অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিবিধ প্রসঙ্গ

জুলাই ১৫, ২০১৭

 

আপিস কথা (৬)

মৃগাঙ্ক মজুমদার

১১

(আগের অংশ) ‘ভাগ্যবানের বোঝা নাকি ভগবানে বয়’। নকুড় আপিসে আসার সময় বাসে বসে বসে ভাবছিল কথাটা। নিজের মত করে বানিয়ে আর মানিয়ে নেবারও চেষ্টা করছিল। সব আপিসেই কিছু ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী আছে যাদের বোঝা তাদের বসেরা ভগবানের মত বয়ে নিয়ে যায়। মানে আপিসের সেই সব মানুষের কাছে বস্ হল ভগবানের প্রতীক, আর তাদের কাছে, ‘শালা বস্ কি লিয়ে কুছ ভি ক্যরেগা’ হল মূলমন্ত্র। তাদের এই চোরের মত অতিভক্তি আপিসের বাকিদের কাছে চক্ষুশূল হলেও তাদের কোনোদিকের দৃকপাত থাকে না। এর ফলে, চামচা, ইত্যাদি ভূষন জুটলেও তাদের সুনির্মিত গণ্ডারের ত্বকের উপর আঁচড়টিও পড়ে না। অবিশ্যি এদের কাছে অতকিছু ভাবার, শোনার  বা প্রতিক্রিয়া দেবার সময়ও থাকে না। কারণ, তাদের নিবেদিত মনপ্রাণ বসের চরণে আর স্মরণে নিমজ্জিত থাকে। আর বেশিরভাগ বসের তাতে উৎফুল্ল না হবার কোন কারণ থাকে না তাই তাদের কৃপাদৃষ্টি সদা সর্বদা সেইসব নিবেদিত ভক্তকূল বা ভক্তের উপর রয়ে যায়।
ভাবতে ভাবতে নকুড় বাসের জানলা দিয়ে দেখে নিল যে কতদূর এসেছে। কতটা রাস্তা বাকি আছে। এমনিতে এই বর্ষার সময়ে আপিসে আসতে নকুড়ের মোটেই ইচ্ছে করে না, তবে আপিসে তো আর ‘রেইনি ডে’ হয় না স্কুলের মত তাই হাজিরা দিতেই হয়। জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নকুড় আবার আপিসের ভক্তকূলের চিন্তায় ডুব দিল।

এ ক’মাসের আপিসের অভিজ্ঞতায় এটুকু বুঝেছে যে আপিসের প্রায় সবাই বসের কাছাকাছি আসতে চায় বা নয়নের মণি হতে চায় কিন্তু বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মত খুব অল্পসংখ্যক লোকেরাই লক্ষ্যের‍ কাছে  পৌঁছায়। আর যারা পৌঁছায়, তাদের তো পোয়া বারো। কারণ তাদের পাপের বোঝা তো তাদের বসেরাই বয়। না না, নকুড় মাথা ঝাঁকালো  জানলায় হেলান দেওয়া অবস্থাতেই, বোঝা তো আপিসের বাকিরা বয়ে বেড়ায়। বস্ ভেবেচিন্তে সেই বোঝার ভার বাকিদের মধ্যে বিলি করে দেন। প্রত্যেককে তাঁদের গুরুদায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেন। মানে ওই আর কী, প্রায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে ফেলেন। শুধু জনে জনে পিঠ চাপড়ানিটাই বাকি থাকে। সেই পিঠচাপড়ানি তার পেয়ারের চামচ আর হাতাদের জন্যই বরাদ্দ থাকে। আর বেশিরভাগ সময়ে বসেদের এই ভক্তকূলের একটাই কাজ থাকে – গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো। আরো খুচখাচ কিছু কাজ অবশ্যই থাকে গাবজাল দেওয়া ছাড়া, তার মধ্যে পড়ে-

ক) সারা আপিস জুড়ে ঘুরে বেড়ানো, মূল উদ্দেশ্য খবর জোগাড় করা।
খ) কাকে  কীভাবে কাঠি করা যায় তাই নিয়ে মাথা ঘামানো।
গ) কিছু কিছু জায়গায় দাদাগিরি আর দিদিগিরি ফলানো, বিশেষ করে নবাগতদের সামনে।
ঘ) বসেদের জন্য খবর জোগাড় করে দেওয়া। সারা আপিস জুড়ে এরা বসেদের চোখকান হয়ে ঘুরে বেড়ান এই একটাই কারণে।
ঙ) মাঝে মধ্যে অবিশ্যি এরা নাকে কেঁদে বেড়ান যে এদের ঘাড়ের ওপর কত কাজের চাপ। বস্ নাকি এদের কাজের পর কাজ দিয়ে যাচ্ছেন, আরো দায়িত্ব নিতে বলছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এর থেকে সোজা অর্থ বের করে নেওয়া যায় যে এঁরা অতি সুকৌশলে নিজেদের সুনিশ্চিত পদোন্নতির কথা জাহির করে বেড়ান।

এইসব ভাবতে ভাবতেই  নকুড় দেখে যে বাস তার আপিস পাড়ায় ঢুকে গিয়েছে। এবারে নামতে হবে। নকুড় আড়মোড়া ভেঙে জানলা দিয়ে তাকায়। তারপরেই আপিসের ব্যাগটা ঘাঁটতে থাকে ছাতাটা  খোঁজার জন্য। ধুর, আজকের দিনে কি কেউ আপিস করে!

১২

 

আপিসে রোজ রোজ ঢুকতে কাঁহাতক ভালো লাগে? কারই বা ভালো লাগে? নাকি কিছু মশলাদার রসদ পাওয়া যায়?
নকুড় ছোটবেলায় বাবার কাছে গপ্প শুনতো, আপিসের সে সব গল্পগাথা শুনলে রূপকথা ছাড়া কিছুই মনে হয় না। অবিশ্যি বাবার ছিল সরকারী চাকরি। তাই একটু আয়েসের ব্যাপার স্যাপার ছিল সেইসব গপ্পের মধ্যে। সঙ্গে জুটতো বাবার বন্ধুদের আপিসের গল্প , যাঁরা সরকারী আপিসে চাকরি করতেন না। তাঁদের সেই সব জগতের মাঝে থাকার একটা আলাদা আনন্দ ছিল। আর এখন, নিজেকে যখন এই বৃষ্টি ঝড় ঠেলে আপিসের কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকতে হয়, তখন একটা বিচ্ছিরি বোদা মুখ করে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। যদি না, হঠাৎ করে মাসে একবার কেউ হুজুগ তুলে এদিক ওদিক থেকে কিছু গরম তেলেভাজা জাতীয় জোগাড় করে আনে আর সঙ্গে থাকে আপিসের কফি ভেন্ডিং মেশিনের থেকে ছ্যার ছ্যার করে ঝরে পড়া নিয়ন্ত্রিত চা/ কফি/ জল/ দুধ। জিভে আর মগজে ছাতা গজানো বস্তুটির থেকে নিস্তার পেতে একটু কড়া চা, আহা! এই টুকরো মুহুর্তগুলোই একটা আমেজ আনে। আর কিছুটা ভালো লাগার সময়। এইগুলোই বাকিদিনগুলো চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার রসদ।

মুশকিল হল, আপিসে ভালোলাগার সময় খুবই কম। একে তো আপিসের বেশিরভাগ লোক ঘাড় খোঁজে বন্দুক রেখে নিশানা করার জন্য, নইলে চাঁদমারি। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নবাগত বা তলানিরা এর শিকার হয়। যারা নতুন আসে কোপটা তাদের উপরেই বেশি পড়ে আর তার পর অধস্তনদের পদমর্যাদা অনুসারে জবাই হয়।
এই কাজগুলো সুনিপুণভাবে করে থাকেন দীর্ঘদিন আপিসে থাকা কিছু ঘাঘু কর্মচারী আর অতি অবশ্যই কিছু চশমখোর বস্ । নকুড় প্রাণপণে ভেবে যাচ্ছিল এদের আর কী কী ভাবে কাঁচা খিস্তি করা যায়। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি শিক্ষা আর মানসিকতার কারণে হড়কা বাণের মত বেরোতে চাওয়া চার, ছয়, দশ ইত্যাদি অক্ষরের গালিগুলোকে প্রবলভাবে বোল্ডার ফেলে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টাতে নিজেকে ব্যস্ত রাখছিল।

কিন্তু এই কাঠি করা যে বেশিরভাগ (সহ) কর্মীদের মধ্যেই আছে, সেটা প্রথমদিকে বুঝতেই পারতো না নকুড়। নেহাত দু একজন আছে যাদের প্রভাব আর ভালো মনের জন্য আপিসে ঝামেলা হয় না। নইলে যে কোনদিন দাঙ্গা লেগে যেত।

সারা আপিস জুড়ে প্রায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের পিছনে কথা বলতে থাকে। যদি কাউকে বিন্দুমাত্র দুর্বল পাওয়া যায়, তো তাকে দুরমুশ করে বাকিরা নিজেদের আধিপত্য আর অহং বজায় রাখার চেষ্টায় মত্ত থাকে। নতুন কেউ আপিসে এলে প্রথমদিকে সবাই জল মাপে, কেউ কাছ থেকে কেউ দূর থেকে আবার কেউ তাদের চ্যালা চামুণ্ডা দিয়ে সারাক্ষণ নজরে রাখে। এরা যে সবাই বিশাল বড় মাপের বস্ হয় তা কিন্তু সবসময় নয়। তাও এরা নিজেদের একটা ছোট ঘোঁট করে রাখে, যার সদস্যসংখ্যা ৩ থেকে ৪ এর বেশি হয় না।  তারপর একে একে নিজেদের পরিকল্পনা মাফিক নিজেদের জাহির করে ফায়দা তোলার চেষ্টায় থাকে।

এমন বৃষ্টির আমেজের দিনে কীরকম কাদা প্যাচপ্যাচে করে  দিয়েছে নকুড়কে। আপিসের কিছু পাবলিক আর মদনা সেই ফাঁকে ইজ্জতের কাদাজল করে ঘোল খাইয়ে দিয়েছে নকুড়কে।

নকুড়ের একমাত্র ভুল যে সে তার বরিষ্ঠ এবং পদমর্যাদাতে উপরে থাকা একজনের ভুলটা দেখাতে গিয়েছিল। সেই ভুল পুরো ভুলভাবে বাঁক খেয়ে কখন কি ভাবে যে নকুড়কেই দোষী করে ভাসিয়ে দিল, সেটা নকুড় বুঝতেই পারল না। ঘটনাপ্রবাহের গতি আর বাঁক এতটাই আচমকা ছিল যে নিজেকে বাঁচানোর সুযোগই পেল না নকুড়। একটা জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পেল, হিংসা যে কোন সময়ে প্রতিহিংসা হয় আর তাই দিয়ে মুহুর্তের মধ্যে সব ছারখার করে দিতে পারে।

নকুড়ের এক সময়ে মনে হচ্ছিল এই আপিসে আজই তার শেষ দিন। কিন্তু ঐ যে, সব আপিসেরই একজন ভালো  থাকে, যে হঠাৎ করে উদয় হয়ে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। কিন্তু সবসময় কি আর সে আসবে? এর পর থেকে আপিসের মধ্যে আরো সাবধানে কথাবার্তা বলতে হবে।

কখন যে কী হয়…
(পরের অংশ)



লেখক পরিচিতি: মৃগাঙ্ক একটি যাযাবর বোহেমিয়ান পাখির উড়ান জীবন। বিজ্ঞাপনী ভাষা লিখে আর বলে তার পেট ভরে। আর্ন্তজালের রাজ্যে হানা তার ট্যাঁক ভরানোর জন্য। হাওয়ার প্রবল টানে গতিপথ বহুবার বদলালেও লক্ষ্য স্থির। একদা ভারতের রাজধানী বঙ্গদেশের কলকাতাতে হলেও প্রবাসী তকমাতেই জীবন কেটেছে আর কাটছে। লেখালিখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বহু বছর ধরে। আগ্রহ নাটক, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য, রান্না, ছবি তোলা, বিনা প্রস্তুতিতে বেরিয়ে পড়া মন চাইলে, বই পড়া আর প্রিয় পরিবার এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।                  

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.