আপিস কথা (২)
মৃগাঙ্ক মজুমদার
৩
(আগের অংশ)গসিপের গন্ধ পেলেই আপিসের দেয়াল থেকে আরশোলা সবার কান খাড়া। আর আপিসের পোষা টিকটিকিদের এমনিতে টিকি মেলা ভার অথচ কোন মুচমুচে টকঝাল গসিপ এর গন্ধকণা উড়লেই তৎক্ষনাৎ হাজির। আর তাদের দেখে আরশোলারা হাল্কা আড়াল নিলেও একেবারে পালায় না, কারন ওরা জানে এই সময়ে টিকটিকির পেট খালি ভরবে গসিপ ভোজনে।
বামপন্থাবিশ্বাসী বা ক্যাপিটালিস্টের ধ্বজাধারী এহেন কেউ নেই যাদের গসিপে আপত্তি আছে। আর যাদের আছে তারা এখন প্রায় লুপ্ত তাই তাদের নিয়ে মাথা ব্যাথা না করে হাতে ঘটিগরমের মত গরমাগরম গসিপ কামড়ে চেটে চিবিয়ে খাওয়ার আনন্দ থেকে কেউই নিজেকে বাদ দিতে চায় না। তবে হ্যাঁ, গসিপের আবার শ্রেনীবিভাজন আছে আর সেটা আপিসের পদমর্যাদার ভেদাভেদ ভুলেই। আরে সারাক্ষণ কি আর পানসে মুখে জীবনের পানসি চালানো যায় নাকি? রোজকার ধ্যাধধ্যারে পান্তাভাতে বদলে যদি চপ, কাটলেট, পোলাও, বিরিয়ানী, ভাজাভুজি, ইত্যাদি ইত্যাদি পাতে পড়ে একি কি ছেড়ে দেয় যতক্ষণ না পেট ছাড়ে?
অগত্যা, আপিসের আকাশে গসিপের ঘনঘটা থাকলেই বেশিরভাগেরই ময়ূরের মত পেখম তুলে আতিশয্যের প্রকাশ করতে থাকে। তবে এর মধ্যে যে বেশ কিছু ছড়িয়ে লাট করে সেটা তো বলাই বাহুল্য, তা বলে কি তারা থাকবে না! আরে জীবনের থুড়ি আপিসের রঙ্গমঞ্চে তাদের ভূমিকা কী করে অস্বীকার করা যায়? মানে এর পরে কোনো এক গসিপালোচনায় তারাও যে মুখ্য চরিত্রে ঠাঁই পেতে পারে, একথা যদি কেউ না মানে তারা তো গসিপ গোষ্ঠীতে জায়গা পাবে না। আর জায়গা না পাওয়ার জ্বালা ত্রিকোণ প্রেমের পরাজিত জনের থেকেও বেশি। অতএব গসিপ শুনতে গেলে নিজের নিজের কৌতুহলী কুচুটে মনকে, কান নাক, চোখের দরজা হাট করে খুলে রাখতে হবে। একটুকু ফস্কে যাওয়া মানে নিজের কাছে নিজের শরীরের ক্ষতি করা আর সেটা তো গুচ্ছের মেডিকেল জার্নাল ঘাঁটলেই নাকি ঠিক প্রমাণিত হবে।
আপিসে ঢোকার আগে নকুড় জানতই না যে গসিপের এত মহিমা আছে। লোকের হাঁড়ির খবর জানতে পাড়া পড়শির যে রকম নেশা, আপিসের লোকেদের তার থেকে কিচ্ছুটি কম না। ফিনান্সের হেডের সাথে মার্কেটিং এর নতুন মেয়েটির রোজ মিটি আর ইটিং অনেকেরই চক্ষুশূল আর তাই থেকে একের পর এক রসালো উপাদান যা দিয়ে শুধু বাংলা না সর্বভারতীয় টেলিভিশনের মেগাসিরিয়াল তৈরী করে ফেলা যায়। প্রতিদিন সেই কাহিনিতে থাকে নতুন চমক, নতুন মশলা, রহস্য-রোমাঞ্চ আর এর পরেও কষ্ট করে হাতের কাজগুলো সেরে ফেলতে হয়।
সকাল থেকেই বোঝা যায় সেদিনের গসিপের গৎটা কোন সুরে বাঁধা। মানে উচ্চগ্রামে বেহাগ নাকি রিনরিনে জয়জয়ন্তী। কোনো কোন সময়ে অবশ্য অপেরা বা ইহুদী মেনুহিনের অর্কেস্ট্রা। নকুড় বাকিদের সহজাত প্রতিভার তারিফ না করে পারে না। মাঝে মধ্যে নোবেল কমিটি আর অস্কারের আয়োজোকদের প্রতি রেগেও যায় কেন এই রকম গসিপ বিভাগ নেই। সাহিতের বাকি বুকার টুকার বা দেশজ একাডেমি ইত্যাদি তো এদের কল্পনাশক্তির কাছে তুচ্ছ।
নকুড় ছোটবেলা ট্যাঁশগরু পড়েছিল, এখনো পুরো সমগ্রটাতে চোখ বোলায় আর ভাবে, যে সুকুমার রায় থাকলে আরো কত কি যে বেরোত মণিমুক্তো। তবে একটা ভ্রান্ত ধারণা নকুড়ের প্রথম দিন থেকেই চলে গিয়েছে যে মেয়েরাই নাকি খালি পাকা গসিপে। নকুড় হলফ করে বলতে পারে ছেলেরাও কোন অংশে কম না। এখানে এক্কেবারে জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি। আর এতেও বয়সের কোন সীমা পরিসীমা নেই। পঁচিশের ছোকরা ছাপান্নর দামড়ার সাথে সমানে ফুসুর ফুসুর করে যাচ্ছে। গসিপে হার্ট ভালো থাকে বলেই বোধহয়। নকুড়ের আজকাল মনে হয়ে এই যে ঢপের যত টিম বিল্ডিং ওয়ার্কশপ করায় আপিসগুলো তার থেকে গসিপ কর্ণার খুলে দিলে সবার মধ্যে কাজের উৎসাহ বাড়বে। যেমন এই কফি বা চা মেশিনের সামনে বা সিঁড়ির ধারে লিফট থেকে একটু দূরে বা ওয়াশরুমে ঢোকার আগে। এই বাথরুমকে ওয়াশরুম বলার কেত নকুড় আপিস থেকেই শিখেছে। তবে রোজ গসিপের হাত ধরে যা শিখেছে আর শিখে চলেছে তার কোন তুলনাই হয় না ।
তবে ওই এক কোন শ্রেনীর গসিপের গোয়ালে তুমি জাবর কাটবে সেটা নিজেকেই ঠিক করতে হবে আর সেই নিয়েই নকুড়ের হয়েছে মহা জ্বালা। আপিসে গসিপের সাথে সাথে তো রাজনীতিও আছে রে বাবা। তাই কে কোন দলের সেই বুঝে গসিপ চালান করা হয়। সেই চালান ট্রাফিক পুলিশের চালানের থেকে বেশী কার্য্করী। আপিসের মধ্যে ছোট ছোট টেবিল কে কেন্দ্র করে গসিপের নানা কার্যালয় খোলা হয় তার পর তার থেকে বেরোতে থাকে জমাটি খবর। এমন সব খবর যা কোনো নিউজ চ্যানেলও বের করতে পারবে না টেলিকাস্ট তো দূরঅস্ত। মাঝে মাঝে নকুড় ভাবে নিউজ চ্যানলের সাংবাদিক =গুলো কি এতই অকর্মন্য যে একটা খবর যোগাড় করতে এত কষ্ট করে আর তার পর দেড় মিনিটের খবরকে বাইশ মিনিট ধরে রেকারিং ডেসিমেলের মত ঘ্যানাতে থাকে? নকুড়ের আপিসে এসে তো জেনে নিতে পারে কীভাবে খবর রোজ বের করতে হয়।
বাবুরাম ব্যস্ত আছে নিচের তলায় পার্সেল প্যাক করতে কখন যে আসবে আর আজকের গসিপের খবরটা দেবে! নকুড়ের বাধ্য হয়ে এক্সেল-শিটটা খুলে বসে। কিছু কাজ তো করছে সেটা দেখাতে তো হবে। নইলে আবার...
৪
গসিপ নিয়ে টানাটানির আগে কিছু দপ্তরখানার দস্তূর জেনে নেওয়াটা জরুরী। প্রতি দপ্তরের বড়বাবু আর তার চ্যালা চামুন্ডা বাঁশ কঞ্চি ইত্যাদির বহর যদি না জানা যায় তাহলে যে আপিসে টেঁকা দায় সেটা যত তাড়াতাড়ি বোঝা যায় ততই ভাল।
সাথে আরো একটা কথা ইদানীং আরো বেশী করে বাংলা ভাষায় ঢুকেছে সেটা হল ‘ঘোটালা’। মানে এই আপিসে ঢোকার আগে অনেক কিছুই জানা ছিল না বাংলা ভাষার, কিন্তু ইদানীং অনেক কিছুই ভাষার মধ্যে ফাঁক পেলেই ঢুকে পড়ছে অনেক অজানা চলতি কথা যা সবার অজান্তেই সেই আপিসের ডিকশনারিতে জায়গা করছে প্রথমে তার পর ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের কোণে কোণে। আপিসও যে ভাষার আর শব্দের খনি হতে পারে আর সেখানে থেকে শুধু রোজকার আপিসের গসিপের জ্বালানী ছাড়াও সমাজে শব্দের নতুন উপাদান পাওয়া যায় সেটা চট করে কেই বুঝতে পারে না। রোজকার আপিসি কথা তার অনায়াস গতিতে প্রথমে বাড়ি আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাড়ার আড্ডার সাথী হয়ে সমাজ আর দেশের সঙ্গে মিশে যায়।
আপিসে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যে নকুড়ের যে ধারণা হয়েছিল তার থেকে কেউই তাকে টলাতে পারেনি আজ অবধি। আপিসে সুন্দরী কোন মহিলা থাকা মানেই তাকে নিয়ে সোজা, ব্যাঁকা, তেরছা, গোপনে, গজল্লায় সর্বঘটের আলোচনায় সেই বিশেষ একজনের উপস্থিতি সারাক্ষণ গুনগুন করে বাজতে থাকে।
অবশ্য সুদর্শন কোন পুরুষ থাকলেও একই ব্যাপার ঘটে আর সে অত সুবেশ না হলেও চলে, তবে আজ নকুড়ের মন মহিলাময় হয়ে আছে।
মানে যেকোনো আপিসে একটা করে সুন্দরী মহিলাকে সবার আগে ধরে সামনের ডেস্কে মানে কিনা রিশেপসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। এই ব্যাপারটার কারণ নকুড় যতই ভাবতে গিয়েছে ততই সে আরো গুলিয়ে হুলিয়ে লাট করেছে। তার মূল কারণ নকুড় নিজেই ভেবে বের করে ফেলেছে। সে আসলে ম্যাদামারা মধ্যবিত্ত বাঙালী যার দৌড় আপিসের পর বড়জোর পাড়ার ক্লাবঘর বা টিভির সামনের অবসর।
আপিসের মধ্যে মহিলাদেরও শ্রেনীবিভাগ করা হয়ে থাকে আর তাতে নানান নাম দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেউ যদি নারীজাতির অবমাননাকর কিছু খুঁজে পেতে চান তাহলে নিরীহ নকুড়ের ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু সে প্রশ্ন কেউ যদি না তোলেন তা হলে সাধারণ শ্রেনীবিভাগটা খুবই সোজাভাবে বিবাহিত আর অবিবাহিতদের মাঝে করা হয়ে থাকে। অবিবাহিতদের কে নিয়ে যেমন মুখরোচক চলে বিবাহিতরাও আবার নানান ভাবে বাকিদের কথার মধ্যে একদম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকেন। আর এই দুটো ক্ষেত্রে আলোচনার প্রধান বিষয় “কিছু চলছে নাকি?”
এই কিছু চলার ব্যাপারটা মানেই কোন সহকর্মীর সাথে কিছু ‘লটঘট’ ‘কেস’ ‘চুলকানি’ ইত্যাদি জাতীয় ব্যাপার সোজা কথায় যাকে বলে ‘প্রেম’ ঝরে পড়ছে কি না। বিবাহিত হলেই সেখানে একটা বেশ নিষিদ্ধ উত্তেজনার স্বাদ পাওয়া যায় আর যা যত বেশি নিষিদ্ধ, সেই কাজে লোকের উৎসাহ আর উত্তেজনা সবচেয়ে বেশী। নিয়ম ভাঙতে অন্যকে বারণ করলেও নকুড়ের বার বার অভিজ্ঞতা হয়েছে কেউ নিজে যখন নিয়ম ভাঙে তার যুক্তির কাছে দাঁড়ানোটা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। তা সেই সুন্দরী মহিলা যখন থেকে আপিসে ঢোকেন আর যখন তিনি বেরোন তার প্রতিদিনের কার্যপ্রণালীর ধারাবিবরণী এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগ যে গতিতে ঘুরে বেড়ায় তার কাছে যে কোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ‘ব্রেকিং নিউজ’ হার মেনে যাবে। মাঝে মাঝে নকুড়ের মনে হয় এই যে আপিসের লোকেরা আছে তাদের কাছ থেকে কি সব সাংবাদিকদের কাজ শেখা উচিত? সাংবাদিকদেরও যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য বিশস্ত সুত্রের প্রয়োজন হয় আর আপিস জুড়ে কে যে কার বিশ্বস্ত সূত্রে এটা বের করাটা বেশ কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এমন সব খবর এই গসিপের মধ্যে থাকে তাতে মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
তা সেই বিবাহিত বা অবিবাহিত মহিলা বা মেয়েটি যদি কোনোভাবে কারো সাথে একটু বেশি কথা বলে বা হাসে তা হলে তার গুঞ্জন আপিসের এমন কোন কোণা বা জায়গা থাকবে না যেখানে শোনা যাবে না। “কী চলছে?” “আজ কি নতুন কিছু হল?” “উফ কী দিয়েছে মাইরি!” “এত কিছু থাকতে ওর পিছনেই পড়তে হল?” একের পর এক বারিধারার মত ঝরতে থাকে। হ্যাঁ কষ্ট করে বৃষ্টি বলার চেয়ে সুললিত ব্যাপার কারণ এই ক্রমাগত কথা, প্রশ্ন আর আলোচনার কোন শেষ হয় না। একের পর এক নতুন নতুন ভাবে খবর বের করার চেষ্টা হতে থাকে। আর সেইখানেই আবার ঘুরে ফিরে খবরে জগতের কথা চলে আসে। ঘাঘু সাংবাদিকদের নেটওয়ার্কও এত ভাল থাকে না তাই গসিপের স্কুপ নিউজেরও অভাব হয় না। আর এই গসিপের জগতের যদি কিছু খবর নকুড়ের কানে কোনোভাবে না আসে তার মানে নকুড় জানে যে সেদিনকার গসিপের হেডলাইনে তার নামটাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই নকুড় এমনিতে উদাসীন মুখ করে বসে থাকলেও ভিতরে ভিতরে খবর শোনার জন্য মুখিয়ে থাকে।
তবে ইদানীং দুটো আপিস প্রেমের গসিপ হাওয়ায় উড়ছে আর নতুন খবর রোজই নতুন নতুন রঙ এমন ভাবে লাগছে যে টেলিভিশনের যে কোনো রিয়্যালিটি শো হার মানবে। কিন্তু সে যাই হোক, প্রেম বলে কথা আর গসিপ বলে পুরোটাও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না? যা রটে তার কিছুটা তো বটে? আজ এইদুটোই নকুড়ের আপিসের সময় খাবে, কাজগুলো চট করে সেরেই শুনে ফেলতে হবে। ইদানীং মশলা আর রস দুইই বেশ সহজলভ্য। দেখা যাক এবারে গসিপ কোথায় দঁড়িয়ে...
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি: মৃগাঙ্ক একটি যাযাবর বোহেমিয়ান পাখির উড়ান জীবন। বিজ্ঞাপনী ভাষা লিখে আর বলে তার পেট ভরে। আর্ন্তজালের রাজ্যে হানা তার ট্যাঁক ভরানোর জন্য। হাওয়ার প্রবল টানে গতিপথ বহুবার বদলালেও লক্ষ্য স্থির। একদা ভারতের রাজধানী বঙ্গদেশের কলকাতাতে হলেও প্রবাসী তকমাতেই জীবন কেটেছে আর কাটছে। লেখালিখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বহু বছর ধরে। আগ্রহ নাটক, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য, রান্না, ছবি তোলা, বিনা প্রস্তুতিতে বেরিয়ে পড়া মন চাইলে, বই পড়া আর প্রিয় পরিবার এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.