অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিবিধ প্রসঙ্গ

অগাস্ট ১৫, ২০১৭

আপিস কথা (৮)

মৃগাঙ্ক মজুমদার

১৫

(আগের অংশ) আপিসের সব কিছুই কি খারাপ? নকুড় মনে মনে ভাবছিল। এমনিতে তোসারাক্ষণ কেউ না কেউ কারও না কারও পিছনেলেগেই থাকে। কেউ মজা করে, কেউ কাঠি করে নিজে বাড়বে বলে। কিন্তু তার বাইরে কি কিছুই নেই? আপিসই কি সেই প্রধান কারণ যেখান থেকে মানুষের মনে প্রথম বৈরাগ্যের কথা জাগে? কিন্তু সে চিন্তা বড়ই ক্ষণস্থায়ী। বৈরাগ্য কেসটা বড়ই অনিশ্চিত আর তা সবার জন্য নয়।তাই নিত্যকর্ম পদ্ধতির মত মানুষ রোজ আপিসে আসে, বকের মত ঘাড় গুঁজে কাজ করে মাঝে মাঝে ওই একই ভাবে জিরিয়ে নেয়। তার পর সে আবার তড়বড়িয়ে উঠে কাজে নেমে পড়ে আর তার মধ্যেই নিজেকে খানিকটা গাল পাড়ে, তার পর আবার কাজে লেগে পড়ে। আর দিনের শেষে ঝাঁপ বন্ধ করে ঝোলা গুটিয়েবাড়িমুখো দৌড়াতে থাকে। কখনো অটোতে গুঁতোগুঁতি করে, কখনো বাসে ঝুলে, কখনো ট্রেনের ভিড়ে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়েআবার কখনো বা শেয়ারে যা জোটে তাতেই লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু এত কিছুর পরে আবার আপিসে আসে ফিরে পরের দিন। তার মূল কারণ অবশ্যই টাকা আর কিছুটা ওই আপিসের খোরাক,যা পাওয়া যায়।

খোরাক আর খোরাকিএকজায়গায় পাওয়া বেশ ভাগ্যের ব্যাপার।আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপিস হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে দুটোই পাওয়া যায়। আর এই দুই নিয়ে সারাক্ষণখো-খো খেলে যায় আপিসের লোকেরা। কখন যে কে কার পিছনে তাড়া করছে বোঝা ভারী দায়।
তবে আজকাল লোকের খেলার ভঙ্গিমাবদলাচ্ছে।বেশিরভাগই আজকাল ক্রিকেটের ভক্ত।তার পরে ফুটবল আর তারও পরে বাকি বাকি খেলাধূলা। তবে কিনা আপিসেরবেশিরভাগলোকজনের ক্ষেত্রে যেটা হয় সেটা হল, নিজের কাজটা বাদ দিয়ে বাকিদের কাজটা ভালো বোঝে ভাবেসবাই। তারা নিজের দপ্তরের কাজ ছেড়ে বাকী যে কোন দপ্তরে হানা দিয়ে হয় ফাইলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারবে,না হয় কিউবিকলে ঢুকে কম্পিউটারের উপর হাল্কা চোখ বুলিয়ে , ‘ তা কী চলছে?’ বলে নাক গলাবে।

এরা টিভির সামনে বসে সৌরভ, শচীন , দ্রাবিড়, কোহলিকে ব্যাটিং আর কুম্বলে , কপিল ইত্যাদিকে বোলিং শিখিয়ে আসে। আর সেটা আপিসে বসে বসেই করে। কিংবাআপিসে আসার সময়ে।তাদের বেশীরভাগের যে রূপ বা স্বরূপ টের পাওয়া যায় নিত্যযাত্রী হিসাবে, সেইকথা নকুড় আরওএক রূপকথার মত শুনেছে খালি।জানার সুযোগ হয়নি, তবে জানার ইচ্ছে আছে ষোলর উপরে আঠারো আনা। কিন্তু ওই আর কী, বেশি হ্যাজালে যা হয়, বুকনিটাই থেকে যায় আর বাকিটা জাস্ট ভোগে যায়।

তা নকুড়ের তো সেই রকম না যে ‘আসি যাই মাইনে পাই’ ধরনের ব্যাপার! তার এত জ্ঞান জাহির করার সময় থাকে না। তাকে খুঁটে আর খেটে খেতে হয়,তাই তাকে ঝড়, জল , পেটব্যাথা , ইত্যাদির অজুহাত দিতে হয় না।সন্ন্যাসী হওয়া তো দূরঅস্ত । এখনওলোকে প্রায় জীবনের শেষদিন অবধি সরকারিচাকরির চেষ্টা চালিয়ে যায়। সরকারিআপিসে ঢুকলে নাকি জেবন এক্করে কেতাত্থ হয়ে যায়। বেশ একটা নিশ্চিন্তির চাকরি। খুব বড় ধরনের গড়বড় - ঘোটালা না করলে চাকরিযাবার কোন নাকি সুযোগই থাকে না।

এসব ভাবতে গিয়েই নকুড় আবার হোঁচট খেলো। এই ঘোটালা শব্দটা বাংলাভাষায় কীভাবে এল যে ওর মাথায় এত সহজভাবে চলে এল? ঘোঁট শব্দটা বাংলায়আছে নকুড় জানে কিন্তু ঘোটালা ?নকুড়ের বাংলা যে খুব একটা ভাল তাও নয়। ইদানীং কালের বাকি সব আপিস করনেওয়ালাদের মত তারও বাংলা জ্ঞান খবরের কাগজ আর টিভি দেখে। গল্পের বই পড়ে মাঝে মাঝে তবে কি না বেশী ভারী জিনিস মাথায় নিতে পারে না। সামন্য মধ্যবিত্ত চাকুরেজীবি মাথা কত আর নেবে এক সঙ্গে।

ওর মতোবাকিদের অবস্থাও প্রায় এক। তার মধ্যে আপিসে তো লোকে কথার বাইরেও সারাক্ষ্ণ খুটুরখুটুর করে চলেছে নিজেদের মোবাইল ফোন নিয়ে। পিড়িং পিড়িং , টুং , টং আর বেশিরভাগেরইদুই হাতের দুটো বুড়ো আঙুল ব্যস্ত। এই আঙুল যে আপিসে কী কীকরতে পারে তা স্বয়ং ‘ অঙ্গুলিমাল- ও বলতে পারবে না হাজার আঙ্গুল কেটে মালা করে পরবার পর। কে জানে কবে ওকে কে ‘ উঙ্গলি ’ করেছিল? আবার ‘ উঙ্গলি ’ চলে এল এটাও কি বাংলার মধ্যে পড়ে? ধুর আপিসে মজার কথা হচ্ছিলসেখানে থেকে কি না কি। নকুড় মোবাইলের ক্যালন্ডার খুলে বসে কী কীতারিখে আনন্দ করা যায় আপিসের তরফ থেকে তার খোঁজে।

১৬

আপিসে আনন্দ হয় কীভাবে তা নির্ভর করে কে কোন আপিসে কাজ করে তার ওপরে।নকুড় শুনেছে দামী দামী নামী কোম্পানী, আই টি আর মিডিয়া কোম্পানীগুলোতে প্রায় একই ধরনেরহইচই আনন্দ হয়ে থাকে। কিছুদিন আগে অবধি ছেলেরা কিছু হলে বলে বসত, অনেক কাজ হল- আজ একটু বসা যাক। আর এই বসা যাক এর অনেক রকম মানেই হতে পারে আর তা সুরা থেকে সুর সবই হতে পারে আর তার মধ্যে সুরাতে আকৃষ্ট বেশী হয়।নকুড়ের এক এক বন্ধু এক এক জায়গায় কাজ করে আর তাদের মুখে তাদের আপিসের আহ্লাদ আর আদিখ্যেতার কথা শোনে তখন ভিতরে ভিতরেচিড়বিড়িয়েজ্বলতে থাকে কিন্তু মুখেউৎসাহজাগিয়ে রাখে একটাই কারণে– যদিফাঁকতালে কিছু জমাটিগসিপ পাওয়া যায়। তা আপিস অনুযায়ী গসিপের তারতম্য তো ঘটেই খানিকটা তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব একটা রকমফের হয় না, পাত্র, পাত্রী আর অভিনয়ের অকুস্থল ছাড়া। তবে কিনা আপিসে মজা মানে মজা আর লাগামছাড়া আনন্দ মানে প্রায় বেল্ট খুলে নাচার মতনও অবস্থা হয় কিছু ক্ষেত্রে আর ক্ষেত্রবিশেষে তবে সেটা যে আপিসের সহকর্মী ব্যতীত আর কারোর সঙ্গে হয়ে বলে নকুড়ের কাছে খবর নেই।

আজকাল আপিসে যে সব মানবসম্পদের ধারক বাহকেরা ঘুরে বেড়ান যাদের সংক্ষেপে ‘ এইচ আর’ বলে লোকজন আর যাদের উপস্থিতি সরকারিআপিস ছাড়া সব আপিসেই আছে তারা নানান রকমের ‘ রিয়েলটি শো’ করবার চেষ্টা করেন আপিস জুড়ে। এমনিতে তাদের অনেক কিছু কাজ আর অকাজ থাকে তবে তার মধ্যে অন্যতম হল সবকটা আপিসের লোকের হাঁড়ির খবর নিয়ে রাখা। আর সেই হাঁড়িতে কখন কি ফুটছে সেটার পর্যবেক্ষ্ণ সারাক্ষ্ণ করে যাওয়া। নকুড়ের এমনিতে তাদের কথা মনে পড়ে মাসমাইনের কিছুদিন আগে বা কিছু আপিসের নিয়মে ফেঁসে গেলে। আজ তাদের কথা মনে করার বিন্দুমাত্রে ইচ্ছে নেই নকুড়ের কারণ সে শুনেছে কোন এক কারণে আপিসে নাকি ‘পার্টি’ হবে।এ পার্টি কোন যাত্রাপার্টি , ব্যান্ডপার্টি বা প্যলিটিকাল পার্টি তা যে নয়, সেটুকু নকুড় কেন বাকিরাও বিলক্ষ্ণ জানে। আপিসে আজকাল পার্টির মানে আগেকার দিনে বাংলায় যাকে বলা হত মোচ্ছব । এই পার্টির কথা যবে থেকে শুনেছে নকুড় তবে থেকে তার পেটের মধ্যে কি রকম গুড়গুড় করছে। এ পার্টি নাকি এলেবেলে পার্টি না একেবারে নব্য আধুনিক পার্টি আর তাতে খাবারার জোয়ার আর পানীয়ের ফোয়ারা তো থাকবেই সাথে নাকি হাত পা ছোঁড়া আর কোমর নাচানোর ব্যবস্থা যাকে বলে কি না নাচনকোঁদনেরও ব্যবস্থা আছে। সেই সবই নাকি হবে শহরের কোন এক অভিজাত হোটেলের আঙ্গিনায়। সেখানে ডিস্কো না ডান্স এর জায়গা আছে,তার একটা বেশ কেতাদূরস্ত নাম ও আছে সেখানেই হবে। মানে যাকে বলে এলাহি ব্যবস্থা।

আগে অবশ্য লোকে অন্যরকম করে করত সবকিছু আপিসের মধ্যে বা বাইরে ম্যারাপ বেধে বা স্টেজ বেঁধে। আজকাল কিছু আপিসের নিজের হলরুম আছে যার এমনিতে সাউন্ড সিস্টেম পাতে দেওয়া যায় না অনুষ্ঠান তো দিবাস্বপ্নের মত। আর এখন সবই একটু বাড়িয়ে চড়িয়ে । তবে এগুলো তারাই করে যাদের নাকি টার্ণওভার ভালো। সরকারী আপিসে অবশ্য নিজ সংস্কৃতির বাইরে কিছু করা হয় না, কারণ ভাবাই হয় না, কারণ বেশী ভাবলে অন্যরকম কিছু করা তো দূর সার্ভিস রেকর্ডে দাগ লেগে যাওয়ার ভয় থেকে যায়। নকুড়ের তাতে কীযায় আসে, পার্টিতে ঢুকে কীকরবে সেটার মানসিক প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে উত্তেজনায় একাকার হয়ে যাচ্ছে।আর এক এক জন এক এক রকম গল্প দিয়ে যাচ্ছে। আপিসে কাজ করার কিছু তো ভাল দিক আছে মাইনে ছাড়া। এই যেমন একটু ঢুকুঢুকু আপিসের পয়সায় সাথে একটু ....



লেখক পরিচিতি: মৃগাঙ্ক একটি যাযাবর বোহেমিয়ান পাখির উড়ান জীবন। বিজ্ঞাপনী ভাষা লিখে আর বলে তার পেট ভরে। আর্ন্তজালের রাজ্যে হানা তার ট্যাঁক ভরানোর জন্য। হাওয়ার প্রবল টানে গতিপথ বহুবার বদলালেও লক্ষ্য স্থির। একদা ভারতের রাজধানী বঙ্গদেশের কলকাতাতে হলেও প্রবাসী তকমাতেই জীবন কেটেছে আর কাটছে। লেখালিখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বহু বছর ধরে। আগ্রহ নাটক, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য, রান্না, ছবি তোলা, বিনা প্রস্তুতিতে বেরিয়ে পড়া মন চাইলে, বই পড়া আর প্রিয় পরিবার এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।                  

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.