আপিস কথা (৭)
মৃগাঙ্ক মজুমদার
১৩
(আগের অংশ) আপিসের গুজব, গুঞ্জন আর প্রেম এর তুলনা কেউই করতে পারে না। পৃথিবীর কোন খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের খবরের চ্যানেল এর সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে না। আগে তাও আপিসের মাঝে বা পরে বেরিয়ে একটা ঝরঝরে চা এর দোকানে ভাঁড়ে চা নিয়ে চুমুক মারতে মারতে আড্ডা চালাত। এখন তার প্রচলন প্রায় উঠেই যাচ্ছে। এখন সরকারি আপিস ছাড়া বাকি সব আপিসেই প্রায় চা কফির মেশিন বসানো সেখানে বোতাম টিপলেই ঝরছে গরম পানীয়ের নানা প্রকার। কিছু বড় আপিস তো আবার প্রায় বিনামূল্যে বা ভর্তুকিতে খাওয়ার ক্যান্টীনের যোগাড় করে রাখে, যেখানে সুযোগ পেলেই কর্মচারীরা গান্ডেপিন্ডে গিলতে থাকে। তবে কি না এ সবই ওই আই টি আর প্রযুক্তির নতুন আপিসগুলোতে। নকুড় শুনেছে, ছবিও দেখেছে নানারকম খাবারের।
খাবার খেয়ে কেউ যদি ভাবে বিশাল মোটা হয়ে যাবে আর ওবেসিটির খপ্পরে পড়বে, তার উপায় নেই। আপিসগুলো এদিক থেকে আবার চালাক। কিছু আপিস আবার নিজের এলাকার মধ্যেই শরীরচর্চার নানাবিধ সমাধান আর উপাচারের ব্যাবস্থা রেখেছে। মানে, যাতে ষষ্ঠীচরনের মত হাতি না হলেও মুগুর ভাঁজতে পারে। শুধু মুগুরের নাম শুনলে কারোর যদি পেট গুড়গুড় করে, তা হলে ‘ইয়োগা’ আছে। খাঁটি আগমার্কা স্বদেশী জিনিস। আজকাল আবার চারিদিকে স্বদেশী আন্দোলোনের ঝড় উঠেছে দিকে দিকে। তাই কি বিদেশি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানী কি দেশী কোটিপতি ‘বেওসাদার’ সবাই ‘ইয়োগা’ করছেন আপিসের মাঝে। সঙ্গে হুজুগের আর যুগের তালে আসে যায় কিছু কিছু, ইদানীং নকুড় কান পাতলেই শুনতে পাচ্ছিল সবাই ‘হাম্বা হাম্বা’ করে নাচছে। পরে শুনলো ওটা নাকি শরীর চনমনে আর রোগা রাখার নাচ ‘জুম্বা’। শুনে নকুড় তো প্রায় টেবিল থেকে পড়ে যায়! ছোটবেলা কোন এক কমিক্সে পড়ে তার ধারণা হয়েছিল ‘জুম্বা’ শুধু হাতিদেরই নাম হয়। নকুড় ভেবেই নিয়েছিল ‘জাম্বো’ র বাংলা সংস্করণ হবে বোধহয়, মধ্যবিত্তের অকর্মণ্য মাথার উর্বর চিন্তার ফসল আর কী!
তা নকুড়ের ভাবনা শুরু হয়েছিল চায়ে চুমুক দেওয়া নিয়ে। সেখান থেকে তার চিন্তা যে কী করে স্বাস্থ্য ভাবনায় চলে গেল, সেটা নকুড় নিজেই বুঝতে পারছিল না। চা এরই গুণ হবে হয়ত। একসময় তো চা কে বিক্কিরি করা হত স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসাবে। তবে চায়ের চুমুক দিতে দিতে ‘চুমু’ র কথা মনে পড়ে গেল নকুড়ের। কোথায় একবার পড়েছিল চুমু নাকি শরীর ও মনের জন্য ভীষণ উপকারী। তাই বোধহয় ইদানীং আপিসের দুজনকে খুব ফুরফুরে দেখাচ্ছে। আপিসের জোর গসিপ এদের দুজনের মধ্যে নিশ্চিতভাবে কিছু একটা চলছে। কারণ হিসাবে বহু লোকে হলফ করে বলেছে যে আপিস ছুটির পরে এদের দু’জনকে বহু জায়গায় একসঙ্গে দেখা গিয়েছে। আর বেশ কিছু ক্ষেত্রে নাকি যথেষ্ট ঘনিষ্ঠভাবে। আপিসের ভিতর আর বাইরে আজকাল সরগরম তাদের সেই আলাপচারিতা নিয়ে। সেইসব আলাপচারিতা পল্লবিত হতে হতে লোকজনের ধারণা, এরা দুজন হয় গোপনে বিয়ে করে নিয়েছে না হলে গোপনে নিবিড় ভাবে মিলিত হচ্ছে।
নকুড়ের কাছে এর থেকে বিশদে বা খোলাখুলি বলতে কেউই চাইল না। তবে নকুড় জানে গল্পের গরু গাছেও ওঠে আর এই রকম মশলাদার খবর বর্ষার দিনে প্রায় গরম চা আর তেলেভাজার মত। এক এক জন এমন বর্ণনা দেয় যে মনে হয়ে ক্রিকেট মাঠের ধা্রাবিবরণী। কোন মোড়ে, কোন কোণায়, কোন ছাতার তলায়, রেস্তোরায়, হাত ধরে ছিল কি না, সিনমার টিকিট কেটেছে কি না। আপিসে কে কখন ঢুকল, একজন একজনের দিকে কি ভাবে তাকাল, আদৌ কোন ইশারা হয়েছে কি না।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এদের দুজনের ফেসবুক আর বাকি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলও ফলো করেন। নকুড় ভাবে ভারতের আলাদা করে ইন্টেলিজেন্স উইং এর কী দরকার, এত দক্ষ লোকজন আশেপাশে ছড়িয়ে থাকতে? এর মধ্যেই একজন সারা আপিসের হইচই ফেলে দিলেন একদিন, যে সেই বিশেষ দুজনকে কোথায় একটা চুমু খেতে দেখা গিয়েছে। ব্যাস আর যায় কোথায়, সারা আপিসের কাজ মাথায়, লাও ঠ্যালা...
১৪
নকুড়ের কাজ কম্ম প্রায় মাথায় ওঠার যোগাড় । তাতে নকুড়ের বিন্দুমাত্র অবদান নেই। যা কৃতিত্ব সব ওই চুমুর। চুমুটা নকুড় নিজে খায়নি। আর খাবার যে খুব একটা ইচ্ছে ছিল, তাও নয়। চুমু আর প্রেমের ব্যাপারে নকুড় খুব খুঁতখুঁতে। বাকিদের মত ওর কথায় কথায় প্রেম পায় না। আর এখানে সারা আপিস জুড়ে যে প্রেমের চুমু নিয়ে তান্ডব চলছে, আলোচনার মাধ্যমে তা টেলিভিশনের যে কোন টক শো কে হার মানিয়ে দেবে। দেশে বিদেশের কোনো টেলিভশন অ্যাঙ্করের ক্ষমতা নেই এদের হার মানানোর।
হঠাৎ করেই নকুড়ের মাথায় চিন্তাটা ভুস করে ভেসে উঠল। সারাক্ষণ আজকাল বাংলায় এদের অ্যাঙ্কর অ্যাঙ্কর করে ডেকে যায় কেন? এদেরই তো কোন এক সময় বাংলাতে অনেকগুলো নামে ডাকা হোত – অনুষ্ঠান সঞ্চালক, সংযোজক, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন নকুড় ভাবছে এইনামগুলোই বোধহয় বিদেশি। সে যা খুশি হোকগে যাক, একটা চুমু নিয়ে সারা আপিসের তোলপাড়ের যে কী আছে, নকুড় ভেবে পাচ্ছে না। এটাতে নিশ্চয়ই সবাই একবার করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে আর নিজেরা পারেনি বলেই এই ভাবে গায়ের জ্বালা মেটায়। আর কী কী কারণ থাকতে পারে? কাজের তো চোদ্দ গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো হয়ে গিয়েছে।
এখানে নকুড় থামল। চুমু পৃথিবীর কোন কোন স্থানে খাওয়া উচিত মানে শহর, মোড়, ঘর, আপিস এই নিয়ে কি কেউ কোন নির্দেশিকা জারি করেছে? মানে আপিসের প্রেম হবে কিন্ত চুমু একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে খেতে হবে? চুমু খাওয়া নিয়েও কি জাতপাতের লড়াই চলে? আবার ভাবনায় ফিরল।
২০ পর্যন্ত আর গেল না নকুড়। সবমিলিয়ে সবার মধ্যে কী রকম একটা গোপন আনন্দের আর চাপা হিংস্রতার আভাস পেল। কিন্তু প্রেম আর চুমু নিয়ে আপিসের লোকেদের এই ভাব কেন? শুধুই কি তার আপিসের নাকি বাকি আপিসেও একই চলে।
নকুড় বাড়ি যেতে চাইছিল ...
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি: মৃগাঙ্ক একটি যাযাবর বোহেমিয়ান পাখির উড়ান জীবন। বিজ্ঞাপনী ভাষা লিখে আর বলে তার পেট ভরে। আর্ন্তজালের রাজ্যে হানা তার ট্যাঁক ভরানোর জন্য। হাওয়ার প্রবল টানে গতিপথ বহুবার বদলালেও লক্ষ্য স্থির। একদা ভারতের রাজধানী বঙ্গদেশের কলকাতাতে হলেও প্রবাসী তকমাতেই জীবন কেটেছে আর কাটছে। লেখালিখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বহু বছর ধরে। আগ্রহ নাটক, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য, রান্না, ছবি তোলা, বিনা প্রস্তুতিতে বেরিয়ে পড়া মন চাইলে, বই পড়া আর প্রিয় পরিবার এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.