঃ।
কিন্তু তারপরেই ঝামেলার শুরু। যদি পিয়ন বা বেয়ারা থাকে, আর সে ভুলে যায় জল দেওয়ার কাজ- অমনি নকুড়ের দিনটা টোকো হতে শুরু করে। তাছাড়া এর শুরুটা যে খুব ভাল হয়েছিল তাও না। মানে অনেক দৌড়োদৌড়ি, ইন্টারভিউ, অনেক সুন্দরী এইচ.আর-দের সামনাসামনি হবার পর চাকরি বাগিয়েছিল। বাবার ইচ্ছেয় জল ঢেলে সরকারি চাকরির মুখ না দেখতে পেয়ে অবশেষে এই বহুজাতিক সংস্থাতে একটা দাঁও মেরেছিল নকুড়। তা সেখানে সে জলের আশা করতেই পারে। কিন্তু ওই যে বহুকাল আগে বাঙাlলিকে সাবধান করে গিয়েছিলেন সুকুমার রায়, আর সেটা কানে কেউই কানে না তোলায় প্রায় সারাক্ষণই ‘জলপাই কাণ্ড’ চলে আপিস জুড়ে।
নকুড়ের আপিস জীবনের প্রথম দিনেই যে তার লালিত আশার জলাঞ্জলি হবে তা সে ভাবতেই পারেনি। শুরুর শুরুটা ঠিকই ছিল প্রায়। সক্কাল সক্কাল উঠে পাটভাঙা ইস্ত্রি করা জামা কাপড় পরে, জুতো চকচকিয়ে, তাতে নিজের মুখ দেখে একটা হলদে ট্যাক্সিকে ট্যাঁকে গুঁজে আপিসের দোরগোড়ায় হাজিরা। আর তারপর থেকে সেই যে অনন্ত প্রতীক্ষা শুরু জলের জন্য, তা আর কহতব্য নয়। রিশেপসনেই সেইদিনটা কেটে যাবার উপক্রম হয়েছিল প্রায়। উল্টোদিকের টেবিলের ওপারে বসা তরুণী দেখতে যতই সুন্দরী আর স্মার্ট হোক, তা দিয়ে কি আর তেষ্টা মেটে। গ্লাসটপ টেবিলে আপিসের কয়েকটা পুরনো ম্যাগাজিন, ব্রোশিওর আর সেই দিনের ইংরেজী পেপার উল্টেও ঘড়ির কাঁটাকে ঠেলে এগনো যায় না। মাঝে যদিও একবার কাচের দরজা ঠেলে ভিতর থেকে আরএল তরুণী এসে তার কাগজপত্রের ফোটোকপি নিয়ে গেছে। অবিশ্যি ‘ফোটোকপি’ কথাটা সেই দিনই নকুড় জানলো অ্যাদ্দিন ধরে ‘জেরক্স’ জানার পর। মানে পাড়ার দোকান থেকে পড়শির মুখে ওই নামটিই তো জেনে এসেছে। কয়েক সেকেন্ড ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকার পর আন্দাজে নিজের হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিয়েছিল সে।
আপিস বলে কতা, তাও আবার বেসরকারি আর তাইতে আবার অনেক কেত্তন। সেই কেত্তন আর বুকনি বুঝতে আর সামলাতে নকুড়ের যতদিন লেগেছিল, ততদিনে আপিস নিয়ে মোহটা আস্তে কাটতে শুরু করেছিল। কিন্তু কাটতে কাটতেও পুরো কাটলো না বরং নানা উপায়ে আপিসটা তাকে জড়িয়ে ধরল।
আর এই জড়িয়ে ধরাতেই যত আপত্তি। এমনিতে গড়পরতা বাঙালির থেকে নকুড় সামান্য লম্বা, মাঝারি গড়ন, রঙ ফরসার দিকে কিন্তু ওই ধপধপে ফরসা নয়। কিন্তু তা নিয়ে নকুড়ের চাপ ছিল না। কোনদিনই, এমনকি আপিসে ঢোকার পরে সহকর্মীরা 'নকুড়ের সন্দেশ' বলে ডাকা শুরু করলেও গায়ে মাখেনি। মানে সন্দেশ ব্যাপারটা তো আর খারাপ না তাও আবার নকুড়ের বিখ্যাত সন্দেশ। কিন্তু চাপ হল যখন সন্দেশকে মিষ্টি হিসাবে না ভেবে খবরের খাজানা বা তেলেভাজা হিসাবে গণ্য করা হয়। তখন নিজেকে প্রায় চুনোপুঁটি নগণ্য ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। তবে কিনা পেটুক নকুড়ের কাছে মাছ হিসাবে চুনোপুঁটির কদর অনেকটাই। বিশেষ করে ঝালঝাল গা-মাখা করে যদি বানানো হয়। যেদিন আপিসে আসার আগে খেয়ে আসে, সেদিন সারাদিনই প্রায় ঘোরের মধ্যে থাকে সে। তা বলে নিজেকে চুনোপুঁটি ভাবতে ঘোর আপত্তি আছে নকুড়ের এই একটা ব্যাপারের অবিশ্যি নকুড়ের সাথে আপিসের সবার মিল আছে। কেউই নিজেকে চুনোপুঁটি ভাবতে চায় না, সে বেয়ারা থেকে বস- যেই হোক না কেন।
এই বেয়ারাদের বাড়াবাড়ি যে কতটা হতে পারে সেটা আপিসের প্রথমদিন থেকেই আঁচ পেতে শুরু করেছিল নকুড়। আর আজ তো তা একেবারে মহাকাব্যের পর্যায়ে। রোজই তাতে নিত্যনতুন অধ্যায় যোগ হচ্ছে। সেই অধ্যায় নিয়ে ভাবতে যাবে নকুড়, অমনি মোবাইলে বসের নাম সশব্দে ভেসে উঠল। 'পরে হবেখন' ভেবে নকুড় ফোনটা তুলে বলল, “হ্যালো স্যার...”
(২)
“ধ্যাত্তেরি!” বিড়বড় করে ওঠে নকুড়। সকাল থেকে আজ মেঘলা আকাশ জুড়ে খিচুড়ি খিচুড়ি গন্ধ। তার সাথে যদি ডিমভাজা, মাছভাজা বা বেগুনভাজা আর ঘি, আর কিচ্ছু চাই না। নিকুচি করেছে আপিসের। খেয়ে দেয়ে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুম। ভাবতে ভাবতে বিছানাতে পালটি খায় আর তখনি ফোনটা আবার কানের পাশে এমনভাবে কেঁপে উঠল যেন রিখটার স্কেলের ৭ ডিগ্রির ভূমিকম্প। অনেক কষ্টে পাশ ফিরে মুখ থুবড়ে কাঁপতে থাকা ফোনটাকে হাতে নিতেই নকুড়ের মাথার ভিতর নরকের কুম্ভীপাকের মোচড় দিতে থাকল। ফোনের মধ্যে যে নামট বড় বড় করে ভাসছে সে হল মদনা। নকুড়ের আপিসের বস। পুরো নাম মদনমোহন মেহেরা। নকুড়ের আবগারি মুডের ক্যাচড়া করে ফোনটা তখনো আনন্দে লাফাচ্ছে, সঙ্গে মদনা।
মদনাই তার ইন্টারভিউ নিয়েছিল ওই এইচ.আর. রাউন্ডের পরে। মালটা এমনিতে পাঞ্জাবি কিন্তু ওর চোদ্দগুষ্টি বাংলার বুকে বেড়ে উঠেছে যুগের পর যুগ ধরে। অতএব বাংলাতে গাল পাড়া যায় না জোরে জোরে। তবে ওর এই মদনা নামটা ও নিজেও জানে, আর ওকে নিয়ে যে আড়ালে খিল্লি চলে- সেটারও আঁচ পায়। পৃথিবীর সব আপিসের বসেদের আড়ালে খিল্লি করা হয় একটা ডাকনাম দিয়ে। এইটা জানার পর নকুড়ের নিজের ওপর থেকে একটা চাপ নেমে গিয়েছিল। মানে ওর নিজের নাম নিয়ে খিল্লির তো সীমা ছিল না। যেদিন মদনা নামটা শুনেছিল ওর এক সহকর্মীর মুখে, সেদিন এক পৈশাচিক আনন্দ বোধ করেছিল নকুড় নিজের ভেতরে। তারপর থেকে জানতে পেরেছে মদনার নানা ঐতিহাসিক কাণ্ডকারখানা।
কিন্তু এখন এই ফোন দেখে নকুড়ের ভিতরে যা জ্বলছে, সেটা আজ অন্তত কমবে না। এখন এই সময়ে স্নান করো রে, গা মোছো রে, খাবার গুলোকে গলার ভিতর ঠোসো রে, জামা প্যান্ট জুতো পরো রে, আর তার পরে পড়ি কী মরি করে বাসের পেছনে ছোটো। টাইমের এসি বাস। তাতে নকুড়ের উইন্ডো সিট চাই। তাতে ওই ঘন্টা খানেকের বাস জার্নিতে ঘুমটা পুষিয়ে নেওয়া যায় আর কী। ডেলি প্যাসেঞ্জার বলে কন্ডাকটার কিছু বলে না। নকুড় নামার আগে টাকাটা ধরিয়ে টিকিটটা নিয়ে রাখে। সে সবই সেট করা, কিন্তু মদনাকে সেট করা যাচ্ছে না কিছুতেই।
কাজ করানোর থাকলে লোকটা নিজেকে পুরোদমে পরিবর্তন করে নেয় এক বিশেষ প্রজাতির খচ্চরে, যারা কিনা গাধার বর্ণসংকর। কাজ না হলে গলা হাঁকিয়ে ইজ্জতের ফালুদা থেকে ময়দা সব বানিয়ে দেবে। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের যোগ থাকলে কান এঁটো করা গা-জ্বালানো হাসি হাসবে আর নকুড়ের ঘাড় ধরে কাজটা করাবে। তা কাজ করতে নকুড়ের অসুবিধা হয় না। কিন্তু বস হয়েও লোকটা পরজীবি আগাছার মত গায়ে এঁটে থাকবে। আর যাবতীয় দায়িত্ব নকুড়ের ঘাড়ে ফেলে নিজে ফুরফুরিয়ে হাওয়া খাবে, চ্যাট করবে মেসেঞ্জারে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর ছবি আপলোড করবে, গুচ্ছের এদিক ওদিক লাইকাবে। এমনকি, নিজের কাজে ভুল করলেও সেটা নকুড়ের উপর দিয়ে চালাবে। নির্লজ্জের মত বলবে, “তুমি কাজ করলে আমার উন্নতি আর তুমি ভুল করলে তোমার অবনতি”। যতবার এই কথাটা শোনে নকুড়, ততবার তার ঠাঁটিয়ে চড়াতে ইচ্ছে করে মদনাকে। কিন্তু ওই আপ্তবাক্যটা তাকে আটকে দেয় বার বার- বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
এই একটা কারণেই রোজ লেফটকে রাইট, আর রাইটকে লেফট করে যেতে হয় নকুড়কে আপিসে বসে দিনভর। তাও যে নিশ্চিন্তে নিজের টেবিলে বসে কাজ করবে তার উপায় নেই। কেউ না কেউ ঘাড় বেঁকিয়ে, কাত করে, জল খাবার নাম করে, আড্ডার নাম করে একবার না একবার কম্পিউটারের মনিটারের দিকে তাকাবেই। কিংবা টেবিলের কাগজের দিকে। আচ্ছা আপদ! না নিজেরা কাজ করবে না, লোকেদের কাজ করতে দেবে শান্তিতে। এদের স্কুলে কি কেউ শেখায়নি, নাকি এরা এখনো সবকটা ধাড়ি বাচ্চা! আসলে এদের সারাক্ষণই মুখ চালানোর কিছু চাই-ই চাই। হয় খাবার, নয় তো গসিপ!
তবে গসিপের নাম শুনলে নকুড়ের কানও খাড়া হয়। কিন্তু তড়বড়িয়ে নিজে হাঁকপাঁক করে না। আরে বাবা, আপিস মানেই তো গসিপের ছড়াছড়ি আর চচ্চড়ি! আজ যে কী আছে, সেটা আপিসে পা রাখলে বোঝা যাবে না। বাবুরামকে চেপে ধরতে হবে আজ আলাদা করে। ভাবতে ভাবতে নকুড়ের মুখে ত্যারছা হাসি জেগে ওঠে...
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি - মৃগাঙ্ক একটি যাযাবর বোহেমিয়ান পাখির উড়ান জীবন। বিজ্ঞাপনী ভাষা লিখে আর বলে তার পেট ভরে। আর্ন্তজালের রাজ্যে হানা তার ট্যাঁক ভরানোর জন্য। হাওয়ার প্রবল টানে গতিপথ বহুবার বদলালেও লক্ষ্য স্থির।
একদা ভারতের রাজধানী বঙ্গদেশের কলকাতাতে হলেও প্রবাসী তকমাতেই জীবন কেটেছে আর কাটছে। লেখালিখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বহু বছর ধরে। আগ্রহ নাটক, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য, রান্না, ছবি তোলা, বিনা প্রস্তুতিতে বেরিয়ে পড়া মন চাইলে, বই পড়া আর প্রিয় পরিবার এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।